এ সময়ে আমি জাতির অস্তিত্বের পক্ষে দুটো বিপদ উপলব্ধি করতে পারি। একটা মার্কসইজম্ আরেকটা হল জুডোইজম বা ইহুদী ধর্মমত।
অনেকের কাছেই ভিয়েনা তখন প্রমোদ নগরী। আনন্দের মুহূর্তগুলো উপভোগের নিমিত্ত বেহিসেবী খরচের জায়গা। কিন্তু আমার কাছে। সে বছরগুলো শুধু দুঃস্বপ্ন বিশেষ। এমন কি সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে আজকে পর্যন্ত মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। সেই স্মৃতিচিহ্নগুলোর একটাতেও যদি এতটুকু রঙের ছোঁয়া থাকত। সুদীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রতিটি দিন রাহুগ্রস্ত যেন প্যাসিয়ান শহরের দিনগুলো। হোমারের ওডিসি কাব্যের রূপক হল প্যাসিয়ান লোকগুলো, তারা ভূমধ্যসাগরের পূর্বদিকের কোন এক অজানা দ্বীপে বসবাস করত। কেউ কেউ বলে আজকে সেই দ্বীপের নামকরণ হয়েছে কোরসিয়া, আধুনিক সুসজ্জিত কর্য। তারা কাজের চেয়ে জীবনটাকে উপভোগ করতে বেশি ভালবাসত। তাই ওডিসি কাব্যে তাদের নামকরণ করা হয়েছে প্যাসিয়ান। যার অর্থ ক্রমে ক্রমে দাঁড়িয়েছে প্যারাসাইট বা সমাজের পরগাছা।
এ পাঁচ বছরে কখনো দৈনিক শ্রমিক অথবা তুচ্ছ ছবি এঁকে আমাকে রুটির জোগাড় করতে হয়েছে। তবু পেট ভরাতে পারিনি। সব সময়ই ক্ষুধা আমার পিছু পিছু তাড়া করে ফিরেছে। সেই সময় একটা বই কেনা বা একবার অপেরায় যাওয়ার মানে হল পরের কয়েকটা দিন মুখিয়ে থাকা ক্ষুধায় ফু দিয়ে আগুন জ্বালানো। তবু এদিনগুলোতেই শিখেছি আমি সবচেয়ে বেশি। আর্কিটেকচারাল স্টাডি অর্থাৎ স্থাপত্যবিদ্যার পড়াশোনার বাইরে মাঝে মাঝে কশ্চিৎ কখনো অপেরায় যেতাম। তখনকার জীবনে বিলাসিতা বলতে ঠিক এটুকুই। আর বই। হ্যাঁ, বই-ই ছিল ক্ষুধা ছাড়া আমার নিত্যসঙ্গী।
তখন আমি খুব পড়তাম। এবং যা যা পড়তাম সেই বিষয়গুলোকে চেষ্টা করতাম মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করতে। যেটুকু সময় ফাঁকা পেতাম পড়াশোনার মধ্যে ডুবে থাকতাম। সেই অল্প কয়েকটা বছরে বই পড়ে যে জ্ঞান আমি অর্জন করেছিলাম, বলতে দ্বিধা নেই আজও তা কাজে লাগছে। তার চেয়েও বড় কথা জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ একটা দৃষ্টিভঙ্গি আর পৃথিবী সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা আমার সে সময়েই গড়ে ওঠে। যেটা ভবিষ্যত জীবনে আজ পর্যন্ত বদলায়নি। উপরন্তু আমার দৃঢ় ধারণা, যৌবনের বছরগুলো মানুষকে যে অভিজ্ঞতার বনিয়াদ গড়ে দেয়, ভবিষ্যতের জ্ঞানের প্রাসাদ তাকেই ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। যৌবনের ধ্যান ধারণাগুলোই ভবিষ্যতের রঙিন ফুল। যদি অবশ্য তার মধ্যে সৃষ্টির বীজ বোনা থাকে। যৌবনের সৃষ্টির চিন্তাধারা ভবিষ্যতের প্রাসাদ নির্মাণের রসদ।
