ডোরিয়েন গ্রে-র ছবি

১. গোলাপ ফুলের মিষ্ট গন্ধে

প্রথম পরিচ্ছেদ

গোলাপ ফুলের মিষ্ট গন্ধে স্টুডিওটি মশগুল হয়ে ছিল, আর বাগানের ভেতরে গ্রীষ্মকালীন বাতাস ঘুরপাক খাওয়ার সময় খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে লাইল্যাক ঝাড়ের ঘন সুবাস, অথবা লাল ফুলে ভরা কাঁটাগাছের ঝোপ থেকে মিষ্টি মেভাজি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে।

স্টুডিওর এক কোণে পারিশিয়ান-গদি মোড়া নীচু একটি বসার ‘কোচ’, তার ওপরে চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী লর্ড হেনরি ওটন শুয়ে শুয়ে একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকে শেষ করছিলেন। মধুর মতো মিষ্টি আর রঙিন সোঁদাল গাছের ফুলের আভা তাঁর চোখে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল গাছটির কম্পমান শাখা-প্রশাখাগুলি তাদের আগুনে সমারোহের ভার বইতে পারছে না। বিরাট জানালার ওপরে সিল্কের পর্দা ঝোলানো ছিল, সেই পর্দার ওপরে মাঝে মাঝে উড়ন্ত পাখিদের ডানার ঝাপটায় মৃদু আলোড়ন ছড়িয়ে পড়ে জাপানি চিত্রকরদের চিত্রকলার সাময়িক ব্যঞ্জনার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। এই দেখে টোকিওর চিত্রকরদের বিবর্ণ জরাজীর্ণ মুখগুলির কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। যে আর্ট অচল, গতিহীন ছাড়া আর কিছু নয়, সেই আর্টের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য আর গতির সৃষ্টি করতে তাঁরা কী আয়াসই না করেন। চারপাশে নিস্তব্ধ। লম্বা ঘাসের মধ্যে অথবা ধূলিমলিন উডবাইন গাছের জড়ানো ডালের ভেতরে আসুরিক জেদ নিয়ে ঘূর্ণায়মান মৌমাছিদের ক্লান্তু গুঞ্জন সেই নিস্তব্ধতাকে আরো ক্লান্তিকর করে তুলেছিল। লন্ডন শহরের মৃদু গর্জন শুনে মনে হচ্ছিল দূরাগত কোনো সঙ্গীতযন্ত্রের উচ্চগ্রামের সুর ধ্বনিত হচ্ছে।

ঘরের মাঝখানে ছবি আঁকার একটি খাড়াই ফ্রেম দাঁড় করানো। তার ওপরে একটি যুবকের পূর্ণ প্রতিকৃতি দেখে মনে হল, যুবকটির চেহারা অদ্ভুত সুন্দর। সেই প্রতিকৃতির সামনে, সামান্য একটু দূরে, চিত্রকর নিজে বসেছিলেন। চিত্রকরের নাম বেসিল হলওয়ার্ড। বছর কয়েক আছে এর হঠাৎ অন্তর্ধানের কাহিনিকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের মধ্যে ভীষণ একটি উত্তেজনা জেগেছিল, আর সেই সঙ্গে মুখর হয়ে উঠেছিল নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত গুজব।

যে মিষ্টি লাবণ্যময় প্রতিকৃতিটি তিনি দক্ষতার সঙ্গে এঁকেছেন তার দিকে চিত্রকর তাকিয়ে ছিলেন। ছবিটিকে দেখে তাঁর মুখের ওপরে একটুকরো আনন্দের হাসি ফুটে উঠল, শুধু উঠল না, মনে হল, হাসিটুকু লেগে রইল একটু। কিন্তু হঠাৎ তিনি চমকে উঠলেন, চোখ বোজলেন; আঙুলগুলি রাখলেন বোজালো চোখের পাতার ওপরে। মনে হল একটি অদ্ভুত স্বপ্নকে তিনি মগজের মধ্যে বন্দী করে রাখতে চান, ভয় হল, হয়তো তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যাবে।

অবসন্নভাবে লর্ড হেনরি বললেন, বেসিল, এটি তোমার শ্রেষ্ঠ চিত্র। এত ভালো চিত্র জীবনে তুমি আর আঁকোনি। পরের বছর এটিকে নিশ্চয় তুমি গ্রসভেনর-এ পাঠাবে। অ্যাকাডেমি হচ্ছে যেমন বড়ো তেমনি কদর্য। যখনি আমি সেখানে গিয়েছি তখনি দেখেছি যে সেখানে এত মানুষের ভিড় জমেছে যে ছবি দেখার সুযোগ পাইনি এতটুকু, ব্যাপারটা ভয়ানক সন্দেহ নেই। অথবা, এত ছবির ভিড় হয়েছে যে মানুষ দেখার সময় পায়নি। এটি আরো খারাপ। গ্রসভেনর-ই একমাত্র জায়গা যেখানে তোমার ছবি তার উপযুক্ত মূল্য পাবে।

একটু অদ্ভুতভাবে ঘাড় নাড়লেন চিত্রকর। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় এইভাবেই তিনি ঘাড় নাড়তেন। সেই ঘাড়নাড়া দেখে তাঁর সহপাঠীরা সবাই হাসতেন। সেই রকম একটি ঘাড় নেড়ে তিনি বললেন, আমার মনে হয় না এটিকে আমি কোথাও পাঠাব। না, এটিকে আমি কোথাও পাঠাব না।

এই কথা শুলে লর্ড হেনরি কেমন যেন আবাক হয়েই মুখটা তুলে আফিঙের গুঁড়ো মেশানো সিগারেটের জমাট ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, কোথাও পাঠাবে না? কেন বন্ধু? এর পেছনে কি কোনো যুক্তি রয়েছে? তোমাদের এই চিত্রকরের জাতটা সত্যিই বড়ো কিম্ভুতকিমাকার। নাম কেনার জন্যে এ দুনিয়ায় তোমরা সব কিছু করতে পার। আর নাম হওয়া মাত্র তোমরা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাও। সুনামটাকে পরিত্যাগ করা মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ আলোচনা করার চেয়ে খারাপ, এবং যে জিনিসটি লোকে প্রায় আলোচনা করতে চায় না এরকম একটি জিনিসই পৃথিবীতে রয়েছে। এই রকম একটি প্রতিকৃতি ইংলন্ডের সমস্ত যুবকদের ওপরে তোমাকে বসাবে, আর বৃদ্ধেরা তোমাকে হিংসা করবে, অবশ্য কোনোরকম ভাব প্রকাশের শক্তি যদি তাদের থাকে।

বেসিল বললেন, আমি জানি আমাকে তুমি উপহাস করবে। কিন্তু আমি সত্যিই বলছি এটিকে আমি বাইরের প্রদর্শনীতে পাঠাতে পারব না। এর মধ্যে আমার নিজেকে অনেকখানি মিশিয়ে দিয়েছি।

সোফার ওপরে শরীরটাকে বেশ ভালো করে ছড়িয়ে দিয়ে লর্ড হেনরি হাসলেন।

হ্যাঁ, আমি জানি তুমি হাসবে, কিন্তু কথাটা যে সত্য সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কী বলছ তুমি, বেসিল! তোমার অনেকখানি এই প্রতিকৃতির ভেতরে রয়েছে? তুমি যে এতটা অন্তঃসারশূন্য তা তো আমি জানতাম না। আর সত্যি কথা বলতে কি তোমাদের দুজনের মধ্যে আমি কোনো সাদৃশ্য দেখতে পাচ্ছি না। তোমার মুখ রুক্ষ, পুরুষ্টু চুলগুলি আলকাতরার মতো কালো; আর ওই যৌবনোদ্দল যুবকটিকে দেখলে মনে হবে যেন হাতির দাঁত আর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে তার দেহটি তৈরি হয়েছে। তোমার ওই প্রতিকৃতিটি আত্মপ্রেমিক নারসিসাস বলে মনে হচ্ছে আমার; অবশ্য ওর মধ্যে তুমি কিছুটা বুদ্ধির কারুকার্য ফুটিয়ে তুলেছ–এই যা। কিন্তু বুদ্ধির জলুস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্য, সত্যিকার সৌন্দর্য বলতে অবশ্য বোঝা যায়, তা নষ্ট হয়ে যায়। বুদ্ধি জিনিসটাই হচ্ছে অতিশয়োক্তির বহিপ্রকাশ। এর কাজ হচ্ছে মুখের কমনীয়তা নষ্ট করা। যে মুহূর্তে মানুষ চিন্তা করতে বসে সেই মুহূর্তেই তার মুখের ওপর থেকে লালিত্য সরে যায়। এক কথায়, মুখের আর কোনো চিহ্নই থাকে না। মানুষ তখন একটা নাক বা কপালে রূপান্তরিত হয়। ঘটনাটা ভয়ঙ্কর ছাড়া আর কিছু নয়। বিদগ্ধ পেশায় সাফল্য অর্জন করেছেন এমন যে কোনো একটি মানুষের দিকে লক্ষ কর। তাঁরা দেখতে কী ভয়ানক! অবশ্য গির্জার পাদরি ছাড়া। কিন্তু সত্যিকার চিন্তা করার বালাই পাদরিদের নেই। আঠার বছর বয়সে বিশপকে যা বলতে শেখানো হয় আশি বছর বয়সেও তিনি তাই বলতে থাকেন। ফলে, চিন্তার ভার থেকে তিনি সব সময়েই মুক্ত, সব সময়েই তিনি খুশি থাকেন। তোমার এই রহস্যময় যুবক বন্ধুটি–যাঁর নাম তুমি কোনো দিনই আমাকে বলনি এবং যিনি আমাকে মুগ্ধ করেছেন, কোনো দিনই চিন্তা করেন না। এদিকে থেকে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ভদ্রলোকটি নির্বোধ, সুন্দর মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। শীতকালে তাকিয়ে দেখার মতো যখন কোনো ফুল ফোটে না তখন এখানে তাঁর উপস্থিতি আমাদের আনন্দ দেবে। গ্রীষ্মকালে বুদ্ধির ধার ভোঁতা করার প্রয়োজন দেখা দিলে তাঁর সাহচর্য সব আমাদের কাছে উপাদেয় বলে মনে হবে। আমার কথা শুনে উৎফুল্ল হয়ো না, বেসিল। কিন্তু তুমি আদৌ ওর মতো নও।

আর্টিস্ট বেসিল বললেন, তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ না, হ্যারি। অবশ্য ওর মতো আমি যে নই তা আমি ভালোভাবেই জানি। বাস্তবিক, ওর মতো আমাকে দেখাচ্ছে একথা কেউ বললে আমি দুঃখই পাব। বিশ্বাস হল না তোমার? আমি তোমাকে সত্যি কথাই বলছি। সমস্ত শারীরিক আর মানসিক উৎকর্ষ ধ্বংস হয়ে যায়। ঠিক এমনিভাবেই ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে এই মরণশীলতা রাজাদের স্খলিত পদক্ষেপের পিছু ধাওয়া করেছে। সহযাত্রীদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে না থাকাটাই ভালো। যারা কুৎসিত এবং মুর্খ এ জগতে তারাই সবচেয়ে ভালো জিনিসটা ভোগ করে। তারা আরাম করে বসে খেলার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। জয় সম্বন্ধে যদি তাদের কোনো জ্ঞান না-ও থাকে, পরাজয় সম্বন্ধে কোনো ধ্যান-ধারণাও তাদের নেই। কোনো ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটই তাদের বিব্রত করে না, আর দশজনের মতো তারা শান্ত আর উদাসীনভাবেই জীবন কাটিয়ে দেয়। কোনোদিনই তারা অন্য লোকের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে না। অন্য লোকের কাছ থেকেও তারা কোনোরকম গুরুতর আঘাত পায় না। হ্যারি, তোমার পদমর্যাদা এবং অর্থ আমার মস্তিষ্ক–দাম তার যাই হোক, আমার কলা–এদের দাম যাই হোক। ডোরিয়েন গ্রে-র মিষ্টি চাহনি, ভগবান আমাদের যা দিয়েছেন তার জন্যে আমরা সবাই দুঃখ পাব–বেশ ভালো রকম দুঃখই পাব আমরা।

বেসিল হলওয়ার্ডের দিকে কয়েকটি পা এগিয়ে যেতে যেতে লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, ডোরিয়েন গ্রে? কী নাম বললে?

হ্যাঁ, ওইটাই তাঁর নাম। ইচ্ছে করেই আমি তোমাকে বলিনি।

কিন্তু কেন বলনি?

তা আমি বলতে পারব না। যাদের আমার খুব ভালো লাগে তাদের নাম আমি কাউকে বলি না। এই নাম বলার অর্থই হচ্ছে তাদের কিছুটা অংশ বলে দেওয়া। সব জিনিসই গোপন রাখতে আমি কেমন যেন ভালোবাসি। আমার ধারণা, যে সব জিনিস আধুনিক জীবনযাত্রাকে রহস্যময় আর অপরূপ করে তুলেছে এটি তার মধ্যে একটি। লুকিয়ে রাখতে পারলে অতি তুচ্ছ সাধারণ জিনিসও আমাদের আনন্দ দেয়। আজকাল শহর ছেড়ে বাইরে কোথাও গেলে ঠিক কোথায় আমি যাচ্ছি সে-কথা আমি কাউকেই বলি না। একথা বললে বেড়ানোর সমস্ত আনন্দ আমার নষ্ট হয়ে যেত। অভ্যাসটা প্রশংসা করার মতো নয়, তবু মনে হয় এই ধরনের গোপনপ্রিয়তা মানুষের জীবনে বেশ কিছু রোমান্সের আমদানি করে। মনে হচ্ছে এর জন্যে আমাকে বেশ বোকা-বোকা লাগছে তোমার?

লর্ড হেনরি বললেন, মোটেই তা নয়। তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমি বিবাহিত। বিবাহের আকর্ষণ হচ্ছে প্রবঞ্চনা, বিবাহিত জীবনকে আকর্ষণীয় করতে হলে স্বামী আর স্ত্রী দুজনকেই প্রবঞ্চনার আশ্রয় অবশ্যই নিতে হবে। আমার স্ত্রী কোথায় যান তা আমি কোনো দিনই জানি না। আমি কোথায় ঘুরে বেড়াই সে বিষয়েও আমার স্ত্রী সমানভাবে অজ্ঞ। মাঝে মাঝে আমাদের দেখা হয়, আমরা দুজনে বাইরে খেতে যাই, তখন বেশ গম্ভীর ভাবেই পরস্পরের কাছে আমরা। নির্ভেজাল মিথ্যে কথা বলে যাই। মিথ্যে ভাষণে আমার স্ত্রী অত্যন্ত পটিয়সী, সত্যি কথা বলতে কি আমার চেয়ে অনেক বেশি। কবে কার সঙ্গে দেখা করার তাঁর কথা রয়েছে সে কথা। তিনি একবারও ভুলে যান না, কিন্তু আমি ভুলে যাই। ফলে, আমি যখন ধরা পড়ে যাই তখন। তা নিয়ে তিনি এতটুকু হইচই করেন না। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, একটু-আধটু হইচই। করলেই হয়তো ভালো হত, কিন্তু তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু উপহাসের হাসি হাসেন মাত্র।

স্টুডিওর একটা দরজা বাগানের দিকে খোলা ছিল, সেই দিকে পায়চারি করতে করতে বেন্সিল বললেন, হ্যারি, তোমার বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে যেসব কথা তুমি বললে তা শুনতে মোটেই ভালো লাগল না আমার। তুমি যে সত্যিকারের একজন ভালো দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন স্বামী সেদিক থেকে আমার কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেকথা বলতে তোমার লজ্জা হয়। তুমি একটি চমৎকার মানুষ কোনোদিনই তোমার মুখ থেকে নীতিকথা বেরোয়নি, কিন্তু কোনোদিনই তুমি অন্যায় কাজ করনি। মানুষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বৈরাগ্যটা তোমার একটা ভান মাত্র।

লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আসল কথা হচ্ছে স্বাভাবিক হওয়াটাই একটা চাল, আর আমার মতে খুব একটা বিরক্তিকর চাল।

এই কথা বলে লর্ড হেনরি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে বাগানের মধ্যে বেরিয়ে এলেন। একটি দীর্ঘ লরেল গাছের ঝোপের ছায়ায় বাঁশের একটা মাচা বাঁধা ছিল। দুজনে সেই মাচায় বসলেন। মসৃণ। পাতার ওপর দিয়ে রোদ গড়িয়ে পড়ছিল। ঘাসের বলে প্রচুর পরিমাণে ফুটে ছিল ডেইজি ফুল।

একটু চুপ করে লর্ড হেনরি তাঁর পকেট-ঘড়িটা টেনে নিলেন পকেট থেকে, বললেন, আমাকে এবার যেতে হবে, বেসিল। কিন্তু যাওয়ার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর আমি জানতে চাই। প্রশ্নটা একটু আগেই আমি তোমাকে করেছি।

মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে চিত্রকর জিজ্ঞাসা করলেন, প্রশ্নটা কী বল তো?

তুমি নিজেই তা ভালো জানো।

আমি জানি না, হ্যারি।

বেশ, আমি তোমাকে তা বলছি। আমি জানতে চাই ডোরিয়েন গ্রে-র প্রতিকৃতি প্রদর্শনীতে পাঠাবে না কেন? আসল কারণটা আমি জানতে চাই।

আমি তোমাকে আসল কারণটাই বলেছি।

না, তুমি তা বলনি। তুমি কেবল বলেছিলে। ওই ছবির ভেতরে তোমার নিজস্ব সত্তার অনেকটা প্রতিবিম্বিত হয়েছে। কিন্তু এটা তোমার ছেলেমানুষের কথা।

বন্ধুর মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বেসিল হলওয়ার্ড বললেন, হ্যারি, গভীর দরদ আর আর অনুপ্রেরণার সঙ্গে যে ছবি আঁকা হয় সেটা হচ্ছে চিত্রকরের নিজস্ব প্রতিকৃতি, মডেলের নয়। সেই বিশেষ হেষ্কত্রে মডেলটা হচ্ছে আকস্মিক, চিত্রাঙ্কনের প্রযোডনে গৌণ। চিত্রকর কোনোদিনই মডেলের সত্তাকে প্রতিফলিত করেন না, সেই রঙিন চিত্রপটের ওপরে তিনি প্রতিবিম্বিত করে নিজেকেই। এই ছবিটিকে প্রদর্শনীতে না পাঠানোর কারণটা হল আমার আশঙ্কা। ভয় হচ্ছে এই ছবির সঙ্গে আমার আত্মার অনেক গোপন বেদনা আর আনন্দ মিশে গিয়েছে।

হাসলেন লর্ড হেনরি, জিজ্ঞাসা করলেন, সেটা কী?

আমি তোমাকে বলব, উত্তর দিলেন চিত্রকর। কিন্তু তাঁর মুখ দেখে মনে হল সব যেন তিনি গুলিয়ে ফেলছেন।

তাঁর দিকে তাকিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আমি শোনার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে আছি, বেসিল।

চিত্রকর বললেন, বলার সত্যিই বেশি কিছু নেই। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে তুমি হয়তো আমার কথা বুঝতে পারবে না। হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করতেও পারবে না তুমি।

লর্ড হেনরি হাসলেন, ঝুঁকে ঘাসের বন থেকে এখটা লাল ডেইজি ফুল তুলে সেটাকে পরীক্ষা। করতে লাগলেন। সেই ফুলটার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, না, না, আমি নিশ্চয় বুঝতে পারব। আর বিশ্বাস করার কথা যদি বল আমি যে-কোনো জিনিসই বিশ্বাস করতে লাগল, এবং সেই ক্লান্ত বাতাসে লাইল্যাক ফুলের ভারী ভারী গুচ্ছগুলি এদিকে-ওদিকে দুলতে লাগল। দেওয়ালের পাশে একটা ঘাস ফড়িং ভনভন করতে শুরু করল, আর নীল,সুতোর মতো লম্বা রোগাটে একটা ফড়িং তার রঙিন ডানা মেলে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল। লর্ড হেনরির মনে হল তাঁর বন্ধুর বুকটা ঘন ঘন ওঠানামা করছে। বন্ধুটি এর পরে কি বলবেন তাই তিনি ভাবতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ পরে চিত্রকর বললেন, ঘটনাটা হচ্ছে এই মাস দুই আগে আমি একদিন লেডি ব্র্যানডনের পার্টিতে গিয়েছিলাম। তুমি জান আমাদের মতো দরিদ্র আর্টিস্টের মাঝে মাঝে বাইরে লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয় শুধু তাদের বোঝানোর জন্যে, যে আমরা। বন্যপ্রাণী নই। তোমার কথাই ঠিক।সান্ধ্য পোশাক আর সাদা গলাবন্ধনী চড়িযে যে-কোনো মানুষই এমনকি একঙন পাতি ব্যবসাদারও সভ্য আর সংস্কৃতিবান বলে পরিচিত হওয়ার সাহস রাখে। সেদিন মিনিট দশেক আমি সুবেশা বিধবা আর বিরক্তিকর পণ্ডিতদের বিরাট সমাবেশে মিনিট দশেক গল্পগুজব করেছি এমন সময় হঠাৎ আমার মনে হল এক৬ল আমার। দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আধখানা ঘুরে দাঁড়ালাম, সেই প্রথম ডোরিয়েন গ্রে-র সঙ্গে চোখাচোখি হল আমার চোখাচোখি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আমি যেন বিবর্ণ হয়ে গিয়েছি। একটা অদ্ভুত ভীতি আমাকে গ্রাস করে বসল। বেশ বুঝতে পারলাম আমি এমন একজনের সংসপর্শে এসে পড়েছি যার ব্যক্তিত্বের মোহিনীশক্তি এত প্রবল যে তাকে যদি সময়ে আমি প্রতিরোধ করতে না পারি তাহলে সে আমার চরিত্র, আত্মা, আমার আর্ট সব গ্রাস করে ফেলবো বাইরে থেকে কেউ আমার ব্যক্তিগত জীবনের ওপরে প্রভাব বিস্তার করবে এ আমি চাইনে। তুমি নিজেই ডান হ্যারি, চরিত্রের দিক থেকে আমি কতখানি স্বাবলম্বী। চিরদিনই আমি সেই রকমই ছিলাম; অন্তত ডোরিয়েন গ্রে-র সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত। তারপর–কিন্তু কী করে যে ব্যাপারটা তোমাকে বোঝাব বুঝতে পারছি না। কে যেন বলে দিল ভীবনে আমি একটি বিষম বিপদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। কী জানি কেন আমার মনে হয়েছিল সে ভাগ্য আমার জন্যে অনির্বচনীয় আনন্দ আর অবর্ণনীয় দুঃখ জমিয়ে রেখেছে। ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। বিবেক যে আমাকে এই কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা নয়, আমার সেই মানসিক অবস্থাকে তুমি বরং কাপুরুষতা। বলতে পার। সেদিন সেখান থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টার মধ্যে কোনো রকম যুৎসই কারণ আমি খুঁজে পাইনি।

বিবেক এবং কাপুরুষতা, সত্যিকথা বলতে কি, একই বস্তু, বেসিলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাযিক নাম হচ্ছে বিবেক, এই যা।

হ্যারি, ওকথা আমি বিশ্বাস করি না। জানি, তুমিও তা কর না। আমার উদ্দেশ্য যাই হোক, হয়তো সেটা আমার গর্বই হবে, এবং চরিত্রের দিক থেকে গর্বিত কিছুটা আমি ছিলাম আমি। যে দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই লেডি ব্র্যানডন-এর সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, মিঃ ইলওযার্ড, এত তাড়াতাড়ি আপনি নিশ্চয় পালিয়ে যাচ্ছেন না? তাঁর গলার সেই অদ্ভুত স্বরটা নিশ্চয় তোমার মনে রয়েছে।

লর্ড হেনরি বললেন, রয়েছে। সৌন্দর্য বাদ দিয়ে ভদ্রমহিলা একেবারে ময়ূরকণ্ঠী।

এই বলে দুর্বল আঙুলগুলি দিয়ে তিনি একটি ডেইডি ফুল ছিঁড়তে লাগলেন।

বেসিল বলে গেলেন, আমি তাঁকে এড়াতে পারলাম না। তিনি অনেকের সঙ্গেই আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজবাডির অতিথি, খেতাবধারী পুরুষ, বড়ো বড়ো। টায়রা পরা সুঁচোল নাকধারিণী মহিলা। সকলের কাছেই তিনি আমার পরিচয় দিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু হিসাবে। এর আগে মাত্র একবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, কিন্তু আমি যে। একজন মহান ব্যক্তি এই রকম একটা ধারণা তাঁর মগডে ঢুকেছিল। আমার বিশ্বাস আমার কোনো একটা ছবি সেই সময় বেশ নাম করেছিল। অন্তত ঊনবিংশ শতাব্দীর নীতিহীন ধ্বজাবাহী সস্তা দামের কিছু সংবাদপত্র সেই ছবিটি নিয়ে বেশ হইচই করেছিল। যে যুবকটির ব্যক্তিত্ব আমাকে ওই রকম অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়েছিল হঠাৎ দেখলাম সেই যুবকটির সামনাসামনি এসে হাজির হয়েছিআমি খুব কাছাকাছি এসেছি আমরা, যাকে বলে স্পর্শ দূরত্বের মধ্যে। আবার আমাদের চোখাচোখি হল। হঠকারিতা সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে আমি সেদিন লেডি ব্র্যানডনকে অনুরোধ করেছিলাম। হয়তো একেবারে হঠকারিতাও নয়। আলাপ হওয়াটা ছিল অবশ্যম্ভাবী। কোনোরকম পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মানুষ না থাকলেও, হয়তো আমরা নিজেরাই আলাপ করতাম। সেবিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। পরে, ডোরিয়েন-ও আমাকে সেই কথাই বলেছিলেন। তাঁর মলে। হয়েছিলে ভাগ্যই আমাদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিত।

তাঁর বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, এবং লেডি ব্র্যানডন তাঁর সেই অদ্ভুত বন্ধুটির কী পরিচয় দিলেন? আমি জানি অতিথিদের বর্ণনা করার সময় তিনি বেশ দ্রুত এবং সংক্ষিপ্তভাবে তাঁদের গুণের বর্ণনা দেন। বেশ মনে পড়ে ভদ্রমহিলা একবার একটি বর্বর, সমস্ত শরীরে সরকার-দেওয়া খেতাব-আঁটা এক বৃদ্ধের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে আমার কানে ফিসফিস করে তাঁর অজস্র গুণের বর্ণনা দিয়ে গেলন। তাঁর সেই ফিসফিসানি কেবল যে ঘরের প্রতিটি লোকের কানে। গিয়ে পোঁচেছিল তা-ই নয়, ভদ্রলোকের গুণাবলীর বর্ণনা তাঁর মুখ থেকে শুনে আমিও কেমন যেন হতচকিত হয়ে পড়েছিলাম। এর পরেই আমি স্রেফ কেটে পড়লাম। আমার সমগোত্র, অথবা আমার পছন্দমতো মানুষ খুঁজে বার করতেই আমি চাই, কিন্তু ভদ্রমহিলার ব্যাপার স্বতন্ত্র। নিলামকারীরা যেভাবে তাদের জিনিসপত্রের দাম ধার্য করে, আমাদের ওই ভদ্রমহিলাটির কাছেও তাঁর অতিথিদের মূল্য নির্ধারণের প্রণালীটি ঠিক সেই অতীয়া হয় তিনি তাঁদের সরিয়ে রাখেন, অথবা তাঁদের সম্বন্ধে এমন কিছু নেই যা তিনি অপরকে বলেন না-বাদ দেন কেবল সেইটুকু যেটুকু আর সবাই ভয়ানতে চায়।

হলওয়ার্ড একটু অন্যমনস্ক ভাবেই বললেন, ভদ্রমহিলার ওপরে অতটা কটোর হয়ো না হারি। হায়, হতভাগ্য নারী লেডি ব্র্যানডন!

