আমি ক্রমেই বুঝতে পারি যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক প্রেসও ইহুদীদের করতলগত। কিন্তু অন্যান্য প্রেসগুলোর যে একই অবস্থা এটা আগে কখনো বুঝতে পারিনি। সবচেয়ে উলঙ্গ সত্য হল, একটা সংবাদপত্রও ছিল না যাতে ইহুদীরা জড়িত নয় এবং যেটাকে সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র বলা যেতে পারে। অন্ততপক্ষে এ ব্যাপারে আমার জ্ঞান এবং বিদ্যা বুদ্ধি অনুসারে আমি যা বুঝতাম।
অনেক চেষ্টার পর নিজের ভেতরের অলসতাটা ভেঙে আমি মার্কসিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত এ ধরনের প্রবন্ধগুলো পড়তে শুরু করি। কিন্তু তাতে ওদের প্রতি বিরূপতাই বাড়ে। এবং এরপরে আমি এসব লেখক আর প্রকাশকদের সম্পর্কে আরো বেশি খোঁজখবর নিতে শুরু করি।
এসব পত্রিকার প্রকাশক থেকে শুরু করে সবচেয়ে নিচু তলার কর্মী পর্যন্ত সবাই ইহুদী। মার্কসবাদী জননেতার নাম স্মরণে আসতে দেখি প্রায় সবাই এ একই সম্প্রদায়ের— রাজ পরিষদের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক সদস্যবৃন্দ থেকে শুরু করে ট্রেড ইউনিয়ানের সেক্রেটারী, পথরোধকারি, বিক্ষোভকারি, সবক্ষেত্রে এ একই সাজানো ছবি। আমার পক্ষে অস্টারলিটজু, ডেভিড, আড়লার,—এলেনবোগেন এবং অন্যান্য নামগুলো বিস্মৃত হওয়া কখনই সম্ভব নয়। একটা সত্য আমার সামনে ঝলঝল করে ওঠে; আমি যে দলটার সঙ্গে মাসাধিককাল মত বিরোধে লিপ্ত, তারা ওদেরই একটা ছোট শাখা বিশেষ। তবে শেষমেষ আমার একটা শান্তি ছিল যে ততদিনে জেনে গেছি ইহুদীরা আর যাহোক জার্মান নয়।
এবারে আমি আবিষ্কার করতে সমর্থ হই, কারা সেই প্রেতাত্মা যারা আমাদের জনসাধারণকে নিয়ত তাড়িত করে ছাইদানির দিকে নিয়ে চলেছে। ভিয়েনায় আমার বছর খানেকের প্রবাসী জীবনে বুঝতে পারি যে কোন শ্রমিকের এ বিষয়ে ধ্যান ধারণার শিকড় এত গভীর নয়। ক্রমে ক্রমে মার্কসীয় মতবাদ সম্পর্কে আমি একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠি এবং এ বিষয়ে অর্জিত জ্ঞানকে, নিজের বিশ্বাসকে দৃঢ় করার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি। বলতে আপত্তি নেই যে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃতকার্য হয়েছি। এ বিশাল জনসাধারণকে অবক্ষয়ের পথ থেকে টেনে তোলা অসম্ভব নয়; তবে তার জন্য প্রয়োজন প্রচুর সময় এবং প্রচণ্ড অধ্যাবসায়।
কিন্তু একটা ইহুদীকেও তার স্থির মতবাদ থেকে এক চুল নড়ানো সম্ভব নয়।
আমি তখন ওদের শিক্ষার অবাস্তবতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে শুরু করি। যে ছোট্ট গণ্ডিটা আমাকে ঘিরে থাকত, গলা না চেরা এবং কণ্ঠস্বর বসে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের একনাগাড়ে বুঝিয়ে যেতাম। আমি মনে করি শেষ পর্যন্ত মার্কসিস্ট মতবাদের ভয়াবহ দিকটার ছবি আমি তাদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হব। যত আমার মতামতটাকে আমি প্রতিষ্ঠা করি, তত ওদের একগুঁয়েমিটা বেড়ে ওঠে।
তর্ক করতে করতে আমি ওদের কৌশলটা বুঝে ফেলি। তর্কের প্রথম পর্যায়ে ওরা বক্তার নিবুদ্ধিতার সুযোগের ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়ে; কিন্তু যখন তর্কের জালে জড়িয়ে যুক্তির হালে আর পানি পায় না, তখন ভণিতা করে সহজে প্রতারিত হয়েছে, এমন ব্যক্তিরা যুক্তির জাল এড়িয়ে অভিনয় করে যেন বক্তার কিছুই ওরা বুঝতে পারছে না এবং প্রাণপণে চেষ্টা করে অন্যদিকে তর্কের স্রোতটাকে প্রবাহিত করার। তারা স্বতসিদ্ধ সত্যটাকে এড়িয়ে গিয়ে অন্য পথে কথাবার্তা বলে চলে। যদি এটাকে সহ্য করে নেওয়া হয়, তবে ওরা তর্কের ব্যাপারটাকে ভিন্নমুখী করে দিয়ে গোড়ার সমস্যার থেকে অন্য কোন বিষয় বস্তৃতে চলে যায়। যার সঙ্গে আগের বিষয়বস্তুর কোন সম্পর্কই নেই।
