তখন আমি আত্মবিশ্লেষণ শুরু করি। এ মানুষগুলো কী মহৎ মানুষের পর্যায়ে পড়ে উত্তরটা রীতিমত চাঞ্চল্যকর। যদি উত্তর হয়— হঁা, তবে এত বিপদ এবং আত্মত্যাগ নিয়ে এ ইতর শ্রেণীর জন্য সগ্রাম করা অনর্থক। অপরদিকে যদি উত্তর হয় না, তবে এ লোকগুলোর জাতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা একেবারেই নেই। অর্থাৎ আমাদের জাতি সত্যি তা হলে গরীব। সেই দ্বিধাপুর্ণ মানসিক দিনগুলোয় গভীর মনসংযোগ দিয়ে মানস চোখে আমি যেন দেখতে পাই ক্রমাগত বেড়ে চলা এ লোকগুলোকে জাতির উন্নতির পথে হিসেবে আনা কোনরকমই সম্ভব নয়।
কয়েকদিন পরে আমার মানসিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে মোড় নেয়। রাস্তা দিয়ে যেতে দেখি কিছু ভিয়েনার শ্রমিক বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। আমি প্রায় ঘন্টা দুয়েক স্থির নিশ্চিতভাবে সেই মনুষ্যরূপী ড্রাগনদের দেখি। যখন জায়গাটা পরিত্যাগ করে আমার বাড়ির দিকে রওনা হই, তখন মনটা হতাশায় ভরে ওঠে। যেতে যেতে একটা তামাকের দোকানে শ্রমিকদের সংবাদপত্র নজরে আসে। সংবাদপত্রটির নাম আরবাইটার ঝাইটুঙ বা শ্রমিকদের মুখপাত্র। এটাই হল পুরনো অস্ট্রিয়ার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির মুখপত্র। সে সস্তা চায়ের দোকানে যেখানে সাধারণ মানুষ ভিড় করত, সেখানে মাঝে মাঝে আমিও যেতাম এ পত্রিকাটা পড়ার জন্য। দোকানদার এ একটা পত্রিকাই রাখত। কিন্তু কখনই কয়েক মিনিটের বেশি এ কদর্য সংবাদ পত্রটায় আমি চোখ বোলাতে পারিনি; আসলে পত্রিকাটার মূল সুরটাই কেমন যেন এক বিশ্রী গন্ধে ভরা। কিন্তু সেদিনকার দেখা বিক্ষোভ আমার মনে যে হতাশার সৃষ্টি করেছিল, সেটাই যেন আমাকে বারবার পত্রিকাটা কিনে খুঁটিয়ে পড়ার তাগাদা অন্তর থেকে দিচ্ছিলো। সুতরাং পত্রিকাটা কিনে আমি বাড়ি গিয়ে সমস্ত সন্ধ্যে ধরে পড়ি। নজর এড়ায় না যে কতগুলো মিথ্যা পত্রিকাটা সত্য বলে চালাচ্ছে।
এখন আমি অন্যান্য বইয়ের থেকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির দৈনিক পত্রিকাগুলো কিনে পড়ে সহজেই ওদের সত্যিকারের রাজনৈতিক দর্শনের চরিত্রটা অনুধাবন করতে পারি।
দুটো সত্যের মাঝখানের ফরাকটা দিনের আলোর মত স্পষ্ট। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি পত্রিকাগুলো যদিও মুখে স্বাধীনতা, শ্রমের মর্যাদা এবং জীবন সম্পর্কে বড় বড় শব্দ বসিয়ে অবতারের ভঙ্গিতে মানুষকে আশ্বাস দিত; কিন্তু এটা পাঠকদের ধোঁকা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। অপরদিকে মানুষের লোভটাই নির্দয়ভাবে প্রকট হয়ে উঠত। কোন কিছুরই সত্যিকারের ভিত্তি তাতে ছিল না, শুধু মানুষকে প্রতারণা করা ছাড়া। এ সাংবাদিকতা সত্য সংবাদ মোচড় দিয়ে ঘুরিয়ে এমনভাবে পরিবেশন করত যাতে সত্যিকারের সংবাদ বোঝা কারোর পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর এ পুঁথিগত তথ্য নিয়ে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ সম্প্রদায় যারা নিজেদের বুদ্ধিমান ভাবতো, তারা আত্ম সন্তুষ্টিতে ভুগত। এ সংবাদপত্রগুলো জনগণের কাছে মিথ্যা প্রচার ছাড়া আর কিছু নয়।