অতিথিদের জন্যে তিনি একটি আপ্যায়ন ক তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যা করতে পেরেছিলেন তা হচ্ছে একটি রেস্তোরাঁ। তাঁকে আমি প্রশংসা করব কেমন করে? কিন্তু সেসব কথা থাক, ডোরিয়েন গ্রে-র সম্বন্ধে তিনি তোমাকে কী বললেন সেইটাই আমাকে বলা

তেমন কিছু নয়। ‘চমৎকার ছেলে, ওর মা আর আমি-যাকে বলে একেবারে হরিহর আত্মা। ও যে ঠিক কী করে তা আমার স্মরণ হচ্ছে না; সম্ভবত কিছুই করে না। হ্যাঁ, হ্যাঁ, করে বটে, পিয়ানো বাজায! প্যিানো, না, বেহালা মিগ্রে?’এই কথা শুনে আমরা দুজনেই হেসে। ফেললাম, কিন্তু আমাদের মধ্যে সঙ্কোচ কেটে গেল, আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।

আর একটি ডেইজি ফুল তুলে নিয়ে লর্ড হেলরি বললেন, বন্ধুত্বের শুরুতে হাসি-ঠাট্টা সূচনা হিসাবে খারাপ নয় আর বন্ধুত্বের সমাপ্তিতেও ওর চেয়ে ভালো জিনিস আর বোধ হয় নেই।

হলওয়ার্ড মাথা নেড়ে বললেন, বন্ধুত্ব আসলে জিনিসটা কী তা তুমি বোঝ না, হ্যারি, অথবা শত্রুতা বলতে ঠিক কী বোঝায় তা-ও হয়তো তোমার অজানা। সবাইকেই তুমি পছন্দ কর, অর্থাৎ সকলের ওপরেই তুমি সমান ভাবে উদাসীন।

টুপিটা মাথার পেছনে একটু ঠেলে দিয়ে, নীলকান্তমণি খচিত শূন্য গ্রীষ্মকাশের বুকে সাদা দুধের ফেলার মতো যে ছোটো ছোটো মেঘের টুকরো ভেসে বেড়াচ্ছিল সেই দিকে তাকিয়ে। লর্ড হেনরি বললেন, কী অন্যায় তোমার! নিশ্চয়, একশোবার অন্যায়। মানুষ আর মানুষের মধ্যে তফাৎ রয়েছে আমার কাছে। আমি সেই সব মানুষকে পছন্দ করি যারা দেখতে ভালো, যারা সৎ তাদের সঙ্গেই পরিচয় জমাই, আর যাদের ধীশক্তি তীক্ষ্ণ তাদেরই আমি শত্রু বলে গণ্য করি। শত্রু নির্বাচনে মানুষ খুব বেশি সতর্ক হতে পারে না। আমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ মূর্খ নেই। সকলেরই কিছু না কিছু বুদ্ধি রয়েছে, ফলে, সকলেই প্রায় আমাকে পছন্দ করে। এ থেকে কি আমার কোনো দম্ভ প্রকাশ পায়, মনে হয় আমি এদিক থেকে কিছুটা দাম্ভিক।

আমারও তাই মনে হত, কিন্তু তোমার তালিকা অনুযায়ী, আমি তোমার নিছক পরিচিত ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রিয় বেসিল, তুমি তার চেয়ে অনেক বড়ো।

আর বন্ধুর নীচে, মনে হয় ভায়ের মতো, তাই না?

ওঃ, ভাই, ভাই! ভাইদের নিয়ে দুর্ভাবনা করার মতো কিছু নেই। আমার দাদা মারা যাবেন না, আর আমার ছোটো ভাইদেরও সেরকম কিছু করার সম্ভাবনা নেই।

হলওয়ার্ড বিরক্ত হয়ে বললেন, হ্যারি!

বন্ধু, আমি মোটেই সিরিয়াস হয়ে ওকথা বলিনি। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনদের আমি ঘৃণা না করে পারি না। মনে হয় আমাদের এই মানসিক অবস্থার জন্যে দায়ী একটা;সেটা হচ্ছে, আমাদের মতো যাদের দোষ রয়েছে তাদের আমরা সহ্য করতে পারি না। ইংলিশ গণতন্ত্র উচ্চ শ্রেণির মানুষের বিকৃত রুচি বলতে যা বোঝাতে চায় তার সঙ্গে আমার পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে। জনসাধারণ মনে করে মদ্যপাযিতা, মুখতা আর চরিত্রহীনতা তাদের বিশেষ সম্পদ, এবং আমাদের মধ্যে কেউ যদি তাদের সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে নাক গলাতে যায় তাহলে সে একটি গর্দভ বলে বিবেচিত হবে। যখন হতভাগ্য সাউথওযার্ক বিবাহিবিচ্ছেদ মামলায় জড়িয়ে পড়ল তখন তাদের ঘৃণা সত্যিই দেখার মতো হয়েছিল। তবু আমার মনে হয়। শতকরা দশজন সাধারণ মানুষও নির্ভুল ভাবে জীবন কাটায় না।

তুমি যা বললে তার একটি কথাও আমি বিশ্বাস করি না, তার চেয়েও বড়ো কথা হ্যারি, আমার বিশ্বাস, তুমি নিজেও তা কর না।

লর্ড হেনরি তাঁর সূঁচলো কটা দাড়ির ওপরে হাত বুলোতে বুলোতে পেটেন্ট চামড়ার তৈরি বুট জুতোর ওপরে তাঁর আবলুস কাঠের লাঠিটা ঠুকতে লাগলেন। তারপরে বললেন, বেসিস, তুমি একটি পাকা ইংরেজ। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তুমি ওই উক্তিটি করলো যদি কেউ কোনো। ইংরেজের কাছে নতুন কিছু বলে–যা বলাটা নিঃসন্দেহে হঠকারিতা, তাহলে সেটা ঠিক কি বেঠিক সে-সম্বন্ধে চিন্তা করার কথা সে স্বপ্নেও ভাবে না। একটি মাত্র জিনিস যা সে সত্যিই বিবেচনার যোগ্য বলে মনে করে তা হচ্ছে এই যে বক্তা নিজেই সেকথা বিশ্বাস করে কিনা। এখন কথাটা হচ্ছে নতুন কথা বলার দাম এই নয় যে বক্তা নিজে সে কথা বিশ্বাস করেন। বরং একথা বললে ঐযৌক্তিক হবে না যে যার মুখের আর মনের কথার মধ্যে ফারাক যত বেশি তার মতবাদ তত উচ্চমানের। কারণ সেই মতবাদের সঙ্গে কোনো দিক দিয়েই তারা। প্রত্যঙ্ক্ষভাবে জড়িত নয়। যাই হোক, আমি তোমার সঙ্গে রাজনীতি, সমাজনীতি অথবা আধ্যাত্মিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। নীতির চেয়ে মানুষকে বেশি পছন্দ করি আমি, এবং এ জগতে নীতিহীন মানুষকে আমি যত পছন্দ করি, এত পছন্দ আর কিছুই আমি করি না। মিঃ ডোরিয়েন গ্রে-র সম্বন্ধে আরো কিছু তুমি আমাকে বল তোমার সঙ্গে তার কেমন দেখাসাক্ষাৎ হয়?

প্রতিদিন, রোজ তাঁর সঙ্গে দেখা না হলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি আমার কাছে একেবারে অত্যাবশ্যকীয়।

অবাক কাণ্ড! আমার ধারণা ছিল আর্ট ছাড়া আর কিছুই গ্রাহ্য কর না তুমি।

চিত্রকর গম্ভীরভাবেই বললেন, তিনিই এখন আমার আর্টের বিষয়। হ্যারি, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যে পৃথিবীর ইতিহাসে মূল্যবান বলতে মাত্র দুটি যুগ রয়েছে। প্রথমটি হল আর্টের নতুন বিষয়বস্তুর আবির্ভাব, দ্বিতীয়টি হল সেই আর্টের জন্যে নতুন ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব। ভেনিসিয্যানদের কাছে তৈলচিত্রের আবিষ্কারের দাম যা, পরবর্তী যুগের গ্রিক ভাষ্কর্যের কাছে অ্যানটিনোস-এর মূল্য যেরকম, ডোরিয়েন গ্রে-র মুখও একদিন আমার। কাচ্ছে সেই রকম মূল্যবান হয়ে দেখা দেবে। সে আমার কাছে নিছক মডেল নয। প্রতিকৃতি আঁকার জন্যে তার কাছ থেকে যতটুকু নেওয়ার দরকার তার প্রায় সবটুকুই আমি নিয়েছি। কিন্তু নিছক মডেল-এর চেয়ে সে আমার কাছে অনেক বড়ো। আমি তোমাকে একথা নিশ্চয় বলব না যে তার কাছ থেকে আমি যেটুকু পেযেছি তাতে আমি খুশি নই, একথা নিশ্চয় বলব না যে তার কাছ থেকে আমি যেটুকু পেয়েছি তাতে আমি খুশি নই, অথবা তার সৌন্দর্য এমন একটা জিনিস যে আর্ট তা প্রকাশ করতে পারে না, আর এটাও আমি জানি যে ডোরিয়েন গ্রে-র সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমি যে ছবি এঁকেছি তা সত্যিই ভালো, অথবা আমার জীবনের ওটি হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ছবি। কিন্তু কেন জানি না, বললে তুমি ও হয়তো তা বিশ্বাস করবে না, তার। ব্যক্তিত্ব চিত্রকলার সম্বন্ধে একটি নতুন রীতি, একটি সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকের সন্ধান দিয়েছে। এখন আমি প্রতিটি জিনিস অন্যভাবে দেখি, প্রতিটি জিনিসের সম্বন্ধে অন্যভাবে চিন্তা করি। এখন আমি কোনো জিনিসকে নতুনভাবে সৃষ্টি করি। এ-শক্তি এতদিন আমার ছিল না। ‘চিন্তার দিনগুলিতে কল্পনার আভাস’ একথা কে বলেছেন বল তো! আমার ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু আমার কাছে ডোবিয়েন গ্রে ঠিক সেই ভাবেই প্রতিভাত হয়েছে। বয়স তার কুডির খুব বেশি নয়। আমি তাকে বালক ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। তুমি ভাবছ সে আমার। জীবনের কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে? নিজের অজ্ঞাতসারেই চিত্রকলার একটি নবদিগন্তের সন্ধান সে আমাকে দিয়েছে। এটা হল গ্রিক মানসিকতার সূর্ণ বিকাশ। আপ্পার সঙ্গে দেহের এই সমঝোতা–এর দাম কত! উন্মাদের মতো আমরা এই দুটিকে পৃথক করে রেখেছি। পৃথক করে, এমন একটি বস্তুবাদের সৃষ্টি করেছি যা সত্যিই বড়ো নিকৃষ্ট, যার আদর্শ মূল্যহীন। ডোরিয়েন সে আমার কাছে যে কত বড়ো সম্পদ তা যদি তুমি জানতে, হ্যারি! অগনিউ আমার যে ছবিটি কেনার জন্যে অনেক টাকা দিতে চেয়েছিল সেটা তুমি দেখেছ। সেই। ছবিটিকে আমি বিক্রি করতে চাইনি। কয়েকটি ভালো ছবির মধ্যে এটি আমার শ্রেষ্ঠ ছবি। কিন্তু কেন বল তো? কারণ, ওই ছবিটি আঁকার সময় ডোরিয়েন গ্রে আমার পাশে বসেছিল। সেই সময়ে নিঃশব্দে তার প্রভাব আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, এবং জীবনে সেই প্রথম সহজ অরণ্যের মধ্যে আমি এমন একটি সৌন্দর্যের, ব্যঞ্জনার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছিলাম। এতদিন ধরে আমি তারই সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, কিন্তু তাকে খুঁজে পাইনি।

বেসিল, তোমার কথা শুনে তাজ্জব লাগছে আমার। ডোরিয়েন গ্রে-কে দেখতেই হবে আমাকে।

হলওয়ার্ড তাঁর জায়গা ছেড়ে উঠে বাগানের ভেতরে পায়চারি করতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি ফিরে এসে বললেন, হ্যারি, ডোরিয়েল গ্রে আমার কাছে আর্টের প্রেরণা মাত্রা তার মধ্যে তুমি দেখার মতো কিছুই খুঁজে পাবে না। আমি তার মধ্যে সব কিছু দেখতে পাই। তার ভাবমূর্তি ছাড়া আর কিছুই আমার চোখে ধরা পড়ে না। তোমাকে যা বলেছি, সে একটি নতুন রীতির ইঙ্গিত ছাড়া আর কিছুই নয়। কয়েকটি রেখার ভঙ্গিমা আর কয়েকটি বিশেষ রঙের চারুত্ব ছাড়া অন্য কোনোভাবেই তাকে আমি দেখতে পাই না। তার সম্বন্ধে এ ছাড়া অন্য কোনো কথা নেই।

লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে, তুমি তাঁর ছবিটা প্রদর্শনীতে পাঠাচ্ছ না কেন?

কারণ, ইচ্ছে না করেই আমি এই সব অদ্ভুত চিত্রকল্পর সুচারু ইঙ্গিত ও ব্যঞ্জনাগুলি ওই প্রতিকৃতির মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছি। এ সম্বন্ধে আমি অবশ্য তাকে বলিনি। সে নিজেও এ বিষয়ে কিছু জানে না। কিছু জানবেও না কখনো। কিন্তু দর্শকরা হয়তো কিছুটা অনুমান করতে পারে এবং সেই সব সাধারণ অনুসন্ধিৎসুদের কাছে আমি নিশ্চয় আমার মনের কথাগুলি খুলে বুলব না। সত্যি কথা বলতে কি হ্যারি, ওই প্রতিকৃতির মধ্যে আমার নিজস্ব অনেকটা মিশে। গিয়েছে।

কবিরাও তোমার মতো দ্বিধাগ্রস্ত নয়। তাঁরাও জানেন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পেছনে তাঁদের তাগিদ কত বেশি। আজকাল হৃদয-যন্ত্রণার কাব্যের বাজার অনেক বড়ো।

একট অস্থির হয়েই হলওয়ার্ড বললেন, ঠিক এরই জন্যে আমি তাঁদের ঘণা করি। আর্টিস্টের। কাজই হচ্ছে সুন্দর জিনিস সৃষ্টি করা, কিন্তু সেইগুলির সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে ফেলাটা উচিত নয়। আমরা এমন একটি যুগে বাস করি যে যুগে মানুষে ললিতকলাকে আত্মজীবনী বলে মনে। করে। সৌন্দর্যের কায়াহীন সত্তাটিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এই সত্তাটি কী একদিন ভাতকে তা আমি দেখাব। আর সেই জন্যেই ডোরিয়েন গ্রে-র যে প্রতিকৃতিটি আমি এঁকেছি তা বাইরের মানুষ দেখতে পাবে না।

বেসিল, আমার মনে হয় তুমি ভুল করছ, কিন্তু তা নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। যাদের মগজে কিছু নেই তারাই তর্ক করে। সত্যি বল দেখি, ডোরিয়েন কি তোমাকে খুব ভালোবাসে?

কয়েকটি মুহূর্ত চিত্রকর কী যেন ভাবলেন, তারপরে বললেন, আমি জানি জানি সে আমাকে পছন্দ করে। অবশ্য আমিও তার ভয়ঙ্কর রকমের প্রশংসা করি। তাকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে আমার বেশ একটা আনন্দ হয়। আমি জানি, সে-সব কথা বলার জন্যে আমাকে দুঃখ করতে হবে। তাকে আমার বেশ ভালোই লাগে। আমার স্টুডিওতে বসে হাজার রকমের গল্প। করি। মাঝে মাঝে সে বড়ো বোকার মতো কাজ করে, মনে হয় আমাকে যন্ত্রণা দিতে পারলে বেশ আনন্দ হয় তার। হ্যারি, তখন আমার মনে হয় আমি যেন আমার সমস্ত সত্তা তার কাছে সমর্পণ করেছি। মানুষ যেমন তার বোতামের ঘরে ফুল গুঁজে রাখে, তার কাছে আমার আ গ্লাটিও সেই রকম ফুলের মতো। তার দম্ভের অলঙ্করণ, গ্রীষ্মের জলুসের মতো।

ধীরে ধীরে বললেন লর্ড হেনরি, গ্রীষ্মের দিনগুলি দীর্ঘস্থায়ী, বেসিল। মনে হয় তার চেয়ে তুমিই তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়বে। একথা ভাবতেও কষ্ট লাগে, কিন্তু প্রতিভা যে সৌন্দর্যের চেয়ে। বিশি দিন বেঁচে থাকে সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই সেইডল্যেই বেশি জ্ঞান অর্জন করার জন্যে আমরা এত কষ্ট পাই। জীবনযুদ্ধের উত্তেজনায় আমাদের এমন কিছু দরকার যা বেঁচে থাকে। ঘাঁটি আগলে রাখার মূর্খ চেষ্টায় আমরা তাই বস্তুর জঙ্গলে আমাদের মন পূর্ণ করে রাখি। আধুনিক ঘটনাবলীর সঙ্গে যাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় যত বেশি তিনিই এ যুগে তত বড়ো আদর্শ মানুষ। আজকাল কোনো জিনিসের ব্যবহারিক দামটা তার প্রকৃত মূল্যের অনেক ওপরে। ব্যাপরটা যাই হোক, আমার ধারণা, তুমিই ক্লান্ত হবে প্রথম একদিন তুমি হয়তো। তোমার বন্ধুর দিকে তাকাবে, মনে হবে দেখে ছবি আঁকার মতো চেহারা আর তার নেই। হয়তো তার রঙটা আর তোমার ভালো লাগবে না। অথবা রোনো এরটি বিশেষ জিনিস তুমি আর তার মধ্যে খুঁজে পাবে না। মনে মনে তুমি তীব্রভাবে তাকে তিরস্কার করবে, তোমার সত্যি সত্যিই মনে হবে সে তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে। তারপরে তোমার সঙ্গে তার দেখা হলে আগের মতো আনন্দের সঙ্গে তুমি তাকে অভ্যর্থনা জানাবে না, উদাসীন হয়ে যাবে তুমি তোমার এই পরিবর্তনটা দুঃখজনক হয়ে দাঁড়াবে সন্দেহ নেই। আমাকে এতক্ষণ ধরে তুমি যা বললে তা রোমান্স ছাড়া আর কিছু নয়। বলতে পার চিত্রকল্পের উচ্ছ্বাস। আর যে-কোনো রঙিন উচ্ছ্বাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট জিনিস হচ্ছে এই যে সে মানুষকে বড়ো অরসিক করে তোলে।

হ্যারি, ওকথা বলো না। যতদিন আমি বেঁচে থাকব, ডোরিয়েন গ্রে-র ব্যক্তিত্ব আমাকে গ্রাস। করে থাকবে। আমি যা অনুভব করি, তুমি তা কর না। তোমার পরির্বতন হতে সময় লাগে না বিশেষ।

সত্যি কথা বলতে কি বেসিল, ঠিক ওই কারণেই আমি তা বুঝতে পারি। যাদের আমরা বিশ্বাসী বলি প্রেমের একটি দুর্বল অংশ ছাড়া অন্য কিছুর সঙ্গেই তাদের পরিচয় নেই। প্রেমের ট্র্যাজিডি বলতে কী বোঝ তা একমাত্র অবিশ্বাসীরাই জানে।

পৃথিবীর অন্তর্নিহিত সত্যটিকে গুটিকতক কথায় চমৎকারভাবে প্রকাশ করে দিয়েছেন এই রকম একটি আত্মতুষ্টির আবেশে মাতোয়ারা হয়ে লর্ড হেনরি তাঁর সুন্দর সিগারেট কেস থেকে একটি সিগারেট বার করে ধরালেন। সবুজ গাছের পাতার ভেতরে চড়ুই পাখিদের। ডানার ঝাপটার সঙ্গে কিচর-মিচির শোনা গেল, ঘাসের ওপরে নীলচে মেঘের ছায়াগুলি। চড়ুই পাখির মতো ছোটাছুটি করতে লাগল। তাঁর মনে হল বাগানের দৃশ্যাটি বড় মনোরম, মনে হল বড়ো সুন্দর মানুষের উচ্ছ্বাস-মতবাদের চেয়ে মানুষের আবেগ অনেক বেশি সুন্দর। বেসিল হওয়ায়ার্ডের সঙ্গে থাকার ফলে তিনি যে বিরক্তিকর লাঞ্চ থেকে মুক্তি পেয়েছেন এই কথাটা ভাবতে তাঁর বেশ আমোদ লাগল। মাসির বাড়িতে লাঞ্চ খেতে গেলে নিশ্চয় লর্ড গুজবডির সঙ্গে তাঁর দেখা হত এবং তাঁদের আলোচনা চলত দরিদ্র ভোডলি আর আদর্শ আবাস বলতে কী বোঝায় তাই নিয়ে। যাঁদের নিজেদের জীবনে এই দুটি জিনিসের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই সেই দুটি জিনিসের গুণাবলী নিয়ে দু’দলেই আলোচনা করতেন সমান উত্তেজনা নিয়ে। ধনীরা মিতব্যয়িতার মূল্য কী তারই ওপরে বক্তৃতা দিতেন আর শারীরিক পরিশ্রমের সম্মান কতটা তাই যে মনোভঃ ভাষায় কথা বলতেন তাঁরা যাঁরা অলসভাবে। জীবন যাপন করেন। এই সমস্ত অহেতুক বিরক্তির পরিবেশ থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি বেশ খুশি হলেন। তাঁর মাসির কথা ভাবতেই একটা কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। তিনি হলওয়ার্ড-এর। দিকে ঘুরে বললেন, বন্ধু, একটা কথা মনে পড়েছে আমার।

কী মনে পড়েছে?

ডোরিয়েন নামটা আমি যেন কোথায় শুনেছি।

সামান্য ভ্রুকুটি করে বেসিল জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায়?

চটো না বেসিল। মাসি, লেডি আগাথার বাড়িতে। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে একটি অসামান্য যুবককে তিনি আবিষ্কার করেছেন। এই যুবকটি ইস্ট এন্ড-এ তাঁকে সাহায্য করতে। উৎসুক। তাঁর নাম হচ্ছে ডোরিয়েন গ্রে। আমি বলতে বাধ্য, ভদ্রলোক যে দেখতে সুন্দর সে কথা মাসি আমাকে জানাননি। মিষ্টি চাহনির কদর মহিলারা জানেন না অন্তত সৎ মহিলাদের সে জ্ঞান বড়ো কম। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে ভদ্রলোক চপলমতি নন, তাঁর চরিত্রটিও বড়ো চমৎকার। ওই কথা শুনেই আমার মনে হয়েছিল ভদ্রলোকটি চশমাধারী, তাঁর চুলগুলি লম্বা, মুখের ওপরে গুটি-গুটি দাগ, লম্বা-লম্বা পা ফেলে তিনি হাঁটাচলা করেন। সেই মানুষটি যে তোমার বন্ধু তা যদি আমি জানতাম!

তুমি যে জানতে পারনি এতেই আমি খুশি, হ্যারি।

কেন?

তার সঙ্গে তোমার দেখা হোক তা আমি চাই না।

চাও না?

না।

এমন সময় খানসামা বাগনের মধ্যে ঢুকে এসে বলল, মিঃ ডোরিয়েন গ্রে স্টুডিওতে রয়েছেন, স্যার।

লর্ড হেনরি হাসতে হাসতে বেশ জোর গলাতেই বললেন, এখন আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় তোমাকে করিয়ে দিতে হবেই।

থানসামার দিকে ঘুরে চিত্রকর বললেন, পার্কার, মিঃ গ্রেকে একটু বসতে বল। আমি এখনি আসছি।

অভিবাদনের ভঙ্গিতে মাথাটি নুইয়ে পার্কার বেরিয়ে গেল বাগান থেকে।

বেসিল হেনরির দিকে তাকিয়ে বললেন, ডোরিয়েন গ্রে আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু। বড়ো সরল, বড়ো সুন্দর তাঁর চরিত্র। তাঁর সম্বন্ধে তোমার মাসিমা যা বলেছেন সেইটাই সত্যি। তাঁকে তুমি নষ্ট করে দিও না। তাঁর ওপরে তোমার প্রভাব বিস্তার করতে চেয়ো না। তোমার প্রভাব তাঁর কাছে খুব খারাপই হবে। বিশাল এই পৃথিবী, এখানে অনেক আশ্চর্য জিনিস তুমি খুঁজে পাবে। আমার কলা-লালিত্যের যিনি প্রতীক তাঁকে তুমি আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেও না। আর্টিস্ট হিসাবে আমার জীবন তাঁরই উপরে নির্ভর করছে হারি, মনে রেখো, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।

কথাগুলি বেশ ধীরে ধীরে বললেন তিনি, মনে হল, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কথাগুলি তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল।

লর্ড হেনরি হাসতে হাসতে বললেন, কী বোকার মতো বকছো?

