কিন্তু দানুবিয়ান শাসকের সময় ভিয়েনা শুধু রাজনৈতিক এবং সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল না। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেও শহরটা গড়ে উঠেছিল। তাই সামরিক, অসামরিক অফিসার, বিজ্ঞানী এবং শিল্পী ছাড়া প্রচুর শ্রমিক শহরের অভ্যন্তরে বসবাস করত। দারিদ্রতার সঙ্গে এ অভিজাত ধনী ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের প্রায়ই মুখোমুখি সংঘর্ষ নেগে থাকত। হাজার হাজার বেকার উদ্দেশ্যহীনভাবে রিঙ স্ট্রীটের প্রাসাদগুলোর সামনে ঘুরে বেড়াত; এবং পুরনো অস্ট্রিয়ার ভায়া ট্রায়াম্ফ ফালিসের নিচে নরক গুলজার করত। অবশ্য তখনকার প্রায় প্রতিটি জার্মান শহরই এরকম ছিল। এ সমস্যাটা আলোচনা করার আগে যথেষ্ট সতর্কতা প্রয়োজন। প্রথমত ওপরতলা থেকে এ সমস্যাটা সম্পূর্ণরূপে বোঝা সম্ভব নয়, এ বিষাক্ত ভাইপারের কবলে যে না পড়েছে, তার পক্ষে বোঝা অসম্ভব যে এর বিষ কত তীব্র হতে পারে। নিজে ভুক্তভোগী না হলে এ সমস্যাটা শুধু আলোচনার স্তরেই থেকে যেতে বাধ্য। এর শিকড়ে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার আরেকটা পথ সমস্যাটার দিকে পেছন ফিরে থাকা, অথবা মৌখিক সহানুভূতি দেখানো। কিন্তু তাতে ক্ষতি বৈ লাভ হয় না। তখন অবশ্য এরাই আবার তাদের অকৃতজ্ঞ বলে গালাগাল করে।
ধীরে ধীরে মানুষগুলো এক সময় বুঝতে পারে যে এ সামাজিক পরিবেশে সমাজ সংস্কারের কাজ করে কোন লাভ নেই। কারণ পুরো সমাজটার গঠনই এমন যে কৃতজ্ঞতা বলে জিনিসটাই সমাজের বুক থেকে অন্তর্হিত। সুতরাং সমাজের কাছ থেকে বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আশা দুরাশা মাত্র; বরং প্রাপ্য যদি কিছু হয় তা হল অন্যায় বিচার। সামাজিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানবার লোভ থাকলেও সেই সময়ের আমার দারিদ্র পীড়িত অবস্থাই আমাকে সেদিকে পা বাড়াতে দেয়নি। অবশ্য এভাবে কোন সমস্যাই দূর থেকে বোঝা সম্ভব নয়, যদি না কেউ তাতে জড়িয়ে পড়ে। তাই বলা যেতে পারে যে, শশক যদিও গবেষণাগারের পাশ কাটিয়ে এসেছে, তবু একেবারে তার ক্ষতি হয়নি তা বলা যায় না।
যখন আমি আজ সেইদিনগুলোকে স্মরণে আনতে চেষ্টা করি, পুরোটা কিছুতেই পারি না। তাই এখানে আমি সেই ঘটনাগুলোর কথাই বলব যেগুলো আমায় ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করে বদ্ধ এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। যার থেকে অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি।
সেই দিনগুলোতে আমার পক্ষে চাকরি জোগাড় করা কষ্টকর হলেও একেবারে অসম্ভব ছিল না। তার প্রধান কারণ হল আমি কুশলী শ্রমিক দলে পড়তাম না। কুলি কামারের কাজ যেগুলো অন্য কেউ করতে চাইত না, আমি পেটের দায়ে সেগুলোই জুটিয়ে নিতাম।
অন্যান্য যারা নিজেদের দেশ ছেড়ে প্রবাসী হয়ে পা থেকে ইউরোপের ধুলো ঝেড়ে লৌহকঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এ নতুন দেশে নতুন জগতে নতুন নীড় তৈরি করতে আসে, আমিও সেই দলেরই একটি নতুন মুখ। শ্রেণী সংস্কার ইত্যাদি সমস্ত কিছু পেছনে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য তারা চাকরিক্ষেত্রে যে দরজা খোলা পায় তা দিয়েই ঢুকে পড়ে। আসলে এখানে এসে তারা উপলব্ধী করতে পারে শ্রমের মর্যাদা। কোন কাজই কাউকে ছোট করে না, যদি তা সততার সঙ্গে সম্পন্ন করা যায়। আর এ চিন্তাধারাই আমাকে নতুন জগতের নতুন রাস্তায় এগিয়ে যাবার প্রেরণা দিয়েছিল।
অতি শীঘ্র বুঝতে পারলাম এ ধরনের কাজ যেমন সব সময় জোগাড় করা যায়, তেমনি চট করে চোখের পলকে সেই চাকরি চলেও যায়।
দৈনিক রুটি জোগাড়ের এ অনিশ্চয়তাই আমার এ নতুন জগতের দিনগুলোকে বিন্ন করে তুলেছিল।