আমার বাল্যকাল যাদের সঙ্গে কেটেছে, তাদের জীবনধারার সঙ্গে আমার জীবনের কোন পার্থক্য ছিল না। আমার ছোটবেলা কেটেছে নিচুস্তরের বুর্জুয়া অর্থাৎ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে। সুতরাং সত্যিকারের মেহনতী মানুষদের সঙ্গে আমার পরিচিত তখন হয়নি। সম্ভবও ছিল না। যে অর্থনৈতিক পরিখাটা এ দুই শ্রেণীর মাঝখানে ছিল সেটা মোটেই গভীর নয়। বরং অনেক সময় মেহনতি শ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল ছিল। তবে কেন এ পার্থক্য? আসলে মেহনতী জনগণের একটা দল যারা একটু উঁচুতে উঠেছিল, তারা চাইত মেহনতী জনগণের ওপর মাতব্বরী করতে অথবা যেখান থেকে তারা উঠেছে, টালমাটাল হয়ে আবার সেখানেই পড়ে যেতে পারে এ ভয়ে তারা মেহনতী জনগণের থেকে দূরে সরে থাকত। আসলে পুরনো দিনের যে রুক্ষ স্মৃতিটা পেরিয়ে এসে তারা সিঁড়ির সবচেয়ে নিচেকার ধাপটা ধরেছে, সেখান থেকে গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার ভয়টাই তাদের সব সময় শঙ্কিত করে রাখত। যে জীবন অতিকষ্টে পেরিয়ে এসেছে সেখানে গিয়ে কিছুতেই আর দাঁড়াতে চাইত না।
এ কারণেই সম্ভবত সত্যিকারের যারা সমাজের ওপরতলার বাসিন্দা, তারা যতটা চট করে সমাজের একবারে নিচুস্তরের সঙ্গে মিশতে পারত, হঠাৎ এ ভূঁইফোড়দের পক্ষে সেটা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। হয়তো বা যে প্রচণ্ড সংগ্রাম করে এসব উঁইফোড়দের দল নিচের তলার বাসিন্দাদের ছাড়িয়ে উপরে উঠেছে, সেই নিদারুণ সংগ্রামের জন্য মানুষের মনের সুকোমল প্রবৃত্তিগুলোই মরে গেছে। নতুবা জীবনযুদ্ধে যুঝতে গিয়ে অপরের দিকে তাকাবার আর ফুরসৎ পায়নি।
এদিক থেকে ভাগ্য আমার ভাল ছিল বলতে হবে। অবস্থা বিপর্যয়ে আমার ছেলেবেলাকার ভূঁইফোড়দের যে জগতে বাস, নিদারুণ দারিদ্রতা আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেদিনকার বুর্জুয়া জীবনের রঙিন ছবিটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়েছিল। জীবনে এ প্রথম আমি হামবাড়া আর সত্যিকারের ভাল লোকদের মধ্যে ফারাক বুঝতে শিখি। মানুষকে চিনি অনেক কাছে থেকে। যাদের রঙ অভিজ্ঞতা থাকলে ধরা অসম্ভব।
বর্তমান শতাব্দীর প্রথমার্ধে পৃথিবীর যে ক’টা শহর অপরাধীতে অধ্যুষিত ছিল, ভিয়েনা তন্মধ্যে অন্যতম। হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ওঠা প্রাচুর্যের পাশে চরমতম দারিদ্রতা পাশাপাশি বিরাজমান। বাহান্ন মিলিয়ান বিভিন্ন জাতির লোকসংখ্যা সমৃদ্ধ এ শহরের ভেতরে ঢুকলেই এটা স্পষ্ট বোঝা যেত। প্রাসাদগুলো উপচে পড়া ঐশ্বর্যের প্রতীক। বিশেষ করে সাধারণকে বঞ্চিত করে এ ঐশ্বর্যের স্থূপ প্রাসাদে প্রাসাদে সবচেয়ে বেশি জমা হয় হাববুর্গ শাসনকালে।
এ কেন্দ্রে সবকিছু জমা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল সম্ভবত পাঁচমিশেলী জনসাধারণের জন্য। সুতরাং শহরের কেন্দ্রে উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং রাজার বসবাস গড়ে ওঠে।