এই বলে হলওয়ার্ড-এর একটা হাত ধরে একরকম টানতে টানতেই ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

ঘরের মধ্যে ঢুকেই ডোরিয়েন গ্রেকে দেখতে পেলেন তাঁরা। তাঁদের দিকে পেছন করে পিয়ানোর পাশে একটি টুলের ওপরে বসে-বসে স্কুম্যান রচিত বন্য দৃশ্যের’ একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। পায়ের শব্দ পেয়েই তিনি বললেন, এগুলি আমাকে ধার দিও, বেসিল, আমি পড়তে চাই। বইগুলি বড়ো সুন্দর।

তুমি আজ কী ভাবে বসবে তারই ওপরে তোমার বই-পাওয়া নির্ভর করছে ডোরিয়েন।

টুল থেকে পেছনে ঘুরে খেলার ছলে গ্রে বললেন, একভাবে বসে-বসে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি পূর্ণ প্রতিকৃতির ওপরে আমার আর কোনো লোভ নেই।

লর্ড হেনরিকে দেখে তাঁর গাল দুটি হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। তারপর নিজেকে সামলিযে নিয়ে তিনি বললেন, বেসিল, আমাকে ক্ষমা কর। আমি বুঝতে পারিনি যে তোমার সঙ্গে অন্য একজন আছেন।

ডোরিয়েন, ইনি হচ্ছেন লর্ড হেনরি ওটোন, অক্সফোর্ডের পুরনো সহপাঠী আমার। মডেল। হিসাবে তুমি যে কত ভালো সেই কথাই এতক্ষণ ওঁকে বলছিলাম। কিন্তু তুমি সব নষ্ট করে দিলে।

লর্ড হেনরি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানানোর ভঙ্গিতে একটি হাত প্রসারিত করে বললেন, মিঃ গ্রে, আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার ফলে আমার যে আনন্দ হয়েছে সে-আনন্দ আপনি নষ্ট করেননি। আপনার কথা মাসিমার কাছে আমি শুনেছি। আপনি তাঁর একজন প্রিয় বন্ধু এবং আমার মনে হয় আপনি তাঁর একটি শিকার-ও।

অনুশোচনার হাসি হেসে মিঃ গ্রে বললেন, লেডি আগাথার কালো খাতায় আমার নাম লেখা হয়ে গিয়েছে। গত মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে আমি হোয়াইট চ্যাপেলের একটি ক্লাবে যাব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। সেকথা আমি একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের দ্বৈত সঙ্গীত গাওয়ার কথা ছিল, তিনটি সঙ্গীত, তিনি কী বলবেন জানি না। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ভয় লাগছে।

মা ভৈঃ। মাসিমার সঙ্গে আপোস করিয়ে দেব আপনার। তিনি আপনাকে বেশ ভালোবাসেন। তাছাড়া সেদিন যে আপনি যাননি তার জন্যে তিনি কিছু মনে করেছেন বলে আমার মনে হয় না। দর্শকরা ওটাকে দ্বৈত সঙ্গীত বলেই হয়তো ভেবে নিয়েছিল। মাসিমা আগাথা যখন পিয়ানোর ধারে বসে গান ধরেন তখন তাঁর গলা থেকে যে স্বর রেরোষ তা দুজনের সমান।

ডোরিয়েন হেসে বললেন, লেডি আগাথার সম্বন্ধে এই মন্তব্য যে ভয়াবহ তা-ই নয়, আমার সম্বন্ধেও বেশ সু-উক্তি নয়।

লর্ড হেনরি তাঁর দিকে তাকালেন। হ্যাঁ, সত্যিই অপরূপ সুন্দরী তিনি। চারুকার্ষের মতো সুন্দর লাল দুটি ঠোঁট, দুটি নীল পরিচ্ছন্ন চোখ, কোঁকড়ানো সোনালি চুল। তাঁর মুখের দিকে তাকালে তাঁকে বিশ্বাস না করে আপনি পারবেন না। যৌবনের সমস্ত উচ্ছলতা তাঁর সর্বাঙ্গে, সেই সঙ্গে রয়েছে যৌবনের শুচিতা। দেখলে মনে হবে, পৃথিবীর সমস্ত কালিমা থেকে তিনি মুক্ত। বেসিল হলওয়ার্ড যে তাঁকে পুজো করবেন তাতে আর আশ্চর্য কী?

সৎকাজের পক্ষে আপনি অত্যন্ত সুন্দর, মিঃ গ্রে, অত্যন্ত সুন্দর।

এই বলে, লর্ড হেনরি সোফার ওপরে বসে পড়ে সিগারেট কেস থেকে একটা সিগারেট বার করলেন।

চিত্রকর এর মধ্যে তাঁর রঙ আর তুলি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। এতক্ষণ তিনি বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন। লর্ড হেনরির শেষ কথা শুনে তিনি একবার তাঁর দিকে ফিরে তাকালেন, একটু দ্বিধা করলেন, তারপরে বললেন, হ্যারি, এই ছবিটা আজই আমি শেষ করতে চাই। তোমাকে যদি আজ আমি চলে যেতে বলি তাহলে কি আমার পক্ষে বেশি অশালীনতা প্রকাশ করা হবে?

লর্ড হেনরি হাসলেন এবং ডোরিয়েন গ্রে-র দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ গ্রে, আমাকে কি চলে যেতে হবে।

না, না, লর্ড হেনরি। আপনি দয়া করে যাবেন না। মনে হচ্ছে, বেন্সিলের মেজাজটা খুব খারাপ আর ও যখন রেগে যায় তখন আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া আমি জানতে চাই সৎকাড করা আমার দ্বারা কেন সম্ভব নয়।

আপনাকে বলব কি না সে কথা জানি না, মিঃ গ্রে। জিনিসটা এতই বিরক্তিকর যে ব্যাপারটা নিয়ে মনোযাগ দিয়ে আলোচনা করা উচিত। কিন্তু বর্তমানে আমি পালিয়ে যাচ্ছি না, বিশেষ করে আপনি যখন থাকতে বললেন। বেসিল, আমি থাকলে নিশ্চয় তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। হবে কি? তুমি আমাকে প্রায়ই বল যে ছবি আঁকার সময় তৃতীয় কেউ তোমার মডেলের সঙ্গে বসে গল্প করলে তোমার কাজের সুবিধা হয়।

হলওয়ার্ড ঠোঁট কামড়ালেন, বললেন, অবশ্য ডোরিয়েনের ইচ্ছে নিশ্চয় তুমি থাকবে। ডোরিয়েনের খেয়াল তার নিজের কাছে ছাড়া অন্য সকলের কাছেই আইন।

লর্ড হেনরি তাঁর টুপি আর দস্তানা তুলে নিয়ে বললেন, তোমার অনুরোধ অগ্রাহ্য করা কষ্টকর, বেসিল, কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। অরলিনস-এ একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা দিয়েছি আমি। মিঃ গ্রে, বিদায়। একদিন বিকেলে কাউন স্ট্রিটে আমার কাছে আসুন। পাঁচটার কাছাকাছি প্রতিদিনই আমি প্রায় বাড়িতে থাকি। কবে আসছেন আমাকে লিখে জানাবেন। আপনার সঙ্গে দেখা না হলে দুঃখ পাব।

ডোরিয়েন গ্রে বেশ জোর গলাতেই বললেন, বেসিল, লর্ড হেনরি যদি চলে যান আমিও তাহলে চলে যাব। ছবি আঁকার সময় একবারও তুমি মুখ খোল না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে খুশি হওয়ার ভান করাটা আমার পক্ষে সত্যিই বড়ো কষ্টকর। ওঁকে থাকতে বল। আমি চাই উনি থাকুন।

ছবির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে হলওয়ার্ড বললেন, ডোরিয়েন আর সেই সঙ্গে আমাকে খুশি করার জন্য তুমি থেকে যাও হেনরি। কথাটা সত্যি যে কাজ করার সময় আমি কারো সঙ্গে কথাও বলি না, কারো কথা কানেও তুলি না। আমার মডেলদের কাছে সেটা সত্যিকারের কষ্টকরই হয়ে দাঁড়ায়। আমি অনুরোধ করছি-তুমি থেকে যাও।

কিন্তু অরলিনস-এ যাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার কথা আছে তাঁর কী হবে?

চিত্রকর হাসলেন, বললেন আমি মনে করি না তার জন্যে তোমার কোনো অসুবিধা হবে। হেনরি, তুমি আবার বসে পড। ডোরিয়েন, এখন তুমি প্ল্যাটফর্মের ওপরে ওঠো, বেশি নড়াচড়া করো না, অথবা লর্ড হেনরির কথাতেও কান দিও না বিশেষ। একমাত্র আমি ছাড়া, সমস্ত বন্ধুবান্ধবদের ওপরেই ওর প্রভাবটা বড়ো খারাপ।

ডোরিয়েন গ্রে প্ল্যাটফর্মের ওপরে উঠে এলেন, দেখে মনে হল তিনি একজন গ্রিক যুবক, আদর্শের জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন। লর্ড হেনরিকে তাঁর কেমন যেন ভালো লেগেছিল, তিনি মোটেই বেসিলের মতো নন। দুজনের মধ্যে পার্থক্যটা বড়ো মধুর। তাছাড়া, হেনরির স্বরটি কী মধুর! কিছুক্ষণ পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, লর্ড হেনরি, সত্যিই কি আপনার প্রভাব খারাপ?

সৎ প্রভাব বলে কিছু নেই, মিঃ গ্রে। সব প্রভাবই দুনীর্তির বাহক, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে দুর্নীতিমূলক।

কেন?

কারণ, কারো ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে গেলে নিজের আত্মাকে বিসর্জন দিতে হয়। তার। স্বাভাবিক চিন্তা আর অনুভূতিকে বর্জন করতে হবে। তার নিজের গুণগুলি তার কাছে। বাস্তব নয়। তার পাপ, যদি পাপ বলে কোনো বস্তু থেকে থাকে, অপরের কাছ থেকে ধার করা। সে অন্য লোকের সঙ্গীতের প্রতিধ্বনি; যে-নাটক তার জন্যে লেখা হয়নি সেই নাটকেরই অভিনয়। করার জন্যে তার ডাক পড়ে। জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে নিজেকে বিকাশ করা। নিজের স্বভাবটিকে সম্পূর্ণরূপে বোঝা, অর্থাৎ কেন আমরা পৃথিবীতে এসেছি সেটা বুঝতে পারা। আজকাল মানুষ নিজেদেরই বড়ো ভয় করে। মানুষ ভুলে যায় নিজের ওপরে তার একটা কর্তব্য রয়েছে, আর সেইটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য। অবশ্য তারা উদার প্রকৃতির। ক্ষুধার্তকে তারা অন্ন দেয়, দরিদ্রকে দেয় বস্ত্র। কিন্তু তাদের নিজেদের আত্মা থাকে অভুক্ত, উলঙ্গ। মনুষ্যডাতির কথা যদি। ধরেন, তাহলে বলতে হবে আমাদের মধ্যে শৌর্য বলে কোনো পদার্থ লেই। সম্ভবত, কোনোদিনই আমাদের ও-জিনিসটা ছিল না। আমাদের শাসন করছে দুটি জিনিস, একটি হল সামাজিক ভীতি–ওটি হল নীতির গোড়ার কথা, আর একটি হল ভগবানের ভ্য, এইটি হল ধর্মের মূল কথা। এবং তবু–

গভীর ভাবে কাজের মধ্যে ডুবে ছিলেন চিত্রকর। তাঁর মনে হল গ্রে-র মুখের ওপরে এমন একটি ভাব প্রতিফলিত হয়েছে যা তিনি আগে কখনো দেখেননি, তিনি বললেন, ডোরিয়েন, লহী ছেলের মতো ডান দিকে ঘাড়টা একটু বাঁকাও।

আস্তে আস্তে মিষ্টি গলায় এবং হাতটিকে অর্ধবৃত্তাকারে সুন্দরভাবে ঘুরিয়ে (ইটনে পড়ার সময় এইভাবে তিনি কথা বলতেন) লর্ড হেনরি তাঁর কথার সূত্র ধরে বললেন, কিন্তু তবু আমি বিশ্বাস করি যদি মানুষকে পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে হয়, যদি তাকে প্রতিটি অনুভূতি ভালোভাবে প্রকাশ করতে হয়, যদি তার প্রতিটি চিন্তা আর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে হয় তাহলে দুনিয়াটা আনন্দের এমন একটা সজীব উচ্ছ্বাসে ভেসে যাবে যে আমরা মধ্যযুগের সমস্ত রোগ থেকে মুক্তি পাব, ফিরে আসব ‘হেলেনিক’ আদর্শেতার চেয়েও সুন্দর, পবিত্র একটি আবহাওয়ায় প্রাণ ভরে বিশ্বাস নিতে পারব আমরা। কিন্তু আমাদের ভেতরে সে। সবচেয়ে বেশি সাহসী সে-ও তার নিজেকে বুড়ো ভয় করে।বর্বরতার অত্যাচার মানুষের আত্মত্যাগের মূর্তিতে তার বিষণ্ণ স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই অকারণ আত্মত্যাগই আমাদের জীবনের সুখ-সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়। ত্যাগের জন্যই আমরা শাস্তি পাই। যে সব প্রবৃত্তিকে আমরা গলা টিপে হত্যা করি, সেই সব রুদ্ধ প্রবৃত্তিই আমাদের মনের মধ্যে বংশ বৃদ্ধি করে, বিষাক্ত করে আমাদের দেহ পাপ করে একবারই, দু’বার নয়, আর আমাদের কর্ম পবিত্র করে তাকে। তারপরে একমাত্র আনন্দের কিছু স্মৃতি, অথবা অনুতাপের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। প্রলোভন এড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে প্রলোভনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। বাধা পাও, না পাওয়ার আকঙহষ্কায় তোমার আত্মা রুগ্ন হয়ে যাবে, যে বাসনাকে ভয়কর নীতিগুলো ভয়ঙ্কর বলে চিহ্নিত করেছে, প্রচার করেছে দুর্নীতি বলে, সেই বাসনার উন্মাদনায় তুমি জ্বলে পুড়ে মরবে। মানুষের বলে বিশ্বের বিরাট বিরাট ঘটনার জন্ম মানুষের মস্তিষ্কে। এই মস্তিষ্কের ভেতরই পৃথিবীর সবচেয়ে বিরাট পাপ অঙ্কুরিত হয়। আপনি, মিঃ গ্রে, নিজের কথাই ধরুন, আপনার এই গোলাপি যৌবন আর গোলাপ-সাদা। তারুণ্যের ভেতরে এমন সব আকাঙ্খা অঙ্কুরিত রয়েছে যাদের কথা ভাবতেই আপনার ভয় লাগে, জেগে জেগে অথবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এমন সব স্বপ্ন আপনি দেখেন যাদের স্মৃতিগুলি আপনার মুখে লজ্জার আভা ছড়িয়ে দেয়।

ডোরিয়েন স্খলিত স্বরে বললেন, থামুন, থামুন। আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছেন। কী বলব আমি তা বুঝতে পারছি না, আপনার প্রশ্নের উত্তর একটা কিছু রয়েছে, কিন্তু সেটা কী তা আমি ঠিক পারছি না। আপনি আর কিছু বলবেন না। আমাকে একটু ভাবতে দিন। অথবা এ বিষয়ে কিছু চিন্তা না করাই ভালো।

ঠোঁট দুটি ফাঁক করে প্রায় দশটি মিনিট তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখ দুটি তাঁর অস্বাভাবিক ভাবে জ্বল জ্বল করতে লাগল। তিনি যেন বুঝতে পারলে একেবারে নতুন ধরনের কিছু প্রভাব তাঁর মনের গভীরে অনুপ্রবেশ করেছে। তবু তাঁর মনে হল এগুলি তাঁর নিজেরই। যে কটি কথা বেসিলের বন্ধু তাঁকে বলেছেন, কথাগুলি নিঃসন্দেহ-হঠাৎ করেই বলা, উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়, সেগুলি তাঁর হৃদয়ের গোপন তারে গিয়ে আঘাত করেছে। এরকম। আঘাত আগে কেউ কখনো করেনি। কিন্তু এখন তার মনে হলো একটি নতুন মূদনায় সেই তন্ত্রীগুলি কেঁপে কেঁপে উঠছে।

সঙ্গীত তাঁকে এইভাবেই উদ্বেলিত করেছে। অনেকবার অঙ্গীত তাঁকে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু সে সঙ্গীত মুখর ছিল না, এটা তাঁর কাছে নতুন কিছু ছিল না, এটি হচ্ছে আর একটি অনাবিষ্কৃত বিশৃঙ্খলা। আমাদের মনের মধ্যে ভগবান এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রেখেছেন। কথা, কেবল কথা! কী নিতুর এরা! কত সপষ্ট, পরিচ্ছন্ন এবং নিষ্ঠুর। এদের হাত থেকে মুক্তি নেই কারো। অথচ তাদের মধ্যে কী তীক্ষ্ণ ব্যঞ্জনা রয়েছে। একদিন যা নিরাকার ছিল তাকেই সাকার করে তোলে এরা। বেহালা অথবা বাঁশির সুরের মতো মিষ্টি এর সুর। শুধু কথা! কথার মতো বাস্তব জিনিস আর কোথাও কিছু রয়েছে?

সত্যি কথা, তাঁর বাল্যে এমন সব জিনিস ছিল যার অর্থ তিনি তখন বুঝতে পারতেন না। সেগুলিকে এখন তিনি বুঝতে পারেন। জীবন হঠাৎ তাঁর কাছে অগ্নিবর্ণ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে তিনি যেন আগুনের ওপরে বিচরণ করছেন। একথা তিনি বুঝতে পারেননি কেন?

ইঙ্গিতমিয় হাসি হেসে লর্ড হেনরি তাঁকে লক্ষ করলেন। মনের অবস্থা ঠিক কী রকম থাকলে মানুষকে কিছু বলা উচিত নয় তা তিনি জানতেন। তাঁর কৌতহল বেশ বেড়ে উঠল। তাঁর কথাগুলি যে হঠাৎ এতটা অর্থবহ হয়ে দাঁড়াবে তা বুঝতে পেরে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। ষোল বছর বয়সে তিনি একটি বই পড়েছিলেন। সেই বইটি পড়ে তিনি এমন কতকগুলি। জিনিস জানতে পেরেছিলেন যেগুলি তিনি আগে জানতেন না। ডোরিয়েন গ্রে কি সেই ধরনেরই বিশেষ কোনো অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন? তিনি তো বাতাসে একটি তীর ছুঁড়েছেন মাত্র, সেই তীর কি কোনো লক্ষ্যবস্তু ভেদ করেছে? মানুষকে মুগ্ধ করার শক্তি ছেলেটির কী সত্যিই অপরিসীম?

দুজনেই যে নির্বাক হয়ে রয়েছেন সে দিকে কোনো খেয়াল ছিল না বেসিলের। তিনি আপন মনে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে ছবি এঁকে চলেছেন। সত্যিকারের নিপুণ চিত্রকর ছাড়া এ ধরনের ছবি আঁকা সত্যিই কল্পনার অতীত।

ডোরিয়েন গ্রে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, বেসিল, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমি একটু বাগানে গিয়ে বসি, আমর দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে।

বন্ধু, আমি খুব দুঃখিত। ছবি আঁকার সময় আমি অন্য কিছু ভাবতে পারি না। কিন্তু আজকের মতো ভালোভাবে আর কোনোদিনই তুমি মডেলের কাজ করতে পারনি। একেবারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি আর আমি তোমর কাছ থেকে যা পেতে চেয়েছিলাম তার সবটুকুই পেযেছি–অর্ধউন্মোচিত দুটি ঠোঁট এবং চোখের ওই উজ্জ্বল আভা। হ্যারি তোমাকে এতক্ষণ কী বলছিল তা আমি জানি না, কিন্তু সে নিশ্চয় এমন কিছু বলেছিল যার প্রভাবে পড়ে তোমার মুখের ওপরে এই রকম অপরূপ একটি ব্যঞ্জনা ফুটে বেরিয়েছে। মনে হচ্ছে, তোমাকে সে প্রশংসা করছিল। ও যা বলে তার একটি বর্ণও তুমি বিশ্বাস করো না।

উনি মোটেই আমাকে প্রশংসা করেননি। সম্ভবত সেই জন্যই উনি আমাকে যা বলেছেন তার একটুও আমি বিশ্বাস করতে পারিনি।

ক্লান্ত আর স্বপ্নিল চোখে তাকিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আপনি জানেন আমি যা বলেছি তার সমস্তটাই আপনি বিশ্বাস করেন। আপনার সঙ্গে বাগানে আমিও যাব চলুন। এই স্টুডিওর ঘরটিতে ভীষণ গরম লাগছে। বেসিল আমাদের ঠান্ডা কিছু খেতে দাও, স্ট্রবেরি মেশানো কিছু।

নিশ্চয়, নিশ্চয় হ্যারি। বেলটা বাজাও। পার্কার এলে তোমাদের যা যা দরকার সব এনে দিতে বলছি। আমার কিছু কাজ বাকি রয়েছে। সেটুকু করতে আমি যাচ্ছি ডোরিয়েনকে বেশিক্ষণ আটকে রেখ না। আজকে আমরা যে মুড এসেছে, এরকম মুড অনেকদিন আসেনি। এটা আমার সর্বোত্তম সৃষ্টি হবে, এমনিতেই এটা একটা মাস্টারপিস।

লর্ড হেনরী বাগানে বেরিয়ে গিয়ে দেখলেন লাইল্যাক ফুলের ঝাডের ঠান্ডা ছায়ার ডোরিয়েন গ্রে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রয়েছেন। যেমন করে মানুষ মদ্যপান করে, মনে হল ঠিক সেই রকম ভাবে ফুলের সুগন্ধ তিনি পান করছেন। তিনি তাঁর কাছে এগিয়ে এলেন, একটা হাত তাঁর কাঁধের উপরে রাখলেন, এবং মৃদুস্বরে বললেন, আপনি ঠিকই করছেন। অনুভূতি ছাড়া আম্মাকে সুস্থ করা যায় না, যেমন আত্মাকে বাদ দিয়ে অনুভূতি পঙ্গু হয়ে যায়।

যুবকটি চমকে উঠে পিছিয়ে বসেন। তাঁর মাথা খোলা এবং গাছের পাতাগুলি তাঁর সেই উদ্দাম বিদ্রোহী চুলগুলির ওপরে পড়ে রঙিন জালের সৃষ্টি করেছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরে মানুষের চোখের মধ্যে যেমন একটা ভীতিজনক বিহ্বলতা ডেংগে ওঠে, তাঁর চোখের ভেতর থেকে সেই রকম একটা ভয়ের আমেজ ফুটে বেরোল। তাঁর খোদাই করা সুন্দর নাকটি কাঁপতে লাগল, কোনো একটি গোপন দুর্বল স্নায়ুর কাঁপুনি জেগে উঠল তাঁর রঙিন ঠোঁটের ওপরে। ঠোঁট দুটি সেই আবেগে কাঁপতে লাগল।

লর্ড হেনরী বলে গেলেন, হ্যাঁ, প্রবৃত্তি দিয়ে আত্মাকে নীরোগ করা, আর আত্মা দিয়ে প্রবৃত্তির নিবৃত্তি করা–এটি হল জীবনের একটি প্রধান গোপন কথা। আপনি একটি অনবদ্য সৃষ্টি। যতটুকু জানেন বলে আপনার ধারণা তার চেয়ে অনেক বেশি আপনি জানেন, ঠিক যেমন যতটা আপনি ভানতে চান তার চেয়ে অনেক কম জ্ঞান আপনার রয়েছে।

ভ্রুকুটি করে ডোরিয়েন গ্রে তাঁর মাথাটা ঘুরিয়ে নিলেন। তাঁর সামনে যে দীর্ঘাঙ্গ সুন্দর যুবক দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁকে তাঁর ভালো না লেগে উপায় ছিল না। তাঁর রোমান্টিক অলিভ রঙের। মুখ এবং ক্লিষ্ট কণ্ঠস্বর তাঁকে কৌতূহলী করে তুলেছিল। তার সেই খাদে বাঁধা এবং ক্লান্ত স্বরের মধ্যে এমন একটি জিনিস ছিল সেটা তাঁকে মুগ্ধ না করে পারেনি। এমন কি তাঁর ঠান্ডা, সাদা, ফুলের মতো হাতের মধ্যেও কেমন যেন একটা অদ্ভুত কমনীয়তা ছিল। কথা বলার সময় লর্ড হেনরির হাতগুলি নড়ছিল। মনে হচ্ছিল সেগুলি যেন সঙ্গীতের তালে তালে দুলছে, তাদের যেন নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে। কিন্তু ডোরিয়েনের কেমন যেন ভয় লাগছিল, এবং সেই ভয় পাওয়ার জন্য তিনি যেন লজ্জিত-ও হচ্ছিলেন। নিজের কাছে নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে একজন অপরিচিতের প্রয়োজন হল কেন? বেসিল হলওয়ার্ডকে তিনি অনেক দিনই জানেন, কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব কোনোদিনই তাঁর মনে কোনোরকম পরিবর্তন আনতে পারেনি। হঠাৎ তাঁর সামনে এমন একজনের আবির্ভাব হল যিনি তাঁর কাছে জীবনের রহস্যটি প্রকাশ করে দিলেন। কিন্তু তবু ভয় করার কী রয়েছে? তিনি তো স্কুলের ছাত্র অথবা ছাত্রী নন। ভয়। পাওয়াটা তো একটা হাস্যকর ব্যাপার।

লর্ড হেনরি বললেন, চলুন, ওই ছায়ায় গিয়ে বসি, পার্কার পানীয় নিয়ে এসেছে, এবং এই রোদের ঝাঁডে আপনি যদি আরো কিছুক্ষণ বসে থাকেন তাহলে আপনার দফা রফা হয়ে যাবে, বেসিল আর কখনো আপনার ছবি তুলবে না। রোদে পোড়া আপনার চলবে না। এটা ঠিক উচিত হবে না আপনার।

বাগানের ধারে বসে হাসতে হাসতে ডোরিয়েন বলেলন, তাতে ক্ষতি কী?

