আমি নিত্যদিনের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে মার্কসবাদীয় মতবাদের শিক্ষার উৎস মুখটা খুঁজতে আরম্ভ করি। কারণ এ মতবাদের ফলাফল আমি বিস্তারিতভাবেই জানতাম। সুতীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে এ মতবাদের নিত্য বিস্তারও আমার নজর এড়ায়নি। কারও একটু কল্পনা শক্তি থাকলেই ব্যাপারটার ভবিষ্যত ফলাফল সম্পর্কে ধারণা করে নেওয়া কোন কষ্টসাধ্য ব্যাপারই নয়। শুধু একটাই জিজ্ঞাসা— এ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতারা কি আজকের ফলাফল তাদের ভবিষ্যত দ্রষ্টার দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিল? নাকি প্রতিষ্ঠাতারা নিজেরাই নিজেদের ভুলের জালে জড়িয়ে পড়েছে। আমার তো মনে হয় দুটোরই সম্ভাবনা আছে।
যদি দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে প্রতিটি চিন্তাশীল ব্যক্তির উচিত তখনই এ দানবকে রজ্জবদ্ধ করা, যাতে ভবিষ্যতে আরো খারাপ কিছু না করতে পারে। কিন্তু যদি প্রথম প্রশ্নটার উত্তর যা হয়, তবে এটাকে স্বীকার করে নিতেই হবে যে এ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতারা ইচ্ছে করেই জাতির মধ্যে এক মূর্ত শয়তানকে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। একমাত্র কোন দানবীয় অস্তিত্বই, হা–মানুষের নয়; এ ধরনের কোন সংগঠনের সৃষ্টি করতে পারে যার কার্যকলাপ ভবিষ্যতে মানব সভ্যতাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে পৃথিবীটাকে সাহারা বানিয়ে ছাড়বে।
এ যদি ব্যাপারটা হয়ে থাকে, তবে এর প্রতিকার হল সমস্ত মনুষ্যশক্তি, বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তি দিয়ে এর বিরোধিতা করা এবং পুরো ব্যাপারটাকেই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে দেখা কার দিকে ভাগ্যদেবী তার প্রসন্নতার হাত বাড়ায়।
সংগ্রামের মূল সূত্রগুলো জানার জন্য আমি এ তথাকথিত প্রবন্ধ সম্পর্কে আরো বেশি সংবাদ সগ্রহ করতে শুরু করি। সত্যি বলতে কি, আমার উদ্দেশ্যের কাছাকাছি আমি অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাই। এত শীঘ্র যে পৌঁছাব এটা আমিও আশা করিনি। আসলে ইহুদীদের ব্যাপারে ততদিনে আমার জ্ঞান চক্ষু খুলে গেছে। এতদিন পর্যন্ত ইহুদীদের সম্পর্কে আমার জ্ঞান ছিল ভাসা ভাসা। এ নতুন অর্জিত জ্ঞানের সাহায্যে আমি সত্যিকারের বিষয় বস্তুটার বক্তব্যটায় তথাকথিত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির অবতারদের লিখিত আদর্শবাদীতার থেকে কতখানি দূরে, এ সত্যটা বুঝতে পারি। কারণ ততদিনে ইহুদীদের ভাষা হৃদয়ঙ্গম করতে আমি সক্ষম হয়েছি। ইহুদীরা ইচ্ছে করেই এমন কৌশলে তাদের বক্তব্য রাখত যাতে ভাষার কারসাজির জাল ভেদ করে কেউ ওদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে। সুতরাং একমাত্র ওদের লেখাগুলোর বিশ্লেষণ করেই তা ধরতে পারা সম্ভব। এ জ্ঞানই আমার ভেতরে সবচেয়ে বেশি মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। একজন হৃদয়বান জাতীয় সংস্কারমুক্ত শহরবাসী থেকে কট্টর ইহুদী বিরোধী করে তোলে।
মাত্র একবার হ্যাঁ, শেষবারের মত আমি নিরাশার চিন্তায় নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করি, যা আমাকে কিছু সময়ের জন্য উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল।
