জার্মানির চেয়ে প্রাচীন ভাণুবিয়ান সাম্রাজ্যের রাজনীতিতে অনেক বেশি বৈচিত্র পরিধি বিস্তৃত ছিল। অবশ্য প্রুশিয়ার কিছুটা অংশ, হামবুর্গ এবং নর্থ-সীর প্রত্যন্ত প্রদেশের কয়েকটা জেলা ছাড়া। যখন আমি অস্ট্রিয়ার কথা বলি, তখন অবশ্য হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের কথাই বোঝাই। কারণ সেই সুবিস্তীর্ণ জার্মান অধ্যুষিত হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের রাজনৈতিক জীবনের মধ্যকার সাংস্কৃতিক জীবনটা ছিল নিছকই কৃত্রিম। যত দিন যেতে থাকে তত যেন অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের ভিত্তিভূমি হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের বীজাণু ভর্তি ইটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
বংশগত রাজকীয় সম্প্রদায় হল সে সাম্রাজ্যের হৃদয়স্বরূপ। আর সে হৃদয়ই দেশের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রক্ত সঞ্চালনের দ্বারা নাড়ীর গতি ঠিক রাখে। এ সাম্রাজ্যের-হৃদয়ের মস্তিষ্ক এবং ইচ্ছাশক্তি হল ভিয়েনা। তখনকার দিনের ভিয়েনার চালচলন দেখে মনে হত যেন মুকুটহীন রাণী, যার আঙুল সঙ্কেতে বিভিন্ন জাতিরা মুহূর্তে একটা পিণ্ডে পরিণত হয়ে হাবুসবুর্গ রাজদণ্ডের নিচে মাথা পেতে দিত। রাজধানী শহরের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে রাজ্যগুলোর বার্ধক্যজনিত অবক্ষয়তা নজর এড়িয়ে যেত।
যদিও ভেতরে ভেতরে তখন সে সাম্রাজ্য ক্ষয়িত। কারণ আর কিছুই নয়, বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব। কিন্তু বাইরের জগৎ থেকে বিশেষ করে জার্মানির নজরে তা পড়ত না। কারণ তাদের দৃষ্টি তখন সেই সুন্দর শহরের দিকেই একমাত্র নিবন্ধ। সেই কুয়াশাচ্ছন্ন দৃষ্টির প্রধান কারণ হল শহর ভিয়েনা— তখন তা গৌরবের উত্তুঙ্গ শীর্ষে। সুযোগ্য মেয়রের সুন্দর প্রশাসনে সেই প্রাচীন শহর যেন যৌবনের নতুন সাজে সুসজ্জিত।
সর্বশেষে যে মহান জার্মান সাধারণ জনতার মধ্য থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং পুরো পূর্বদিকটা কজা করতে পেরেছিল, সত্যিকারের নেতা যদিও তাকে বলা যায় না, তবু এ ডক্টর লুইগের মেয়র হিসেবে এ সাম্রাজ্যের রাজধানীটিতে এতটুকু প্রাণ সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিল যে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উভয় দিক থেকে সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের হৃদয়টাই নতুন উদ্দীপনায় জেগে উঠেছিল। সেই কারণে তৎকালীন রাজনীতিজ্ঞদের থেকে নেতা হিসেবে তার স্থান অনেক উঁচুতে।
এটাও সত্যি যে এ ধরনের পাঁচ মিশেলী জাতির সমন্বয়ে গঠিত অস্ট্রিয়া শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অক্ষমতার জন্যেই ভেঙে পড়ে। অসম্ভব পরিস্থিতির পরিণতিই হল এ ভঙ্গুর অবস্থা। পঞ্চাশ লক্ষ বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গঠিত কতগুলো প্রদেশকে, যারা প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে লিপ্ত দশলক্ষ লোকের একটা দেশ হয়ে তাদেরকে শাসন করা অসম্ভব। যদি শেষপর্যন্ত বিশেষ সংগঠিত কোন পরিকল্পনা হাতে থাকে।