তাতে আপনারই সমূহ ক্ষতি, মিঃ গ্রে।

কেন?

কারণ আপনার অনবদ্য যৌবন রয়েছে আর যৌবন এমন একটা জিনিস যাকে পাওয়ার জন্য মানুষ লালায়িত হয়।

লর্ড হেনরি, আমার কিন্তু সে রকম কিছু মনে হয় না।

না, এখন তা আপনারা মনে হবে না। একদিন আপনি যখন বৃদ্ধ হবেন, আপনার দেহের চামড়া যখন কুঁচকে যাবে, আপনি যখন দেখতে কদাকার হয়ে যাবেন, দুশ্চিন্তা আপনার কপালের রেখাগুলিকে যখন কুঞ্চিত করে তুলবে, আর কামনায় আপনার ঠোঁট দুটি মারাত্মকভাবে জ্বলতে থাকবে, তখনি যৌবনের কথা আপনার মনে পড়বে, তখনি আপনি। এর অভাবটা ভীষণভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। এখন যেখানেই আপনি যাবেন সেখানেই সবাইকে আনন্দ দেবেন। এটা কি সব সময়েই সম্ভব হবে? আপনার মুখটা কেবল সুন্দর নয়, অসম্ভব সুন্দর, মিঃ গ্রে, হাসবেন না। কথাটা সত্যি। আর যৌন্দর্য যে প্রতিভার এ অথবা তার চেয়েও বড়ো–সেকথা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা নে আলো, বসন্তকাল, অথবা কালো জলের ওপরে চাঁদের প্রতিফলনের মতো এটাও বিশ্বের একটি বড় সত্য। এ নিয়ে তর্ক করার অবকাশ নেই। এর সার্বভৌমত্ব ঈশ্বর ঠিক করে দিয়েছেন। যাঁদের এই বস্তুটা রয়েছে তাঁরা রাজকুমারের পর্যায়ে পড়েন। হাসছেন? হায়, যখন আপনার যৌবন থাকবে না তখন কিন্তু আপনি আর হাসবেন না। লোকে মাঝে মাঝে বলে সৌন্দর্য নাকি দেহের বাইরের জিনিস। তা হতে পারে। কিন্তু চিন্তা যতটা বাহ্যিক, এ অন্তত ততটা নয়। আমার কাছে সৌন্দর্য হচ্ছে সকল বিস্ময়ের সেরা বিস্ময়। বাইরের চেহারা দেখে যারা মানুষকে বিচার করে না তাদের বৈদগ্ধ্য সম্বন্ধে আমার সন্দেহ রয়েছে। বিশ্বের আসল রহস্য যা আমরা সাদা চোখে দেখতে পাই তার মধ্যে নিহিত, যা দেখতে পাই না তার মধ্যে ন্য। হ্যাঁ, মিঃ গ্রে, দোতারা আপনার ওপরে অদয়। কিন্তু দেবতারা যা দেন তা তাঁরা তাড়াতাড়িই ফিরিয়ে নেন। মাত্র কয়েকটি বছরই আপনি ভালোভাবে, পরিপূর্ণভাবে বাঁচতে পারেন। যৌবন চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার যৌন্দর্য শেষ হয়ে যাবে। তখনি আপনি হঠাৎ আবিষ্কার করবেন জয় করার মতো আর আপনার কিছু নেই। যেটুকু রয়েছে সে শুধু অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতি পরাজযের চেয়েও আপনার কাছে তিক্ত বলে মনে হবে। প্রতি মাসে এই ক্ষয়মান সৌন্দর্য আপনাকে এমন সব পরিবেশের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলবে সেগুলি ভয়নক ছাড়া আর কিছু নয়। সময় আপনাকে হিংসা করে, আপনার লিলি আর গোলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আপনার বুদ্ধিবৃত্তি কমে যাবে, গাল যাবে তুড়ে, চোখের দৃষ্টি যাবে হক্কীণ হয়ে। ভীষণভাবে দুঃখ পাবেন আপনি। হায, যতক্ষণ আপনার যৌবন রয়েছে ততক্ষণই তাকে উপলব্ধি করুন। নীরস নীতিকথা শুনে, অপরিবর্তনীয় ব্যর্থতাকে দেখার ভল্যে, অজ্ঞদের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়ে, সাধারণ আর অশিক্ষিতদের সেবা করার বাসায আপনার সোনার দিনগুলিকে নষ্ট করবেন না। এ যুগের এইগুলিই হচ্ছে রুগ্ন আদর্শ, মিথ্যা উন্মাদনা। বাঁচুন, ভগবান আপনাকে যে সুন্দর জীবন দিয়েছেন তাকে পরিপূর্ণ ভাবেউপলব্ধি করুন। কোনো কিছুই যেন আপনার কাছে নগণ্য বলে গণ্য না নয়, সব সময় নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চযের পথে এগিয়ে যান, কিছুই ভয় করবেন না, একটি নতুন ভোগসুখবাদ–আমাদের শতাব্দী এই মতবাদেই বিশ্বাসী। আপনি হয়তো এর প্রকাশ্য প্রতীক। এমন কিছু নেই যা আপনি আপনার ব্যক্তিত্ব নিয়ে করতে পারেন না। কিছুদিনের জন্যে পৃথিবী আপনার, যখনি আপনার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হল তখনি দেখলাম আপনি নিজে কী, এবং কী হতে পারেন সে বিষয়ে আপনি নিজেই জানেন না। আপনার মধ্যে অনেক জিনিস আমি দেখেছি যেগুলি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার মনে হয়েছিল আপনার সম্বন্ধে আপনাকে আমি কিছু বলব। আমার মনে হয়েছিল আপনি যদি নষ্ট হয়ে যান তাহলে ব্যাপারটা খুবই মর্মান্তিক হবে। কারণ, খুব। অল্পদিনই আপনার যৌবন বেঁচে থাকবে। সাধারণ পাহাড়ি চুল ঝরে যায় বটে, কিন্তু আবার তারা ফোটো এখনো যেমন আগামী জুন মাসেও ল্যাবারনাম ফুল তেমনি হলুদ রঙা হয়ে ফুটবে। এখন থেকে একমাসের মধ্যে ক্লিম্যাটিস লতা গাছের পাতায় বেগনে রঙের তারকা চিহ্নগুলি ফুটে বেরোবে এবং বছরের পর বছর এর পাতার সবুভ রাত্রিগুলি বেগনে তারকা চিহ্নগুলিকে মেলে ধরবে। কিন্তু কোনো দিনই আমরা আমাদের হারানো যৌবনের ফিরে পাব না। বিশ বছর বয়সে আমাদের মধ্যে যে আনন্দের জয়ধ্বনি ওঠে সেই আনন্দ শেষ পর্যন্ত। ঝিমিযে আসে। আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি শিথিল হয়ে আসে, আমাদের প্রবৃত্তিগুলি পচে যায়। ভয়ঙ্কর অতলে আমরা অধঃপতিত হই। সে বাসনার জন্যে আমরা অতিমাত্রায় ভয় পাই তারই অতৃপ্তির স্মৃতি আমাদের পিছু ধাওয়া করে। যৌবন! যৌবন! এ পৃথিবীতে এ ছাড়া দ্বিতীয় আর কিছু নেই।

চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে, অবাক হয়ে ডোরিয়েন গ্রে তাঁর কথাগুলি শোনেন। লাইল্যাক ফুলের পাপডিগুলি তাঁর হাত থেকে খসে নীচে শানুবাঁধানো জায়গায় পড়ে যায়, একটা ব্যস্তবাগীশ মৌমাছি কাছে এসে একটু ভনভন করে। তারপরে সে ফুলের ওপরে ঘোরার আশায় ছুটে বেরিয়ে যায়। সামান্য জিনিসের ওপরে কৌতূহলে নিয়ে তিনি এর দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভয়ে বড়ো জিনিসের কাছাকাছি ঘেঁষতে না পেরে আমারা ঠিক এই ভাবেই ছোটোর দিকে ঝুঁকে পড়ি। কোনো নতুন ভাবধারা প্রকাশ করতে না পেরে, অথবা ভয়ঙ্কর কোনো চিন্তা যখন হঠাৎ আমাদের মগডাকে অবরোধ করে বসে, এবং তার কাছে আমাদের আত্মসমর্পণের দাবী জানায়-তখন আমরা এই ধরনের ক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে মেতে থাকি। কিছুক্ষণ পরে মৌমাছিটা উড়ে গেল, গিয়ে বসল আর একটি ফুলের ওপরে। ফুলটি এপাশ থেকে ওপাশে ধীরে ধীরে নড়তে লাগল।

স্টুডিওর দরজার সামনে হঠাৎ চিত্রকরকে দেখা গেল, তিনি ভেতরে আসতে তাঁদের ইশারা করলেন।

তিনি বললেন, আমি অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্যে। আলো বেশ ভালোই রয়েছে। তোমাদের পানীয় নিয়ে এস।

তাঁরা দুজনে উঠে পড়লেন, তারপরে ধীরে ধীরে স্টুডিওর দিকে এগিয়ে গেলেন, সবুজ আর সাদা রঙে মেশানো দুটি প্রজাপতি তাঁদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল, বাগানের কোণে একটা পিয়ারা গাছে একটা থ্রাসপাখি গান শুরু করল।

লর্ড হেনরি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ গ্রে, আমাকে দেখে আপনি খুশি হয়েছেন?

হ্যাঁ। বর্তমানে আমি খুশি। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে এই রকম আনন্দ কি সব সময় আমি পাব?

সব সময়! শব্দ দুটো সত্যিই বড়ো ভয়ঙ্কর। কথাটা শুনলেই আমি কাঁপতে থাকি। এই কথাটা বলতে মহিলাদের বেশ ভালো লাগে। চিরকালের জন্যে ধরে রাখতে চাওযার ফলে প্রতিটি রোমান্সকেই তারা নষ্ট করে ফেলে। তা ছাড়া, কথাটা অর্থহীন, খামখোল আর জীবনব্যাপী আকাঙ্খার মধ্যে তফাৎ এই সে খামখেয়াল একটু বেশি দীর্ঘস্থায়ী।

স্টুডিওতে ঢোকার পরে ডোরিয়েন গ্রে তাঁর একটি হাত লর্ড হেনরির কাঁধের ওপরে রেখে। বললেন, তাহলে, আমাদের বন্ধুত্ব খামখেয়াল-ই হোক।

এই বল তিনি প্ল্যাটফর্মের ওপরে উঠে গিয়ে মডেলের ভঙ্গিমায় দাঁড়ালেন।

একটা বড়ো আরাম কেদারার ওপরে বসে লর্ড হেনরি তাঁকে দেখতে লাগলেন। চারপাশে। নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে কেবল ক্যানভাসের ওপরে ব্রাশের মৃদু খসখসানি সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছিল, আর যখন চিত্রকর কখনো-সখনো দু-এক পা পিছিযে দূর থেকে তাঁর ছবিটিকে দেখছিলেন তখন। খোলা দরজার ভিতর দিয়ে তির্যক ভঙ্গিতে সূর্যের আলো এসে পড়েছিল, সেই আলোর মধ্যে সোনালি রঙের ধূলিকণাগুলি নাচতে লাগল। গোলাপ ফুলের ভারী গন্ধ এসে ভরিয়ে দিয়েছিল ডায়গাটা।

প্রায় মিনিট পনেরো কাজ করার পরে হলওয়ার্ড থামলেন। অনেক্ষণ ধরে ডোরিয়েন গ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপরে তাঁর বিরাট একটা ব্রাশের ডগা দাঁতের মধ্যে চেপে ধরে। তাকলেন তাঁর ছবিটির দিকে, ভ্রূকুটি করলেন।

প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে ছবিটা।

এই বলেই তিনি এগিয়ে গিয়ে ক্যানভাসের বাঁদিকের এক কোণে সিঁদুরে অক্ষরে নিজের নামটা লিখে দিলেন।

চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন লর্ড হেনরি। ছবিটিকে বেশ ভালো করে পরীক্কা করলেন। অপরুপ চিত্রকলাই বটে, যেন জীবন্ত, প্রাণচঞ্চল, একেবারে দ্বিতীয় ডোরিয়েন গ্রে।

তিনি বললেন, বন্ধু, আমার আন্তরিক অবিনন্দন গ্রহণ করা আধুনিক যুগের একটি সুন্দরতম প্রতিকৃতি তুমি সৃষ্টি করেছ। মিঃ গ্রে, নেমে আসুন, নিজের প্রতিকৃতির দিকে একবার তাকান।

যুবকটি চমকে উঠলেন, মনে হল হঠাৎ যেন তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠেছন।

প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে এসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যিই কি শেষ হয়েছে?

চিত্রকর বললেন, প্রায়। আজ তোমার বাটি হচ্ছে অদ্ভুত, চমৎকার। তোমার কাছে আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ।

লর্ড হেনরি বললেন, সেই সাফল্যের মূলে রয়েছি আমি। তাই না মিঃ গ্রে?

কোনো উত্তর দিলেন না ডোরিয়েন, অন্যমনস্কভাবে একবার তাঁর প্রতিকৃতির সামনে দিয়ে হাঁটলেন। তারপরে সেই দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। প্রতিকৃতিটির সঙ্গে চোখাচোখি হওয়া মাত্র তিনি পিছ ফিরলেন, আনন্দের আতিশয্যে কয়েকটি মুহূর্তের জন্যে তাঁর গাল দুটি হয়ে উঠল। তাঁর চোখের মধ্যে বেরিয়ে এল আনন্দের এক টুকরো জ্যোতি, মনে হল, তিনি যেন এই প্রথম নিজেকে চিনতে পেরেছেন। সেখানে তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে কেমন যেন নির্বাক হয়ে গেলেন তিনি। মনে হল, হলওয়ার্ড তাঁকে যেন কিছু বলছেন, কিন্তু ঠিক কী বলছেন তা তাঁর কানে ঢুকল না। তিনি যে এত সুন্দর এই কথাটা আজই যেন তিনি জীবনে প্রথম বুঝতে পারলেন। এর আগে ঠিক এমনভাবে তিনি বোঝেননি। বেসিল হলওয়ার্ড এতদিন তাঁকে যে-সব কথা বলে এসেছিলেন সেগুলিকে তিনি বন্ধুর মিষ্ট ভাষণ বলেই মনে করতেন। সে সব কথা তিনি শুনতেন, হাসতেন, এবং ভুলে। যেতেন। সেই কথাগুলি তাঁর চরিত্রের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তারপরে এলেন লর্ড হেনরি যৌবনের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলেন তিনি, কিন্তু সেই সঙ্গে বলে দিলেন, সাবধান, যৌবন ক্ষণস্থায়ী।

কথাটা শোনার সময় তাঁর মনে লেগেছিল সত্যি কথা, কিন্তু এখন নিজের পূর্ণ প্রতিকৃতির মাযার সামনে দাঁড়িয়ে সেই কথাগুলি তাঁকে বিপুলভাবে নাড়া দিয়ে গেল। হেনরির বক্তব্যের আসল ব্যঞ্জনাটা তিনি বুঝতে পারলেন। হ্যাঁ, সত্যি কথাই। এমন একটা দিন আসবে যেদিন তাঁর মুখের রেখাগুলি কুঁচকে যাবে, ঝুলে পড়বে গালের চামড়া, চোখের দৃষ্টি হবে নিষ্প্রভ, বির্বণ, হ্যাঁ লাবণ্য নষ্ট হয়ে যাবে, নিটোল প্রাণবন্ত স্বাহ্যটি ঝুরঝুর করে পড়বে ভেঙে। তাঁর ঠোঁটের লালিমা, চুলের সোনালি বর্ণ সব নষ্ট হয়ে যাবে, নিঃশব্দে মিলিয়ে যাবো আত্মার পরিপোষক যে জীবন, সেই জীবনই তাঁর দেহটিকে বিকৃত করে তুলবে। তিনি পরিণত হবেন একটি ঘৃণ্য জঘন্য, ভয়ঙ্কর মাংসপিণ্ডে।

এই কথা চিন্তা করতে করতে একটি তীক্ষ্ণ বেদনা শাণিত লৌহ শলকার মতো বুকে গিয়ে খোঁচা দিল। তাঁর দেহের প্রতিটি স্পর্শকাতর তন্ত্রী সেই আঘাতে আর্তনাদ করে উঠল। ঘোলাটে হয়ে উঠল তাঁর চোখ দুটি, ধীরে ধীরে সে দুটি অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে গেলা মনে হল কার যেন তুষারশীতল একটি হাত তার বুকের ওপরে এসে পড়েছে।

ডোরিয়েন গ্রে-কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন হলওয়ার্ড, ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝতে না পেরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, পছন্দ হচ্ছে না?

লর্ড হেনরি বললেন, অবশ্যই ওঁর পছন্দ হয়েছে। এ ছবি কার পছন্দ হবে না?

আধুনিক চিত্রকলায় এটি হচ্ছে সর্বোত্তম চিত্র। এর জন্যে তুমি আমার কাছে যা চাও তাই দেব। ছবিটা আমার চাই।

এটা আমার সম্পত্তি নয় হ্যারি।

কার সম্পত্তি?

কার আবার? ডোরিয়েনের

ভাগ্যবান মানুষ।

ডোরিয়েন গ্রে তখনো তাঁর প্রতিকৃতির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন, সেইভাবে তাকিয়ে থেকেই বিড়বিড় করে অনেকটা স্বগতোক্তির মতোই তিনি বললেন, কী দুঃখের, কী দুঃখের! আমি বৃদ্ধ হব, বিকৃত আর ভয়ঙ্কর হবে একদিন। কিন্তু এই প্রতিকৃতি চিরকালই যৌবনের। আবেগে থাকবে ভরা। আজকের এই উঁচুন মাসের বিশেষ দিনটিতে সে যেমন রয়েছে, চিরকাল সে ঠিক তেমনিই থাকবে। মনে হবে এ যেন এই সেদিনের ব্যাপার। যদি ঠিক উল্টোটা হত, আমি চিরকালই যুবক থাকতাম, আর এই প্রতিকৃতিটা যেত বুডিযে। এর জন্য আমি আমার সর্বস্ব দিতে পারতাম। হ্যাঁ, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা আমি দিতে পারতামি না। প্রয়োজন হলে, আমার আত্মাকেও বিকিয়ে দিতে পারতাম।

লর্ড হেনরি হেসে বললেন, এ ব্যবস্থার নিশ্চয় তুমি রাজি হবে না বেসিল। এর জন্য তুমি অনেক পরিশ্রম করে।

হলওয়ার্ড বললেন, আমার খুব বেশি আপত্তি রয়েছে হ্যারি।

ডোরিয়েন গ্রে ঘুরে তাঁদের দিকে তাকলেন, বললেন, বেসিল, আমি জানি তা তুমি করবে। বন্ধুদের চেয়ে তোমার চিত্রকলাকে তুমি বেশি ভালোবাসা একটা সবুজ ব্রোঞ্জের মূর্তি ছাড়া তোমার কাছে আমি আর কিছু নই। মনে হয় ততটুকুও নয়।

চিত্রকর অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ডোরিয়েন তো ঠিক এইভাবে কথা বলেন না? ওঁর হল কী? মনে হচ্ছে যেন বেশ চটেছেন তিনি। তাঁর মুখ আর গাল দুটি লাল টকটকে হয়ে উঠেছে।

ডোরিয়েন বলে গেলেন, হ্যাঁ, তোমার হাতির দাঁতের ‘হারমিস’ অথবা রুপোর ফন যা, আমার দাম তোমার কাছে তার চেয়েও কম। তুমি তাদের সব সময়েই পছন্দ করবে। কিন্তু আমকে তোমার কতদিন ভালো লাগবে? যতদিন পর্যন্ত আমার মুখে প্রথম কুঞ্চন না দেখা। দেয়। তাই না? এখন আমি বুঝতে পারছি, দেহের সৌন্দর্য, তার দাম যাই হোক, নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার সব কিছু হারিয়ে ফেলে, তোমার ছবি আমাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে। লর্ড হেনরি খাঁটি কথা বলেছেন। পরম-পাওয়া বলে যদি মানুষের কিছু থাকে তা হল একমাত্র ওই যৌবন। যখনি আমার মনে হবে আমি বুড়ো হচ্ছি তখন আমি আত্মহত্যা করব।

হলওয়ার্ডের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলা ডোরিয়েনের একটা হাত ধরে তিনি বললেন, ডোরিয়েন, ডোরিয়েন! ওকথা বলো না। তোমা মতো বন্ধু আমার নেই, আর হবেও না। এইসব জিনিসগুলোকে নিশ্চয় তুমি হিংসে কর না। কর কি? এইসব জিনিসের চেয়ে তুমি অনেক বেশি সুন্দর।

পৃথিবীতে যাদের সৌন্দর্য নষ্ট হয় না তাদের সকলেরই আমি হিংসে করি। আমার যে চিত্রটি তুমি এঁকে সেটিকেও হিংসা করি আমি। আমি যা হারাব তা এ ধরে রাখবে কেন? চলমান প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছ থেকে কিছু-না সরিয়ে নিচ্ছে, তার পরিবর্তে কিছু দিচ্ছে। হায়রে, এর উল্টোটা যদি হত! যদি চিত্রটারই পরিবর্তন ঘটত, আমি এখন যা রয়েছি তাই যদি আমি চিরকাল থাকতাম! তুমি এ-ছবি কেন আঁকলে? একদিন না একদিন এ আমাকে বিদ্রুপ করবে, মর্মান্তিকভাবে বিদ্রুপ করবে।

উষ্ণ অশ্রু তাঁর চোখের ওপরে ছলছল করে উঠল। তিনি তাঁর হাতটাকে ছিনিয়ে নিলেন। তারপর ডিভানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখটাকে লুকিয়ে ফেললেন, মনে হল তিনি যেন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করছেন।

চিত্রকর তিক্তভাবে বললেন, এর জন্যে হ্যারি তুমি দায়ী।

লর্ড হেনরি চিত্রকরের তিরস্কারকে গ্রাহ্য না করে কাঁধে একা শ্রাগ করে বললেন, এ-ই হচ্ছে আসল ডোরিয়েন গ্রে-অন্য কিছু নয়।

না, এ তা নয়।

এ যদি তা-ই না হয়, তাহলে একে নিয়ে আমি কি করব?

