কিন্তু সমস্ত প্রদেশগুলোকে এক সূতোতে বেঁধে রাখার জন্য প্রাথমিক উপকরণ যা দরকার তারই অভাব ছিল অত্যন্ত বেশি।
এ বিভিন্ন প্রদেশের জাতিকে এক জায়গায় ধরে রাখার মাত্র একটাই পথ। অস্ট্রিয়ার প্রদেশগুলোকে অন্তশক্তি দিয়ে শাসনের মাধ্যমে শক্তিশালী এক কেন্দ্রের নিচে নিয়ে আসা। অন্য আর কোন পথই ছিল না যার দ্বারা এর অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়।
মাঝে মধ্যেই ওপর মহলে এ সত্য আবিস্কার হত। কিন্তু তা কিছুক্ষণের বা কয়েকদিনের জন্য। এক সময় সবাই তা ভুলে যেত বা ইচ্ছে করে ভুলে থাকত। এ দিনের আলোর মত স্পষ্ট সত্যটাকে। কারণ এটাকে স্বীকার করে নেওয়ার মত কষ্টটাকে দৃঢ়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে বাঁধার চিন্তাধারা কখনই কার্যকর করা হত না। এ চিন্তাধারাটাকে কার্যে পরিণত করার মত শক্তিশালী কোন কেন্দ্রও ছিল না। এখানে মনে রাখা সবিশেষ প্রয়োজন যে তকালীন অস্ট্রিয়ার অবস্থা বিসমার্ক শাসিত জার্মানির মত ছিল না। জার্মানির সমস্যা তখন একটাই; তা হল রাজনৈতিক। কারণ বিসমার্কের সময় জার্মানির সাংস্কৃতিক পটভূমিতে কোন মিশেল ছিল না। সাম্রাজ্যের প্রতিটি সদস্য একই জাতির বা গোষ্ঠীর; শুধু স্বল্প সংখ্যক কয়েকটা টুকরো ছাড়া।
অস্ট্রিয়ার গৃহ ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। হাঙ্গেরী ব্যতীত রাজনৈতিক কোন ধারা ছিল না, এবং এটা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছিল। যদি থেকেও থাকে, তবে তা ইতিমধ্যে হয় ধুয়ে মুছে লুপ্ত হয়েছে, নয় যুগের অন্ধকারে তলিয়ে গিয়ে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সর্বপরি এ যুগটা হল জাতীয়তাবাদী উত্থানের প্রাক্-মুহূর্ত। আর সে কারণে হাবুসবুর্গ রাজদণ্ডের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেশগুলোও তার স্বাদ ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে। এ নতুন উদ্ভুত জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকে দমন করে রাখাও অসম্ভব। তার কারণ হল সীমান্ত ঘেঁষা সাম্রাজ্যগুলো এ নতুন জন্ম দেওয়া প্রদেশগুলো হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশগুলোর আত্মীয় হওয়াতে এর ছোঁয়া লেগে সাম্রাজ্য রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় ছিল না। অস্ট্রিয়ার বসবাসকারী জার্মানদের থেকে ওদের হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের ওপর প্রভাব ছিল অনেক বেশি।
এমন কি ভিয়েনা পর্যন্ত এ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খুব বেশি দিন নেতৃত্ব দিতে পারে নি। তখন বুদাপেস্তও ধীরে ধীরে ইউরোপের একটা প্রধান নগর হিসেবে সবেমাত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন কেন্দ্রীয় শক্তিগুলোকে একসঙ্গে বেঁধে না রেখে, কোন একটা বিশেষ শক্তিকে আরও বেশি শক্তিশালী করা। কিছুদিনের মধ্যে প্রাণও বুদাপেস্তের মত একই লাইনে গিয়ে ভেড়ে। পেছনে পেছনে আসে লেমবার্গ, লাইখ আর অন্যান্যরা। এসব প্রাদেশিক শহরগুলো ধীরে ধীরে রাজধানীতে রূপান্তর হওয়ায় এদের এক পৃথক সাংস্কৃতিক জীবনও গড়ে ওঠে। এবং সাধারণ জনতার মাধ্যমে। ওরা নিজেদের সাংস্কৃতিক দৃঢ় ভিত স্থাপন করে। এক সময় সাধারণ জনতার স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থটাই উঁচু হয়ে ওঠে, যখন সমস্ত পর্যায়টা এক ছন্দে ওঠে, তখনই অস্ট্রিয়ার ভাগ্য ওদের কাছে বন্ধক পড়ে।
