সোফার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে তিনি গিটারের লেখা একখানা বই, জাপানি কাগজে ছাপানো ছবি ভ্যাকিমার্ট-এর; সবুজ চামড়া দিয়ে বাঁধাই। বইটি আদ্রিয়েন সিঙ্গলটল তাঁকে দিয়েছিলেন। বইটির পাতা ওলটাতে-ওলটাতে ল্যাসিন্যের-এর ঠান্ডা সবুজ, হাতের ওপরে লেখা একটি কবিতার ওপরে তাঁর চোখ পড়ে গেল। কবিতাটি পড়ে নিজের সাদা সূচালো। আঙুলগুলির দিকে তিনি একবার তাকিয়ে দেখলেন; দেখে, নিজের অজান্তেই কেমন যেন শিউরে উঠলেন। তারপরে পড়লেন ভেনিস-এর ওপরে লেখা সুন্দর একটি কবিতা।
কী সুন্দর বর্ণনা ভেনিস-এর কবিতাটা পড়তে-পড়তে পাঠকের মনে হবে সে যেন পাটল বর্ণের মুক্তার মতো শহরে নদীর ওপর দিয়ে পাল তুলে রূপালি দাঁড় লাগানো কালো গনডোলার ওপরে বসে ভেসে চলেছে; শরৎকালে ভেনিসে তিনি যে দিনগুলি কাটিয়েছিলেন সেইগুলির কথা মনে পড়ে গেল তাঁরা কী আনন্দেই না কেটেছিল দিনগুলি–অজস্র আনন্দ আর ভুলের উত্তেজনায় মাতোয়ারা হয়ে ছিলেন তিনি। প্রতিটি জায়গায় রোমান্স একেবারে থইথই করছে সেখানে; কিন্তু অক্সফোর্ডের মতো, ভেনিসও তার সমস্ত রোমান্সকে পেছনে সরিয়ে রেখেছে। আর সত্যিকার রোমান্টিক চিন্তাধারার মানুষের কাছে পটভূমিকাটাই আসল অথবা একমাত্র সত্য। কিছুদিন বেসিলও তাঁর সঙ্গে ওখানে কাটিয়েছিলেন। হতভাগ্য বেসিল! মানুষে যে এভাবে মারা যেতে পারে সেকথা ভাবতেও তাঁর হৃৎকম্প উপস্থিত হল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বইটা তুলে নিলেন তিনি। সব কিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা। করলেন। একটার পর একটা পাতা ওলটাতে লাগলেন তিনি। দেশ-বিদেশের পাখির কাহিনি। পড়লেন; স্মার্নার ছোটো কাপের জানালার ভেতর দিয়ে চড়াই পাখিরা উড়ে বেড়ায–সেখানে। হ্যাঁডিসরা বসে-বসে হলদে রঙের মালা গণে, পাগড়িওয়ালা বণিকদের দল তাদের লম্বা-লম্বা পাইপ টানে; আর মাঝে-মাঝে গম্ভীরভাবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সব পড়লেন তিনি। আরো অনেক কিছু পড়লেন তিনিঃ সূর্যহীন প্যালেস দ্য লা কনকোর্ড-এর ওবেলিক পাখির কথা, নীল নদের ধারে সিম্পনিকস-এর কথা, ইজিপ্টের শকুন আর কুমিরের কথা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বইটি তাঁর হাত থেকে পড়ে গেল। কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়লেন তিনি। বিরাট ভয় এসে তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। অ্যালেন ক্যাম্পবেল যদি ইংলন্ডের বাইরে চলে যায়? তাঁর ফিরে আসতে অনেকদিন লাগবে। তিনি নাও আসতে পারেন। তাহলে তিনি কী করবেন? প্রতিটি মুহূর্ত এখন জরুরি। পাঁচ-ছ’ বছর আগে তাঁদের মধ্যে অগাধ বন্ধুত্ব ছিল–যাকে বলে অচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব। তারপরেই হঠাৎ তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এখন মাঝে-মাঝে কোনো জায়গায় যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তাহলে ডোরিযেই পরিচিতির হাসি হাসেন অ্যালেন পরিচয়কে অগ্রাহ্য করে যান।
