লিনৎস শহরে ইহুদীদের সংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল। শতাব্দী ধরে এসব ইহুদী সেখানে বসবাস করার ফলে বাইরে থেকে দেখতে ইউরোপের আর পাঁচজন অধিবাসীর মতই লাগত এবং বলতে দ্বিধা নেই আমি অন্যান্যদের মত তাদেরও জার্মান বলেই ভাবতাম। এর কারণ হল মানুষ হিসেবে তাদের বাইরের চেহারায় অন্য কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনি। একমাত্র ধর্মীয় ব্যাপারগুলোয় তাদের অদ্ভুত আচরণ ছাড়া। আমার তখন ধারণা ছিল যে তাদের ধর্ম-বিশ্বাসের জন্য অন্যেরা তাদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং আমারও তাদের প্রতি তীব্র একটা ঘৃণা বোধ জেগে ওঠে। তখন পর্যন্ত আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না যে ইহুদীদের সম্পর্কে একটা বিদ্বেষের ভাব দেশ জুড়ে ফলু ধারার মত চলে আসছে। এরপরে আমি ভিয়েনায় চলে আসি।
জনসাধারণের চিন্তাধারায় আমি বিভ্রান্ত হই যখন আমি স্থাপত্যকর্মে নিযুক্ত। তখন অবশ্য নিজের বিপদের জন্যও আমি হতাশাগ্রস্ত। প্রথমে বুঝতে পারিনি সে শহুরে জনজীবন কতগুলো বিভিন্ন সামাজিক স্তরে গঠিত। যদিও তখন ভিয়েনার অধিবাসীর সংখ্যা কুড়ি লক্ষ, কিন্তু ইহুদীদের সংখ্যা মাত্র লাখ দুয়েক। সেই জন্যই ব্যাপারটা আমার নজরে আসেনি। সেই প্রবাস জীবনে প্রথম কয়েক সপ্তাহ আমার মনে এবং চোখে নতুন ধারণা ও চিন্তাধারার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি। যখন আমি ধীরে ধীরে আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলাম, তখন চোখের সামনে এ গোলমেলে ছবিগুলো এক এক করে আমার সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল; আমি আমার নতুন জগতটা সম্পর্কে অবিসাংবাদিত ধারণা নিতে সক্ষম হই ও ইহুদী সমস্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।
আমি বলতে চাই না যে প্রথমে আমি যেভাবে এ সমস্যাটার সঙ্গে পরিচিত হই, তা খুব একটা অপ্রীতিকর ছিল। ইহুদীদের সম্পর্কে তখন আমার ধারণা যে ওরা অন্যধর্মী, সুতরাং মানবত্বের খাতিরে অন্যধর্মী বলে তাদের আক্রমণ করার বিপক্ষে আমি ছিলাম। এবং ইহুদী বিরুদ্ধ যে সংবাদপত্রগুলো ভিয়েনাতে প্রচলিত ছিল তাদের সংস্কৃতির প্রতি আমার সন্দেহ ছিল। মধ্যযুগে যে বিশেষ কতগুলো ঘটনা ঘটে গিয়েছিল সেগুলোও আমার স্মৃতিতে ছিল এবং আমি চাইতাম যে এগুলোর পুনরাবৃত্তি আর যেন না হয়। বিশেষ করে বলতে গেলে এ ইহুদী বিরুদ্ধ পত্রিকাগুলো মোটেই প্রথম শ্রেণীর ছিল না। কিন্তু আমি তখন এর কারণটা বুঝতে পারিনি এবং ভেবেছি ঈর্ষার ফল, যার মধ্যে এতটুকুও সপ্রচেষ্টা নেই।
আমার নিজস্ব অভিমত আমি গাম্ভীর্যের সঙ্গে পর্যালোচনা করতেই অভ্যস্ত ছিলাম; যে কারণে প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রগুলো হয় তার উত্তর দিত, নয় সেগুলো পাশ কাটিয়ে যেত। ভবিষ্যতে আমি বুঝতে পেরেছি যে এটাই হল সবচেয়ে সম্মানজনক পথ।
