মাটির নিচের আর্দ্র দুটো ঘরে একজন শ্রমিক তার পরিবার নিয়ে বাস করে, সর্বসাকুল্যে তারা সাতজন। ধরে নেওয়া যাক পরিবারের একজন হল তিন বছরের একটা ছেলে। এ বয়সে বাচ্চারা যা দেখে এবং শোনে, তাদের মনে তা গভীরভাবে দাগ কেটে বসে। প্রতিভাশালী লোকের ক্ষেত্রে এ বয়সের ঘটনা এমনভাবে মনের মধ্যে রেখাপাত করে যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তা তাদের স্মরণে থাকে। সুতরাং এ জীবনের সংকীর্ণতা এবং এতটুকু পরিবেশে অতো লোকের ভিড় তার মনে নিশ্চয়ই কোন সুখস্মৃতির ছবি আঁকে না। এ পরিবেশে তাই ঝগড়া আর পরস্পরের বোঝাপড়ার অমিল তো থাকবেই। এতটুকু জায়গায় যেখানে পাশাপাশি শোওয়াও অসম্ভব; ওপর নিচে শোওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ছোট ছোট অমিলগুলো, যেগুলো ঘরে বেশি জায়গা থাকলে পরস্পরের কাছ থেকে একটু দূরে সরে বসতে পারলে সহজেই মিটে যায়; এখানে সেগুলোই পুরনো রোগের মত দেখা দেয়। ছোটদের ক্ষেত্রে তারা পরস্পর ঝগড়া করলেও ঝগড়া সহজে মিটে যায়। এবং অল্পক্ষণের মধ্যে তা ভুলেও যায়। কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটাই অন্যরকম হয়ে দেখা দেয়। প্রাত্যহিক ঝগড়াতে যে নির্দয়তা থাকে, সেটাই সংসারের সব শান্তি ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। এগুলো ছেলেপেলেদের জীবনে প্রতিক্রিয়াও কম করে না। কারোর যদি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকে, তার পক্ষে ব্যাপারটা বোঝা সম্ভব। যখন মত্তমাতাল অবস্থায় ঘরে ফিরে স্বামী স্ত্রীকে দৈহিক নির্যাতন করে, সমস্ত পারিবারিক প্রতিক্রিয়া ব্যাপারটাতে যা হয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া বোঝা এটা সম্ভব নয়। বছর ছয়েক বয়স হলে বাচ্চারা তো দূরের কথা, এসব ঘটনাতে বড়রাও স্থির থাকতে পারে না। বিষাক্ত তত্ত্বে জারিত, পেট ভরে খেতে না পাওয়ায় অপুষ্ট শরীর আর মস্তিষ্ক ভরা কীট নিয়ে তারা ঢেকে গিয়ে প্রাইমারী স্কুলে। এরাই দেশের ভবিষ্যত নাগরিক। অতিকষ্টে সেখানেই তারা যতটুকু পারে পড়াশোনা করে। বাড়িতে তো পড়াশোনা করার না আছে জায়গা, না পরিবেশ। উপরন্ত বাবা মা সর্বক্ষণ স্কুলের শিক্ষকদের সমালোচনায় মুখর। বিশেষ করে এ পরিবেশে যেসব সমালোচনা হয়, তার আওতা থেকে কিছুই বাদ পড়ে না। স্কুল থেকে শুরু করে গভর্নমেন্ট পর্যন্ত। ধর্ম, আদর্শ, রাষ্ট্র কোন কিছু সম্পর্কেই এখানে গঠনধর্মী কোন আলোচনা হয় না। যখন চৌদ্দ বছর বয়সে সে স্কুল ছেড়ে বেরয়, তখন সুশিক্ষার বদলে এ জিনিসগুলোই নড়াচড়া করে বেশি।
জীবনের এ সন্ধিলগ্নে মহৎ আদর্শের প্রতি মন ধাবিত না হয়ে মানব জীবনের অন্ধকার দিকটার প্রতিই মন আকৃষ্ট হয় বেশি। পনেরো বছর বয়সে সেই তিন বছরের ছেলেটা সব কিছুর বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু করে। জীবনের নোংরা এবং কদর্যময় দিকটার প্রতি-ই তার আকর্ষণ গড়ে উঠে; চিন্তাধারার উঁচু দিকটার প্রতি তখন তার চরম অনীহা। মানসিক ঠিক এ অবস্থাতে সে স্কুলে গিয়ে প্রবেশ করে।
