পুরোপুরি নিজেকে হতাশার সমুদ্রে নিমজ্জিত না করার জন্য আমি তঙ্কালীন পরিবেশটাকে দু’ভাগে ভাগ করি। এক, বাইরের চেহারা অনুযায়ী; দুই যে যে কারণে তারা এরকম পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে। এ একমাত্র পথ যার দ্বারা নিজেকে হতাশা সমুদ্রে পুরোপুরি ডোবার হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছি। তারা এ দুঃখ দুর্দশায় এবং দুর্ভাগ্যের সমুদ্রে ডুবে নিজেদের এ নোংরা পরিবেশ এবং নিচুতে নামাতে বাধ্য হয়েছে। তাদের অবস্থা সত্যই শোচনীয়। আমার জীবনেও এ একই ধরনের দুর্দশা আমাকে মানুষগুলোর প্রতি ভাবালু হতে দেয়নি। না, ভাবালু হয়ে পড়লে কোন কিছুরই সঠিক মূল্যায়ণ সম্ভব নয়।
সে দিনগুলোতে আমি বুঝতে পারতাম যে একমাত্র এ অবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য দুটো পথ খোলা আছে। এক সামাজিক অবস্থার পুরো একটা পরিবর্তন এনে নিচেকার লোকদের সমাজের প্রতি কর্তব্য এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। দুই, এ কর্তব্য এবং দায়িত্ব বোধের সমন্বয় সাধন করে নিষ্ঠুর হাতে সমাজের অপ্রয়োজনীয় অনুশাসন তথা শুকনো ডালপালা হেঁটে দিতে হবে— যেগুলো এ সমাজটাকে সুস্থভাবে বাড়তে দিচ্ছে না।
প্রকৃতি যেমন স্থিতাবস্থায় থাকে না, তেমনি মানুষের জীবনেও যান্ত্রিক উপায়ে উন্নতি সাধন করা অসম্ভব। জন্মের পর থেকেই তার ভবিষ্যতের উন্নতির জন্য একটা সুনির্দিষ্ট এবং পাকা রাস্তা চাই, যেটা ধরে সে তরতর করে এগিয়ে যেতে পারে।
ভিয়েনাতে আমার সংগ্রামের দিনগুলোতে আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম যে শুধু ভাবাবেগ দিয়ে সামাজিক এ অদ্ভুত সমস্যার সমাধান করা যাবে না। বরং তা ভাবতে গেলে পুরো ব্যাপারটাই হাস্যাস্পদ এবং অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। তার চেয়ে এমন একটা পথ আবিষ্কার করতে হবে যা আমাদের সমাজের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক এ ক্ষয়িষ্ণু দিকের ক্ষয় রোধ করে ওপরে টেনে তুলতে পারে। সমাজের এ ক্ষুয়িষ্ণু দিকটাই একটা মানুষকে তার নিজের সিংহাসন থেকে ঠেলে নিচে নামিয়ে দিয়েছে বা দিতে সাহায্য করেছে। এবং বেকারত্বই হল তার একটি সর্বপ্রধান কারণ; যেটা মানুষকে প্রতিনিয়ত এক চরম অনিশ্চয়তার পথে এগিয়ে দিয়েছে। আর এ প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তাই তাকে নিচের দিকে আকর্ষণ করেছে; গভীর বা সুনির্দিষ্ট জীবনের ধারা গ্রহণ করতে দিচ্ছে না। তাদের কাপুরুষ আর জীবন সম্পর্কে উদাসীন বা অমনোযোগী করে তুলছে। এবং এ মনোভাব তাকে আত্মবিশ্বাসে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। যখন এ আত্মপীড়ন থেকে লোকে মুক্তি পাবে, তখনই তার অন্তশক্তি এবং বহিঃশক্ত দুটো মিলিয়ে সে সমাজের এবং নিজের উন্নতির চেষ্টা করবে। হ্যাঁ, পঙ্গু ডালপালা এবং অপ্রয়োজনীয় শিকড়ের ডাল থেকে বেরিয়ে আসার এ একমাত্র পথ।