যদিও শিক্ষিত শ্রমিকদের কুলি কামারদের মত যখন তখন চাকরি থেকে বরখাস্ত করে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত না, তবু তাদের চাকরির নিশ্চয়তা বলে তেমন কিছু ছিল না। তাই শিক্ষিত শ্রমিক দলের একেবারে অনাহারের মুখোমুখি হতে না হলেও বেকারী, ধর্মঘট আর লক্ আউটের দরুন প্রতিদিনই তাদের রুটির চিন্তায় বিপর্যস্ত থাকতে হত। এ দৈনন্দিন রুটির অনিশ্চয়তা সামাজিক অর্থনীতির অন্ধকারময় দিক।
গ্রামে থেকে অনেক ছেলে শহরে সহজ কাজের লোভে চলে আসে। সহজ কাজ মানে কয়েক ঘন্টার কাজ। অবশ্য সেই সঙ্গে শহর জীবনের রহস্যময়তাও তাদের আকর্ষণ করত। গ্রামে তবু যা হোক বাঁধাধরা একটা রোজগার ছিল। কারণ চাষাবাসের কাজে লোক খুঁজে পাওয়া তখন রীতিমত কষ্টকর। অনেকেই শহরের সহজ জীবনযাত্রার হাতছানিতে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে পাড়ী দিয়েছে। তবু যারা গ্রাম ছেড়ে দিয়ে শহরে আসত তাদের অবস্থা গ্রামে থাকা লোকদের থেকে খারাপ ছিল একথা বলা যায় না। অবশ্য আমি প্রবাসী বলতে যারা আমেরিকায় পাড়ী দিয়েছে তাদের কথা বলছি না। যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসত তাদেরও আমি প্রবাসী বলেই মনে করি। কারণ সরল যে ছেলেটা বেশি রোজগারের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে, শহর জীবনে সে তো সম্পূর্ণ বিদেশী। অবশ্য অনিশ্চিত জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সে শহরে এসেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পকেটে গোনাগুণতি পয়সা নিয়ে আসা ছেলেগুলোর ভাগ্য খুব খারাপ না থাকলে প্রথম কিছুদিন মন্দ কাটত না। কিন্তু চাকরি পেয়ে অল্পদিনের মধ্যে হারালেই, যা অহরহ ঘটত, অবস্থা তাদের শোচনীয় হয়ে উঠত। বিশেষ করে শীতের সময় তো অসম্ভব। অবশ্য চাকরি যাওয়ার পরের কয়েকটা সপ্তাহ ততবেশি দুঃসহ ছিল না। পকেটে তখন শেষ মাইনের রেস্ত কিছুটা অবশিষ্ট। ট্রেড ইউনিয়ন থেকে তখন পর্যন্ত পাওয়া বেকার ভাতার টাকায় দিনগুলো চলে যেত। কিন্তু একসময়ে শেষ মাইনের টাকাটা আর দীর্ঘ বেকারত্বের জন্য ট্রেড ইউনিয়নের বেকার ভাতাও বন্ধ হয়ে যেত। তখনই পড়তে হত অসহনীয় দুর্দশার মধ্যে। পেটের জ্বালায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ছাড়া উপায় কি? উপায় বলতে অবশিষ্ট যা কিছু তা বন্ধক দেওয়া বা বিক্রি করা। কিন্তু সে পয়সায় আর কতদিন চলে। জামাকাপড় ততদিনে নোংরা আর শতচ্ছিন্ন। বাইরের অবয়বেও দারিদ্রতার ছাপ ফুটে উঠেছে। বাধ্য হয়ে সমাজের নিম্নস্তরের লোকগুলোর সঙ্গে মেলামেশা করতে হত, যাদের চিন্তাধারায় মন যায় বিষিয়ে। তদুপরি শারীরিক দুর্দশা তো আছেই। উপরন্তু মাথা গোঁজার ঠাঁই কোথায় পাবে? শীতের দিন হলে তো দুর্দশার একশেষ। শেষমেষ যদি আবার প্রাণপণ চেষ্টাতে একটা চাকরি যোগাড় করতে পারে; কিন্তু সেটা তো আবার আগেকার ব্যাপারটাই পুনরাবৃত্তি। তৃতীয় বারেও সেই একই নাটক। অর্থাৎ দিনে দিনে সে আরও বেশি হতাশা আর অনিশ্চয়তার সমুদ্রে নিমজ্জমান। ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে কঠোর পরিশ্রমে একটা লোক তার জীবনের প্রতি উদাসীন আর অমনযোগী হয়ে ওঠে। এবং একসময় কতগুলো ঠগ জোচ্চরের হাতের পুতুল হয়ে পড়ে, যারা তাদের নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করে। এত বেশি বেকারত্বের বোঝা বইতে স্ট্রাইক, দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি, নিজের ভবিষ্যত অনিশ্চিয়তার ব্যাপারগুলো সম্বন্ধে পুরোপুরি উদাসীন হয়ে পড়ে। যদিও সে মনেপ্রাণে স্ট্রাইক ইত্যাদি ব্যাপারগুলো চায় না; তবু মনের সব অনুভূতি হারিয়ে ফেলে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে ধর্মঘটীদের দলে ভিড়ে যায়।