মানুষ হিসাবে অ্যালেন সত্যিকারের বুদ্ধিমান যুবক। কিন্তু বাস্তব কলার সৌন্দর্য তাঁকে কোনোদিনই আকর্ষণ করতে পারেনি; আর কাব্যিক সৌন্দর্য বলতে যেটুকু তিনি বুঝতেন। বলে মনে হত তার সবটুকুই তাঁর ডোরিয়েন-এর কাছ থেকে নেওয়া। বিজ্ঞানের দিকেই তাঁর ঝোঁকটা ছিল প্রবল। কেম্ব্রিজে পড়ার সময় বেশিরভাগ সময়টাই তিনি ল্যাবরেটরিতে কাটাতেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে তিনি ভালোই ছিলেন। এখনো পর্যন্ত তিনি রসায়নশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করতেন, নিজের একটি পরীক্ষাগারও তিনি তৈরি করেছেন এবং সেইখানেই দিনের অধিকাংশ সময় দরজা বন্ধ করে দিয়ে গবেষণায ডুবে থাকতেল অ্যালেন। তাঁর মা তাঁর এবম্বিধ ব্যবহারে বড়ো হব্ধ ছিলেন। তিনি মনে করতেন কেমিস্টরা কেবল রোগীর প্রেসক্রিপশন লেখে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র পার্লামেন্টের নির্বাচনে দাঁড়াক। গায়ক হিসাবেও অ্যালেনের যথেষ্ট নাম ছিল। অনেক শখের বাজিয়েদের চেয়ে অনেক ভালো তিনি। বেহালা আর পিয়ানো বাড়াতে পারতেন। সত্যি কথা বলতে কি এই গান বাজনার মধ্যে সেই ডোরিয়েন-এর সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়; আর অন্যান্য ক্ষেত্রে যা ঘটেছে–ডোরিয়েন-এর অদ্ভুত সৌন্দর্য আর সম্মোহনী শক্তিই তাঁকে তাঁর কাছে টেনে এসেছিল। লেডি বার্কশায়ারের বাড়িতে যে রাত্রিতে রুবিনস্টেন বাজনা বাড়িয়েছিলেন সেই রাত্রিতেই ওঁদের দুজনের পরিচয় হ্য; তারপরেই তাঁরা একসঙ্গে অপেরায় যেতে শুরু করেন; শুরু করেন গানের মজলিসে যোগ দিতে। আঠারো মাস ধরে তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল নিবিড়। এই সময় সেলবিরয়্যাল অথবা। গ্রসভেনর স্কোয়ারে প্রায় অ্যালেনকে দেখা যেত। তাঁদের মধ্যে কী কারণে কলহ হয়েছিল, অথবা কলহ কোনো আদৌ হয়েছিল কি না সে কথা কেউ জানে না। কিন্তু হঠাৎ শোনা গেল তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে; আর কোনো জায়গায় ডোরিয়েন হাজির হলে অ্যালেন অনেক আগেই সেখান থেকে চলে যান। অ্যালেন-এর ভেতরেও অনেক পরিবর্তন। দেখা দিয়েছে। সেই হাসিখুশি ভাবটা তাঁর আর নেই; সব সময়েই কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকেন। গান-বাজনার জলসায় বিশেষ দেখা যায় না তাঁকে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন বিজ্ঞানের গবেষণায় তিনি এতই ব্যস্ত থাকেন যে ও-সব দিকে মন দেওয়ার মতো সময় তাঁর আর নেই। কথাটা সত্যি। দিনদিন তিনি শরীরতত্ত্ব নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। মাঝে-মাঝে অদ্ভুত ধরনের গবেষণাও তিনি করতেন। বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকপত্রে তাঁর নামও মাঝে-মাঝে দেখা যেত।