যে পত্রিকাগুলোকে পৃথিবীর মুখপাত্র বলা হয়, যেমন নয়ি প্রেসে, ভিনার টাগেরাটে ইত্যাদি পড়তাম। আশ্চর্য হয়ে যেতাম এরা কত বেশি পরিমাণে এদের পাঠকদের জন্য সংবাদ পরিবেশনা করে। তার চেয়ে বড় কথা কোন একটা বিশেষ সমস্যাকে এরা নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে থাকে। তাদের অভিজাত ভঙ্গিতে লেখা আমার ভাল লাগত। তবে কখনো কখনো এ প্রচণ্ড রকমের স্টাইল সর্বস্ব সাংবাদিকতা আমার পছন্দ হত না। কিন্তু সারা পৃথিবীর প্রধান প্রধান শহরগুলোর সংবাদ রাখতে আমি ভালবাসতাম।
আমার ধারণায় ভিয়েনাও পৃথিবীর প্রধান নগরীগুলোর অন্যতম; সে কারণেই ভিয়েনার সংবাদের স্বল্পতা সম্পর্কে কোন নালিশ করা চলে না। কিন্তু ভিয়েনা প্রেসের রাজবংশীয়দের প্রতি এ চাকরের মত আনুগত্য আমাকে বিরক্ত করত। যদি হাববুর্গের প্রতি কোন আক্রমণ করা হত, সেটা যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে পাঠকদের কাছে হাজির করা হত না। এটা পৃথিবীর অন্যতম চালাক একজন রাজার প্রতি প্রচেষ্টা, তখন গৌরবের সঙ্গে তুলে না ধরাটা আমি বোকামী বলেই মনে করতাম। এগুলো যেন আমাকে স্মরণ করিয়ে দিত বনমোরগ তার সঙ্গিনীকে চিন্তার সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে হঠাৎ পালিয়েছে। আমি ভাবতাম এ চালাকি আর কিছুই নয়, ঢিলে গণতন্ত্রের আদর্শের ওপর রঙ করা মতবাদ মাত্র। এটা হল কতগুলো অপদার্থ লোকের আনুকূল্য কুড়াবার অপচেষ্টা। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভাবতাম এ ধরনের সংবাদ ভিয়েনার সংবাদপত্রগুলোর সুনামের কলঙ্ক বিশেষ।
ভিয়েনায় থাকাকালীন রাজনীতি বা সংস্কৃতি যে কোন ব্যাপারেই হোক জার্মানিতে যা ঘটত তার প্রতি নজর রাখতাম। এবং বলতে আপত্তি নেই নিজেকে গর্বিত মনে হত যখন ভাবতাম কী ভাবে অস্ট্রীয়াকে অস্বীকার করে নতুন সাম্রাজ্যের অভ্যুদয় হল। সে সাম্রাজ্যের বৈদেশিক নীতি রীতিমত প্রশংসার যোগ্য, যদিও আভ্যন্তরিক নীতি ততটা নয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় উইলহেলমের বিরুদ্ধে প্রচারটাকে কোন মতেই আমি মেনে নিতে পারিনি। কারণ আমার চোখে দ্বিতীয় উইলহেলম্ শুধু একজন জার্মান সাম্রাজ্যের অধীশ্বরই নন, জার্মান নৌ-বাহিনীরও স্রষ্টা। বিশেষ করে রাইখষ্টাগে তাকে বক্তৃতা দিতে না দেওয়ায় আমি ক্রুদ্ধ হই। কারণ যারা তাকে বক্তৃতা দিতে দেয় না তাদের সে ক্ষমতাই নেই। পার্লামেন্টের এক অধিবেশনে তথাকথিত রাজহংসগুলো অনেক বেশি প্যাক প্যাক করে যা পুরো রাজবংশীয়দের এমন কি দুর্বলতম রাজার সময়েও পুরো শতাব্দী ধরে এর চেয়ে অনেক কম কাজ হয়েছে।