চিত্রকর বিড়বিড় করে বললেন, তোমাকে যখন চলে যেতে বলেছিলেন তখনি তোমার চলে যাওয়া উচিত ছিল হ্যারি।

লর্ড হেনরি বললেন, তুমি থাকতে বললে বলেই তো থাকলাম।

হ্যারি, একই সঙ্গে আমার দুটি প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে আমি ঝগড়া করে থাকতে পারব না। কিন্তু আমার জীবনের যেটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তোমরা দুজনে সেটিকে ঘৃণা করতে আমাকে বাধ্য করছ আমি এটাকে নষ্ট করে ফেলব। এটা ক্যানভাস আর রঙ ছাড়া আর কী! আমাদের তিনটা ভীবলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ধ্বংস করতে আমি আর কী! আমাদের তিনটি জীবনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ধ্বংস করতে আমি একে দেব না।

এই বলে হলওয়ার্ড ভারী পর্দা দেওয়া জানালার নীচে বসানো ছবি আঁকার টেবিলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ডোরিয়েন গ্রে বালিশের ওপর থেকে মাথাটা তুলে বিবর্ণ মুখে আর অশ্রুসিক্ত লোচনে তাঁর দিকে তাকালেন। হলওয়ার্ড ওখানে কী করছেন? টিনের টিউব আর শুকনো ব্রাশের জঙ্গলে তিনি কি যেন হাতড়ে বেড়াতে লাগলেন। হ্যাঁ, তিনি লম্বা পাতলা ব্লেডের স্টিলের ছুরিটা খুঁজছিলেন। শেষ পর্যন্ত জিনিসটা খুঁজে পেলেন তিনি, তারপরেই প্রতিকৃতিটা এফোঁড়-ওফোঁড় করার জন্য তিনি তৈরি হলেন।

একটা চাপা আর্তনাদ করে ছেলেটি সোফা থেকে লাফিয়ে উঠলেন, এবং দৌড়ে গিয়ে। হলওয়ার্ড-এর হাত থেকে ছুরিটা ছিনিয়ে নিলেন। ছুরিটাকে স্টুডিওর একধারে ছুঁড়ে ফেলে তিনি বললেন, বেসিল, ও কারো না, কো না। ওটা হত্যা ছাড়া আর কিছু নয়।

ডোরিয়েনের ক্রিয়াকলাপে চিত্রকর কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন। সেই বিস্ময় কাটার পরে তিনি একটু উদাসীনভাবেই বললেন, ডোরিয়েন তুমি যে শেষ পর্যন্ত আমার তৈরি প্রতিকৃতির মূল্য বুঝতে পেরেছে তা বুঝতে পেরে আমি খুশি হয়েছি। আমি ভাবতে পারিনি যে তুমি তা পারবে।

মূল্য বোঝার কথা বলছ? আমি এর প্রেমে পড়ে গিয়েছি, বেসিল। ওটা আমার অচ্ছেদ্য অংশ। এটা আমার মুখের নয়, মনের কথা।

ঠিক আছে তোমার ছবিটা শুকিয়ে গেলেই তাকে বার্নিশ করা হবে, বাঁধানো হবে ফ্রেম দিয়ে। তারপর তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তখন তোমার প্রতিকৃতিটা নিয়ে তোমার যা খুশি তা-ই করতে পারা।

এই কথা বলে তিনি ঘরের একপ্রান্তে এসে চা আনার জন্য বেল বাজালেন, ডোরিয়েন, নিশ্চয় তুমি চা খাবে? হ্যারি, তুমিও? অথবা এই সাধারণ আনন্দে তোমাদের কোনো আপত্তি রয়েচ্ছে।

লর্ড হেনরি বললেন, সাধারণ আনন্দকে আমি পুজো করি। জটিলতার শেষ আশ্রয় তারাই। কিন্তু একমাত্র স্টেডের ওপরে ছাড়া আমি হইচই পছন্দ করি না। তোমরা দুজনেই কি অদ্ভুত জীব বল তো? আমি ভেবে আশ্চর্য হই কে মানুষকে সামাজিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী বলে চিহ্নিত করেছেন। যত অপরিপক্ক ব্যাখ্যা রয়েছে এটি হচ্ছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে অর্বাচীন। মানুষ অনেক কিছু সন্দেহ নেই, কিন্তু সে আদৌ বিচারবুদ্ধিসম্মপন্ন নয়। সব দিক দিয়ে। ভাবতে গেলে সে যে মোটের ওপরে তা নয় এতে আমি খুশিই হয়েছি। যদিও আমি মনে করি একটা ছবি নিয়ে তোমাদের মতো ছোকরাদের এতটা কচকচি করা উচিত হয়নি। বেসিল, এত গোলমালে কাজ নেই। ওটা বরং আমাকে দিয়ে দাও। এই মূর্খ বালক সত্যি সত্যিই ওটা চায় না। আমি চাই।

ডোরিয়েন গ্রে চিৎকার করে উঠলেন, আমাকে না দিয়ে ও-ছবি যদি তুমি আর কাউকে তাহলে আমি তোমাকে কোনোদিনই ক্ষমা করব না, বেসিল এবং অন্য লোকে আমাকে বোকা বলবে তা-ও আমি সহ্য করব না।

ডোরিয়েন, তুমি জান এ ছবি তোমার। আঁকার আগেই এটা আমি তোমাকে দান করেছি।

এবং আপনি যে কিছুটা বোকার মতো কাজ করেছেন তা আপনি জানেন, মিঃ গ্রে। আপনাকে নিশ্চয় স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না যে আপনার বয়সটা খুব কাঁচা।

লর্ড হেনরি, আজ সকালেই আমার ভীষণ আপত্তি জানানো উচিত ছিল।

হ্যাঁ, আজকে সকাল! তখন থেকেই আপনি বেঁচে আছেন।

দরজায় একটি টোকা পড়ল, বাটলার একটা পেতলের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তারপরে সেটিকে একটি ছোটো জাপানি টেবিলের ওপরে রেখে দিল। চায়ের কাপ আর সসারের টুঙ-টাঙ আওয়াজ হল, একটি চাকর বয়ে নিয়ে এল দুটি গোলাকার চায়না ডিশ। ওই দুজনে অবসন্নভাবে টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন ঢাকনির তলায কী রয়েছে।

লর্ড হেনরি বললেন, আজকে রাত্রিতে আমরা সবাই থিয়েটারে যাই চল। কোথাও না কোথাও নিশ্চয় কিছু-না-কিছু হচ্ছে। হোয়ইট-এ আভা আমার ডিনার খাওয়ার কথা। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তিটি হচ্ছে আমারই এক বৃদ্ধ বন্ধু। তাঁকে আমি একটা টেলিগ্রাম করে দেব, বলব শারীরিক অসুস্থতার জন্যে যেতে পারলাম না। অথবা হঠাৎ জরুরি কাজ পড়ায় যেতে পারলাম না। সেকথাও বলতে পারি। আমার ধারণা অজুহাত হিসাবে ওটা বেশ জুৎসই হবে। অকপটতার মধ্যে যত বিস্ময রয়েছে এটা হবে তাদের মধ্যে আর এক বিস্ময়।

হলওয়ার্ড বিড়-বিড় করলেন, এটা হচ্ছে নিজের পোশাক পরার মতো একঘেয়ে। পরার পরেই মনে হয় সেগুলি কত বিতিকিচ্ছিরি।

লর্ড হেনরি স্বপ্নিল চোখে বললেন, ঠিক কথা। উনবিংশ শতাব্দীর পোশাকই হচ্ছে জঘন্য এটা যেমন জাঁকালো তেমনি হতাশাব্যঞ্জক। আধুনিক জীবনে পাপই হচ্ছে একমাত্র রঙিন।

হ্যারি, ডোরিয়েনের কাছে ওই সব কথা বলা তোমার নিশ্চয় উচিত হচ্ছে না।

কোন ডোরিয়েনের কথা তুমি বলছ? যিনি এখন আমাদের জন্যে চা করছেন, তিনি? না, ওই ছবির ডোরিয়েন?

দুজনের কাছেই।

ডোরিয়েন বললেন, লর্ড হেনরি, আমি আজ আপনার সঙ্গে থিয়েটারে যাচ্ছি।

তাহলে আপনি আসুন। বেসিল, তুমিও নিশ্চয় আসছ। না কি?

না, সত্যিই যেতে পারব না। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে আমার।

মিঃ গ্রে, এই পরিস্থিতিতে আমরা একাই যাব।

খুব খুশি হব আমি।

ঠোঁট কামড়ালেন চিত্রকর। তারপরে একটি কাপ হাতে নিয়ে তিনি ছবিটির দিকে এগিয়ে গেলেন। বিষণ্ণভাবে তিনি বললেন, আমি আসল ডোরিয়েলের সঙ্গেই থাকব।

জীবন্ত ছবিটি তাঁর কাচ্ছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এটাই কি তোমার আসল ডোরিয়েন? আমি কি সত্যিই ওই রকম দেখতে?

হ্যাঁ, তুমি তাই।

কী চমৎকার, কী চমৎকার বেসিল!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হলওয়ার্ড বললেন, অন্তত বাইরে থেকে দেখতে। তবে এটার কোনো পরিবর্তন হবে না। তারও দাম যথেষ্ট।

লর্ড হেনরি চেঁচিয়েই বললেন, আনুগত্য নিয়ে মানুষ কেন যে এত হইচই করে বুঝি না। এমনকি প্রেমের ব্যাপারেও জিনিসটা শারীরবৃত্ত ছাড়া অন্য কিছু নয়। আমাদের নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই। যুবকরা বিশ্বাসী হতে চায়, কিন্তু তারা বিশ্বাসী নয়। বৃদ্ধেরা অবিশ্বাসী হতে চান, কি হতে পারেন না। এছাড়া আর কিছুই বলার নেই আমাদের।

হলওয়ার্ড বললেন, তুমি আজ থিয়েটারে যোযো না ডোরিযেত। এখানে রয়ে যাও। রাত্রিতে আমরা একসঙ্গে ডিনার খাব।

না, বেসিল।

কেন?

কারণ লর্ড হেনরির কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য ওর কাছে তোমার দাম বাড়বে না। নিজের প্রতিজ্ঞাই ও ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে। আমি অনুরোধ করছি তুমি যেয়ো না।

হেসে মাথা নাড়লেন ডোরিয়েন।

আমি তোমাকে অনুরোধ করছি।

ডোরিয়েন ইতস্তত করতে লাগলেন। চায়ের টেবিলে বসে লর্ড হেনরি বেশ রসিকতার দৃষ্টি দিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন।

ডোরিয়েন বললেন, আমাকে যেতেই হবে বেসিল।

হলওয়ার্ড বললেন, ঠিক আছে।

তিনি ফিরে গিয়ে চায়ের কাপটা টেবিলের ওপরে রেখে দিলেন, বললেন, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। তোমাদের আবার পোশাক পালটাতে হবে। বিদায় হ্যারি। বিদায় ডোরিয়েন। তাড়াতাড়ি একদিন এস। কালকেই।

নিশ্চয়।

ভুলে যাবে না?

না, নিশ্চয় না।

আর…হ্যারি?

বলুন বেসিল।

আজকে সকালে তোমাকে কী বলেছিলাম মনে করে দেখা

আমার মনে নেই।

তোমার ওপরে আমার বিশ্বাস রয়েছে।

লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আমি যদি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারতাম! আসুন, মিঃ গ্রে, বাইরে আমার গাড়ি দাঁড়িয়ে। আপনাকে আমি যথাস্থানে নামিয়ে দেব। বেসিল, চললাম, আজকের বিকালটা বেশ ভালোই কাটল।

তাঁদের পেছলে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেসিল সোফার ওপরে ঢলে পড়লেন। তাঁর চোখের ভেতর থেকে একটি ক্লিষ্ট বেদনার জ্যোতি বেরিয়ে এল।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

পরের দিন বেলা সাড়ে বারোটার সময় লর্ড হেনরি ওটোন কার্ডন স্ট্রিট থেকে বেড়াতে বেড়াতে তাঁর কাকার সঙ্গে দেখা করার জন্যে অ্যালব্যানির দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর কাকা। হচ্ছেন লর্ড ফারমোর, বৃদ্ধ এবং অবিবাহিতা বাইরে থেকে কিছুটা রুক্ষ মনে হলেও, আসলে। তিনি ছিলেন মিষ্টি স্বভাবের। তাঁর সমাজের বাইরের লোকেরা তাঁকে স্বার্থপর বলে চিহ্নিত করত, কারণ তার কাছ তাঁরা কোনো উপকার পেত না। অথচ তাঁর নিজস্ব সমাড়ে দিলদরিযা বলে নামডাক ছিল তাঁর। কারণ যারা তাঁকে খুশি করতে পারত তাদের তিনি ভূরিভোজনে আপ্যায়িত করতেন। ইসাবেলা যখন যুবতী ছিলেন সেই সময় তাঁর বাবা মাদ্রিদে আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ব্যাপরটা অচিন্ত্যনীয়, কিন্তু সত্য যে প্যারিসের দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতের পদ না। পাওয়ায় বিরক্ত হয়ে খামাখেয়ালি করে তিনি কূটনৈতিক চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বসেন। তিনি বিশ্বাস করতেন উচ্চ বংশ, আলস্য সরকারি চিঠিপত্র লেখার যোগ্যতা এবং আমোদ-প্রমোদের অযৌক্তিক সম্পৃহার দিক থেকে বিচার করলে ওই পদটির যোগ্যতম প্রার্থী ছিলেন একমাত্র তিনিই। পত্রটি ছিলেন তাঁর পিতার সেক্রেটারি। পিতার সঙ্গে সঙ্গে পুত্রও চাকরিতে ইস্তফা দেন, সে সময়ে সকলেই ভেবেছিল কাজটা তাঁর নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। হয়েছিল; এবং কিছুদিন পরে পিতার খেতাবের অধিকারী হয়ে অভিজাত সম্প্রদায়ের যেটি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কলা–সেই কিছু-না-করার চর্চার তিনি মশগুল হয়ে রইলেন। শহরে তাঁর দুটি বড়ো বাড়ি ছিল, বেশি ঝামেলা এড়ানোর জন্য তিনি ছোটো বাড়িতে বাস করতে ভালোবাসতেন, খাওয়া-দাওয়া করতেন ক্লাবে। মিডল্যান্ড-এ তাঁর যে সব কয়লার খনি ছিল সেগুলি দেখাশোনা করতেন কিছুটা। পৃথিবীতে এত ডিজনিস থাকতে তিনি কলার ব্যবসাতে মেতেছেন কেন কেউ এই প্রশ্ন করলে তিনি প্রায়শই বলেন যে ওইটাই একমাত্র জিনিস যা ভদ্রলোকেরা নিজেদের বাড়িতে জ্বালানোর ভব্যতা অর্জন করেন। রাজনীতির দিক থেকে তিনি ছিলেন টোরি সম্প্রদায়ভুক্ত। যখন অবশ্য টোরিয়া সরকার গঠন করতে অসমর্থন হত, সেই সময় তিনি তাদের একদল ব্র্যাডিক্যাল বলে যথার্থই গালাগালি দিতেন। নিজের পরিচারকের কাছে তিনি ছিলেন বীরপুরুষ যদিও সেই পরিচারকটি সব সময় তাঁর কাছে তর্জন-গর্জন করত। বেশির ভাগ আত্মীয়-স্বজনরা তাঁকে রীতিমতো ভয় করত, কারণ তিনি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাঁদের ধমক দিতেন। একমাত্র ইংলন্ডেই তাঁর মতো মানুষের জন্ম সম্ভব। এবং সব সময়েই তিনি অভিযোগ করতেন যে দেশটা একেবারে জাহান্নামে গিয়েছে। তাঁর সমস্ত নীতিগুলিই পুরনো যুগের, কিন্তু তাঁর যতগুলি খেয়াল অথবা বদখেয়াল রয়েছে তাদের সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলা যায়।

লর্ড হেনরি ঘরে ঢুকে দেখলেন তাঁর কাকা লর্ড ফারমোর সাধারণ গোছের শিকারে-কোট গায়ে দিয়ে চুরুট খেতে খেতে টাইমস কাগজের ওপারে চোখ বুলোতে বুলোতে ঘোঁত-ঘোঁত করছেন।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি বললেন, আরে হ্যারি যে! এত সকালে? আমার ধারণা ছিল তোমাদের মতো সুখী ছোকরারা বেলা দুটোর আগে বিছানা থেকে ওঠে না। বিকাল পাঁচটার আগে টিকিট দেখা যায় না তাদের।

সত্যি বলছি কাকা, একেবারে ঘরোয়া ব্যাপার! কিছু পেতে এসেছি তোমার কাছ থেকে।

বিকৃত মুখে লর্ড ফারমোর বললেন, সম্ভবত টাকা চাই! ঠিক আছে, বসো। ব্যাপারটা কী খুলে বল আমাকে। আজকাল যুবকরা মনে করে টাকাটাই মানুষের সব।

কোটের বুকে বোতামটা লাগিয়ে লর্ড হেনরি ধীরে ধীরে বললেন, ঠিক বলেছ কাকা, এবং টাকার সত্যিকার দামটা যে কী তা তারা বড়ো হলেই বুঝতে পারে। আমি কিন্তু টাকা চাইতে আসিনি। আঙ্কল জর্জ, সত্যিকার টাকার দরকার তাদেরই যাদের জিনিসপত্রের দাম মেটাতে হয়। আমি কোনদিন ক্যাশ টাকা দিয়ে জিনিস কিনি না। ছোটো ছেলের ধারটাই হচ্ছে। একমাত্র মূলধন। ওর ওপরে বেশ আরাম করে বাঁচা যায়। তাছাড়া আমি সব সময় ডার্টমুরের ব্যবসাদারদের সঙ্গে কারবার করি। ফলে টাকা-পয়সা নিয়ে কোনোদিন তারা আমাকে বিরক্ত করে না। বর্তমানে আমি এখানে এসেছি কিছু সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য। অবশ্য এমন কিছু প্রয়োজনীয় সংবাদ নয়, একেবারে অপ্রয়োজনীয়।

ইংলিশ ব্লু-বুক-এ যা রয়েছে তার সবটুকুই আমি তোমাকে বলতে পারি। অবশ্য আজকাল লোকগুলো যা-তা লিখে যাচ্ছে। আমি যখন ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসে ছিলাম তখন এখানকার চেয়ে লোকে আরো অনেক ভালো লিখত। কিন্তু শুনছি ওরা আজকাল পরীক্ষা করে ওই সব চাকরিতে লোক নিচ্ছে। কী তুমি আশা কর? পরীহষ্কাটা নিছক প্রতারণা ছাড়া আর কী বল? মানুষ যদি ভদ্রলোক হয় তাহলে তার সব জিনিসই ডানা হয়ে যায়, আর যদি সে তা না হয়, তাহলে সে যতটুকু শেখে তার সবটুকুই তার ক্ষতি করে।

লর্ড হেনরি কিছুটা বিকৃত স্বরেই বললেন, তোমার ওই সব সরকারি কেতাবে মিঃ ডোরিয়েন গ্রে-র সম্বন্ধে কিছু লেখা নেই, আঙ্কল জর্জ।

সাদা চুলে ভরা ভুরু দুটি কুঁচকিয়ে লর্ড ফারমোর জিজ্ঞাস করলেন, মিঃ ডোরিয়েন গ্রে? কে বল তো?

সেইটাই তো আমি জানতে এসেছি, আঙ্কল জর্জ। অথবা বলতেও পার আমি তা জানি, তিনি হচ্ছেন শেষ লর্ড কেলসোর নাতি। তাঁর মা ছিলেন দেবেরু, লেডি মার্গারেট দেবেরু। তাঁর আমাকে কিছু বল। তিনি কেমন দেখতে ছিলেন? তিনি বিয়ে করেছিলেন কাকে? তোমার সময়কার প্রায় সকলকেই তুমি চিনতে, তাঁকেও হয়তো তুমি জানতে পার। বর্তমানে মিঃ গ্রে-র সম্বন্ধে কিছু জানার কৌতূহল আমার হয়েছে। তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে সবেমাত্র।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি লর্ড হেনরির স্বর অনুকরণ করে বললেন, কেলাসোর নাতি! কেলাসোর। নাতি! হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। তার মা-কে আমি খুব ভালো করেই জানতাম। মনে হচ্ছে তার যখন খ্রিশ্চানিং হল সেই থেকেই তাকে আমি ডানি। অপরূপ সুন্দরী বলতে যা বোঝায় সে ছিল সেই রকম মেয়ে–এই মার্গারেট দেবেরু। একটা কপর্দশূন্য ছোকরার সঙ্গে পালিয়ে গেল মেয়েটা। এই দেখে সবাই তো খাপ্পা। ছোকরাটার কিছুই ছিল না, পদাতিক সেনাবাহিনীতে সামান্য বেয়ারা ছিল মাত্র, কিম্বা ওই জাতীয় সামান্য একটা চাকরি করত। নিশ্চয়। মনে হচ্ছে এই সেদিনের কথা। বিয়ের কয়েক মাস পরেই স্পা-তে একটা দ্বন্দ্বযুদ্ধে ছোকরাটা মারা যায়। এ-সম্বন্ধে একটা নোংরা কথাও অবশ্য শোনা যায়। লোকে বলে কেলসো নাকি একটা। বেলজিয়াম গুণ্ডাকে তার পেছনে লেলিয়ে দেয়। গুণ্ডাটা প্রকাশ্য রাস্তার ওপরে জামাইকে অপমান করে। এর জন্যে কিছু অর্থও ঢালতে হয়েছিল তাকে। তারপরেই যা ঘটার ঘটল। লোকে যেমন ভাবে পায়রা জবাই করে সেই গুণ্ডটাও ঠিক তেমনিভাবে একদিন সেই ছোকরাকে শেষ করে ফেলল। ব্যাপারটা চেপে দেওয়া হল বটে, কিন্তু সেই থেকে বেশ কিছুদিন কেলসোর সঙ্গে বিশেষ কেউ আর মেলামেশা করত না। বেচারাকে ক্লাবে বসে একাই খাওয়া শেষ করতে হত। শুনেছি সে তার মেয়েকে আর নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছিল। সেই মেয়ে কিন্তু তার বাবার সঙ্গে জীবনে আর কোনদিন কথা বলেনি। না, না, কাজটা কেলসো ভালো করেনি। মেয়েটাও মারা গেল–এক বছরের মধ্যেই। তার একটা ছেলে ছিল। তাই কি? আমার মনে নেই। কেমন দেখতে বল তো? যদি তার মায়ের মতো হয় তাহলে ছোকরাটাকে নিশ্চয় সুন্দর-ই বলতে হবে।

সায় দিলেন লর্ড হেনরি, দেখতে ছেলেটি বেশ সুন্দরই বটে।

বৃদ্ধ লোকটি বলে চললেন, আশা করি উপযুক্ত মানুষের হাতেই সে পড়বে। কেলসো যদি তার জন্যে যতটুকু করা উচিত তাই করে যায় তাহলে অনেক টাকার মালিক সে হবে। তার মায়ের ঠাকুরদার মারফৎ সেলবি-র সমস্ত সম্পত্তি তার মা পেয়েছিল। তার ঠাকুরদা। কেলসোকে ঘৃণা করতেন, তাঁর মতে কেলসো ছিল একটা ঘৃণ্য কুকুর। কথাটা মিথ্যে নয। আমি যখন মাদ্রিদে ছিলাম সেই সময় একবার তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, সত্যি বুলছি, তাকে দেখে আমি তখন লজ্জিত হয়েছিলাম। রানি একবার আমাকে জিজ্ঞাসা। করেছিলেন, আচ্ছা, ভাড়া নিয়ে কোচোযানের সঙ্গে সব সময়ে ঝগড়া করেন ওই ইংরেজ ভদ্রলোকটি কে বলুন তো? এই নিয়ে স্থানীয় লোকেরা বেশ একটা মুখরোচক গল্পই রচনা করে বসল। তোমাকে কী বলব, মাসখানেক আমি কোর্টে মুখ দেখাতে পারিনি। আমার ধারণা নাতির সঙ্গে সে খুব একটা ভালো ব্যবহার করত না।

লর্ড হেনরি বললেন, তা আমি জানি না। আমার ধারণা, ছেলেটির যথেষ্ট অর্থ রয়েছে। তবে সে এখনো সাবালক হয়নি। সেলবি যে তাঁর আত্মীয় সেকথা আমি জানি, তিনিই আমাকে তা বলেছেন। আর…তাঁর মা খুব সুন্দরী ছিলেন, তাই না?

আমার মতে মার্গারেট দেবেরু সবচেয়ে সুন্দরী রমণী, যাকে বলে পরমা সুন্দরী। সে যে কেন। অমন কাজ করল তা আমি জানি না। কত ভালো পাত্র ছিল। তাদের যাকে খুশি তাকেই সে। বিয়ে করতে পারত। কার্লিংটন তো তাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিল। রোমান্টিক বলতে তোমরা যা বোঝা মার্গারেট ছিল তা-ই। আর শুধু তার কথাই বা বলি কেন, ওই বংশের সব মহিলারাই ওই রকম। পুরুষ মানুষরা অতি সাধারণ, কিন্তু মেয়েরা অসাধারণ। কার্লিংটন তার কাছে নতজানু হয়ে প্রেম ভিক্ষা করেছিল, সেকথা সে আমাকে নিজেই বলেছিল। মার্গারেট তাকে বিদ্রূপ করে হাসতা বিবেচনা কর, লন্ডনে এমন কোনো যুবতী ছিল না যে কার্লিংটনকে বিয়ে করার জন্যে পাগল হয়ে ছোটাছুটি না করত। আচ্ছা হ্যারি বিয়ের কথা যখন উঠলই তখন একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। ডার্টমুর নাকি একটি আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করতে চায়? কোনো ইংরেজ যুবতীই কি তার যোগ্য নয়?

আঙ্কল জর্জ, এখন আমেরিকান বিয়ে করাই তো ফ্যাশান।

টেবিলের ওপরে ঘুষি মেরে লর্ড ফারমোর বললেন, পৃথিবীর সমস্ত মেয়েদের মধ্যে ইংরেজ মেয়েরাই শ্রেষ্ঠ, হ্যারি। একথা আমি জোর করেই বলতে পারি।

সেদিক থেকে আমেরিকান মেয়েদেরই আমাদের দেশের ছেলেরা বেশি পছন্দ করে, একথা আমি বাজি রেখে বলতে পারি।

তাঁর কাকা বিড়বিড় করলেন, আমি শুনেছি, আমেরিকাল মেয়েরা বেশিদিন টেকে না।

দীর্ঘদিন ধরে প্রণয়লীলা তাদের ক্লান্ত করে তোলে, কিন্তু বেড়াবাজির দৌড়ে তারা অনবদ্য। ঘোড়ার মতো সব সময়েই তারা ছুটতে ভালোবাসে। ডার্টমুর-এর কোনো আশা রয়েছে বলে আমার মনে হয় না।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক গজগজ করে জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটির আত্মীয়স্বজন কেন জান? আছে কেউ?

লর্ড হেনরি মাথা নাড়লেন, আমেরিকান মহিলারা তাদের বাপ-মায়ের পরিচয় লুকিয়ে রাখে, ঠিক যেমন ইংরেজ মহিলার লুকিয়ে রাখে তাদের অতীত জীবনের কাহিনি।

তারা শুয়োর মাংসের ব্যবসা করে, তাই না?

ডার্টমুরের দিক থেকে ভাবলে ব্যাপারটা সেই রকমই দাঁড়ায় বটে, আঙ্কল জর্জ, শুনেছি, আমেরিকাতে রাজলীতির পরেই যে ব্যবসাটা জমজমাট হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে ওই শুয়োর মাংসের ব্যবসা।

মেয়েটি কি দেখতে ভালো? তার ধারণা সে সুন্দরী। বেশির ভাগ আমেরিকান মহিলারা নিজেদের সুন্দরী বলে মনে করে। তাদের লাবণ্যের এইটাই হচ্ছে গোপন কথা।

এই সব আমেরিকান মহিলার নিজেদের দেশে কেন থাকতে পারে না বল তো? তারা তো সব সময়েই বলে বেড়াচ্ছে যে আমেরিকা হচ্ছে স্বর্গ।

তাই বটে। লর্ড হেনরি বললেন, বিশেষ করে সেই জন্যেই ইভ-এর মতো সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে তারা ব্যাকুল। এখন আমি চলি আঙ্কল ভর্ত। এখানে আর বেশিণ অপেক্ষা করলে লাঞ্চের দেরি হয়ে যাবে। আমি যে সংবাদ জানতে চাই সেইটুকু আমাকে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ। নতুন বন্ধুদের সম্বন্ধে সব সময় আমি কিছু জানতে চাই। পুরনো বন্ধুদের সম্বন্ধে কোনো আগ্রহ নেই।

আজ কোথায় লাঞ্চ খাচ্ছ হ্যারি?