তার জীবনের ছোটবেলায় দেখা পিতার দৈনন্দিন খাত ধরেই বয়ে চলে। ভবঘুরে হয়ে সারাটা দিন রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে ঘরে ফেরে। আর সেই অর্ধমৃত জন্মদাতার উদ্দেশ্যে গালাগাল ছোড়ে। শুধু তাই নয় অভিশাপ দেয় ঈশ্বর এবং এ পৃথিবীটাকেও; শেষমেষ গিয়ে ঢেকে অল্প বয়স্ক ছেলেদের শুদ্ধিকরণের জন্য তৈরি জেলখানায়। বাকি যেটুকু ছিল তা ওখানেই পূর্ণতা পায়। এবং মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ওদের ভেতরে দেশপ্রেমের অভাব দেখে সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।
দিনের পর দিন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় দেখে আসছে থিয়েটার, সিনেমা; নোংরা সাংবাদিকতা এবং কদর্য বইপত্রগুলি জনতার মধ্যে বিষ ছড়িয়ে চলেছে। তবু ওরা আশ্চর্য হয় যখন দেখে যুবক সম্প্রদায়ের আদর্শ এত নিচু বা দেশপ্রেম বলতে কিছু নেই। আসলে ছোটবেলা থেকে যে মানসিকতা নিয়ে এ ছেলেগুলো বেড়ে ওঠে, বড় হয়ে সিনেমা, থিয়েটার এবং সাংবাদিকতায় তারই প্রতিফলন দেখতে পায়। এ যেন আগুনের সঙ্গে ঝড়ের হাওয়া এসে ফু দেওয়ার মত অবস্থা।
আমি কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলাম। যেটা আগে আমার ধারণায় ছিল না, সেই ব্যাপারটা এরকম;
উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন মানুষের ভেতরে দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদী আদর্শ জাগরিত করা। যা ছাড়া সমাজকে কিছুতেই ওপরে টেনে তোলা যাবে না। কিন্তু সেটা করতে প্রথমেই শিক্ষা এবং পারিবারিক পরিবেশের আমূল পরিবর্তন দরকার। প্রত্যেকের সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সচেতনতারও প্রয়োজন; সর্বোপরি দেশের রাজনৈতিক পটভূমিকাও মহৎ হওয়া চাই একমাত্র তাহলেই সে দেশের নাগরিক হিসেবে গর্ব অনুভব করা যাবে। মানুষ যাকে ভালবাসে, তারই জন্য যে সংগ্রাম করতে পারে; আর যেটাকে সে শ্রদ্ধা করে, তাকেই সে ভালবাসতে পারে। আর শ্রদ্ধা করার জন্য সেই বিষয়টা সম্পর্কে পুরো না হলেও কিছুটা জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
যেইমাত্র সামাজিক সমস্যায় আমার উৎসাহ আসে, সঙ্গে সঙ্গে তার ভিত্তি সম্পর্কে বিচার বিবেচনা শুরু করি। নতুন আর একটা অনাবিষ্কৃত জগতের পর্দা চোখের সামনে থেকে সরে যায়।
১৯০৯-১০ সালে আমার অবস্থা অনেকটা ভাল অর্থাৎ কায়িক শ্রমের কাজ করে আর আমাকে পেট ভরাতে হয় না। আমি তখন স্বাধীনভাবে ড্রাফটসম্যান এবং জল রঙের অংকন শিল্পী হিসেবে যা রোজগার করি তাতে পেটে ভরবার মত রুটি কেনার সামর্থ্য হয়েছে। এবং সেই রোজগারে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। যদিও যথেষ্ট রোজগার নয়, তবুও পেশাটাকে আমি ভালবাসি। আমাকে ভবিষ্যত উৎসাহ দেয়। তদুপরি সন্ধ্যেবেলায় যখন আমি ঘরে ফিরে আসি, আগেকার মত অতো পরিশ্রান্ত হই না। আগে যখন আমি বাড়ি ফিরতাম তখন পড়াশোনা করার মত অবস্থা আর থাকত না। শরীরটাকে কোনরকমে বিছানায় ছুঁড়ে দিতে পারলে বেঁচে যেতাম। আমার বর্তমান কাজকর্ম ভবিষ্যতের পেশাভিত্তিক। সর্বোপরি আমি আমার কর্মসময়ের নির্ধারক, এবং নিজের মত অনুযায়ী সেই কাৰ্যসূচি পরিবর্তন বা সময় ভাগ করাও আমার হাতে। আমি ছবি আঁকতাম পেট ভরাবার জন্য, এবং পড়াশোনা করতাম, পড়াশোনা করতে ভালবাসতাম বলে।