তখন অবশ্য ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে আমার জ্ঞান বলতে কিছু ছিল না। সত্যি বলতে কি এর প্রয়োজনীয়তা বা অপ্রয়োজনীয়তা কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু আমাকে যখন বলা হল যে ট্রেড ইউনিয়নে আমাকে নাম লেখাতে হবে, আমি সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করলাম। প্রত্যাখ্যানের কারণ হিসেবে আমি বললাম, যে বিষয়ে আমার কোন জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে নিজেকে আমি কখনই জোর করব না। সম্ভবত এ কারণটাই আমাকে আমার সত্যিকারের পথ থেকে বিচ্যুতি করেনি। ওরা বোধহয় ভেবেছিল কয়েকদিনের ভেতরে আমার চিন্তাধারা বদলে আমি ওদের বাধ্য হয়ে উঠব। কিন্তু ওরা এটা ভেবে যে প্রচণ্ড রকমের ভুল করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। সপ্তাহ দুয়েক পরে আমি বুঝতে পারি, প্রথমে রাজী যদি হয়েও যেতাম, কিন্তু বর্তমানে রাজী হওয়া অসম্ভব। এ দুই সপ্তাহে আমি আমার সহকর্মিদের আরো ভালভাবে বুঝতে পারি এবং নিজের মনটাকে এমন দৃঢ়ভাবে স্থির করি যে পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই যা আমাকে ট্রেড ইউনিয়ানে যোগ দেওয়াতে পারে। আসলে এখন আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের স্বরূপটা ভালভাবেই বুঝতে পেরেছি।
বলাবাহুল্য আমার চাকরির প্রথম দিনেই ব্যাপারটাতে তখন আমার বিরক্তি এসে গেছে। দুপুরবেলা আমার কয়েকজন সহকর্মি শ্রমিক কাছের গুড়িখানায় গিয়ে হাজির হত, আর অন্যেরা সেই নির্মীয়মান বাড়ির একাংশে বসে তাদের মধ্যাহ্নের খাওয়া-দাওয়া সারত; বেশিরভাগ খাওয়া-দাওয়া বলতে বোঝাতে শুকনো এক আধ টুকরো রুটি। অবশ্য এরা সবাই সংসারী, বিবাহিত। তাদের স্ত্রীরা ভাঙা পাত্রে দুপুরের খাওয়ার জন্য স্যুপ নিয়ে আসত। সপ্তাহের শেষের দিকে শুঁড়িখানায় যাওয়ার লোক কমতে থাকত; বেশির ভাগই দুপুরের খাওয়ার জন্য নির্মীয়মান বাড়ির একাংশে ভিড় জমাত। পরে অবশ্য এর কারণটা আমি বুঝতে পেরেছি। তখন তারা রাজনীতি নিয়ে তর্কে-বিতর্কে মেতে থাকত।
আমি বাইরে কোথাও বসে দুধের বোতলের সঙ্গে রুটির টুকরো চিবোতাম আর যে পরিবেশে আমি বর্তমানের দিনগুলো কাটাচ্ছি তার দুর্ভাগ্যের কথা মনে মনে চিন্তা করতাম। যদিও আমি ওদের কথাবার্তা বেশিরভাগই শুনতে পেতাম। আমার ধারণা, দলে টানবার জন্য ওরা ইচ্ছে করেই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আলোচনাগুলো উঁচু স্বরে করত। কিন্তু আসলে ওদের কথাবার্তা শুনে আমার মনটা আরো বেশি বিষিয়ে উঠত। সেই সমালোচনায় সবকিছুরই নিন্দা চলত–বিশেষ করে জাতির উদ্দেশ্যে; কারণ তা নাকি খালি বড়লোকদেরই স্বার্থ দেখেছে। (এ কথাটা আমাকে যখন তখন প্রায়ই শুনতে