কিন্তু যে দেশের লোকসংখ্যা মিশ্রিত নয়, সে দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। কারণ শাসন ব্যবস্থা সেখানে একার হাতে থাকলেও রক্ত তো এক নয়। যদি এমন সরকার বহাল থাকে যা ঘুমিয়ে থাকা একটা জাতিকে জাগানোর পক্ষে দুর্বল, তবে তা তাদের পক্ষে কখনই সম্ভব নয় যতক্ষণ না পর্যন্ত দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি দ্বারা কেন্দ্রীয় কোন সরকার পরিচালিত হয়। এ ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিপদের সম্ভাবনা কম থাকে যদি শতাব্দী ধরে একই শিক্ষা, এক ট্রাডিসন এবং একই ধরনের স্বার্থ থাকে। সরকার যত নবীন হয়, কেন্দ্রের ওপর তার নির্ভরশীলতাও তত বাড়ে। যদি তাদের ভিত্ কোন সক্ষম নেতার ব্যক্তিত্বের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তবে সে নেতা বা ব্যক্তিত্বের অপসারণের সংগে সংগে সে অট্টালিকা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা। কারণ ব্যক্তিত্ব বিরাট হলেও সে তো একক। কিন্তু শতাব্দী ধরে সহশিক্ষা থাকলেও আমি যে সব ব্যক্তিত্বের কথা বলছি তাদের এড়িয়ে যাওয়া সবসময় সম্ভব নয়। অনেক সময় তারা হয়ত বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতা দেখলেই হঠাৎ তারা জেগে ওঠে। এবং সে সময় একক ব্যক্তিত্বের স্বার্থের স্রোতে শতাব্দী ধরে চলে আসা শিক্ষা বা ট্রাডিসন ভেসে যেতে বাধ্য।
এ সব সত্যগুলোর অবলুপ্তিই হল হাবুসবুর্গ শাসকদের অপরাধ বিশেষ।
একমাত্র একজন হাবুসবুর্গ শাসকের চোখের সামনে ভবিতব্যের আলোটা দপ্ করে জ্বলে ওঠে, যাতে হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হয়। কিন্তু সে হঠাৎ আলোর ঝলকানিও চিরতরে নিভে যায়।
যোসেপ দ্বিতীয়: জার্মান জাতির রোমান সম্রাট যখন অত্যন্ত উদ্বিগ্নতার সঙ্গে ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল, তখন অবশ্য পুরো ব্যাপারটাই সীমান্তের ওপরে দাঁড়িয়ে। ক্ষয়িষ্ণু, মিশ্রিত দেশবাসীর দ্বারা সৃষ্ট বিরাট বিরাট ঘূর্ণাবর্তগুলি যেন হাঁ করে পুরো সাম্রাজ্যটাকেই গিলতে আসছে। যদি শেষ মুহূর্তে তার পূর্বপুরুষদের অবহেলার প্রতিকার এ মুহূর্তেই কিছু করা যায়। অতি মানবীয় মানসিক শক্তিতে দ্বিতীয় যোসেপ তার পূর্বপুরুষদের অবহেলা এবং বোকামির মোকাবিলা করে, মাত্র এক যুগের মধ্যে সে প্রাণপণে চেষ্টা করে শতাব্দী ধরে ফুটো হওয়া নৌকাটাকে সারাতে। যদি তার ভবিতব্য তাকে আর মাত্র চল্লিশটা বছর পরিশ্রম করার সুযোগ দিত, এবং পরবর্তী দুটো বংশধর তার ইঙ্গিত কাজ চালিয়ে যেতে পারত, তবে হয়ত বা আশ্চর্যজনক কিছু ঘটে যাওয়া বিচিত্র ছিল না। কিন্তু মাত্র দশ বছরের শাসনকার্যের পর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, তার প্রগতিমূলক কার্যাবলী ও দৃষ্টিভঙ্গিও কবরের অন্ধকার গহ্বরে চিরতরে প্রোথিত হয়ে যায়; যারা আর কোনদিন প্রাণের ইসারা নিয়ে জেগে ওঠেনি। সেগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত তার পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে না ছিল ইচ্ছাশক্তি, না কর্মক্ষমতা।