আনট আগাথার বাড়িতে আমি আর মিঃ গ্রে দুজনেই যাচ্ছি। তিনিই হচ্ছেন তাঁর সর্বাধুনিক অনুগৃহীত।

হুম। হ্যারি, তোমার আট আগাথাকে ডঘনিয়ে দিয়ো তিনি আর যেন চাঁদা দেওয়ার জন্যে বিরক্ত না করেন। আমি তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছি। ভদ্রমহিলা মনে করেন তাঁর ওইসব বদ খেল চরিতার্থ করার জন্যে চেক কাটা ছাড়া আর কোনো কাজ আমার নেই।

ঠিক আছে আঙ্কল ভক্ত, তোমার কথা আমি তাঁকে জানিয়ে দেব, কিন্তু তাতে কোনো কাভ হবে না। পরোপকারী ব্যক্তিদের মনুষ্যত্ব বলে কোনো বোধশক্তি নেই। এইটাই হচ্ছে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে শব্দ করলেন, তারপরে চাকরকে ডাকার জন্যে বেল বাজালেন। নীচু খিলান পেরিযে লর্ড হেনানি বার্লিংটন স্ট্রিটে গিয়ে পড়লেন, তারপরে এগিয়ে চললেন বার্কলে স্কোয়ারের দিকে।

তাহলে ডোরিয়েন গ্রের বাবা আর মায়ের কাহিনীটা হল এই? কাহিনিটি যত অমার্জিত ভাবেই বলা হোক না কেন, একটা অদ্ভুত, যাকে বলে বলে আধুনিক রোমান্সের গন্ধে তাঁর মন ভরে উঠেছিল। উন্মাদ আবেগের জন্য একটি সুন্দরী যুবতী জীবনের সবকিছু ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কয়েকটি সপ্তাহের উন্মাদ আনন্দ। তারপরেই একটি ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতক অপরাধ তাঁর সেই জীবনকে কেটে ছোটো করে দিল। কয়েকটি মাসের নির্বাক যন্ত্রণার পরে ৬ন্ম হল একটি ছেলের মৃত্যু ছিনিয়ে নিল মাকে, নিঃসঙ্গ শিশুটি পড়ে রইল এমন একটি মানুষের কাছে যার মনে স্নেহ ছিল না, ছিল না কোনো ভালোবাসা। হ্যাঁ, এইটিই হচ্ছে ছেলেটির জীবনের পটভূমি। এই পরিস্থিতিতেই সে মানুষ হয়েছে, সম্ভবত এইটাই যেন তাকে পূর্ণ করে তুলেছে। প্রতিটি অপরূপ সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এই রকমের একটি যন্ত্রণা, একটি দাহাসামন্য একটি ফুল ফোঁটানোর জন্যেও পৃথিবীকে, প্রকৃতিকে কত কষ্টই না সহ্য করতে হয়। গত রাত্রিতে ডিনার-এর সময় কী সুন্দরই না দেখাচ্ছিল তাঁকে! সন্ত্রস্ত চোখে আর ঠোঁট দুটি ফাঁক করে একটি উদ্বিগ্ন আনন্দ নিয়ে ক্লাবে ঠিক তাঁর মুখোমুখি বসে ছিলেন তিনি। বাতির লাল রঙের ঢাকনি থেকে রঙিন আলোর দ্যুতি তাঁর মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়ে গণ্ড দুটিকে গোলাপ রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে আলাপ করা আর একটি প্রথম শ্রেণির বেহালার ঝঙ্কার তোলার মধ্যে কোনো ফারাক নেই। প্রতিটি কথা আর ইঙ্গিতের উত্তর তিনি দিয়েছিলেন। প্রভাব বিস্তার করার মধ্যে একটি চরম দাসত্বের গন্ধ রয়েছে। আর কোনো কাজই বোধ হয় ঠিক এরকমাটি নয। এইভাবে নিজের আত্মাটিকে অপর একটি শরীরের মধ্যে অনুপ্রবেশ করিয়ে দাও। একটু অপেক্ষা কর, তারপরে কান পেতে শোন। যৌবনের আবেগে ঝক্ত হয়ে তোমারই চিন্তাধারা নতুনভাবে রূপায়িত হবে, নতুন তার ব্যঞ্জনা, দ্যোতনা নতুন। নিজের চিন্তাধারা আর একজনের ভাবরসে সিঞ্চিত হয়ে প্রকাশ পাওয়ার মধ্যে সুখকর বস্তু আর নেই। মনে হবে একটি অতীন্দ্রিয় সুবাসের জারক রসে সঙ্গীরিত হয়ে মধুর মোত তা একটু একটু করে ঝরে পড়ছে। আমাদের এই সীমিত, অশালীন যুগে, আত্মসর্বস্ব এবং দেহ আনন্দে যখন আমরা সবাই মতোয়ারা, সেই সময় এই রকম একটি অনুভূতি যে নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সত্যিই বড়ো অদ্ভুত এই ছেলেটি। বেসিল-এর স্টুডিওতে তার সঙ্গে লর্ড হেনরির নেহাৎ আকস্মিকভাবেই আলাপ হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিসের ভাস্কর্যের মতো তার গঠন, তার লালিত্যা বিশ্বে এমন কিছু নেই যা তাকে দিয়ে করানো যায় না। তাকে দিয়ে মহীরুহ সৃষ্টি করা যায় অথবা খেলার পুতুলের মতোও ব্যবহার করা যায় তাকে। এই সৌন্দর্য বিবর্ণ হয়ে যাবে–এটা কী দুঃখের কথা!

আর বেসিল! মনস্তত্ত্বের দিকে থেকে আর ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করা কত কৌতুককর। আর্টের নতুন আঙ্গিকস, জীবনকে দেখার নতুন রীতি তিনি কী সুন্দরভাবেই না ফুটিয়ে তুলেছেন। অথচ যার প্রতিকৃতির মধ্যে দিয়ে তিনি এই পরীক্ষা করলেন সে তা জানতেও পারল না। যে নির্বাক আত্মা এতদিন কুয়াশাচ্ছন্ন বনপ্রদেশে ঘুমিয়েছিল এবং উন্মুক্ত প্রান্তরে অদৃশ্যভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেই আত্মাটি যেন হঠাৎ বন্য-অন্সরীর মতো নিজেকে প্রকাশ করে দিল। এই আত্মাটিকে প্রকাশ করার জন্যে তিনি কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করেননি। কারণ তিনি জানতেন এরই মাধ্যমে অপরূপ সৃষ্টি সম্ভব, সেই আত্মার দ্যুতিতে পৃথিবীর যা কিছু সাধারণ তাই অসাধরণত্ব লাভ করে। অসাধারণত্ব লাভ করে সত্যিকার বাস্তবে রূপায়িত হয়। কী আশ্চর্য অনুভূতি-কী অপরূপ সৃজন দক্ষতা!

ইতিহাসে এরকম দৃষ্টান্তের কথা কোথায় যেন তিনি পড়েছিলেন। চিন্তাকুশলী প্লেটোই কি এই দহষ্কতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি? কিন্তু আমাদের দেশে এর নজির নেই। চিত্রকর বেসিল-এর কাছে নিজের অজ্ঞাতসারেই ডোরিয়েন গ্রে যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে ঠিক সেইভাবেই হেনরি তাকে প্রতিফলিত করবেন। তিনি তার ওপরে নিজের প্রভাব বিস্তার। করবেন, সম্পূর্ণভাবে অধিকার করবেন তার চিন্তার জগৎ। অর্ধেকটা তার প্রায় অধিকার করেই ফেলেছেন। সেই অনবদ্য আত্মাটিকে তিনি তাঁর নিজস্ব করে নেবেন। ভগবানের এই অদ্ভুত সন্তানটির মধ্যে রয়েছে একটি দুর্নিবার আকর্ষণ।

হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, চারপাশের বাড়িগুলির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তিনি তাঁর কাকিমার বাড়ি অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছেন, একটু হেসে তিনি ফিরলেন। কাকিমার থমথমে বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই বাটলার তাঁকে জানালেন যে সবাই লাঞ্চের ঘরে রয়েছেন। একটি চারককে তাঁর টুপি আর ছডিটা দিয়ে তিনি ডাইনিং ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

তাঁর দিকে মাথা নেড়ে আনট বললেন, হ্যারি, আজ-ও তোমার দেরি হয়েছে–স্বভাব যাবে কোথায়?

হেনরি একটা জুতসই কৈফিয়ৎ দিয়ে তাঁর পাশের ফাঁকা চেয়ারটায় বসলেন, চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন কে কে এসেছেন। টেবিলের একপ্রান্ত থেকে ডোরিয়েন তাঁর দিকে লজ্জিত ভাবে একবার তাকালেন। হ্যাঁ গালের ওপরে আনন্দের একটা মৃদু রেখা ফুটে উঠল। বিপরীত দিকে বসেছেন হার্লের ডাচেস পরিচিত মহলে ভদ্র বলে তাঁর পরিচিতি রয়েছে, এবং তাঁর শরীরের গঠন দেখে সমসাময়িক ইতিহাসকাররা ডাচেস নয় এই রকম সব মহিলাদের শক্ত-সমর্থ বলে রায় দেন। তাঁর পাশে, ডান দিকে বসেছেন স্যার টমাস বার্ডন। ইনি পার্লামন্টের ব্যাডিক্যাল সদস্য। বাইরের জগতে ইনি এঁর দলীয় নেতাকে অনুসরণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে অনুসরণ করেন পাকা রাঁধুনিদের চরিত্রের দিক থেকে বিজ্ঞ মানুষ এবং বহুল প্রচারিত বিভ্র নীতির মতোই তিনি খানাপিনা করতেন টোরিদের সঙ্গে, চিন্তা করতেন। লিবারেলদের মতো। তাঁর বাঁদিকের চেযাটিতে বসেছেন ট্রেডলির মিঃ এর্কস্কিন, সুন্দর। চেহারার সংস্কৃতিবান একটি বৃদ্ধ। চুপচাপ বসে আছেন তিনি, চুপচাপ থাকার কারণটা লেডি আগাথাকে তিনি একবার বলেছিলেন। কারণটি হচ্ছে তাঁর বলার আর কিছু নেই, যা বলার ছিল তা তিরিশ বছরের মধ্যেই তিনি বলে শেষ করে ফেলেছেন। হেনরির নিজের পাশে। বসেছিলেন মিসেলস ভ্যানডেলার, ভদ্রমহিলা তাঁর আনট-এর একজন পুরনো বন্ধু, মানুষ হিসাবে একেবারে খাঁটি সোনা। কিন্তু পোশাক-আশাকে এবং চেহারায় একেবারে নিকৃষ্ট। তাঁকে দেখে রদ্দি বাঁধাই একটি প্রার্থনার বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। তার কপাল ভালো যে সেই সময় লেডি আগাথা লর্ড ফডেল-এর সঙ্গে তখন তন্ময় হয়ে কথা বলেছিলেন। ভদ্রলোক মধ্যবয়শী, বুদ্ধির দিক থেকে মাঝামাঝি হাউস-অফ-কমনস-এ মন্ত্রীর ঘোষণার মতো যাঁর মাথাটা ছিল টোটো। একটা তন্ময় হয়ে দুজনে কথা বলছিলেন যেটা তাঁর মতে একটি বিশেষ ত্রুটি। প্রতিটি সৎ মানুষটা এই ত্রুটির শিকার এবং এর হাত থেকে মুখ কম মানুষই নিস্তার পেয়েছে।

টেবিলের পাশ থেকে তেরচাভাবে তাকিয়ে মিষ্টি সুরে ডাচেস তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, আমরা বেচারা ডার্টমুরের সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম, হেনরি। তোমার কি মনে হয় ডার্টমুরর এই কুহকিনী যুবতীটিকে সত্যিই বিয়ে করবে?

আমার বিশ্বাস, মেয়েটি ডার্টমুরকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে মনস্থির করে ফেলেছে, ডাচেস।

চিৎকার করে উঠলেন লেডি অগাথা, কী ভয়ঙ্কর! সত্যি বলছি, এ ব্যাপারে কারো না কারো প্রতিবাদ করা উচিত।

স্যার টমাস বার্ডান উদ্ধতভাবে বললেন, আমি খুব ভালো জায়গা থেকে শুনেছি, মেয়েটির বারার শুকনো খাবারের দোকান রয়েছে।

স্যার টমাস, আমার কাকা বলেছেন দোকানটা শুয়োরের মাংস প্যাক করার।

শুকনো খাবার! আমেরিকান শুকনো জিনিস বলতে কী বোঝাতে চাও তোমারা! বেশ উত্তেজিত ভাবে অবাক হয়েই ডাচেস তাঁর বড়ো বড়ো হাত দুটি তুলে প্রশ্ন করলেন।

কিঞ্চিৎ সঙ্কুচিত হয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আমেরিকান নভেল।

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন ডাচেস।

লেডি আঘাথা ফিস ফিস করে বললেন, ওর কথা তোমরা কেউ বিশ্বাস করো না। ও একবিন্দু সত্যি কথা বলে না।

র‍্যাডাক্যাল সদস্যটি বললেন, যখন আমেরিকান আবিষ্কার করা হল….।

এইটুকু বলার পরেই তিনি কিছু ক্লান্তিকর একঘেয়ে ঘটনার পরিবেশন করতে লাগলেন। এবং যে-সব কথকরা ঘটনার বিশদ বর্ণানায় ক্লান্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে তিনিও তাদের মতো তাঁর শ্রোতাদের ক্লান্ত করে তুললেন। ডাচেস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাধা দিয়ে বললেন, আমেরিকাকে যদি কেউ কোনো দিন আবিষ্কার না করত তাহলে কত ভালো হল। সত্যি বলছি, আমাদের মেয়েদের আর হিল্লে হবে না। এটা খুব অন্যায়।

মিঃ আরস্কিন বললেন, সম্ভবত আমেরিকা আদৌ আবিষ্কৃত হয়নি। আমার কথা যদি ধরেন তাহলে আমি বলতে পারি যে আমেরিকাকে আমরা সবেমাত্র দেখতে পেয়েছি।

ডাচেস সাধারণভাবে বললেন, তাই বুঝি? আমি কিন্তু আমেরিকার অধিবাসীদের কিছু কিছু দেখেছি। আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে তারা সত্যিই খুব সুন্দর। তাদের পোশাক-পরিচ্ছেদও বেশ ভালো। প্যারিস থেকেই তারা তাদের পোশাক তৈরি করায়। আমি যদি তা পারতাম!

স্যারা টমাস রসিকতা করে বললেন, এবং পুরনো পরিত্যক্ত রসিকতার বাণীতে তাঁর বিরাট আলমারি একবাসে ঠাসা। লোকে বলে, সৎ আমেরিকানরা মরার পর প্যারিসে যায়।

ডাচেস প্রশ্ন করলেন, বলেন কী? তাহলে মরার সময় খারাপ আমেরিকানরা কোথায় যায়?

লর্ড হেনরি আস্তে আস্তে বললেন, আমেরিকায়।

স্যার টমাস ভ্রূকুটি করলেন, লেডি আগাথাকে বললেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে, আমেরিকার বিরুদ্ধে আপনার ভাইপোর মনে কিছু ভ্রান্ত ধারণা বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে। সমস্ত দেশটা আমি গাড়িতে করে ঘুরেছি। অবশ্য ডায়রেকটাররাই সেই গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। এসব বিষয়ে ওরা বেশ ভদ্র। আমি আপনাদের নির্ভয়ে বলতে পারি যে আমেরিকাতে শেখার জিনিস অনেক রয়েছে।

মিঃ আরস্কিন করুণাভাবে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কিছু শেখার জন্যে আমাদের শিকাগোতে কি যেতেই হবে? আমার তো মনে হয় তার জন্যে যাওয়ার ঝক্কি পোষাবে না।

স্যার টমাস হাত নেড়ে বললেন, ট্রেডলির মিঃ আরস্কিনের ঘরে সারা পৃথিবী ঢোকানো রয়েছে। বাস্তববাদী আমাদের মতো মানুষ নিজেদের চোখে সব কিছু দেখতে চায়, বই পড়ে তাদের আশা মেটে না। আমেরিকানরা সত্যিকারের হৃদয়গ্রাহী মানুষ। তাদের কাজ অথবা কথার মধ্যে যুক্তিহীনতার স্থান নেই। আমার মতে ওইটিই তাদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। হ্যাঁ, মিঃ আরস্কিন, সত্যিকারের যুক্তিবাদী ওরা। আমি আপনাদের নিশ্চিতভাবে বলতে পারি বাজে কথা অথবা বাজে কাজের ধার দিয়ে তারা হাঁটে না।

লর্ড হেনরি বললেন, কী বিপদ, কী বিপদ! পাশবিক শক্তি আমি সহ্য করতে পারি, কিন্তু কঠোর যুক্তিবাদ আমার অসহ্য। এই যুক্তি ব্যবহার করার বিপক্ষে কিছু বলার নেই। কিন্তু যুক্তির রাজত্বে ওইটাই হচ্ছে নাভির তলায় আঘাত করার মতো অযৌক্তিক।

চটে লাল হয়ে স্যার টমাস বললেন, আপনার বক্তব্যটা আমার মাথায় ঢুকছে না।

মিঃ আরস্কিন হেসে বললেন, আমার মাথায় ঢুকছে, লর্ড হেনরি। ব্যারনেট যোগ দিলেন, প্যারাজকস্ অর্থাৎ কূটাভাস হিসাবে কথাটা একরকম সত্যি…

মিঃ আরস্কিন বললেন, কূটাভাস! ওঁর কথার মধ্যে কূটের আভাসটা কোথায় দেখলেন? আমার তা মনে হয়নি। হয়তো আপনার কথাই সত্যি। সত্যের রীতিটাই হচ্ছে কুটা সত্যকে যাচাই করতে গেলে আমাদের সরু শক্ত দডির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। সেই দডির ওপর দিয়ে নিশ্চিন্ত হেঁটে চলার নির্ভরতা অর্জন করতে পারলেই তবে আমরা সত্য উপলব্ধি করতে পারব।

লেডি আগাথা বললেন, হায় ভগবান, পুরুষরা কীরকম তর্ক করে দেখ! সত্যি বলছি, তোমরা কী সব তর্ক করছ তার কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না। আর হ্যারি, তোমার ওপরে আমি খুব বিরক্ত হয়েছি। আমাদের প্রিয় ডোরিয়েন গ্রেকে ইস্ট এন্ড ছেড়ে যাওয়ার জন্যে তুমি তাঁকে তাতাচ্ছে কেন? আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি এখানে তাঁর উপস্থিতি নিঃসন্দেহে মূল্যবান। এখানের সবাই তাঁর পিয়ানো বাজানো শুনেতে ভালোবাসে।

লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আমি চাই তাঁর বাজনা আমি শুনবো।

এই বলেই তিনি টেবিলের দিকে তাকালেন, ডোরিয়েন গ্রে-র সম্মতিনেক দৃষ্টির সঙ্গে চোখাচোখি হল তাঁর।

লেডি আগাথা বললেন, কিন্তু হোয়াইট চ্যাপেলের সবাই বড়ো কষ্ট পাচ্ছে।

লর্ড হেনরি কাঁধে ত্যাগ করে বললেন, দুঃখ ছাড়া সব জিনিসের ওপরেই আমার সহানুভূতি রয়েছে। ওই দুঃখবোধের ওপরে আমার কোনো সহানুভূতি নেই। কেউ যন্ত্রণা পেলে আভকাল মানুষরা তাকে সহানুভূতি জানায়। এটাই হচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর রকমের মানসিক ব্যাধি। মানুষের উচিত রঙ, সৌন্দর্য আর আনন্দের সঙ্গে সহানুভূতি জানানো। জীবনের দুঃখ সম্বন্ধে যত কম বলা যায় ততই ভালো।

স্যার টমাস গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, তবু জরুরি সমস্যাটা হচ্ছে ইস্ট এন্ড।

লর্ড হেনরি বললেন, ঠিক কথা। এ সমস্যা হচ্ছে দাসত্বের। ক্রীতদাসদের মনে ফুর্তি জাগিয়ে আমরা সেই সমস্যার সমাধান করতে চাই।

রাজনীতিবিদটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে আপনি কী করতে চান?

লর্ড হেনরি হাসলেন, এক আবহাওয়া ছাড়া ইংলন্ডে আর কিছুই আমি পরিবর্তন করতে চাই না। দার্শনিক চিন্তা করেই আমি খুশি। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে মানুষ সহানুভূতি খরচ করে করে একেবারে দেউলে হয়ে গিয়েছে, আমি তাই বিজ্ঞানের কাছে আবেদন রাখছি সে যেন মানুষকে ঠিক পথে চালিত করে। উচ্ছ্বাস-আবেগের সুবিধে হচ্ছে এ মানুষকে বিপদে পরলিচালিত করে, আর বিজ্ঞানের সুবিধে হচ্ছে তার কাছে উচ্ছ্বাসের কোনো দাম নেই।

মিসেস ভ্যানডেলর ভয়ে ভয়ে বলেন, কিন্তু আমাদের দায়িত্বও বড়ো কমন নয়।

লেডি আগাথা সমর্থন করলেন তাঁর কথা: গুরু দায়িত্ব।

লর্ড হেনরি মিঃ আরস্কিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, মানুষ নিজের অত্যন্ত সিরিয়াস জীব বলে মনে মনে করে। এইটি হচ্ছে পৃথিবীর আদি পাপা গুহাবাসী মানুষ যদি হাসতে জানত তাহলে মানুষের ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হত।

ডাচেস মিষ্টি সুরে বললেন, তোমার কথায় সান্ত্বনা পেলাম। তোমর আট-এর সঙ্গে দেখা করতে আসার সময় আমি নিজেকে অপরাধিনী মনে করতাম, কারণ ইস্ট এন্ডের ওপরে আমার কোনো মোহ ছিল না। ভবিষ্যতে কোনো রকম লজ্জিত না হয়েই আমি তাঁর মুখের দিকে চাইতে পারব।

লর্ড হেনরি বললেন, একটুখানি লজ্জা ভালোই দেখাবে, ডাচেস।

তিনি উত্তর দিলেন, সে কথা ঠিক, তবে ও জিনিসটা যৌবনেই ভালো মানায। আমার মতো বৃদ্ধার গাল যখন লজ্জায় লাল হয়ে যায় তখন দেখবে কুৎসিতই লাগে। হায়, লর্ড হেনরি, কী করে আবার যৌবন ফিরিয়ে পাওয়া যায় তা যদি আপনি আমাকে বলতে পারতেন!

একটু চিন্তা করে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আচ্ছা ডাচেস, পূর্ব জীবনে আপনি কোনো দিন খুব বড়ো ধরনের ভুল করেছিলেন?

ডাচেস বললেন, একটা নয়, অনেক।

লর্ড হেনরি বেশ গম্ভীরভাবেই বললেন, তাহলে সেই ভুলগুলি আবার করুন। যৌবন ফিরে পেতে প্রথম জীবনের সব ভুলগুলি আবার আবার আপনাকে করতে হবে।

চিৎকার করে উঠলেন ডাচেস, চমৎকার নীতি! ওই নীতিটাকে আবার আমাকে খাটাতে হবে।

স্যার টমাসের পাথর-চাপা ঠোঁটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কথাটা, অতি বিপজ্জনক নীতি!

লেডি আগাথা ঘাড় নাড়লেন, কিন্তু তিনিও খুশি না হয়ে পারলেন না। মিঃ আরস্কিন শুনলেন কথাগুলি।

লর্ড হেনরি তাঁর পূর্ব কথার ডেজর টানলেন, হ্যাঁ, জীবনের গোপন রহস্যগুলির মধ্যে এ হচ্ছে একটি। আজকাল একটি নিঃশব্দ সঞ্চারী সাধারণ জ্ঞানের কবলে পড়ে অধিকাংশ মানুষই মারা যায়, তারা অনেক দেরিতে আবিষ্কার করে যে মানুষ যেগুলির জন্যে অনুতাপ করে না। সেগুলি হচ্ছে তাদের ভুল।

সারা টেবিল জুড়ে হাসির বন্যা বয়ে গেল।

কথাটা নিয়ে খেলতে লাগলেন তিনি, ইচ্ছে করেই লোফালুফি করতে লাগলেন। একটি অর্থহীন চিন্তাকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগলেন নানাভাবে-কল্পনার রঙে তুলতেন রাঙিয়ে, উড়িয়ে দিলেন আপাতবিরোধী সত্যের ডানায়। তাঁর আবেগের উচ্ছ্বাসে মূর্খতার স্তুতি দার্শনিক তত্ত্বে রুপান্তরিত হল। তারুণ্যের উন্মাদনায় সেই দর্শন জীবনের চড়াই-এর ওপরে মনের আনন্দে নৃত্য করতে লাগল। জীবনের বাস্তব ঘটনাগুলি তার সামনে থেকে অরণ্যের পশুর মতো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লাগল পালাতে মনে হল যেন একটা অদ্ভুত অপরিকল্পিত কবিতা স্বতঃ উৎসারিত হয়ে তার মুখের মধ্যে থেকে ঝরে পড়ছে। তাঁর মনে হল ডোরিয়েন গ্রে-র চোখ তাঁর দিকে নিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সমবেত শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে এমন একডনি রয়েছেন যাঁকে তিনি মুগ্ধ করতে চান, এই সজাগ অনুভূতির ফলে তাঁর বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, কল্পনা হয়ে উঠল রঙিন। অপরিসীম চাতুরির মায়াজাল বিস্তার করে তিনি সবাইকে আপহষ্ক সমর্থনে বিভ্রান্ত করে দিলেন। এবং তাঁরাও সকলে হাসতে হাসতে তাঁকে সমর্থন জানালেন। ডোরিয়েন গ্রে একদৃষ্টি দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন, যতক্ষণ লর্ড হেনরি কথা বলছিলেন ততক্ষণ তিনি চোখ দুটি অন্য পাশে সরাতে পারেননি। মনে হল একটি সম্মোহন মন্ত্র এসে তাঁকে একবারে গ্রাস করে ফেলেছে, অভিভুত করেছে তাঁকে। মাঝে মাঝে দুজনের স্মিত হাসি দুজনকেই অভিবাদন জানাতে লাগল। এবং ডোরিয়েনের কালো চোখের তারা দুটি একটি গভীর আবেদনা মুহ্যমান হয়ে পড়ল।

অবশেষে বাস্তব জগতে ফিরে এল সবাই। যুগের উপযোগী পোশাক পরে একটি চাকর ঘরে ঢুকে ডাচেসকে সবিনয়ে জানাল যে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তাঁর গাড়িটি দরজার সামলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত সুব্ধ হয়েছেন এই রকম ভান করে নিজের হাত দুটো। মুচড়ে বললেন, কী জ্বালা! আমাকে এবার যেতেই হবে। ক্লাব থেকে আমার স্বামীকে তুলে নিতে হবে। উইলিস রুমস-এর ‘কাজ নেই তো খই ভাজ’ মিটিং-এ যোগ দিতে যাবেন তিনি। একটু দেরি হলেই তিনি রেগে বোম হয়ে যাবেন। আমি তাঁর সঙ্গে রাগারাগি বা হইচই করতে চাইনি। শক্ত কথা বললে তাঁর মাথাটা বিগড়ে যাবো না, না, আর আমি অপেক্ষা করতে পারব না। আমাকে যেতেই হবে। ডিযার আগাথা বিদায়, লর্ড হেনরি, তোমার কথা শুনে খুব আনন্দ হল আমারা ভয়ঙ্কর রকমের দুর্নীতির একটি ডিপো তুমি তোমার মতবাদের বিরুদ্ধে যে কী বলব তা আমিই জানি না। একদিন রাত্রিতে আমাদের সঙ্গে ডিনার খেতে এস, আগামী মঙ্গলবার, ওই দিন কি ডিনার খাওয়ার জন্যে কাউকে কথা দিয়েছে?