অস্ট্রিয়ায় বসবাসকারী জার্মানদের চিন্তাধারা সব সময়েই উঁচু ছিল। বিরাট একটা সাম্রাজ্যে বসবাস করে এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে সদা সর্বদাই সচেতন থাকত। অস্ট্রিয়ার এতগুলো প্রদেশের মধ্যে একমাত্র ওরাই একফালি জমি পেরিয়ে সীমান্তের ওপারের দেশটায় দৃষ্টি মেলে দিত। সত্যি বলতে কি, নিয়তি তাদের নিজেদের পিতৃভূমির থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেও, তাদের ওপর সম্পর্কিত কর্তব্য তারা ভোলেনি। এ কর্তব্য বা দায়িত্ব হল স্বদেশপ্রেম, যা তাদের পূর্বপুরুষেরাও মনেপ্রাণে পোষণ করে এসেছে। তবে এটাও স্মরণীয় যে অস্ট্রিয়ার জার্মানরা মনেপ্রাণে সেই পথের প্রয়াসী হতে পারেনি। কারণ হৃদয় এবং মস্তিষ্ক তাদের মাতৃভূমির আত্মীয়স্বজনের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেয়নি। সে কারণে সমস্ত শক্তি তাদের পক্ষে বিনিয়োগ করা সম্ভব ছিল না।
অস্ট্রিয়ার জার্মানদের মানসিক উদারতাও ছিল অন্যান্যদের চেয়ে বেশি। তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সেই মিশ্রিত সাম্রাজ্যের প্রায় প্রতিটি শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত। অধিকাংশ বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের দ্বারাই পরিচালিত। শিল্প বিশেষজ্ঞ এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বেশিরভাগ তাদের মধ্যে থেকেই এসেছে। এমন কি বৈদেশিক বাণিজ্যও তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত; বিশেষ করে ইহুদীদের এ জগতে ঠাঁই ছিল না বললেই হয়। শুধু তাই নয়, অস্ট্রিয়ার বসবাসকারি জার্মানরাই বিভিন্ন প্রদেশগুলোকে একসূত্রে গ্রথিত করে রেখেছিল। তাদের সামরিক কলাকৌশলের খ্যাতি দেশের সীমান্ত পেরিয়ে বহুদূরে গিয়েছিল। যদিও সে বাহিনীর অধিকাংশ সৈনিক জার্মান, তবু তাদের রাখা হয়েছিল হেরজে-গাভিনা এবং ভিয়েনা অথবা গেলিসিয়া প্রভৃতি জায়গায়। হাবুসবুর্গ সামরিক বাহিনীর অফিসার এবং বেসামরিক অফিসারবৃন্দ প্রায় সবাই ছিল জার্মান। বিজ্ঞান এবং শিল্পকলাও ছিল তাদেরই হাতে। তথাকথিত আধুনিক শিল্পকলার নামে আবর্জনা বিশেষ; যা এমন কি নিগ্রোদের পক্ষেও সৃষ্টি করা সহজ। বাকি উঁচু দরের শিল্পকর্ম বলতে যা বোঝায় সবাই প্রায় জার্মান গোষ্ঠী থেকেই সৃষ্টি হত। সঙ্গীত, স্থাপত্য, ভাস্কর্য বা অঙ্কন শিল্প প্রভৃতি যেসব শিল্পকর্ম দ্বারা শহর ভিয়েনা সমৃদ্ধ, তার অধিকাংশের সৃষ্টিকর্তা ছিল অস্ট্রিয়ার বসবাসকরি জার্মানরা। এবং এ ভান্ডার নিঃশেষিত হবার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছিল না। সর্বপরি, এ জার্মানরাই বৈদেশিক নীতির নির্ধারক ছিল, যদিও খুবই স্বল্প পরিমাণে হাঙ্গেরীয়ানরাও এ বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে সহায়তা করত।