এ ধরনের মানসিক জমি প্রস্তুত না করে যদি কেউ রাজনীতিতে প্রবেশ করে, তবে সে উভয় সংকটে পড়তে বাধ্য। প্রথমে সে উপলব্ধি করবে জরুরী কতগুলো ঘটনায় তার চিন্তাধারা সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত, তার চিন্তাধারা অসমর্থনীয় হওয়াতে তার আগের মতবাদ সমর্থন না পাওয়ায় স্বভাবতই তাকে আরও ভাল জ্ঞান এবং পরিপূর্ণ বিচারের আশায় ছুটতে হবে। যদি সে তার আগের চিন্তাধারাটাকে আঁকড়ে পড়ে থাকে, তবে অতি শীঘ্র এমন এক সংকটপূর্ণ জায়গায় এসে দাঁড়াবে যে সেটা অতিক্রম করা তার পক্ষে দুঃসাধ্য। কারণ তা হলে তার চিন্তাধারায় এত বেশি অসংগতি দেখা যাবে যে তাকে কেউ নেতা বলে আগের মত মানবে না। আর তার অধীনস্থ পাটির লোকেরা সহজেই বুঝে ফেলবে যে যাকে তারা এত দিন নেতা বলে মেনে নিয়েছে, তার চরিত্রে পরিবর্তন তাদের মধেও নৈরাশ্য এনে দেবে, যেটা তাদের নেতা আগে কখন সহ্য করত না।
যদি সে দ্বিতীয় পথ অবলম্বন করে যেটা ইদানীং অহরহ ঘটে থাকে, সেক্ষেত্রে। জনসাধারণকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির পেছনে নিজের মানসিক প্ররোচনা কাজ করে না। এটার উর্ধ্বগতিতে তাকে বেশি করে ভাবিয়ে তোলে। এবং বিষয়বস্তুর ওপরেই ভাসিয়ে নিয়ে বেড়ায়। ভেতরে ঢুকতে দেয় না। সুতরাং আত্মরক্ষার খাতিরে তাকে নোংরা পথ বাধ্য হয়েই অবলম্বন করতে হয়। যেহেতু সে নিজেই তার স্বপ্নের পেছনে দৃঢ়ভাবে। দাঁড়ায় না, তাই কোন মানুষই মনেপ্রাণে সেই মতবাদকে বিশ্বাস করে না এবং তার জন্য
জীবন দিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রস্তুতও হয় না। তখন সে তার অনুবতীদের কাছ থেকে। আরও বেশি কিছু দাবি করে। সত্যি বলতে কি, যত বেশি পরিমাণে তার নিজের চিন্তাধারার স্বচ্ছতা এবং মানসিক গতিবেগ হ্রাস পায়, তত বেশি চাপ আসে তার অনুগত কর্মীদের ওপর। শেষপর্যন্ত সত্যিকারের নেতৃত্বের খোলসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাজনীতির সঙ্গে সে শুধু খেলাই করে। এভাবে দিনে দিনে তার দৈনন্দিন কাজকর্মের অসংলগ্নতা সামঞ্জস্যের পরিপূরক হয়ে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে যোগ হয় অসত্যতা আর একগুয়েমী মনোভাব,—যেটার সমাপ্তি হওয়া সম্ভব একেবারে চরমে উঠে। দলিত মানুষদের দুর্ভাগ্যের জন্য এ ধরনের লোকেরা নিজেদের দুধের বোতলটাকে দৃঢ় হাতে ধরে নিয়ে বসে পার্লামেন্টে, আর নিজের সন্তান-সন্ততি এবং পরিবারের সমস্ত রকম বিলাসিতার খরচ জোগাড় করতেই রাজনৈতিক খেলা দেখায়।
পরিবারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে তার রাজনৈতিক খেলাও বাড়তে থাকে। সে কারণে যে মানুষ নিজেকে রাজনীতির খেলায় যত বেশি দক্ষ বলে মনে করে, নিজেই সে নিজের তত বড় শত্রু। প্রতিটি নতুন সংগ্রামের ক্ষেত্রে সে নিজেকেই ধাক্কা দিয়ে নিচের দিকে নামিয়ে নিয়ে চলে এবং তার চেয়ে যোগ্যতর যে কোন ব্যক্তিকেই সে নিজের আলোয় অযোগ্য বলে মনে করে।