ঘাড়টা কিঞ্চিৎ নত করে লর্ড হেনরি বললেন, আপনার জন্যে ডাচেস সকলকে আমি সাময়িকভাবে পরিত্যাগ করব।

ডাচেস বললেন, সুন্দর কথা, সেই সঙ্গে অন্যায়ও। যাই হোক, আমি ধরে নিলাম তুমি আসছ, আগামী মঙ্গলবার।

এই বলেই তিনি ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন, লেডি আগাথা এবং অন্যন্য মহিলারা তাঁকে এগিয়ে দিতে পিছু পিছু গেলেন।

লর্ড হেনরি আবার বসে পড়লেন। মিঃ আরস্কিল নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন, লর্ড হেনরির কাছে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। একটা হাত তাঁর হাতের ওপরে রেখে বলেলন, আপনার কথা শুনলে আর বই পড়তে ইচ্ছে করে না। আপনি বই লেখেন না কেন? আমি বই পড়তে এত ভালোবাসি যে বই লেখার কথা ভাবার সময় পাইনে, মিঃ আরস্কিন। আমার একখানা উপন্যাস লেখার নিশ্চয় বাসানা রয়েছে। উপন্যাসটি হবে পার্শিয়ান। কার্পেটের মতো ঝলমলে, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তার এতটুকু সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু পড়বে কে? আজকাল ইংলন্ডের পাঠক-পাঠিকারা পড়েন কেবল খবরের কাগছে, আর এনসাইক্লোপিডিয়া। পৃথিবীর মধ্যে ইংরেজরাই বোধ হয় একমাত্র জাত সাহিত্যের সৌন্দর্য বলতে ঠিক কি বোঝায় সে-সম্বন্ধে যাদের ধারণা নেই বললেই হয়।

মিঃ আরস্কিন বললেন, আমার মনে হয় আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। আমারও একসময় সাহিত্যিক হওয়ার বাসানা ছিল, কিন্তু সেই বাসনাকে অনেক দিন আগেই আমি পরিত্যাগ করেছি। কিন্তু প্রিয় বন্ধু, যদি অবশ্য বন্ধু বলে আপনাকে সম্বোধন করার অনুমতি দেন, একটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করি, আজকে লাঞ্চের সময় যেসব কথা আপনি বললেন, সেগুলি কি আপনি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন?

লর্ড হেনরি হেসে বললেন, তখন কি বলেছিলাম তা আমার মনে নেই। সত্যিই কি আমার কথাগুলো খুব খারাপ লাগছিল আপনাদের?

সত্যিই খুব খারাপা আমার বিশ্বাস আপনার সঙ্গে কথা বলা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমাদের প্রিয় ডাচেসের শেষ পর্যন্ত কোনো ক্ষতি হয় তাহলে তার জন্যে আমরা আপনাকেই মূলত দায়ী করব। কিন্তু সে কথা থাকজীবন সম্বন্ধে আপনি কি বোঝেন সেই সম্বন্ধে কিছু আপনার মুখ থেকে আমি শুনতে চাই। যে-যুগে আমি ভন্তোছি সে যুগটা বড়ো বিরক্তিকর। কোনোদিন যদি লন্ডনের আবহাওয়ায় আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন তাহলে বিনা দ্বিধায় ট্রেডলেতে চলে আসবেন। আমার স্টকে কিছু প্রথম শ্রেণির বার্গেন্ডি সুরা রয়েছে। তারই গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে জীবনদর্শন বলতে আপনি কী বোঝেন তাই শোনা যাবে।

খুব খুশি হব আমি। সেদিনের আশায় দিন গুনবো আমি। ট্রেজলের আতিথ্যই কেবল প্রথম শ্রেণীর ন্য, আমি জানি আপনার লাইব্রেরিটিও উৎকৃষ্ট।

ভদ্রভাবে এবং ভদ্রসমাজের রীতি অনুযায়ী বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি তাঁর মাথা কিঞ্চিৎ অবনত করে বললেন, আবনি তাদের পূর্ণ করবেন। এখন আপনার ওই অতিথিবৎসলা আনটা-এর কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে। এখন আমার অ্যাথিনিযাম-এ যাওয়ার কথা। এইখানেই আমরা ঘণ্টাখানেক দিবানিদ্রা উপভোগ করি।

মিঃ আরস্কিন, আপনারা সবাই?

চল্লিশজন, চল্লিশটি আরাম কেদারায় চুপচাপ বসে থাকি আমরা। ‘ইংলিশ অ্যাকাডেমি অফ লেটারস’-এর সভ্য হওয়ার জন্য ওইখানেই আমাদের প্রস্তুতি চলে।

হাসলেন লর্ড হেনরি, তারপরে উঠে বললেন আমি পার্কে যাচ্ছি।

দরজার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ডোরিয়েন গ্রে তাঁকে আলতো ভাবে ধরে ফিসফিস করে বললেন, আমিও যাব।

কিন্তু আমি ভেবেছিলাম বেসিল হলওয়ার্ডের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে আপনার।

আপনার সঙ্গেই আমি যেতে চাই। হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। আপনি অমত করবেন না। কথা দিন সব সময় আমার সঙ্গে আপনি কথা বলবেন? আপনার মতো অত সুন্দর কথা আর কেউ বলতে পারবে না।

লর্ড হেনরি হেসে বললেন, আজ আমি অনেক কথা বলেছি। এখন আমি আসল জীবনটা কী তাই দেখতে চাই। আপনি আমার সঙ্গে আসতে পারেন, এবং ইচ্ছে হলে আমার চোখ দিয়ে রক্তমাংসের মানুষ বলতে কী বোঝায় তা-ও পারেন দেখতে।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

মাসখানেক পরের কথা। সময় অপরাহ্ন। মে ফেয়ারে লর্ড হেনরির যে বাড়ি ছিল তারই ছোটো লাইব্রেরিতে একটি মোটা গদি-আঁটা ইজিচেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে আরাম করে বসেছিলেন ডোরিয়েন গ্রে। বলতে গেলে ঘরটি বড়ো চমৎকার। ভেতরের খিলানগুলি ওক কাঠের তক্তা দিয়ে আঁটা, এর পীত রঙের কারুকার্য করা কার্নিশ, পলেস্তারা করা উঁচু ছাদ আর মেঝে পার্শিয়ান কার্পেটি দিয়ে মোড়া। ছোটো মাটিন কাঠের টেবিলের ওপরে ক্লডিনের তৈরি একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার পাশে পড়ে রয়েছে লা সাঁৎ নোভেলার একটি কপি, ক্রোভিস ইভ ভ্যালয়-এর মার্গারেটর এটি বেঁধেছেন চারপাশে ডেইডি ফুলের রঙ দিয়ে ছোপানো, রানি এই রঙটিই বড়ো পছন্দ করতেন।

কতকগুলি বড়ো বড়ো নীল রঙের চিনা জার আর প্যারটফুলের গুচ্ছ সাজানো রয়েছে অগ্নিকুণ্ডের ওপরে কারুকাজ করা তাকে। গ্রীষ্মকালে লন্ডনে কমলালেবু রঙের আলো জানালার ভেতর দিয়ে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

লর্ড হেনরি তখনো ফেরেননি। সব সময়েই তিনি দেরি করে ফিরতেন। তাঁর মতে সমযানুবর্তিত হচ্ছে সময়-অপহারক। সেই জন্য ডোরিয়েন গ্রে উদাস দৃষ্টিতে বসেছিলেন মাঝে মাঝে চিত্রবহুল ম্যানন লেকট-এর একখানি বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। ঘড়ির অবিরাম টিক টিক শব্দ একঘেয়ে সুরে একটি বিরক্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। ঘর থেকে চলে যাওয়ার জন্যে দু-একবার চেষ্টাও তিনি করেছিলেন।

অবশেষে দরজার বাইরে কার যেন পায়ের শব্দ হল, দরজা খুলে গেল। তিনি একটু বিরক্তির সুরে বললেন, হ্যারি, কত দেরি করলে বল তো!

তারপরেই তিনি চকিতে একবার আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে ক্ষমা করুন, আমি ভাবছিলাম…

আপনি আমাকে আমার স্বামী বলে ভুল করেছিলেন। আমি তাঁর স্ত্রী মাত্র। আমি নিজেই আমার পরিচয় দিচ্ছি। আপনার ছবি দেখেছি, সেই থেকেই আমি আপনাকে চিনি। আমার স্বামীর কাছে আপনার সতেরখানা ফটো রয়েছে।

লেডি হেনরি, সতেরখানা নয়।

তাহলে, আঠারখানা। সেদিন অপেরাতে তাঁর সঙ্গে আপনাকে আমি দেখেছি।

কথা বলতে বলতে তিনি একটু হাসলেন, সেই হাসিতে একটু ভডত ছিল, হাসতে হাসতে তাঁর সেই ভুলো-না-আমায় চোখ দুটি দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। অদ্ভুত মহিলা এই লেডি হেনরি। তাঁর পোশাক দেখলে মনে হবে সেগুলি তাঁর মানসিক অব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যে তৈরি হয়েছে পরিধানের মধ্যেও বেশ হঠকারিতার লক্ষণ বিদ্যমান। সাধারণত সব সময়েই কারো না কারো সঙ্গে তিনি প্রেমে পড়েন এবং প্রতিদিন না পাওয়ার ফলে তিনি সব সময়েই ভ্রান্তির স্বপ্নে মশগুল হয়ে থাকেন। নিজেকে অপরুপা করে সাজানোর জন্যে চেষ্টার অন্ত ছিল না তাঁর, কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। তাঁর নাম ভিকটোরিয়া, গির্জায় যাওয়াটা তাঁর একটা ঝোঁকে পরিণত হয়েছিল।

আপনি বোধ হয় লোহেন গ্রিন-এর কথা বলছেন, তাই না, লেডি হেনরি?

হ্যাঁ। আমার প্রিয় লহেন গ্রিন-এর কথাই বলছি। ওযাগনারের সঙ্গীত আমার খুব ভালো লাগে। সত্যি কথা বলতে কি অত ভালো আর কারো সুরই আমার লাগে না। এ গালের লয় এত চড়া যে নিবিবাদে কথা বলা যায়, পাশের লোক সেকথা শুনতে পায়না। চড়া গানের সুবিধে এইখানে, তাই না, মিঃ গ্রে?

সেই একই রকমের ভীরু হাসি তিনি হাসলেন, তাঁর পাতলা ঠোঁট দুটি ফাঁক হল। কচ্ছপের খোলা দিয়ে তৈরি লম্বা একটা কাগজকাটা ছুরি তিনি আঙুলের মধ্যে ধরে নাড়াতে লাগলেন।

ডোরিয়েন হেসে তাঁর মাথা নাড়লেন, লেডি হেনরি, আমার তা মনে হয় না। গানের সময় আমি কথা বলি না। বিশেষ করে গান যদি ভালো হ্য। গান খারাপ হলে শ্রোতাদের কর্তব্য হচ্ছে চেঁচিয়ে সেই গান মহৎ করে দেওয়া।

ওঃ, এটা হ্যারিরই একটি মত, তাই না মিঃ গ্রে? হ্যারির সমস্ত মত-ই আমি তার বন্ধুদের মুখ থেকে শুনতে পাই। তার মত ডানার এইটিই আমার একমাত্র উপায। কিন্তু আপনি নিশ্চয়। ভাববেন না। আমি ভালো গান পছন্দ করি না। ভালো গানকে আমি খুব প্রশংসা করি। কিন্তু ভয়-ও পাই যথেষ্ট। আমাকে এ অতিমাত্রায় কল্পনাবিলাসিনী করে তোলে। আমি। পিয়ানোবাদকদের পুডো করি বলতে পারেন, কখনো কখনো দুজনকে–হ্যারি সেই কথাই আমাকে বলে। তাঁদের মধ্যে কী রয়েছে তা আমি জানি না, হয়তো তাঁরা বিদেশি বলে। ভালো পিয়ানো বাজিয়েদের সবাই বিদেশি, তাই না? এমন কি যাঁরা ইংলন্ডে জন্মনি তাঁরাও একটা সময় পরে বিদেশি হয়ে যান। তাই না? তাঁরা অতি বুদ্ধিমান, এবং ললিতকলার পল্কে সেটা বেশ গৌরবের কথা। এই ধরনের রীতি বাজিয়েদের সর্বজনীন করে তোলে। আপনার তাই মনে হয় না? মিঃ গ্রে, এই ধরনের কোনো মজলিসে আপনি কখনো গিয়েছেন? আপনার যাওয়া উচিত। ওর্কিড কেনার সামর্থ্য নেই আমার, কিন্তু বিদেশিদের জন্য কিছু খরচ করতে কার্পণ্য করি না আমি। তাঁদের উপস্থিতি ঘরকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে। কিন্তু হ্যারি এসে পড়েছে। হ্যারি, তোমার খোঁড়ে আমি এই ঘরে ঢুকেছিলাম, তোমার সঙ্গে কিছু দরকার ছিল আমার, কী দরকার ছিল তা আমি ভুলে গেছি তোমার পরিবর্তে মিঃ গ্রে-কে দেখলাম। সঙ্গীত সম্বন্ধে আমাদের বেশ চমৎকার আলোচনা হচ্ছিল এতক্ষণ আমাদের ধারণা প্রায় একই। না, না। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে আমাদের মতবাদ পৃথক। কিন্তু আমার সঙ্গে আলোচনা করে উনি খুব খুশি হয়েছেন। ওঁকে দেখে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি।

বাঁকানো অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভুরু তুলে, এবং দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে লর্ড হেনরি বললেন, আমিও খুব খুশি হয়েছি, প্রিয়তমে। দেরি হল বলে আমি অত্যন্ত দুখিত, ডোরিসেনা ওয়ার্ডোর স্ট্রিটে একটা পুরনো ব্রকেডের তল্লাশে যেতে হয়েছিল আমাকে, এবং দর কষাকষি করতে। অনেকটা সময় নষ্ট হল আমার। আজকাল সবাই জিনিসের বাডার দরটাই ডালে, কোনো জিনিসের মূল্যবোধ বলতে তাদের কোনো জ্ঞান নেই।

হঠাৎ একটু বোকার মতো হেসে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ভেঙে দিলেন লেডি হেনরি, বললেন, আমাকে এখনি বাইরে যেতে হব। ডাচেসকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছি আমি। মিঃ গ্রে, হ্যারি, আমি চললাম। সম্ভবত তুমিও বাইরেই ঘাচ্ছ? আমিও। সম্ভবত লেডি থ্রেবেরির বাড়িতে আমাদের দেখা হবে।

দরজাটা বন্ধ করতে করতে লর্ড হেনরি বললেন, আমারও তাই মনে হচ্ছে।

ঘরের মধ্যে মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে লেডি হেনরি লঘু পদক্ষেপে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন, মনে হল, সারা রাত্রি ধরে বৃষ্টিতে ভিজে স্বর্গের একটা পাখি আটকে পড়েছিল, হঠাৎ দূরজা খোলা সেযে সে তীব্র বেগে উড়ে গেল। দরজা বন্ধ করে একটা সিগারেট ধরালেন লর্ড হেনরি। তারপরে সোফার ওপরে বসে পড়লেন।

সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, কটা চুল রয়েছে এরকম কোনো মহিলাকে তুমি বিয়ে করো না, ডোরিয়েন।

কেন বল তো?

তারা বড়ো ভাবপ্রবণ হয়।

কিন্তু ওই জাতীয় মানুষকেই যে আমার ভালো লাগে, হ্যারি।

কক্ষনো বিয়ে করো না। মানুষ বিয়ে করে কেন? কারণ তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কারণ তাদের কৌতূহল থাকে যথেষ্ট। এই জাতীয় মহিলাদের বিয়ে করলে দু’দিক থেকেই তাদের নিরাশ হতে হয়।

হেনরি আমার বিয়ে করার সম্ভাবনা বড়ো কম। আমি একজনকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। এই অদ্ভুত যুক্তি অবশ্য তোমারই সেইটাই আমি বাস্তব ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে যাচ্ছি, ঠিক অন্যান্য বিষয়েও আমি যেমন তোমার উপদেশ মতো চলার বা করার চেষ্টা করি।

একটু থেকে হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে তুমি ভালোবেসেছ?

লজ্জা পেয়ে ডোরিয়েন বললেন, একজন অভিনেত্রীকে।

লর্ড হেনরি কথাটাকে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে কাঁধে একটা শ্রাগ করে বললেন, এটা একটা সাধারণ রোমান্স ছাড়া আর কিছু নয়।

তাকে দেখলে তুমি একথা বলতে না, হ্যারি।

তার পরিচয়?

তার নাম সাইভিল ভেন।

ওরকম নাম তো কখনো শুনিনি।

কেউ শোনেনি, তবে একদিন সবাই শুনবে। মেয়েটি অভিনয় জগতে একটি জিনিস।

শোন বালক, শোল। কোনো নারীই কোনোদিন ডিসি–এর পর্যায়ে পড়তে পারে না। নরলোকে ওরা অলঙ্করণের পূজারিণী। কোনোদিনই ওদের বলার কিছু থাকে না, কিন্তু সেই কথাটাই ওরা বেশ মিষ্টি করে ললিতকলার ছন্দে বলে যায়। পুরুষরা যেমন নীতির ওপরে মননকে প্রাধান্য দেয়, নারীরা তেমনি প্রাধান্য দেয় মনের ওপরে নিছক বস্তুকে।

হ্যারি, এই রকম কথা বলছ কী করে?

প্রিয় বন্ধু, যেমন করেই বলি, কথাটা সত্যি। বর্তমানে আমি নারীচরিত্র বিশ্লেষণ করছি। সুতরাং নারীচরিত্র বলতে কী বোঝা যায় তা আমার জানা উচিত। বিশ্লেষণ করে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে নারী মূলত দুটি শ্রেণির সাধারণ এবং রঙিনা সাধারণ অর্থাৎ ঘরোয়া মহিলারা প্রয়োজন মেটানোর দিক থেকে উৎকৃষ্ট। তুমি যদি সমাজে সম্ভ্রম পেতে চাও তাহলে এই শ্রেণির একটি মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢোক। অন্য শ্রেণির মহিলারা দেখতে সুন্দরী, কিন্তু তারা একটা ভুল করে। নিজেদের যুবতী বলে জাহির করার জন্যে তারা অতিমাত্রায় প্রসাধন করে। আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা প্রসাধন করতেন সুন্দর করে কথা বলার জন্যে। রুভ-পাউডারের সঙ্গে তখন মেশানো থাকত বুদ্ধিদীপ্ত বাক্যবিন্যাসের কলাকৌশল। কিন্তু সে যুগকে আমরা আজ হারিয়েছি। আজকাল মহিলারা খুশি হয় কিসে জান? যদি তারা নিজেদের ব্যসটাকে তাদের মেয়েদের বয়সের চেয়ে দশটা বছর কমিযে। আনতে পারে। আর বাচনভঙ্গির কলাকৌশলের কথা যদি ধর তাহলে আমি বলব যে বর্তমানে সারা লন্ডন শহরে ওই ডাতীয়া মহিলা মাত্র পাঁচজন রয়েছেন। এবং সেই পাঁচজনের মধ্যে দুজনকে কোনো সভ্য, বিদগ্ধ সমাজে বার করা যায় না। সে যাক গে, এখন তোমার ওই ভিনিযাসটির সম্বন্ধে আমাকে কিছু বল। কদিন তোমাদের আলাপ হয়েছে?

হায় হ্যারি, তোমার কথা শুনে আমার ভয় লাগছে।

ওকথা বাদ দাও। কদ্দিন তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তোমার?

তিন সপ্তাহের কাছাকাছি।

তার সঙ্গে তোমার দেখা হল কোথায়?

তোমাকে আমি সব বলছি, হ্যারি। কিন্তু আমার কাহিনি শুনে তুমি নির্দযের মতো হাসবে না। অবশ্য তোমার সঙ্গে পরিচয় না হলে এ সমস্যা আমার কোনোদিনই দেখা দিত না। জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ভালো করে দেখার একটা উন্মাদ কামনা তুমিই আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার পরে অনেকদিন আমার শিরায়-শিরায় কৌতূহলের ঢল নেমেছিল। পার্কে ঘুরতে ঘুরতে অথবা পিকাডেলির পথে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে বেড়াতে বেড়াতে একটা উদগ্র বাসনা নিয়ে, একটি অপ্রতিরোধ্য কৌতূহল নিয়ে পথচারী প্রতিটি মানুষের দিকে আমি তাকিয়ে থাকতাম। কী ভাবে তারা বেঁচে রয়েছে তাই অনুসন্ধান করে বেড়াতাম। কেউ কেউ আমাকে মুগ্ধ করেছিল, কেউ কেউ বা আমাকে করে তুলেছিল ভয়ার্ত। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল লক্ষ লষ্ক বিষের অতি মনোরম কণিকা। উন্মাদ উচ্ছ্বাসের। ওপর আমার কেমন যেন একটা ঝোঁক ছিল।…তারপরে একদিন সন্ধ্যায় জীবনের সম্বন্ধে নতুন কোনো অভিজ্ঞতা সঞ্চযের উদ্দেশ্যে আমি বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। আমি মনে করেছিলাম আমাদের এই ধোঁয়াটে রঙের দানব লন্ডন শহর কেবল বহু বিচিত্র মানুষেরই আবাসস্থল নয়, আদর্শহীন পাপী আর গৌরবময় পাপে একেবারে বোঝাই। লন্ডনের এই ব্যাখ্যা অবশ্য তোমারই। ভেবেছিলাম এ-হেন লন্ডন শহর আমার জন্যে কিছু সঞ্চয় করে রেখেছে হাজার রকমের কল্পনায় মন আমার উদ্বেলিত হয়ে উঠল। নিছক বিপদের সম্ভাবনা আমাকে উৎসাহিত করল। সে চমৎকার রাত্রিতে আমরা দুজনে একসঙ্গে প্রথম ডিনার খেলাম সেদিন। তুমি আমাকে যা বলেছিল তা আমার মলে ছিল। ঠিক কী চাইছিলাম তা আমি জানতাম না, কিন্তু আমি বেরিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে পূর্বদিকে হাঁটতে হাঁটতে শেষ পর্যন্ত আমি। শক্ত দৈত্যদীঘল গাছ, কালো আর রুক্ষ পার্কের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। সাড়ে আটটার কাছাকাছি আমি একটা কিম্ভুতকিমাকার ছোটো থিয়েটারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, বড়ো বড়ো গ্যাসের আলো আর মোটা মোটা হরফে লেখা পোস্টারে ঝকমক করছিল তার দেওয়ালগুলি। একটি বিরাটাকার জু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সস্তাদামের সিগার খাচ্ছিল। তার গায়ের ওপরে ওয়েস্ট কোট দেখে আমার হাসি পাচ্ছিল। আসল কথা, ওরকম পোশাক জীবনে আর কখনো আমার চোখে পড়েনি। তার আঙুলে একটা তেল চিটচিটে ছোটো আঙটি, একটা। নোংরা শার্টের মাঝখানে বিরাট একটা হিরে বসালো। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে জিজ্ঞাসা করল, মি লার্ড, একটা বক্স চাই? এই কথা বলেই দাসত্বের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে। আমাকে অভিবাদন জানানোর উদ্দেশ্যে সে তার টুপিটা খুলে ফেলল। হ্যারি, লোকটির মধ্যে এমন একটি জিনিস ছিল যা আমার কাছে বেশ কৌতুকপ্রদ বলে মনে হয়েছিল। চেহারার দিক থেকে মানুষটা একেবারে দৈত্যবিশেষ। বুঝতে পারছি আমার কথা শুনে মনে মনে তুমি হাসছ, কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই ভেতরে ঢুকে এক গিনি খরচ করে একটা বক্সের টিকিট কিনে ফেললাম। কেনই বা ওই থিয়েটারে ঢুকলাম, আর কেনই বা অত দামের টিকিট কিনলাম তা আমি আজও বুঝতে পারছি না, তবু একথাও সত্যি যে আমি যদি সেদিন না যেতাম, সত্যি বলছি হ্যারি, তাহলে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রোমান্স থেকে বঞ্চিত হতাম আমি। দেখতে পাচ্ছি আমার কথা শুনে তুমি হাসছ। ভারি অন্যায়, ভারি অন্যায়।

না ডোরিয়েন, আমি হাসছি না, অন্তত তোমাকে উপহাস করার জন্যে হাসছি না। কিন্তু তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রোমান্স বলে ওটিকে চিহ্নিত করো না। বরং বল, ওটি তোমার জীবনের প্রথম রোমান্স। সব সময়েই তোমাকে কেউ না কেউ ভালোবাসবে, তুমি ভালোবাসবে কাউকে না কাউকে করার মতো কোনো কাজ যাদের হাতে থাকে না এই রকম উচ্ছ্বাসের শিকার হওয়ার নৈতিক অধিকার নিশ্চয় তাদের রয়েছে। দেশের অলস শ্রেণির ওইটিই একমাত্র কাজ। ভয় পেযো না। অনেক অপরূপ সুন্দর জিনিস তোমার জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছে। এই তো সবে শুরু।

চটে উঠলেন ডোরিয়েন গ্রে, একটু চেঁচিয়েই বললেন, তোমার ধারণা আমার চরিত্র এতখানি খেলো, অগভীর?

