বিপক্ষদের আক্রমণ করার চেয়ে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নিজেরাই ওদের চাপ এবং ভয় প্রদর্শন মেনে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় এমন একটা পথ বেছে নেয় যা এত মন্থর এবং ভোতা, ফলে অচিরে সেটাকে বর্জন করতে বাধ্য হয়। সুতরাং সমস্ত অবস্থাটাই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে যেখানে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ব্যাপারটাতে মাথা গলাবার পূর্বে ছিল; কিন্তু ততদিনে জনসাধারণের অসন্তোষ চরমে উঠেছে।
বিদ্যুৎ ঝড়ের মত মুক্ত ট্রেড ইউনিয়ান রাজনৈতিক দিগন্তে এবং ব্যক্তিগত জীবনের ওপর চক্র কেটে বেড়ায়। জাতীয় অর্থনীতির অনিশ্চয়তা এবং পরনির্ভরতা হল দেশের এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক চরম বিপজ্জনক ব্যাপার। সর্বোপরি এ মুক্ত ট্রেড ইউনিয়ান গণতন্ত্রকে শুধু হাস্যাস্পদ করে তোলেনি, ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়াও বাঁধিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাকে কলংকিত করে ধ্বনি তুলেছে— তোমরা যদি আমাদের সঙ্গে হাত না মিলাও আমরা তোমাদের মস্তিষ্ক চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেব।
সেই সময়ে আমি মানবত্বের সত্যিকারের বন্ধুকে চিনতে পারি। দিনে দিনে আমার জ্ঞান যেমন বিস্তৃত হয়, তেমনি গভীরতাও বাড়ে; তবু অন্তত এ বিষয়ে আমার মত পরিবর্তনের কোন কারণ খুঁজে পাই না।
যতই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির বাইরের রূপের সঙ্গে পরিচিত হই, তত বেশি এ মতবাদটার অন্তর প্রকৃতি দেখার জন্য আমার তৃষ্ণা বেড়ে ওঠে।
এ তৃষ্ণা নিবারণের উপায় পার্টির প্রচার পুত্রের মাধ্যমে ছিল না। কারণ ওদের অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলোর সঙ্গে যে বিবৃতি থাকত তা মিথ্যা এবং অগভীর। ওদের রাজনৈতিক লক্ষ্য বলতে কিছু ছিল না। উপরন্তু যুক্তিতর্ক উপস্থাপনায় ওরা যে আধুনিক ছল চাতুরীর আশ্রয় নিত তা ছিল আমার কাছে চরম অপ্রীতিকর। ওদের বড় বড় কথা শুধু শূন্যগর্ভ এবং ধারণাতীত বাক্যে ভরা। হঠাৎ পড়লে মনে হয় এগুলো মহৎ চিন্তার ফসল; কিন্তু এগুলো ছিল সত্যিকারের চিন্তা-শূন্যতায় ভরা এবং অনর্থক কতগুলো শব্দের সমষ্টি। আজকের এ আধুনিক সমাজে যে কোন লোক নিজেকে ক্ষয়িত বলে মনে করে, কারণ এ শহরে জীবনের বিচিত্র গোলকধাঁধা তাদের মনকে বিপথগামী করে তোলে। সেজন্য হয়ত বা এ দুর্গন্ধময় ধোঁয়ার মধ্যে সে তার স্বাধীনতার নামে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার গন্ধ পায়। এ লেখকগুলো আমাদের জনগণের এক অংশের যে সুবিদিত লাঞ্ছনা সেইগুলোকে শুধু দেখে; আর তা দেখেই বিশ্বাস করে যে ব্যক্তিকে ধারণায় আনা যায় না, সে নিশ্চয়ই অত্যন্ত জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান।
