দারিদ্রতা আর নিষ্ঠুর বাস্তব করালরূপ ধরে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। সংসারে সঞ্চয় বলতে যা ছিল মার দীর্ঘ রোগভোগের সময়েই তা নিঃশেষ। অনাথ হিসেবে সরকারি তহবিল থেকে যা পেতাম তা আমার বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সুতরাং রুটির তাগাদা অনুভব করলাম।
একটা ছোট চামড়ার সুটকেশে জামাকাপড় আর মনের ভেতরে অদম্য ইচ্ছেটাকে পুরে নিয়ে আমি ভিয়েনার রাস্তা ধরি। অজানা ভবিষ্যত; যেমন আমার বাবা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ভাগ্যকে ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিয়ে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তবু মনে দৃঢ়তা ছিল। জীবনে কিছু করবই— কিন্তু সরকারি চাকুরে হব না।
০২. ভিয়েনার যন্ত্রণাময় বছরগুলো
মা’র মৃত্যুর পর আমার ভাগ্য নৌকোর হাল একমুখী। মা’র অসুখের শেষের দিকে একবার ভিয়েনায় গিয়েছিলাম আকাদমি অফ্ ফাইন আর্টসে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। পকেটে এক গাদা স্কেচ নিয়ে আমি তখন নিশ্চিত যে অতি সহজেই পরীক্ষাটায় উরোবো। স্কুলে ড্রইয়ে বরাবর ভাল রেজাল্ট করেছি। ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি। সুতরাং ড্রইংয়ে আমার ক্ষমতা প্রশ্নাতীত। তাই বুক ভরা গর্ব ছিল যে সেই দক্ষতার জোরে প্রবেশ পরীক্ষার সমুদ্র পার হওয়া আমার পক্ষে কিছুই নয়।
কিন্তু আমার ভুল ঠিক কোথায় আকাদমিতে পরীক্ষা দিতে এসে বুঝতে পারি। ড্রইংয়ে আমার হাত পাকা হলেও অঙ্কন শিল্পে নয়। বিশেষ করে আর্কিটেক্টারাল অর্থাৎ স্থাপত্য বিদ্যার ড্রইংয়ে। তখন স্থাপত্য বিদ্যায় আমার উৎসাহ বাড়ছে। এবং ভিয়েনায় দু’সপ্তাহ কাটিয়ে আসার পরে স্থাপত্য বিদ্যার তৃষ্ণা আরো বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। তখনো আমার বয়স সোল পূর্ণ হয়নি। হোফ মিউজিয়ামে যাতায়াত শুরু করি, আর্ট গ্যালারির ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখার জন্য। কিন্তু ছবির বদলে হোফ মিউজিয়ামের বাড়িটার গঠনশৈলী আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় ঘুরে ঘুরে প্রাচীন বাড়িগুলোর গঠন নৈপুণ্য লক্ষ্য করতাম। এবং প্রায় ভেঙে পড়া অতি পুরনো বাড়িগুলো কি এক অদ্ভুত আকর্ষণে আমাকে টানতো। কিছুতেই স্থির থাকতে দিত না। ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম অপেরা হাউস বা পার্লামেন্টের সামনে। বিশেষ করে পুরো রি স্ট্রীটটা আমাকে যেন ভানুমতীর যাদু করেছিল। মনে হত বাড়িঘরগুলো আরব্য রজনীর পাতা থেকে হঠাৎ উঠে আসা কোন দৃশ্যপট।
এবার নিয়ে দ্বিতীয়বার আমি এ সুন্দরী নগরী ভিয়েনায় আসি; অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি প্রবেশিকা পরীক্ষার ফলাফলের জন্য। অবশ্য নিজের মনে নিশ্চিত যে এ পরীক্ষায় পাশ আমি করবই। