তাই ১৯১৯ সালের প্রথম দিকে আমরা একথা বেশ বুঝতে পারি যে দেশের জনগণকে ব্যাপক জাতীয়করণ অর্থাৎ তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগানোই হবে আমাদের আন্দোলনের প্রধানতম লক্ষ্য। অবশ্য এ কাজের জন্য কতগুলি দায়-দায়িত্ব আমাদের সাধন করতে হবে। যেমন :
(১) জনগণের মনকে জাতীয় ভাবাপন্ন করে তোলার জন্য যে সামাজিক ত্যাগের প্রয়োজন তার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। জাতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিপতি ও মালিকশ্রেণীর পক্ষ থেকে শ্রমিকশ্রেণীকে যতদূর সম্ভব সুযোগসুবিধা দিতে হবে। কারণ এসব সুযোগসুবিধা জনগণকে জাতীয় বৃত্তের গণ্ডীর ভেতরে টেনে আনবে। শ্রমিকশ্রেণী তাহলে জাতীয় ভাবধারায় ভাবিত হয়ে উঠবে। দেশের মধ্যে রাজনৈতিক স্থিরতা বা শৃঙ্খলা না থাকলে মালিকপক্ষের আর্থিক বা ব্যবসাগত লাভের কোন অর্থ হবে না। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থাগুলি যদি শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য মালিকদের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে সংগ্রাম করতে এবং মালিকপক্ষকে শ্রমিকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিতে বাধ্য করত তাহলে যুদ্ধে আমাদের পরাজয় ঘটত না। এসব আর্থিক সুযোগ-সুবিধে দিয়ে শ্রমিকদের মনকে দেশ ও জাতির প্রতি অনুগত করে তোলা যেত জাতীয় অর্থনৈতিক মূল কাঠামোর কোন ক্ষতি না করে যতদূর সম্ভব দেশের মালিকপক্ষকে লাভ কম করে আর্থিক ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে।
(২) জাতীয় ভাবধারার দিকে লক্ষ্য রেখে জনগণকে শিক্ষাদানের জন্য পাঠ্যক্রম রচনা করতে হবে। তাদের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধন করতে হবে যাতে করে জাতির সাংস্কৃতিক জীবনে এরা অংশগ্রহণ করতে পারে।
(৩) এ বিষয়ে কোন কুণ্ঠা বা দ্বিধা থাকলে বলবো সব দ্বিধা কুণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে জনসাধারণকে প্রকৃত অর্থে মনে প্রাণে জাতীয়তাবাদী করে তুলতে হবে। এ বিষয়ে তাদের মনকে উগ্র করে তুলতে হবে। তথাকথিত ক্ষতিকারক আন্তর্জাতিকতাবাদের বিষক্রিয়াকে নষ্ট ও ব্যর্থ হলে জাতীয়তাবাদের পাল্টা বিষ প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
কোন জাতির বৃহত্তর জনসাধারণ শুধু অধ্যাপক ও রাজনীতিবিদদের দ্বারা গঠিত নয়। এ সাধারণ জনগণ কোন জটিল ভাবধারা বা তত্ত্বের সঙ্গে মোটেই পরিচিত নয়। তারা সাধারণত জ্ঞান বা যুক্তিতে নয়, আবেগ বা অনুভূতির দ্বারা পরিচালিত হয়। সেই আবেগে অনুভূতি সদর্থক হতে পারে। জগতে আজ পর্যন্ত যত বড় বড় পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে তার মূলে কোন ভক্তি ভালবাসা বা প্রবল ঘৃণা প্রভৃতি কোন না কোন মৌল অনুভূতি বা আবেগ মূল প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে। জনসাধারণের মন জয় করতে হলে তাদের অন্তরের চাবিকাঠি লাভ করতে হবে। আর সেই চাবিকাঠি হল দৃঢ় সংকল্প।
(৪) দেশের জনগণকে কোন আন্দোলনের সামিল করে তুলতে হলে তাদের মধ্যে শুধু তাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য এক সংগ্রামশীল সমর্থক প্রকৃতি জাগিয়ে দিয়ে চলবে না, শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করার এক নঞর্থক প্রবৃত্তিও জাগাতে হবে। যখন কোন পক্ষ এক আপোষহীন প্রচণ্ডতায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে, ধ্বংস করে, তখন সাধারণ মানুষ ভাবে নিশ্চয় তারা ন্যায়ের খাতিরেই এ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু যখন দেখে আক্রমণকারীদের মধ্যে কুণ্ঠা বা দ্বিধা রয়েছে, তখন তারা স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করে তাদের এ আক্রমণ ও সংগ্রামের পেছনে কোন ন্যায়সঙ্গত যুক্তি নেই। সাধারণ জনগণ প্রকৃতিরই এক অংশ বিশেষ। তারা চায় বলবানেরা জয়লাভ করুক আর দুর্বলেরা মুছে যাক ধরাপৃষ্ঠ হতে। তবে জনগণের মন জয় করতে হলে যারা তাদের মনে আন্তর্জাতিকতার বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে তাদের তাড়াতে হবে শেষে।
(৫) কোন জাতির উত্থান বা পতন নির্ভর করছে তার রক্তগত উপাদানের শুচিতা ও অখণ্ডতার ওপর। যে জাতি তার রক্তের এ শুচিতাকে অক্ষুণ্ণ রাখে না বা এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় না সে জাতির অন্তরাত্মা খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়, সে জাতি কখনই সংহতি লাভ করতে পারে না। কোন জাতির রক্ত দূষিত হলেই তার জাতীয় চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়।
সুতরাং জার্মান জাতিকে আজ বাঁচতে হলে তার জাতীয় দেহ থেকে বিজাতীয় ও বৈদেশিক বীজাণুগুলোকে দূর করতে হবে। তাদের রক্তগত পবিত্রতার সমস্যাটিকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিতে হবে।
(৬) দেশের জনগণের জাতীয়করণের অর্থ এ নয় যে যারা উপরতলায় রয়েছে তাদের নামিয়ে আনা। কাউকে কোন স্তর হতে নামিয়ে না এনে নিচুতলার লোকদের উপরতলায় নিয়ে যেতে হবে। আমাদের যুগে যারা বুর্জোয়া বলে আখ্যাত হচ্ছে, তারা নিজেদের চেষ্টাতেই স্তরে উঠে গেছে। শ্রমিক শ্রেণীর জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করতে হলে তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার উন্নতি করতে হবে। আমাদের আন্দোলনকে সফল করে তুলতে হলে শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে থেকে বেশি সদস্য সংগ্রহ করতে হবে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে থেকে একমাত্র সেইসব লোকদের সদস্য হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে যারা আমাদের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ও আদর্শকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পেরেছে।
কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীর লোকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সদস্য সংগ্রহ করার বাধা হল তাদের আন্তর্জাতিকতাবাদ। শ্রমিকশ্রেণীর লোকের মনে যে আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শ ঢুকিয়ে দিয়েছে সেই আন্তর্জাতিকতাবাদ তাদের মন থেকে দূরীভূত করে জাতীয়তাবাদ সঞ্চারিত করতে হবে।