এ মতবাদের তত্ত্বের দিক দিয়ে মিথ্যা উক্তি এবং অবাস্তবতা, এর বাইরের অভিব্যক্তির মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি ক্রমে ক্রমে এর শেষ লক্ষ্য কি সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারি।
এ মুহূর্তগুলোতে আমি সেই ভবিষ্যতের অন্ধকার প্রতিচ্ছবি এবং অমঙ্গলের পূর্বাভাস যেন দেখতে পাই। আমার যে শিক্ষা, সেই শিক্ষার ইন্ধন জুগিয়েছে অহমিকা আর ঘৃণা যেটা গাণিতিক ছকে ফেলে হিসেব করলে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সে সাফল্য হবে মানবত্বের ওপরে প্রচণ্ড এক মুষ্ঠাঘাত।
ইতিমধ্যে এ ধ্বংসমূলক শিক্ষা এবং সত্যিকারের জনসাধারণের চরিত্র, যেটা এতদিন পর্যন্ত আমার কাছে অজ্ঞাত ছিল স্পষ্ট বুঝতে পারি।
ইহুদীদের সম্পর্কে অজ্ঞানতা হল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির প্রকৃত চরিত্র এবং সত্যিকারের লক্ষ্য বোঝার চাবিকাঠি। যে লোক এ জাতটার সম্পর্কে তার দৃষ্টির সামনের কুয়াশা সরিয়ে দিতে পেরেছে, তার পক্ষে এ পার্টির অর্থ এবং লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে বোঝা সম্ভব; এবং তারপর এ অন্ধকার তথাকথিত সামাজিক উন্নতির কুয়াশা সরিয়ে সে মার্কসীয় মতবাদের নিকট আসল রূপ দেখতে পারে।
আজকে আমার পক্ষে বলা অত্যন্ত কষ্টকর, প্রায় অসম্ভব যে কখন ‘ইহুদী’ শব্দটা আমার মনে বিশেষ এক চিন্তাধারার উদয় করেছিল। আমি ঠিক স্মরণে আনতে পারি না, পিতার জীবিতকালে বাড়িতে থাকাকালীন এ শব্দটা আমি শুনেছি কিনা। যদি এ শব্দটা কোন অপমানকর ভাষায় ব্যবহার করা হত তাহলে সেই বৃদ্ধ লোকটি ভাবত যে এটা একমাত্র অশিক্ষার ফল। কারণ তার চাকরি জীবনে এত বেশি এবং বিভিন্ন ধরনের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করেছে যে তাকে জাতীয় সংস্কারমুক্ত বলা চলে। যদিও তার জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রখর ছিল, এবং তার সেই প্রভাব আমার ওপরেও ভালভাবে বর্তেছিল। স্কুল জীবনেও আমি আমার এ ধারণার পরিবর্তনের কোন কারণ খুঁজে পাইনি; যেটা আমার মনের মধ্যে বাড়িতে থাকাকালীন বেড়ে উঠেছিল।
মাধ্যমিক স্কুলে আমার সাথে একটা ইহুদী ছেলে পড়াশুনা করত যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালই ছিল। কিন্তু তার মৌন ভাব এবং কয়েকটা ব্যাপারে আমরা সর্বদা সতর্ক থাকতাম। এছাড়া আমি এবং আমার বন্ধুদের ওর সম্পর্কে অন্য কোন রকম ধারণা ছিল না।
চৌদ্দ পনের বছর বয়সে আমি ‘ইহুদী’ শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হই রাজনৈতিক প্রতিবেদনের সম্পর্কে। এসময়ে আমার মনে ইহুদী সম্পর্কে একটা বিরূপ ভাব জাগে। সত্যি বলতে কি মনের এ অবস্থা আমি সব সময়ে আয়ত্তে রাখতে পারিনি। বিশেষ করে ধর্মের সম্পর্কে সংঘর্ষের ব্যাপারগুলোতে। কিন্তু এছাড়া ইহুদীদের সম্পর্কে অন্য কোন বিরূপ ধারণা আমার মনে সে সময় ছিল না।