এরকম বহু উদাহরণ আমি দিনের পর দিন দেখিছি। যতদিন গেছে, এ দানব শহরটা যেভাবে পাগলের মত লোকগুলোকে আকর্ষণ করে তা দেখে দেখে শহরটার প্রতি মনের মধ্যে একটা তিক্ততা জন্মে গেছে। প্রথম যখন তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে, কিছুদিন পর্যন্ত সেই গ্রাম্য জীবনের সংগে তাদের একটা যোগাযোগ বজায় থাকে, তারপর, একদিন তাদের অলেক্ষ্যে ছিঁড়ে যায়।
আমি সেই শহর জীবনের আবর্তে পড়ে বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার ভাগ্যও সেই লোকগুলোর মত; এবং আমার ওপরেও শহুরে জীবন তার থাবা নিয়ত বসিয়ে চলেছে। এ অর্থনৈতিক ওঠা নামায় স্বভাবতই তার খরচা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যখন পকেটে পয়সা থাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খায়; বাকি সময় অনাহারে কাটায়। এটা শারীরিক একটা চক্রের আবর্ত। ক্ষুধার্ত অবস্থায় দীর্ঘদিন কাটানোর সময় যে স্বপ্ন দেখে খাওয়ার দিনগুলোর। এবং এ স্বপ্নগুলো তার মানসিক অবস্থাকে এমন এক জায়গায় পৌঁছে দেয় যে সে এ খরচা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে মানসিক ভারসাম্য একেবারে হারিয়ে ফেলে। তাই আবার যখন সে চাকরি পায়, মাইনের দিনগুলোর আগামীদিনের কথা মনে না রেখে পুরোটাই খরচা করে বসে। এটা যে শুধু তার ব্যক্তিগত জীবনের অভাব ডেকে আনে তা নয়, তার এ স্বল্প সাপ্তাহিক বেতনে গৃহের প্রয়োজনীয় খরচের হিসেবও রাখতে পারে না। ব্যাপারটা এরকম; প্রথম দিকে তার সাপ্তাহিক রোজগারে পাঁচদিন কোন রকমে চলে যায়; তারপরে অভ্যাসটা বাড়তে বাড়তে সেই একই রোজগারে তিনদিন পার হওয়া মুস্কিল হয়ে পড়ে। শেষে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় একদিনে। অবশেষে এক উৎসবের রাত্রেই পুরো সাপ্তাহিক মাইনে সে খুঁকে দেয়। এগুলোর একমাত্র কারণ হল তার নিজস্ব রোজগারে খরচা করার বাজেট তৈরি করার অক্ষমতা।
অনেক সময়েই তাদের ঘরে স্ত্রী পুত্র থাকে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার এ অভ্যাস ওদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়; বিশেষ করে স্বামী যদি তার পরিবারকে নিজস্ব ধরনে ভালবাসে আর সেই পরিবারকে জড়িয়ে ধরে দিনগুলোকে পাড়ী দিতে চায়; সেই ক্ষেত্রে পুরো সপ্তাহের রোজগারে পরিবারটির তিন চার দিনের ভরণপোষণ কোনক্রমে চলে। যতদিন টাকা থাকে সবাই মিলে খাদ্য আর পানীয়ের মহাফিল জুড়ে দেয়, সপ্তাহের বাকি দিনগুলো তারপর ওদের কাটে অনাহারে। তখন তার স্ত্রী প্রতিবেশীদের থেকে গোপনে ধার করে আর পাড়ার দোকানদারদের কাছে সামান্য জিনিসের জন্য হাত পেতে দুঃখের দিনগুলো পাড়ি দিতে চায়। পুরো পরিবারটা শূন্য খাবার টেবিলে বসে মনে মনে কল্পনা করে আগামী সপ্তাহে এ অভাবের আর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। আর সেই ক্ষুধার দিনগুলোয় স্বপ্ন দেখে প্রাচুর্যের দিনে পেট ভরে খাওয়ার। এবং শিশুকাল থেকেই এ দুঃখের দিনগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওরা এ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
এ অভাবরূপী শয়তান পুরুষটাকে সপ্তাহের প্রথম দিকে তাড়া করে ফেরে। স্ত্রী স্বভাবতই ছেলে মেয়েদের মুখ চেয়ে সংসারের দাবি আদায়ের জন্য সচেষ্ট হয়। ক্রমে সেটা রূপ নেয় কদর্য কুৎসিত ঝগড়ায়। স্বামী আর কোন পথ খুঁজে না পেয়ে মদ খেতে আরম্ভ করে। দিনে দিনে পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে মনের দিক থেকে অনেক দূরে সরে যায়। তারপর মানুষটার শুরু হয় প্রতি শনিবারে মদ খাওয়া; স্ত্রী তার এবং সন্তানদের অস্তিত্ব রাখার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামে নামতে বাধ্য হয়। কারখানার রাস্তা থেকে নোংরা পুঁড়িখানা পর্যন্ত কয়েকটা পয়সার জন্য মাইনের দিনে স্বামীকে ধাওয়া করে। সব পয়সা খুইয়ে রোববার বা সোমবার যখন সে বাড়ি ফেরে তখন সম্পূর্ণ নিঃস্ব। আবার অভাব অনটন, ঝগড়াঝাটি, শেষে ভগবানের দাহাই পেড়ে চিৎকার আর কান্নাকাটিতে ভরা প্রহরগুলো কাটে।
এরকম শয়ে শয়ে ঘটনা আমার চোখের ওপর দেখেছি। প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে ট্রাজেডি এবং দুর্ভাগ্য কোথায় বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ওরা হল শয়তান সমাজ ব্যবস্থার শিকারমাত্র।
তখনকার পারিবারিক অবস্থা প্রায় সব পরিবারেই এক। বিশেষ করে ভিয়েনার শ্রমিকেরা চারিদিকে দুঃখ-দুর্দশার দেওয়ালের মধ্যে দিন যাপন করত। এখনো যখন সেই দুঃখের দিনগুলো আমার স্মৃতির সামনে ভেসে ওঠে, সারা শরীরটা ভয়ে কাঁপতে থাকে। গভীর নিঝুম রাত্রে বস্তি থেকে ভেসে আসা মাতাল স্বামীর সঙ্গে তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের ঝগড়া আর নিষ্ঠুর মারামারি। ক্লেদাক্ত পরিবেশে ওদের জীবনযাত্রা মানুষকে এক একটা পুরো শয়তান বানিয়ে ছাড়ে।
সেদিন কি হবে যেদিন মানুষগুলো নিজেদের অবস্থা বুঝতে পেরে যারা তাদের এ অবস্থায় এনে ফেলেছে তাদের তাড়া করবে? কিন্তু আশ্চর্যের কথা সে জগতের বাসিন্দারা এ জগতের লোকদের কোন খোঁজ খবরই রাখে না। কিন্তু একদিন আসবে যখন পুরো ঘটনাটা তার আপন গতিপথে মোড় নেবে, যদি না সময় মত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
আজ এতদিন পরে আমি আমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাই এজন্য যে নিয়তি আমাকে এমন একটা বিদ্যালয়ে ঘটনাক্রমে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল, ইচ্ছে না থাকলেও সেই পরিবেশে বাধ্য হয়েছি ঘটনাগুলোর প্রতি মন সংযোগ করতে। এ স্কুলই আমাকে জীবনের এক শক্ত বুনিয়াদের ওপর এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।