এভাবে এবং সংবাদপত্রগুলোর মাধ্যমে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির উপদেশাবলী পড়ে আমার দেশের মানুষের প্রতি আমাকে আরো বেশি আকর্ষণ করে। যেটাকে আমি প্রথমে অনতিক্রম্য গহ্বর বলে ভেবেছিলাম, পরে সেটা অনেক বেশি স্নেহ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
একবার যখন বুঝতে পারি কী বিরাট পদ্ধতিতে ওরা জনগণের মনকে বিষাক্ত করে তুলেছে, তখন একমাত্র বোকারাই এর বলী হতে পারে। সেই বছরগুলোতে যখন আমি ক্রমে ক্রমে স্বাধীন চিন্তার জগতে পা রাখতে শুরু করেছি, তখন আমি ভালভাবেই বুঝতে শিখেছি, কি করে ওরা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির সুসমাচারের মাধ্যমে জয় লাভ করছে। এখন আমি উপলব্ধি করতে পারি কেন এবং কী উদ্দেশ্যে ভাল ভাল বই এবং সংবাদপত্র পড়া ওরা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বিশেষ করে যে সব বই আদৌ লাল বলে গণ্য নয়। কিন্তু লাল মিটিংয়ে যোগদান করা নিষিদ্ধ হয়নি। পরিষ্কার নিষ্ঠুর বাস্তবের আলোকে আমি ভবিষ্যতকে যেন দেখতে পাই। যে ভবিষ্যত এ অসহ্য উপদেশাবলীতে কালো হয়ে গেছে।
বিরাট গনমানসকে একমাত্র তাদের দৃঢ় এবং অনমনীয় মন দ্বারাই মাপা যায়। যেমন মেয়েদের অন্তর মানস এতটা নিষ্ফলা যে কোন কারণে দোলা খায় না, কিন্তু মিথ্যা আর আবেগে তারা তাদের সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত করে। শক্ত মানুষের কাছে দুর্বলরা সত্বর যেমন মাথা নোওয়ায়— ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষ শক্ত শাসকের কাছে প্রার্থনা জানাতে ভালবাসে। যদিও সেই শাসক আবার তাদের উপদেশাবলীর আড়ালে মানসিক নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়। কারণ সাধারণ জনতার পছন্দ সম্পর্কে কোন ধ্যান-ধারণা থাকে না। এবং সবসময় তারা ভাবে যে সমাজ কর্তৃক তারা পরিত্যক্ত। বুদ্ধির দিক দিয়ে তাদের ভয় দেখালেও তারা লজ্জিত হয় না। কারণ তারা চিন্তাতেও আনতে পারে না যে মানুষ হিসেবে তাদের স্বাধীনতা নির্লজ্জের মত তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং তাদের সামান্যতম সন্দেহ হয় না যে ভুল মতবাদটাই তারা স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছে। একমাত্র নির্দয় শক্তি এবং বীভৎসতার কাছেই তারা মাথা নত করে।
যদি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসিকে সত্যিকারের শিক্ষা দিয়ে বিরুদ্ধতা করা যায় তবে সে সংগ্রাম হবে তিক্ততায় পরিপূর্ণ। তবু এ সত্যিকারের শিক্ষাই হবে চিরস্থায়ী অবশ্য যদি ঠিক একই রকম নির্দয়ভাবে সঙ্গে সেটাকে রূপায়িত করা সম্ভব হয়।