সমগ্র ইউরোপে নব বিপ্লবের সঙ্গে ধীরে ধীরে তা অস্ট্রিয়াতেও ছড়িয়ে যায়। কিন্তু সেই আগুনের শিখা ভালভাবে প্রজ্জ্বলিত হওয়ার আগেই তা জ্যোতিহীন হয়ে পড়ে। কারণ আর কিছুই নয়, এ আগুনের উৎপত্তি হয়েছিল মিশ্রজাতিদের মধ্য থেকে। সুতরাং জোর থাকবে কোথায়। ১৮৪৮ সালের ইউরোপের বিপ্লবের সময় যখন সমগ্র ইউরোপ শ্রেণী সংগ্রামে রত, তখন অস্ট্রিয়ায় এর রূপ ছিল পরস্পরের জাতি বিদ্বেষে। অস্ট্রিয়ায় বসবাসকারী জার্মানদের ব্যাপার হল তারা বিপ্লবের মূল উৎপত্তির কারণটাকেই হয়ত বা ভুল বুঝেছিল; অথবা প্রথমদিকে ব্যাপারটাকে ঠিক মত বুঝে উঠতে না পারায় শেষমেষ তাদের ভাগ্যের দরজাটাই বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে একরকম নিজেদের অজ্ঞাতসারে তারা। পশ্চিমের গণতন্ত্রে জাগরণ নিয়ে আসে এবং কালে যা তাদের নিজেদের অস্তিত্বটাকেই বিপন্ন করে তোলে।
এ তথাকথিত ব্যাপারটা দুঃখজনক হলেও অভিজ্ঞতা যে বাড়ায় তাতে সন্দেহ নেই। সহস্র ধারায় প্রবাহিত হয় এ অমোঘ ইতিহাসের আদেশ। এ বিশাল জনতার অন্ধত্ব সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়ে অস্ট্রিয়ার ধ্বংস ডেকে আনে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজনও যেমন নেই, অবকাশও কম। কারণ তা এ বইয়ের বিষয় বস্তুর বাইরে। আমি শুধু সে বিষয়গুলোর ওপরেই আলোকপাত করতে চাই, যেগুলো একটা জাতি এবং প্রদেশগুলোকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। উপরন্তু এসব ঘটনাগুলো আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতেও অনেক সাহায্য করেছে।
এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যা সবচেয়ে বেশি ধ্বংস ডেকে এনেছে তা হল দুর্বল এবং সঙ্কীর্ণময় ব্যক্তিবর্গ, যারা নিয়মিত ভিড় করেছে পার্লামেন্টে বা ইপিরিয়াল কোর্ট-এ, অস্ট্রিয়ায় যে নামে পার্লামেন্টকে অভিহিত করা হয়।
এ ধরনের সম্মিলিত সভা ঠিক ইংল্যাণ্ডের অনুকরণে গঠিত হয়েছিল; ইংল্যান্ড হল গণতন্ত্রের স্বর্গভূমি।
প্রায় সময় সংঘটাই বলতে গেলে অস্ট্রিয়াতে পাচার করে দেওয়া হয়েছিল। সামান্য কিছু রদবদল করে।
ব্রিটেনের বদলী ভিয়েনাতে দু’কামরা বিশিষ্ট গণতন্ত্রের প্রচলন করা হয়। সহকারী সদস্যদের জন্য একটা কামরা আর লর্ডদের জন্য আরেকটা। বাড়িগুলোই অন্যরকম ঢঙে তৈরি করা হয়েছিল। ব্যারি যখন তার রাজপ্রাসাদ তৈরি করে, যাকে আমরা হাউস অফ পার্লামেন্ট বলে থাকি, টেমস নদীর ধারে, সে বাড়িটার স্থাপত্যের উৎসমুখ ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের মধ্য থেকেই সে প্রচুর উপকরণ এবং মালমশলা সংগ্রহ করে যা দিয়ে ব্যারী বারশ’ কুলাচ্ছি, থাম প্রভৃতির অলংকরণ করে সেই রূপকথার মত সুন্দর প্রাসাদ ও অট্টালিকা তৈরি করে। সে অট্টালিকার গাম্ভীর্য এবং অলংকরণ, রঙ সবকিছুই জাতির জন্য একটা বিশিষ্ট মর্যাদার স্থান অধিকার করে। যেটা মন্দিরের মত পবিত্রও বটে।