কিন্তু অস্ট্রিয়ার শাসককুলের সামাজিক দাবি দাওয়া সম্বন্ধে কোন ধ্যান ধারণা বা সামাজিক সঠিক অনুশাসনের অভাবই সমাজের এ দুষ্ট ক্ষতগুলোকে সারতে দেয়নি।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি সঠিক কোন জিনিসটা আমাকে বেশি আচ্ছন্ন। করেছিল? দারিদ্রতা, যেটা আমার সেদিনের সর্বক্ষণের সঙ্গী অথবা আমাকে ঘিরে থাকা লোকগুলোর বুদ্ধিমত্তা এবং সাংস্কৃতির অভাব।
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা কত তাড়াতাড়ি কুদ্ধ হয়ে ওঠে যখন এসব ব্যাপার তারা পদদলিত কোন ব্যক্তির কাছ থেকে শোনে। তারা জার্মান হোক, বা না হোক। এ অবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভে তারা ফেটে পড়ে, কিন্তু তাদের সেই ঘৃণা মিশ্রিত ক্ষোভের বেশির ভাগটাই ভাবালুতায় ভরা ফানুস মাত্র।
কিন্তু ক’জন সত্যিকারের আত্মবিশ্লেষণ করে? অবশ্য ভাবালুতার বাষ্পে তা সম্ভবও নয়। ক’জন বুঝতে চেষ্টা করে যে পিতৃভূমির যে অংশটার তারা অংশীদার, তার সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক সমৃদ্ধির দিকটাকে। আমাদের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় কি একবারও ভাবে যে পিতৃভূমির সমাজের এমন একটা উজ্জ্বল দিক থাকা উচিত যা নিয়ে তারা গর্ব করতে পারে।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, যে অন্যান্য দেশের শ্রমিক শ্রেণীও কম দেশপ্রেমিক নয়। যদি সেটা স্বীকার করে নেওয়া যায় তবু আমাদের অবহেলাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। কিন্তু ব্যাপারটা এ রকম নয়। আমরা যেটাকে বলি অন্ধ জাতীয়তাবাদী, ফ্রান্সের মহত্বের পরিপূর্ণ বিকাশে সেটাই তাদের সভ্যতা। শুধু সামনে একটা আদর্শ বা লক্ষ্যকে দাঁড় করিয়ে রেখে ফরাসী ছেলেদের শিক্ষা দেওয়া হয় না। শিক্ষা বলতে তাদের দেশের বিস্তারিত সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক পটভূমিকা শেখা, এবং তা শেখানো হয় অতি বিস্তারিতভাবে।
এ ধরনের শিক্ষার পটভূমি বিরাট হওয়া উচিত এবং বারবার শিখিয়ে মনের গভীরে তার অনুপ্রবেশ ঘটানো চাই।
আমাদের ক্ষেত্রে আমরা যে শিক্ষার সেই দিকটাকে উপেক্ষা করে চলেছি শুধু তাই নয়, যারা ভাগ্যবলে স্কুলের দৌলতে একটু আধটু শিক্ষা পাচ্ছে তাদের মনটাও সম্পূর্ণ বিকৃত করে দেওয়া হচ্ছে। বিষাক্ত ইঁদুর প্রতিনিয়ত আমাদের রাজনৈতিক দেহে বিষ ছড়িয়ে চলেছে। হৃদয় এবং সেই স্মৃতিশক্তিকে সেই বিষে আচ্ছন্ন করে দিয়ে এ বিশাল জনতাকে দুঃখ দুর্দশার চরমে নামিয়ে দিচ্ছে।
পাঠকগণকে নিচের একটা দৃশ্য কল্পনা করতে অনুরোধ করি।