বিশেষ করে দ্বিতীয় যোসেপের মৃত্যুর পর সমস্ত ব্যাপারটা দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ স্বাভাবিক দ্রুতগতি নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর, কয়েকটা বিষয়ের জন্য স্বয়ং রাজা দায়ী। বাকিগুলো অবশ্য বৈদেশিক নীতির গর্ভে উদ্ভূত।
অস্ট্রিয়ার প্রদেশগুলোকে বিশেষ কোন একটা কেন্দ্রীয় শক্তি ছাড়া একসূতোয় বাধা। একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। অন্য কিছু করার আগে সমস্ত প্রদেশগুলোয় একমাত্র একটা ভাষার প্রচলন করার দরকার। যার মাধ্যমে সরকারি কাজকর্ম চালানো সম্ভব হবে। এ একটা সুতো দিয়েই একমাত্র রাজকীয় টুকরোগুলোকে একসঙ্গে জোরে বাঁধা যায়। সুতরাং পুরো শাসন ব্যবস্থাটাই এমন এক যন্ত্রের মাধ্যমে বাঁধতে হবে, যা ছাড়া রাজনৈতিক একতা সম্ভব নয়। এভাবেই প্রতিটি বিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একই মন্ত্র জপ করে মনের এমন এক স্তরে গেঁথে দিতে হবে যে নিজেরা নিজেদের একই দেশের নাগরিক বলে মনে করে। এটা অবশ্য দশ-বিশ বছরের মত অল্প সময়ের মধ্যে করা সম্ভব নয়। এ প্রচেষ্টা শতাব্দী ধরে চালানোর প্রয়োজন, বিভিন্ন উপনিবেশ স্থাপন করার সময় যেমন মানসিক ধৈর্যের প্রয়োজন সাময়িক উৎসাহের চেয়ে অনেক বেশি।
সুতরাং এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে এ পরিবেশে দেশের শাসনব্যবস্থা একত্র আদর্শে দৃঢ় হাতে পরিচালিত হওয়া উচিত।
অন্য প্রদেশের চেয়ে পুরনো অস্ট্রিয়ার অস্তিত্ব রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল শক্ত এবং সুপরিচালিত সরকারের। হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের পরিচালনার ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে অভাব ছিল মানুষ যে বাঁধনে পরস্পরকে বাধে, সে বন্ধনের। এবং কোন জাতির যদি ভিত মানবজাতির বন্ধনের ওপর গড়ে ওঠে তবে সরকার পরিচালন ব্যবস্থায় অনভিজ্ঞ হলেও সহসা তা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা নেই। যখন কোন প্রদেশ বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে, তখন তাদের স্বাভাবিক জড়তা পরস্পরকে কুশাসন এবং অপরিণত শাসনব্যবস্থা; সত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে দীর্ঘদিন ধরে রাখে।
অনেক সময় মনে হয় যে এ রাজনৈতিক দেহ থেকে জীবনের আদর্শগুলোই হয়ত বা মরে গেছে। কিন্তু যথা সময়ে দেখা যায় সে মৃতদেহগুলো আবার হঠাৎ জেগে উঠে ২ কলরব করতে শুরু করেছে, এবং এ রকম অবিনশ্বর শক্তি দেখে পৃথিবী বিস্ময় মানে।