এ সমস্যার গভীরে ঢোকার সময় এ ধরনের নিচ লোকগুলো পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে কিভাবে ওপরে ওঠে তার বিশদ ব্যাখ্যা করব।
একজন মানুষ যখন তার ত্রিশ বছরের বন্দরে পা রাখে, তখন তার সমুদ্রযাত্রার অনেক বাকি। অর্থাৎ তার সামনে শিক্ষণীয় অনেক কিছু পড়ে থাকে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে তার আগের চিন্তাধারাটাকেই আঁকড়ে ধরে বসে থাকে,—যেটা তার জীবনের সংগে ততদিনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে গেছে। নতুন যেগুলো সে শোনে, সেগুলো আগেকার আদর্শগুলোকে পরিত্যক্ত করতে পারে না, বরং মনের অবচেতনে গভীরভাবে গেঁথে দেয়। তার সহকর্মীরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না যে তারা তার চিন্তাধারা বা আদর্শ নিয়ে প্রতারিত হচ্ছে। উপরন্তু তাদের নেতাদের নতুন চিন্তাধারাকে পরিপাক করার ক্ষমতা দেখে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। সুতরাং তার অনুগামীদের মধ্যে নেতার মতবাদে আরও বিশ্বাস আনে। তাদের চোখে এ ধরনের প্রতিটি ঘটনা তাদের নেতার উন্নতির স্বর্ণোজ্জ্বল স্বাক্ষর।
একজন নেতা যাকে একদিন নিজের ভুলের ভিতের ওপর স্থাপিত পটভূমি ছেড়ে দিতে হয়, তখন সে আবার সম্মানের সঙ্গে কাজ শুরু করতে পারে, যদি তার পক্ষে ভুলগুলোকে ভুল বলে মেনে নিয়ে বাস্তবকে স্বীকার করার মত মানসিক জোর থাকে। এ সমস্ত ক্ষেত্রে গণজীবনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে তার সরে আসাটাই উচিত। একবার যখন সে ধ্বংসের পথে পা বাড়িয়েছে, দ্বিতীয় বারেও যে সেদিকে সে যাবে না তার স্থিরতা কোথায়। যাহোক এক্ষেত্রে অন্তত তার অনুগামীদের কাছ থেকে নৈতিক দাবি স্বপক্ষে থাকা উচিত নয়।
বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের চারিত্রিক দুনীতিপরায়ণতার এগুলো হল প্রধান কারণ। তাই আজকের রাজনৈতিক আকাশে একজনকেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যে এ দুর্নীতির আওতার বাইরে নিজেকে রেখে আলোর গতিপথে এগিয়ে চলেছে।
অবশ্য অতীতের সেই দিনগুলোয় রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর চিন্তার পেছনেই আমি বেশি সময় খরচ করতাম; কিন্তু তবু আমি রাজনীতিতে প্রকাশ্যভাবে অংশ নেওয়ার থেকে অতি সতর্কভাবে বিরত থাকতাম। যে সমস্যাগুলো অবিরত আমাকে দংশনে ক্ষত বিক্ষত করত, সেগুলো নিয়ে সীমাবদ্ধ অতি স্বল্পসংখ্যক লোকের কাছে মুখ খুলতাম, আলোচনা করতাম, সীমাবদ্ধ এ গম্ভীর আলোচনা চালানোর সুফল অনেক। নিজে কথা বলার চেয়ে আমাকে ঘিরে থাকা স্বল্পসংখ্যক লোকগুলোর চিন্তাধারা এবং মতামত বুঝতে অনেক বেশি সচেষ্ট থাকতাম। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের চিন্তাধারা এবং মতামত সে করলে ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত; তবু এ পথেই আমি মানুষ সম্পর্কে আমার জ্ঞান বাড়িয়েছি। ভিয়েনায় এ ব্যাপারে যত সুযোগ আমি পেয়েছি জার্মানদের সম্পর্কে জ্ঞান বাড়ানোর, অন্য কোথাও সে সুযোগ পাওয়া সম্ভব নয়।