আবার যদি ওদের মূল তর্কের বিষয়ে টেনে আনার চেষ্টা করা হয়, ওরা আবার পালাবে সেই জাল থেকে। মোটকথা ওদের দিয়ে বিষয়বস্তুটার ওপরে কোন মন্তব্যই পাওয়া সম্ভব নয়। যখন কেউ শক্ত মুঠিতে এ তথাকথিত অবতারদের একজনকে পাকড়াতে চেষ্টা করে, জেলী বা আঠালো কাদার মত ঠিক আঙুলের ফাঁক দিয়ে সে গলে গিয়ে পরক্ষণেই আবার সেই কাদা বা জেলী জমে শক্ত জিনিসের অবয়ব ধরবে। যদি উপস্থিত জনতার উপস্থিতিতে বিরুদ্ধজনক পরিস্থিতিতে কারোর বিরুদ্ধপক্ষ যুক্তি স্বীকারও করে নেয়, এবং তা নিয়ে কেউ যদি ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যে যাক শেষপর্যন্ত ওদের একটা নির্দিষ্ট জমিতে দাঁড় করান গেছে, তা হলে তার পরের দিনের জন্য তার কাছে অবাক করা কিছু লুকানো থাকবে। ইহুদীরা বড়ই বিস্মৃতিপরায়ণ। অর্থাৎ কাল যা ঘটেছে তা আজ ভুলে যেতে ওরা এতই ওস্তাদ যে তারা আবার গতকালের সেই অসংগতিপূর্ণ যুক্তিটাকেই তুলে ধরবে এমনভাবে যেন গতকাল তাদের সঙ্গে কোন আলোচনাই হয়নি। তখন যদি কেউ রাগ করে তাকে গতকালের কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়,–সে এমন অবাক হওয়ার ভাণ করবে যেন তার কিছুই মনে নেই। শুধু একমাত্র তার যা স্মরণ আছে তা হল গতকাল সে তো প্রমাণই করে দিয়েছে যে তার যুক্তিগুলোই ঠিক। আমি তো এ অবস্থায় হতবুদ্ধি হয়ে যেতাম। আমাকে ঠিক কোনটা হতবুদ্ধি করে দিত,–তার বাগাড়ম্বরের প্রাচুর্য নাকি সুনিপুণভাবে মিথ্যেটাকে সত্য বলে পরিবেশন করার ভঙ্গি, তা বলতে পারব না। ক্রমে ক্রমে আমি তাদের ঘৃণা করতে শুরু করি।
তবু এসবগুলোর ভাল একটা দিক ছিল,–কারণ আমি যত বেশি এসব নেতাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতে পারি, (নেতা না বলে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির প্রচারক বলাই ঠিক) আমার নিজের লোকেদের প্রতি তত বেশি ভালবাসা বাড়তে থাকে, ঠিক সেই অনুপাতে। ওদের এ পৈশাচিক কুশলতা যেটা এ শয়তান মন্ত্রণাসভার সভ্যগুলোর কার্যকলাপ এবং কথাবার্তায় প্রদর্শিত হত, তাতে ওদের নিকটে হতভাগ্য পরাজিতদের পরাজিত হওয়ার জন্য কোন দোষ আমি দেখি না। সত্যি বলতে কি, এ প্রাদেশিক বিশ্বাসঘাতকগুলোর সঙ্গে কোনরকম সামঞ্জস্য রেখে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। সত্য বলায় বিকৃত এ মুখগুলো, যারা নিজেদের উচ্চারিত কথা পরমুহূর্তেই অস্বীকার করে, পরক্ষণেই আবার মুক্তির ধ্বজা তুলে ধরতে তর্ক প্রসঙ্গে সেটাকেই ফিরিয়ে আনে, এরকম নোংরা জীবগুলোর বিরুদ্ধে তর্ক যুদ্ধে জয়ী হওয়ার প্রস্তাবটাও নিরর্থক। অসম্ভব তো বটেই। না, যত বেশি ইহুদীদের আমি চিনতে পারি, তত সহজে আমি সেই শ্রমিকদের মতামতের জন্য তাদের ক্ষমা করি। শেষে আমার মত হল এ যে শ্রমিকদের মধ্যে নিন্দনীয় কিছু নেই। কিন্তু যারা নিজেদের আপন লোকদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর কষ্টটুকু পর্যন্ত স্বীকার করতে নারাজ, তারা জাতির পরিশ্রমী সন্তানকে বিনা দ্বিধায় অবিচার স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেছে, অপরদিকে একদল নিচুমনা লোভী এবং দুর্নীতিপরায়ণকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, যাদের কোনরকমেই ক্ষমা করা উচিত নয়।