আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ড্যামিয়েন ক্যুপার। কিচেন কাউন্টারের ধারে একটা বার স্টুলের উপর বসে আছে সে। তাকে দেখে কেন যেন ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। কেমন অবসন্ন দেখাচ্ছে। চওড়া কলারের শার্টটা খুলে রেখেছে বুকের কাছে। বুকের লোমের সঙ্গে লেপ্টে থাকতে দেখা যাচ্ছে সোনার একটা চেইন। দেখা যাচ্ছে, রোদে পুড়ে বাদামি হয়ে গেছে ওর সে-জায়গার চামড়া। মনে হচ্ছে, কোনো একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের জন্য পোজ দিচ্ছে বোধহয়।
নজরকাড়া সুদর্শন সে, এবং ব্যাপারটা জানা আছে তার। জেট পাথরের মতো কালো চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে রেখেছে। দুই চোখ গাঢ় নীল। প্লেনে চেপে এতদূর যাত্রা করে এসেছে বলেই হয়তো ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে, লন্ডনে পা দেয়ামাত্র হয়তো তাকে ছেঁকে ধরেছিল পুলিশ… জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তা ছাড়া মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানটাও আয়োজন করা বাকি আছে।
মোবাইল ফোনে কথা বলছে সে, ওই অবস্থাতেই হাতের ইশারায় কাছে ডাকল আমাদেরকে। তাকে বলতে শুনলাম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি যাবো তোমার কাছে। এখন আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য কয়েকজন লোক এসেছে। নিজের খেয়াল রেখো। দেখা হবে।
লাইন কেটে দিল। তাকাল আমাদের দিকে।
‘হাই। দুঃখিত… জরুরি একটা ফোন এসেছিল। মাত্র গতকাল ফিরে এলাম, আর এসেই পাগলপারা হওয়ার অবস্থা।’
মনে পড়ে গেল ড্যামিয়েন ক্যুপারের ব্যাপারে আমাকে কী-কী বলেছিল হোথর্ন। টাকাপয়সার টানাটানি চলছে লোকটার। ঝামেলা হচ্ছে বান্ধবীকে নিয়ে। ড্রাগসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সে।
কথাগুলো কেন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হলো আমার।
হাত মেলালাম আমরা।
‘কফি খাবেন?’ জানতে চাইল ড্যামিয়েন। ইশারায় দেখিয়ে দিল সোফাটা,
বসতে বলছে আমাদেরকে।
‘ধন্যবাদ।’
কফি বানানোর মেশিন আছে ড্যামিয়েনের এখানে। ওটা চালু করে দিল সে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বলতে শুরু করল, ‘মনে হচ্ছে কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি যেন। আমার বেচারী মা-টা! গতকাল বিকেলে পুলিশের সঙ্গে লম্বা সময় ধরে কথা হয়েছে আমার। আজ সকালেও কথা বলেছি। আমাকে যখন খবরটা জানানো হলো, বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।’ একটুখানি থামল, তারপর আবার বলতে লাগল, ‘আপনারা যা-যা জানতে চাইবেন, সব বলবো। যে-বেজন্মা খুন করেছে আমার মাকে, তাকে ধরতে যা যা করা সম্ভব আমার পক্ষে…
‘আপনার মাকে শেষ কবে দেখেছেন?’ জিজ্ঞেস করল হোথৰ্ন।
‘শেষ যে-বার এসেছিলাম লন্ডনে, তখন। মানে ডিসেম্বরে।’ ফ্রিজ খুলে দুধ বের করল ড্যামিয়েন। ‘বাচ্চাটার সঙ্গে সময় কাটাতে চাইছিল মা… তাঁর একটা নাতনি আছে। গতবারের ক্রিসমাস একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা। মায়ের সঙ্গে ভালোই বনিবনা হয়েছে গ্রেসের। ওরা যে একজন আরেকজনকে ভালোমতো চিনতে পেরেছে, সেজন্য আমি খুশি।’
