এভাবে সামাজিক সমস্যাগুলোর পুঁতিগত দিকটা বুঝতে পারি, যাকে সাহায্য করে দিনের পর দিন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। যে সমস্ত বইপত্র এ বিষয় নিয়ে লেখা, প্রায় সবই আমি জোগাড় করে নিয়ে পড়তাম। শুধু পড়া নয়; রীতিমত চিন্তাও করতাম সেগুলো নিয়ে। সেজন্যই লোকে আমাকে খামখেয়ালী বলে ভাবত।
সমাজ সংস্কার ছাড়া আমি সাগ্রহে আর্কিটেকচার বিষয়ে পড়াশোনায় ঝাপিয়ে পড়ি। পাশাপাশি মনোনিবেশ করি সংগীত চর্চায়। যেটা আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করতাম আর্টের রানী। আর সবচেয়ে বড় কথা এ ব্যাপারে আমার যেমন উৎসাহ ছিল, আনন্দও পেতাম প্রচুর। আমি সারারাত ধরে এমন কি ভোর হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে চর্চা বা পড়াশোনা করতাম। এবং দিনে দিনে আমার আত্মবিশ্বাসও দৃঢ় হয়। সময়ে আমার স্বপ্ন সফল হবে; হয়তো বা তারজন্য আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। আমি এখন সুনিশ্চিত যে একদিন বড় স্থপতি শিল্পী হব।
আমার পেশাগত পড়াশোনার পাশে পাশে রাজনীতি সম্পর্কেও পড়াশোনা করতে শুরু করি। কিন্তু রাজনীতি বিষয়টাই আমার মনে তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। বরং ব্যাপারটা সম্পর্কে আমার তখনকার ধারণা যে প্রতিটি চিন্তাশীল লোকের রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রাথমিক কর্তব্য। যাদের পারিপার্শ্বিক জগতটার রাজনীতি সম্বন্ধে জ্ঞান নেই, তাদের আলোচনা বা সমালোচনার কোন অধিকারই নেই। রাজনীতি সম্পর্কে আমি যথেষ্ট পড়াশোনা করি, এবং বলতে দ্বিধা নেই পড়াশোনা বলতে তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা যা বোঝে, আমার কাছে তা ছিল অন্য।
আমি এমন অনেককে জানি যারা বইয়ের পর বই, পাতার পর পাতা পড়ে চলে, তবু আমি তাদের পাঠক বলি না। হয়ত বা তারা অনেক পড়ছে। এমনকি তাদের কোন বইটা প্রয়োজনীয় আর কোনটা অপ্রয়োজনীয় সেটুকু তফাৎ করার মত ক্ষমতা নেই। সুতরাং তাদের অবস্থা আগেরটা পড়ে তা পরেরটা ভোলে; তারপর আবার সেটা পড়ে। আর নইলে সমস্ত ব্যাপারটাই অপ্রয়োজনীয় মাল বোঝাই জাহাজের মত মাথা ভারী করে। পড়াশোনা ব্যাপারটা শেষের জন্য নয়; বরং শেষের দিকে পা বাড়াবার প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। একটা মূল উদ্দেশ্যই হল প্রত্যেকের ভেতরে যে সুপ্ত প্রতিভা বা বিশ্বাস ঘুমিয়ে আছে তাকে জাগিয়ে তোলা। দৈনন্দিন রুটির রোজগার অথবা বড় কাজ করার বাসনা— একমাত্র পড়াশোনাই এর রসদ এবং উৎসাহ জোগাতে পারে। এগুলোই হল পড়াশোনা করার প্রথম উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল, যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি সেটা সম্পর্কে পড়াশোনাই সম্যক জ্ঞান আমাদের দিতে পারে। উভয়ক্ষেত্রেই সমস্ত অধীত বিষয় মস্তিষ্কে জড়ো করে রাখার প্রয়োজন নেই। পড়াশোনার মাধ্যমে যে ছোট ছোট জ্ঞান আহরিত হয়, সেটা মোজাক করা মেঝেতে পাথরের মত গেঁথে রাখা উচিত। যাতে ভবিষ্যতে সাধারণ জ্ঞানের পরিপূর্ণতার জন্য সঠিক সময়ে টুকরোটা সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। নইলে অধীত বিষয়গুলো প্রয়োজনের সময়ে শুধু গোলমালের সৃষ্টিই করবে; এগুলো শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়, প্রয়োজনের সময়ে বিপথগামীও করতে পারে। কারণ সে তো নিজেকে সব সময় বিদ্বান বলে ভাববে; মনে করবে জীবনের অনেকটাই বুঝি সে দেখে ফেলেছে। সে তখন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। সে মনে করে জীবনে সত্যের দিকে এগোচ্ছে, কিন্তু সত্যি বলতে কি এগুলো তাকে সত্যিকারের জীবন থেকে দূরেই সরিয়ে দেয়। যদি না তাকে শেষজীবনে স্যানিটোরিয়াম বা রাজনীতি গ্রহণ করে পার্লামেন্টে জীবন পাড়ী দিতে হয়।
এসব লোকেরা জীবনে যখন সুযোগ আসে তখন তাদের বই পড়া বিদ্যা কাজে লাগাতে সক্ষম হয় না। বিশেষ করে তার মানসিক গঠনটাই তো দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, তার জন্য তৈরি নয়। মাথায় হয়তো বা বোঝাই বই পড়া বিদ্যা জমা হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু ভাগ্যক্রমে যদি একদিন হঠাৎ ডাক পড়ে যে সে বিদ্যা কাজে লাগাও কোন একটা বিশেষ কাজের জন্য; কিন্তু কোন বইয়ের কোন অধীত পৃষ্ঠাটাকে ঠিক সেই সময় সেই কাজে লাগাতে হবে তা বলে না দিলে বেচারা এত পড়াশোনা করেও শুধু হাতড়ে মরবে। মনের এ উত্তেজক অবস্থায় সে হয়ত মন হাতড়ে ঘটনার সাদৃশ্য কিছু খুঁজে বেড়াবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে হয়ত বা দেখা যাবে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে।
এ যদি সত্যিকারের অবস্থা হয়, তবে আমাদের দেশের পার্লামেন্টের যারা তাবড় তাবড় নায়ক, তাদের কাছ থেকে রাজনীতির ব্যাপারে কতটুকু আশা করতে পারি। আসলে তারা তাদের কথার জাল বিস্তার করে, খিস্তি খেউড় করে আর ছল চাতুরীতে সবাইকে ভোলায়।
অপরদিকে পঠিত বিদ্যা যে জ্ঞান সম্যকরূপে আহরণ করে, তা বই, জার্নাল বা বিজ্ঞাপনলিপি যা থেকেই হোক প্রয়োজনে তৎক্ষণাৎ তা স্মরণ করে সেটা কাজে লাগাতে পারে। যেটা সে পড়েছে সেই বিষয়টা মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে যায় যে সেটা শুধু মানসিক চিন্তাধারটাকেই সঠিক পথে চালনা করে না, মনটাকেও উদার করতে সাহায্য করে যাতে সেটা সঠিক জায়গায় ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে। হঠাৎ কোন বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হয়ে পড়লে স্মৃতির পৃষ্ঠা হাতড়ে সেই বিশাল জ্ঞান সন্দ্র থেকে মুক্তাটা তুলে এনে জায়গা মত বসিয়ে দিতে পারে। এ পড়াশোনার কিছু অর্থ হয় বা এর কিছু মূল্য আছে।