হত।) ফাদারল্যান্ড অর্থাৎ পুরো দেশটাই নাকি বুর্জোয়াদের হাতে এবং তারা ইচ্ছে মত শ্রমিক শ্রেণীর ওপর নিরঙ্কুশ শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। শাসক স্কুলের কাজই নাকি প্রলেতেরিয়া গোষ্ঠীকে নিচে ঠেলে ফেলে দেওয়া; ধর্ম তো শুধু লোকেদের ফাঁকি দিয়ে প্রতারণা করার জন্য; আদর্শ-টাদর্শ কথাগুলো স্রেফ লোকেদের বোকা বানানো আর মেয়েদের মত জনতাকে সুবোধ রাখার জন্য। এমন কিছু বিষয়বস্তু বাদ থাকত না যা তারা আলোচনার নোংরা কাদায় টেনে না নামাত।
প্রথমদিকে আমি চুপচাপ থাকতাম। কিন্তু এমনি মুখে কুলুপ এঁটে আর কতদিন থাকা যায়। শেষে ওদের আলোচনায় অংশ নিতে শুরু করি; এবং তাদের বক্তব্যের উত্তর দিতে থাকি। যদিও জানতাম এসবের কোন ফলই পাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি ওদের আলোচনার বা সমালোচনার সঠিক উত্তর দিতে পারছি, সুতরাং আমি স্থির করি ওরা যেখান থেকে ওদের জ্ঞান বুদ্ধি আহরণ করে, সেই জায়গাগুলোর খোঁজ খবর আমাকে রাখতে হবে। সুতরাং আমি বই এবং পত্র-পত্রিকার সমুদ্রে ডুবে যাই।
ইতিমধ্যে সেই নির্মীয়মান বাড়ির মধ্যে বসে আমাদের তর্ক-বিতর্ক চলতেই থাকে। দিনে দিনে তারা যেসব বিষয়ে নিজেদের বিশেষজ্ঞ বলে মনে করত, তাদের চেয়ে সেসব বিষয়ে আমার জ্ঞান অনেক বেশি বেড়ে যায়। তারপর একদিন আসে যখন আমার আহরিত জ্ঞানের ধারালো কথাগুলোকে তাদের জোরালো যুক্তি দিয়ে খণ্ডনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু যুক্তি থাকলে তো খুঁজে পাবে। সুতরাং শুরু হয় আমাকে গায়ের জোরে ভয় দেখানো। দলের কয়েকজন নেতা আমাকে সেই চাকরি ছেড়ে দিতে আদেশ দেয় নইলে মারধোর করে তাড়াবে। আমি একা হওয়াতে গায়ের জোরে ওদের সঙ্গে পেরে উঠব কেমন করে? সুতরাং আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আরো কিছু অভিজ্ঞতা ভরে নিয়ে প্রথম সুযোগেই তাদের সংস্পর্শ ত্যাগ করি।
যদিও আমি বিরক্তিতে দূরে চলে গিয়েছিলাম, তবু পুরো ব্যাপারটা আমার মনকে এত প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল যে কিছুতেই আমার পক্ষে তার দিকে পেছন ফিরে থাকা সম্ভব হয়নি। পুরো ব্যাপারটা নিজেই চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছি। রাগ পড়ে এলে আবার আমার মধ্যেকার একগুঁয়েমিটা ফিরে আসে এবং যে কোন মূল্যের বিনিময়ে আমি আবার বাড়ি তৈরির কাজে ফিরে আসার জন্য মনস্থির করি। এ চিন্তাধারাটা কয়েক সপ্তাহ পরে আরো বেশি দৃঢ় হয়, কারণ সঞ্চয় বলতে স্বল্প যে কয়েকটা টাকা ছিল, ইতিমধ্যেই তা খরচ হয়ে গেছে। ক্ষুধা তার নির্মম থাবা আবার হেনেছে আমার ওপর। অন্য কোন রাস্তাও আমার সামনে খোলা নেই। কাজ খুঁজে পেলেও আমাকে আবার তা ছেড়ে দিতে হয়। কারণ সেই আগেকার অবস্থা।