‘শুনলাম আপনার মায়ের সঙ্গে আপনার ভালো সম্পর্ক ছিল,’ বলল বটে, কিন্তু হোথর্নের চোখ দেখে বুঝতে পারলাম, অন্যকিছু ভাবছে ওর মন।
‘হ্যাঁ। অবশ্যই। মানে… আমি আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর এখানে একা একা থাকাটা সহজ ছিল না মায়ের পক্ষে। কিন্তু আমার কাজে সব সময় সবরকমের সহযোগিতা করেছেন তিনি। আমি যা করছিলাম, তা নিয়ে গর্ব ছিল তাঁর মধ্যে। থাকবে না-ই বা কেন? আমার বাবা মারা গেছেন অনেক বছর আগে। তারপর আর বিয়ে করেননি মা। আমার মনে হয় আমার সাফল্যই তাঁর জন্য অনেক বড় কিছু ছিল।’ দুই কাপ কফি বানিয়ে আমার আর হোথর্নের হাতে দিল ড্যামিয়েন। ‘মায়ের খুন হওয়ার খবর শুনে কত বড় চোট যে পেয়েছি আমি মনে, বোঝাতে পারবো না আপনাদেরকে।’
‘সপ্তাহখানেক আগে মারা গেছেন তিনি,’ মন্তব্য করল হোথ
‘মানে… আমি আরও আগে কেন আসিনি, সেটা জানতে চাইছেন? জরুরি কিছু কাজ ছিল। নতুন একটা শো’র রিহার্সাল করছিলাম আমরা। সব কিছুগোছগাছ করে আসতে হয়েছে আমাকে। আমেরিকাতে একটা কুকুর আছে আমার, ওটার দেখভালের দায়িত্বও বুঝিয়ে দিতে হয়েছে।
‘একটা কুকুর আছে আপনার? বাহ্, ভালো
‘হ্যাঁ, ওটা ল্যাব্রাডুডল প্রজাতির।’
বুঝতে পারার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘আপনি যখন আমেরিকায় থাকতেন, তখন নিশ্চয়ই আপনার মায়ের সঙ্গে কথা হতো?’
‘হ্যাঁ, হতো।’
‘নিয়মিত?’
‘সপ্তাহে একবার। সেটা যদি সম্ভব না-হতো, তা হলে দু’সপ্তাহে অন্তত একবার। …মা প্রায়ই আসতেন আমার এখানে, দেখে যেতেন ঠিক-ঠাক আছে কি না সব কিছু। টেরেসের গাছগুলোতে পানি দিতেন। টুকটাক আরও কিছু কাজ করতেন।’ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল ড্যামিয়েন। ‘আসলে সব সময় কথা হতো না আমাদের দু’জনের। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন মা। আমেরিকার সঙ্গে ইংল্যান্ডের সময়ের পার্থক্য আছে, সেটাও একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত কখনও কখনও। তবে টেক্সট মেসেজ আর ই-মেইলের আদান-প্রদান নিয়মিত চলত আমাদের মধ্যে।
‘যেদিন মারা গেলেন তিনি,’ মুখ খুললাম আমি, ‘সেদিন একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিলেন আপনার কাছে।
‘হ্যাঁ। পুলিশকে কথাটা বলেছি। মা বলেছিলেন, তিনি ভয় পেয়ে গেছেন।’
‘ওই মেসেজের মাধ্যমে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি, জানেন?’
‘বিশেষ একটা ছেলের কথা বোঝাতে চেয়েছেন। আপনারা হয়তো জানেন… একবার ডিলে…’
‘ছেলেটা শুধু আহতই হয়নি,’ চট করে বলে উঠল হোথর্ন, ‘বলতে গেলে বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে।’ সোফার কোনায় বসেছে সে, পায়ের উপর পা তুলে দিয়েছে। ওকে যতটা না গোয়েন্দা বলে মনে হচ্ছে,তার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে একজন ডাক্তার। ‘গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওর মস্তিষ্ক। সার্বক্ষণিক পরিচর্যার দরকার আছে ওর।’