আমি ইহুদীদের অতীতের দীর্ঘ ইতিহাসের কার্যাবলী বিশ্লেষণ করে রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করি, কোন দুয়ে কারণে যেটা আমাদের হতভাগ্য নশ্বরদের বোধগম্যের বাইরে, পরিণতির অপরিবর্তনীয় আদেশে প্রছন্ন রয়ে গেল। আর জয় সুনিশ্চিতভাবে চলে যাবে এ ছোট্ট একটা জাতির হাতে। হতে পারে পৃথিবীতে এতদিন ধরে যারা বসবাস করে এসেছে, পৃথিবীর নিকট তারা তাদের ঋণ কি পরিশোধ করেনি? নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য আমরা এ যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছি তার ভিত্তিমূল কি বাস্তবতার মাটিতে পোথিত? নাকি এটা শুধু একটা রঙিন কল্পনা? আমি যত বেশি মার্কসীয় মতবাদ সম্পর্কে অনুধাবন এবং বিশ্লেষণ করি, ভাগ্যই আমাকে এর উত্তর দিয়ে দেয়। ইহুদীদের কার্যকলাপ এদের সঙ্গে কতখানি জড়িত তা স্পষ্ট চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়।
ইহুদীদের মার্কসীয় মতবাদ প্রকৃতির সম্ভ্রান্ত আদর্শগুলো থেকে লোকগুলোকে বর্জন করে। এভাবে ওদের শিক্ষা জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা থেকে সাধারণ মানুষকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। এবং এর অর্থ মানুষের অস্তিত্ব এবং সভ্যতাটার ভিত্তিমূলটাকেই প্রচন্ডভাবে নাড়া দেওয়া। যদি মার্কসীয় মতবাদকে জীবনের ভিত্তিমূল বলে সারা পৃথিবী মেনে নেয়, তবে মানব মনের পুরো ধ্যান ধারণাটাই অদৃশ্য হয়ে যাবে। এবং এ ধরনের কোন মতবাদকে মেনে নেওয়ার অর্থই হল নিজেদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করা, যা এ পৃথিবী নামক মধ্যগ্রহের বাসিন্দাদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে ছাড়বে।
সুতরাং ইহুদীরা যদি ওদের এ মার্কসীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীতে কোনরকমে জয়ী হতে পারে, তবে সেদিন হবে মানুষের ইতিহাসের শেষদিন। এ উপগ্রহ আবার তাহলে জনপ্ৰাণীহীন মহাশ্মশান হিসেবে তার অক্ষরেখা ধরে পরিক্রমা করবে, যা আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগে করত।
আমি বিশ্বাস করি যে আমার ধ্যান-ধারণা এবং চিন্তাধারা সেই সর্বশক্তিমানের দ্বারা পরিচালিত। সুতরাং ইহুদীদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোই হল ইশ্বরের আপন হাতে সৃষ্ট মহান শিল্পকর্মকে রক্ষা করার একমাত্র পথ।
০৩. ভিয়েনায় প্রবাসের দিনগুলোয় আমার
রাজনৈতিক চিন্তাধারা তিরিশ বছর বয়স হবার আগে কোন পুরুষের প্রকাশ্যে কোন রাজনৈতিক ঘটনাতে অংশগ্রহণ করা উচিত নয় বলেই আমি মনে করি। অবশ্য প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের মত এক্ষেত্রেও যদি ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা তার থাকে, তবে তা স্বতন্ত্র কথা। এটা বলাবাহুল্য আমার মতামত। এর কারণ হল তিরিশ বছর পর্যন্ত মানুষের মানসিকতাটা গড়ে ওঠে দৈনন্দিন যেসব সমস্যার উদ্ভব হয়, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে, সেসব অভিজ্ঞতাগুলোকে উল্টেপাল্টে এদিক ওদিক সরিয়ে সে একটা নির্দিষ্ট চিন্তায় স্থির হতে পারে; আর এটাই তাকে ভবিষ্যত রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্ গড়তে সাহায্য করে। তার পক্ষে সব বিষয়ে মনস্থির করে একটা নির্দিষ্ট পথ নেওয়া সম্ভব হয়। একজন পুরুষের পক্ষে প্রথম উচিত হল সাধারণ জ্ঞানের একটা ভান্ডার নিজের মধ্যে গড়ে ভোলা, যাতে জীবন সম্পর্কে তার নিজস্ব চিন্তাধারার একটা সুসংবদ্ধতা লাভ করতে পারে। অর্থাৎ যাকে এককথায় জীবন দর্শন বলে। তাহলে তার একটা নিজস্ব মানসিক ব্যারোমিটার গড়ে ওঠে, যেটা ছাড়া তার পক্ষে দৈনন্দিন কোন সমস্যা সম্পর্কে নিজের বিচার বিবেচনা গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। এবং এটাই তাকে কোন রাজনৈতিক বিষয়ে দৃঢ় এবং স্থির সংকল্প নিতে সাহায্য করবে। আপাতদৃষ্টিতে এ ধরনের পুরুষ তার রাজনৈতিক চরিত্রের দিক থেকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের যোগ্যতা রাখে।