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ফলাফল বেরোলে দেখি পাশ করতে পারিনি। বিশ্বাস করা কঠিন। তবু সত্যি আমি যে আমি পাশ করিনি। সুতরাং অধ্যক্ষর সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসা করি যে কেন আমি আকাদমীর অংকন বিভাগে সুযোগ পাব না। অধ্যক্ষ জানালেন, যে স্কেচগুলো আমি পরীক্ষার ব্যাপারে দাখিল করেছি সেগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে আর্কিটেকচারে আমার দখল অনেক বেশি, অংকন শিল্পের চেয়ে। সুতরাং অংকন শিল্প বিভাগে আমাকে নেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তবে আকাদমির আরেক বিভাগ আর্কিটেকচারে নেওয়া যেতে পারে। মানে? আমার বিস্ময় তখন তুঙ্গে। স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কে আমার বিশেষ কোন জ্ঞানই নেই। এমন কি কারোর থেকে আর্কিটেকচার ড্রইং সম্পর্কে কোন শিক্ষাও পাইনি।
শিলার প্লাটৎজের হানসেন প্যালস ছেড়ে যখন বেরিয়ে আসি, তখন আমি নিরাশার গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত। এ বয়সে প্রথম যেন জীবনে নিজেকে ছোট বলে মনে হয়। যার জন্য নিজেকে উপযুক্ত বলে এতদিন ভেবে এসেছি, স্বপ্নের সেই সৌধ আজ মুহূর্তে ভেঙে পড়ে।
কয়েকদিনের মধ্যে মনের জোর আবার খুঁজে পাই। আর্কিটেকটু আমাকে হতেই হবে। যদিও জানি সে পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়; বরং অনেক কঠিন। আকাদমির আর্কিটেকচার বিভাগে যোগদানের আগে আমাকে টেকনিক্যাল বিল্ডিং স্কুলে পড়তে হবে। কিন্তু স্কুলে পড়ার অধিকার পেতে হলে মাধ্যমিক স্কুলের শেষ পরীক্ষায় পাশের সার্টিফিকেট চাই, যেটা আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়, আমার স্বপ্ন আমার ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে।
মার মৃত্যুর পর তৃতীয় বার ভিয়েনায় আসি। অবশ্য এবারে বেশ কয়েক বছরের জন্য। এতদিনে আবার আত্মবিশ্বাসটা ফিরে এসেছে। সুতরাং লক্ষ্যের দিকে আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ। আমাকে আর্কিটেক্ট হতেই হবে। জীবনের পথে বাধা তো থাকবেই। যে করেই হোক সেগুলো ডিঙিয়ে যাব। তাছাড়া বাবার স্মৃতি তো চোখের সামনে সব সময় ভাসছে। দরিদ্র চর্মকারের সন্তান হয়েও কত সংগ্রাম করে তাঁকে সরকারি চাকুরে হতে হয়েছে। তার চেয়ে আমার জীবনের শুরু তো অনেক মসৃণ, আমার যুদ্ধের প্রতিকূলতাও বাবার পরিবেশের মত তীক্ষ্ণ নয়। তখন অবশ্য মনের দিক থেকে এমন একটা অবস্থায় এসে উপস্থিত হয়েছি যে বারবার মনে হয় ভাগ্যদেবী নিদারুণ হাতে কষাঘাত করে চলেছে। আমার প্রতি বিমুখ, নির্দয়। তবু ইচ্ছা বেগবতী নদী; বাধা পেলে আরো ফুলে ফেঁপে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আমার সেই অদম্য ইচ্ছাশক্তিটাই জয়ী হয়।
জীবনের এ অধ্যবসায়টার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কারণ জীবনের এ পর্বটাই আমাকে শক্ত আর অনমনীয় করে তুলেছিল। সেই কারণে খুব কাছে থেকে জীবনটাকে চিনতে পেরেছি। সত্যি বলতে কি আজকে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, এখানে আমার পক্ষে ওঠা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র জীবনের এ অধ্যায়টার জন্য। এবং জীবনের এ দিনগুলোই আমাকে শূন্যতার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। স্নিগ্ধ মায়ের কোল থেকে ছুঁড়ে দিয়েছে রুক্ষ আরেক নতুন মায়ের হাতে। যদিও এ দুঃসময়ে চরম দারিদ্রতার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য নিষ্ঠুর ভাগ্যের প্রতি মাঝে মাঝে মনটা বিদ্রোহ করে উঠেছে; তবু যাদের জন্য পরবর্তী জীবনে আমি সংগ্রাম করেছি, এ পথেই আমি সেসব মানুষদের কাছে এসে দাঁড়াতে পেরেছি।