না, আমার মনে হয় তোমার চরিত্র সত্যিকারের গভীর।

অর্থাৎ?

প্রিয় বালক, অবধান করা যারা জীবনে একবার মাত্র প্রেমে পড়ে সত্যিকারের অগম্ভীর হচ্ছে তারা। যে জিনিসটাকে তারা আনুগত্য অথবা আস্থা বলে, আমার মতে সেটা হয় সামাজিক আলস্য, অথবা সুস্থ চিন্তার অভাব। বুদ্ধিজীবীদের কাছে চারিত্রিক দৃঢ়তা যা, উচ্ছ্বাসম্য। মানুষের কাছে বিশ্বাসের দাম তাই। দুটিই পরাজযের কলঙ্ক ছাড়া অন্য কিছু নয়। বিশ্বাস! ওটা নিয়ে বিশদ আলোচনা একদিন আমাকে করতেই হবে। এর ভেতরে রয়েছে কিছু হাতিয়ে নেওয়ার প্রয়াস। পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস রয়েছে যেগুলিকে আমরা অবহেলায় ছুঁড়ে। ফেলে দিতে পারি, ফেলে দিই না এই ভয়ে যে অন্য লোকে হয়তো সেগুলি কুড়িয়ে নেবে। কিন্তু তোমাকে আমি বাধা দিতে চাই না তোমার গল্পটা বলে যাও।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম: আমি একটা বিশ্রী ছোটো বক্সের ওপরে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বসলাম। একটা নোংরা পর্দা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল। পর্দার আড়াল থেকেই ঘরটাকে আমি পরীক্ষা করে দেখছিলাম। বিবাহের নিকৃষ্ট কেকের মতো ঘরটা খুবই চটক দিয়ে সাজানো, গ্যালারি আর নীচেটা মোটামুটি ভর্তি ছিল কেবল খালি ছিল সরু সরু দু’সারি বিবর্ণ স্টল। আর ড্রেস সার্কেলে একজন দর্শকও আমার চোখে পড়েনি। কমলালেবু আর ডিনডার ব্যিার। নিয়ে মহিলারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারপাশে বাদামের ছাড়ানো খোলায় একেবারে ভরপুর। ব্রিটিশ নাটকের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

আমারও তাই মনে হয়, কিন্তু মন-মেজাজ একেবারে বিগড়ে দেয়। নাটকের নাম শুনে তো আমি অবাক। এ কী কাণ্ড! কী অভিনয় হচ্ছিল বল তো, হ্যারি?

আমার ধারণা, নাটকের নাম হয় ‘ইডিযট বোয়’ অথবা ‘ডাম্ব বাট ইনোসেন্ট’। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ওই রকম নাটকই পছন্দ করতেন বেশি। যতই দিন যাচ্ছে ডোরিয়েন, ততই বুঝতে পারছি বাপ-কাকা-জেঠাদের কাছে যেটা ভালো ছিল সেটা আর আমাদের কাছে ভাল নয়। আর্টই বল, অথবা রাজনীতিই বল–সর্বত্র ওই একই ব্যাপার।

না, হ্যারি, নাটকটা আমাদের পক্ষে ভালোই। নাটকের নাম হচ্ছে ‘রোমিও-জুলিয়েট’। এই রকম একটা গর্তের মধ্যে সেকসপীয়রের নাটক অভিনীত হচ্ছে বুঝতে পেরে সত্যি কথা বলতে কি প্রথমেই আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। তবু ভাবলাম, দেখাই যাক না শেষ পর্যন্ত কী রকম দাঁড়ায়। যাই হোক, প্রথম অঙ্কটা পর্যন্ত দেখতে আমি মনস্থির করে ফেলেছিলাম। আবহসঙ্গীত কী ভয়ানক রে বাবা! একটা ভাঙা পিয়ানোর সামনে দাঁড়িয়ে একটি ইহুদি যুবক সঙ্গীত পরিচালনা করছিল। এই দেখেই চম্পট দেব ভাবছি এমন সময় সিল উঠে গেল, শুরু হল অভিনয়। একটি মোটাসোটা বয়স্ক ভদ্রলোক রোমিওর অভিনয় করছিলেন, তাঁর ভুরু যুগল কিঞ্চিৎ উঁচু স্বর শ্রুতিকটু, ভারিক্কি–অনেকটা বিযোগান্ত ধাঁচের। চেহারাটা হচ্ছে বিয়ারের পিপের মতো। মারকিউরিযার চেহারাটা আরো খারাপ অভিনয় করল একটা নিম্নমানের বিদৃষকের মতে, পোশাক আর চালচলনে মনে হল মানুষটি এই গর্তের আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছে। পারিপার্শ্বিক দৃশ্যাবলীর মতো তারাও কিম্ভুতকিমাকার, তাদের দেখে মনে হল এইমাত্র তারা যেন পাড়াগাঁয়ের কোনো অঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসছে।

কিন্তু জুলিয়েট! হ্যারি, ভেবে দেখ–একটি মেয়ে, সতের ছুঁই-ছুঁই করছে তার বয়স, ফুলের মতো ছোটো তার মুখ, তামাটে রঙের ঘন চুলের স্তবকে যার মাথাটা গ্রিক ভাস্কর্যের নিপুণ কারুকার্যের মতো দেখাচ্ছিল, চোখ দুটি তার ঢল-ঢল, দেখলেই মনে হবে ভাবের উচ্ছ্বাসে যেন তারা উপছে পড়ছে। ঠোঁট দুটি যেন গোলাপের পাপড়ির মতো। জীবনে অত সুন্দর আর কোনো যুবতী আমার চোখে পড়েনি। তুমি একবার আমাকে বলেছিলে যে মানুষের দুঃখ তোমার মনে কোনো রেখাপাত করে না, কিন্তু একটি সুন্দর ডিজনিস, তা সে যত সামান্যই হোক, তোমার চোখ জলে ভরিয়ে দেয়। তোমাকে আমি সত্যি কথাই বলছি হ্যারি, মেয়েটিকে দেখে আমার চোখ দুটিও জলে ভরে উঠল, ফলে তার দিকে ভালো করে সেদিন আমি তাকিয়ে থাকতেই পারিনি।

আর তার কণ্ঠস্বর! ওরকম স্বর আর কখনো আমি শুনিনি। প্রথমে মৃদু সুরে সে কথা শুরু করল, ধীরে ধীরে সেই সুর পরিণত হল উদাত্ত স্বরে, তারপরে সঙ্গীতের মূৰ্ছনায় আবিষ্ট করে ফেলল তোমাকে। ধীরে ধীরে সেই স্বর উচ্চগ্রামে উঠে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। মনে হল অনেক দূরে কোথাও কোনো ফুট অথবা সানাই বাজছে। বাগানের দৃশ্যটাও একই রকমের উচ্ছ্বাসবিধুর, নাইটেল পাখির গানের মধ্যে দিয়ে ভোরের আলো ফুটে ওঠার কিছু আগে প্রেমিক-প্রেমিকারা আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় যেমন মুষড়ে পড়ে–এই দৃশ্যটিও ঠিক সেই রকমের বেদনার্ত হয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝে বিচ্ছেদ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সমতা রাখার চেষ্টায় বেহালার করুণ সুর বেশ চড়া গলায় ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে তুমি জান, মাঝে মাঝে কারো কণ্ঠস্বর মানুষকে মাতাল করে দেয়, কানের ভেতর দিয়ে ঢুকে একেবারে মর্মস্থানে গিয়ে আঘাত করো তোমার স্বর আর সাইবিল ভেন-এর স্বর–এই দুটি স্বর জীবনে আমি কোনোদিনই ভুলতে পারব না, হ্যারি, চোখ বন্ধ করে থাকলেই আমি সেই স্বর দুটি শুনতে পাই। যদিও চরিত্রের দিক থেকে, ব্যঞ্জনার দিক থেকে তারা ভিন্ন জাতের। ওদের কোনটিকে আমি অনুসরণ করব তা আমি জানি না।

আমি তাকে ভালোবাসব না কেন? হ্যারি, তাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আমার জীবনে সে একটি আবিষ্কার ছাড়া আর কিছু নয়। দিনের পর দিন আমি তার অভিনয় দেখতে যাই একদিন সে রোজালিনড-এর অভিনয় করে, আর একদিন ইমোডেন-এর। প্রিয়তমের। বিষমাখা ঠোঁটে চুম্বন করে, ইটালিয়ান কবরখানার অন্ধকারে তাকে মারা যেতে আমি দেখেছি। আর্ডেন-এর বনপ্রদেশ কিশোরের পোশাক পরে কিশোরের বেশে ঘুরে বেড়াতে তাকে আমি দেখেছি। সে উন্মাদ হয়ে অপরাধী রাজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে তাঁকে তাঁর কৃতকার্যের জন্যে অনুশোচনা করতে বাধ্য করেছে। হিংসার কালো কুটিল হাত সেই অপাপবিদ্ধা মেয়েটির শরগাছের মতো নরম গলা চিপে ধরেছে। প্রতিটি বয়সের অভিনয় করতে নানান যুগের পোশাক পরা তাকে আমি স্টেজের ওপরে দেখেছি। সাধারণ মেয়েরা। কারো চিন্তার জগতে আবেদন জাগায় না। তাদের যুগে তাদের ক্রিয়াকলাপ অত্যন্ত সীমিত। কোনো জাঁকজমকই তাদের সৌন্দর্য বাড়ায় না, তাদের চিনে নিতে মানুষের বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না। তাদের মধ্যে কোনো রহস্য নেই। সকালে গাড়িতে চড়ে তারা পার্কে বেড়াতে যায়, বিকালে চায়ের টেবিলে কিচমিচ করে। তাদের মুখের হাসি আর চমকপ্রদ পোশাক গতানুগতিকতার ছাপ মারা। তারাই অত্যন্ত সাধারণ

কিন্তু অভিনেত্রীদের কথা স্বতন্ত্র। সাধারণের কাছ থেকে তাদের পার্থক্য কত! পৃথিবীতে ভালোবাসার একমাত্র উপযুক্ত নারী যে অভিনেত্রী, একথা আগে তুমি আমাকে কেন বলনি হ্যারি?

কারণ, আমি অনেক অভিনেত্রীকে ভালোবেসেছি, ডোরিয়েন।

হ্যাঁ, নিশ্চয়। তুমি সেই সব অভিনেত্রীদের ভালোবেসেছ যারা চুলে কলপ দিয়ে আর মুখে প্রসাধনের ছোপ লাগিয়ে বিতিকিচ্ছির দেখায়।

চুলের কলপ আর মুখের প্রসাধন ওভাবে নাকচ করে দিও না। মাঝে মাঝে তাদের ভেতরে অসাধারণ মহিলা লুকিয়ে থাকে।

এখন ভাবছি, সাইবিল ভেন-এর কথা তোমাকে না শোনালেই ভালো হত।

তার কথা আমাকে না বলে তুমি পারতে না, ডোরিয়েন। সারা জীবন ধরে যা করবে তার সবটুকুই তুমি আমাকে বলবো

হ্যাঁ, হ্যারি। মনে হচ্ছে তুমি সত্যি কথাই বলেছ। তোমাকে কোনো কিছু না বলে আমি থাকতে পারি না। আমার ওপরে তোমার প্রভাব বিস্ময়কর। যদি আমি কোনোদিন কোনো অন্যায় কাজ করি, তা-ও তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি। আমাকে বুঝতে পারবে।

ডোরিয়েন, তোমার মতো সুন্দর মানুষ ইচ্ছে করে ভুল করে না। কিন্তু তুমি এইমাত্র যা বললে তার জন্যে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এখন বল দেখি-তার আগে দেশলাইটা এগিয়ে দাও, লক্ষী ছেলে, এখন বল সাইবিল ভেন-এর সঙ্গে তোমার আসল সম্পর্কটা কোথায়?

হঠাৎ চটে উঠলেন ডোরিয়েন, চোখমুখ লাল হয়ে উঠল তাঁর, তড়াক করে লাফিয়ে উঠে তিনি বললেন, হ্যারি, সাইবিল ভেন পবিত্র, নিষ্পাপ।

কথার মধ্যে অদ্ভুত একটা দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, ডোরিয়েন, পবিত্র জিনিসকেই মানুষের স্পর্শ করা উচিত। কিন্তু তুমি এত বিরক্ত হচ্ছ কেন? আমি ধরে নিচ্ছি। একদিন সে তোমারই হবে। প্রেমে পড়লে মানুষ নিজের সঙ্গে প্রতারণা করতে শুরু করে, আর সব সময়ে শুরু করে অপরকে প্রতারণা করতো এই প্রতারণাকেই আমরা বলি রোমান্স। যাই হোক, ধরে নিচ্ছি তুমি তাকে চিনতে পেরেছ!

হ্যাঁ নিশ্চয়। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। প্রথম যেদিন আমি থিয়েটারে গিয়েছিলাম। সেইদিন নাটক ভাঙার পরে সেই ভীষণদর্শন বৃদ্ধ ইহুদি এসে আমার সঙ্গে দেখা করল, তারপরে সাজঘরে নিয়ে গিয়ে সাইবিলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিল। আমি খুব চটে উঠে তাকে বললাম, জুলিয়েট কয়েকশো বছর আগে মারা গেছে, তার মৃতদেহ এখন ভেরোনার মার্বেল কবরখানার মধ্যে শুয়ে রয়েছে। সে কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার চাহনি দেখে মনে হল বেটা ভেবেছিল আমি প্রচুর পরিমাণ শ্যাম্পেন বা অন্য কোনো মাদকদ্রব্য পান করে বেহেড হয়ে গিয়েছি।

তোমার কথা শুনে আমি আশ্চর্য হইনি, ডোরিয়েন।

তারপরে সে জিজ্ঞাসা করল আমি কোনো খবরের কাগজে লিখি কিনা, আমি তাকে বললাম, লেখা দূরের কথা কোনো খবরের কাগজই আমি পডি না। আমার কথা শুনে মনে হল সে বেশ হতাশ হয়ে পড়েছে। তারপরে সে আমাকে গোপনে ভাল যে সমস্ত নাট্য সমালোচকরা। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। এখন ব্যবসা চালাতে গেলে তাদের সবাইকে কিনে নিতে হবে।

লোকটি যে ঠিক কথা বলেছে সেদিক থেকে আমার কোনো রকমসন্দেহ নেই। তবে একথাও আমি বলতে চাই যে, তাদের চেহারা আর হাবভাব দেখে আমার মনে হয় তাদের কিনতে বেশি কিছু খরচ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

ডোরিয়েন হেসে বললেন, তার কথা শুনে মনে হল সে সামর্থ্যও তার নেই। এই সময় থিয়েটারে আলো লেবানোর সময় হয়ে এল, কয়েকটা বাতি নিবেও গেল। সুতরাং আমাকেও বেরিয়ে আসতে হল। তার ইচ্ছে আমি তার দেওয়া দু’একটা সিগার খাই, আমি তার উপহার প্রত্যাখ্যান করলাম। পরের রাত্রিতেও আমি আবার সেই আগের আসনটি দখল করলাম। আমাকে দেখেই সে মাথাটা নীচু করে অভিবাদন জানিয়ে বলল, আমার মতো অর্থশালী এবং দিলদরিযা পেট্রল তার আর নেই। লোকটা একটা দুর্বিনীত পশু, মানুষকে বৃঢ় কথা বলতে ওস্তাদ। কিন্তু শেকসপীয়রকে সে অসাধারণ ভালোবাসো একবার সে বেশ বুক ফুলিয়ে গর্ব করে আমাকে বলেছিল যে ওই ‘চারণকরিটির জন্যে সে পাঁচবার দেউলিয়ার খাতায় নাম। লেখাতে বাধ্য হয়েছিল। শেকসপীয়রকে সে চারণকবি ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকতে রাজি নয়। এই নামে ডাকার মধ্যে সে তার আভিজাত্য খুঁজে পেয়েছে।

হ্যাঁ, এটা তো একটা অভিজাত-বোধ বটেই, ডোরিয়েন, বড়ো রকমের অভিজাত-বোধ। অনেক মানুষ গদ্যময় জীবন নিয়ে ফাটকাবাজি খেলতে গিয়ে দেউলিয়া হয়েছে। কাব্যের জন্যে নিজেকে ধ্বংস কার একটা সম্মান বৈকি! কিন্তু মিস সাইবিল ভেন-এর সঙ্গে তোমার প্রথম আলাপ হল কবে?

তৃতীয় রাত্রিতো সেদিন সে রোজালিনড-এর অভিনয় করেছিল। আমি তার কাছাকাছি না গিয়ে পারিনি। আমি তাকে কিছু ফুল ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে দেখল। অন্তত, সেই রকমই মনে হল আমার। বৃদ্ধ ইহুদিও তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্যে আমার কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছিল। আমাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সে বদ্ধপরিকর। হয়েছিল। আমিও তাই শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম। তার সঙ্গে আমি যে আলাপ করতে চাইনি সেটা অস্বাভাবিক, তাই না?

না, আমি তা মনে করি না।

কেন?

এর উত্তর আর একদিন তোমাকে আমি দেব। এখন মেয়েটির সম্বন্ধে আমি কিছু শুনতে চাই।

সাইবিল? ওঃ, সে বড়ো লাজুক মেয়ে, আর কি ভদ্র! একেবারে যাকে বলে শিশু।তার অভিনয় সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা হয়েছিল সেকথা আমার মুখ থেকে শুনে সে অবাক হয়ে চোখ দুটি বড়ো বড়ো করে সোৎসাহে আামার দিকে তাকিয়েছিল। নিজের দক্ষতার সম্বন্ধে কোনো ধারণাই তার ছিল না। মনে হয়, আমরা দুজনেই কেমন আমতা আমতা করতে লাগলাম। সেই ধূলিমলিন সাজঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বুড়ো ইহুদি পরম কৌতুকের সঙ্গে তাকিয়ে রইল, তারপরে আমাদের দুজনের ওপরে লম্বা টানা বক্তৃতা দিল। আর আমরা নির্বাক হয়ে শিশুর মতো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ইহুদিটি বার বার আমাকে ‘দি লার্ড’ বলে সম্বোধন করতে লাগল। সেই জন্যে সাইবিলকে নিশ্চিন্ত করতে হল যে আমি আদৌ ও-শ্রেণির মানুষ নই। সে আমাকে শুধু বলল, আপনি রাজকুমারের চেয়ে দেখতে সুন্দর, আপনাকে আমি ‘প্রিন্স চার্মিং’ বলে ডাকব।

সত্যি বলছি ডোরিয়েন, কী ভাবে মানুষকে প্রশংসা করতে হয় সাইবিল তা জানে।

হ্যারি, তুমি তাকে বুঝতে পারছ না। নাটকের একটি অভিনেতা বলেই সে আমাকে ধরে নিয়েছিল। বাস্তব জীবনের সমন্ধে কোনো ধারনাই তার নেই। সে তার মায়ের সঙ্গে থাকে, সংসারের চাপে পড়ে ভদ্রমহিলা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছেন। পরিশ্রমের ক্লান্তিতে স্বাস্থ্য তাঁর ভেঙে পড়েছে। কিন্তু সুদিন তাঁর জীবনে এসেছিল।

আঙুলের আংটি খুঁটতে খুঁটতে লর্ড হেনরি মন্তব্য করলেন, ওদের মুখের চেহারা কি তা আমি ভানি। ওদের দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়।

ইহুদিটি তার কাহিনি বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমি তাকে বলতে দিইনি, কারণ তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।

তুমি ঠিকই করেছ, অন্য লোকের দুঃখের কাহিনির মধ্যে সব সময় অসম্ভব রকমের নীচতা রয়েছে।

সাইবিলই একমাত্র জিনিস যার ওপরেই আমার আগ্রহ রয়েছে। সে কোথায় জন্মেছে তা ডেলে আমার লাভ নেই। সেই ছোটো মাথা থেকে ছোটো পা পর্যন্ত সবটাই তার স্বর্গীয়। প্রতিদিন রাত্রিতেই তার অভিনয় আমি দেখতে যাই, আর প্রতিদিনই সে আমার চোখে অপরূপা হয়ে দেখা দেয়।

আমার মনে হয় সেই জন্যেই তুমি আজকাল আমার সঙ্গে ডিনারে যাওয়ার সময় পাও না। আমি ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় কারো সঙ্গে রোমান্স করছ। করছ ঠিকই, কিন্তু আমি তোমার সম্বন্ধে যা ভেবেছিলাম তা করছ না।

শোন হ্যারি, প্রতিদিন আমরা হয় লাঞ্চ না হয় ডিনার খাই। আর তোমার সঙ্গে এর ভেতরে অনেকবারই আমি অপেরায় গিয়েছি-তাই না! অবাক হয়ে দুটি নীল চোখ বিস্তারিত করে ডোরিয়েন হেনরির মৃদু অভিযোগ নস্যাৎ করে দিলেন।

তুমি প্রায়ই অনেক দেরি করে আস।

অবশ্য সাইবিলের অভিনয় না দেখে আমি পারি না। একটা অঙ্কের জন্যে হলেও আমাকে থিয়েটারে যেতে হয়। তাকে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠি আমি। যখন ভাবি তার ওই হাতির দাঁতের মতো কারুকার্যমণ্ডিত ছোটো দেহটির মধ্যে অত্যাশ্চর্য একটি আত্মা লুকিয়ে রয়েছে তখন আমি ভয় পেয়ে যাই।

আজ তুমি আমার সঙ্গে ডিনার খাবে চল, ডোরিয়েন। যাবে না?

ডোরিয়েন মাথা নাড়ল, আজ সে ইমোজেন-এর অভিনয় করবে। আগামীকাল সাজবে জুলিয়েট।

কখন সে সাইবিল ভেন-এর অভিনয় করবে?

কোনোদিন না।

আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাই।

কী ভয়ঙ্কর তুমি হ্যারি! বিশ্বের সমস্ত নায়িকাকে এক করলে যা দাঁড়ায় সাইবিল হচ্ছে তাই। ব্যক্তির চেয়ে অনেক বড়ো সে। তুমি হাসছ? কিন্তু আমি তোমাকে বলছি সে একটি জিনিয়াস। আমি তাকে ভালোবাসি। সে যাতে আমাকে ভালোবাসে সে চেষ্টা আমাকে অবশ্যই করতে হবে। তুমি তো জীবনের অনেক গোপন রহস্যের সন্ধান ভান। কেমন করে। সাইবিলকে আমি মুগ্ধ করব, কী করলে সে আমাকে ভালোবাসবে সে-কথাটা আমাকে তুমি। বলে দাও। রোমিওকে বাধ্য করব সে যাতে আমাকে হিংসে করে। আমি চাই বিশ্বের মৃত প্রেমিকদের আত্মা যেন আমাদের দ্বৈত হাসির শব্দ শুনতে পায়, শুনতে পেয়ে বিষণ্ণ হয়। আমি চাই আমাদের উন্মাদ ভালোবাসার নিশ্বাস ধূলায় মেশানো তাদের মৃত আত্মাগুলিকে যেন সঞ্জীবিত করে তোলে, তাদের ছাইগুলিকে বেদনার আঘাতে জর্জরিত করে। ভগবানের দিব্যি, হ্যারি, আমি তাকে পুজো করি।

এই কথা বলতে বলতে তিনি ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন, তাঁর গাল দুটি লাল টকটকে করতে লাগল। বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন তিনি।

লর্ড হেনরি তাঁকে লক্ষ করলেন, মনে মনে খুশিই হলেন তিনি। বেসিল হলওয়ার্ডের স্টুডিওতে যে লাজুক, নম্র, আর ভীতচকিত যুবকটিকে তিনি দেখেছিলেন, আজকের এই মানুষটির সঙ্গে পার্থক্য তার কত। তাঁর স্বভাবটি ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে, রক্তবর্ণ কুসুমস্তবকে ভরে উঠেছে তাঁর আবেগ। গোপন বিবর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছে তাঁর আত্মা, তার সঙ্গে মিতালি করার জন্যে বিবর থেকে এগিয়ে এসেছে আকাঙ্খা।

শেষকালে লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে কি করতে চাও তুমি?

আমি চাই একদিন তুমি আর বেসিল আমার সঙ্গে তার অভিনয় দেখতে এস। এর ফল কী হবে সে-সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ আমার নেই। অভিনয়ে তার দক্ষতা যে তর্কাতীত সেকথা স্বীকার করতে তোমরাও বাধ্য হবে। তারপরে তাকে আমরা ইহুদির হাত থেকে ছাড়িয়ে আনব। তিন বছরের জন্যে, আজ থেকে মোটামুটি দু’বছর আট মাসের মতো চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তাকে ওখানে থাকতে হবে। অবশ্য তাকে ছাড়িয়ে আনতে গেলে ইহুদিকে কিছু দিতে হবে। সব চুকেচুকে গেলে, ওযেস্ট এন্ডে আমি একটা থিয়েটার খুলব, সেইখানে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে অভিনয় করাব। আমাকে যেমন সে উন্মাদ করে সেই রকম উন্মাদ সারা বিশ্বকে সে করে তুলবে।

প্রিয় বালক, তোমার ও-আশা পূর্ণ হবে না।

হ্যাঁ, সে করবে। অভিনয় কলাটাকে সে যে বিশেষভাবে রপ্ত করেছে তা-ই নয়। ব্যক্তিত্বও তার খুব জোরালো এবং তুমি আমাকে অনেকবারই বলেছ যে আধুনির যুগকে যা নাচাতে পারে তা মানুষের নীতি নয়, ব্যক্তিত্ব।

ঠিক আছে। কবে আমরা যাচ্ছি?

দাঁড়াও, দেখি। আজ হচ্ছে মঙ্গলবার। আগামীকাল যাই চলা কাল সে জুলিযেটের অভিনয় করবে।

বহুৎ আচ্ছা। ব্রিস্টল-রাত আটটা। বেসিলকে আমি আনানোর ব্যবস্থা করব।

আটটা নয়, প্রিন্স হ্যারি। সাড়ে ছটা। পর্দা ওঠার আগেই আমাদের সেখানে পৌঁছতে হবে। প্রথম অঙ্কেই রোমিওর সঙ্গে তার দেখা হবে। সেই সময়েই তাকে তোমাদের দেখা উচিত।

সাড়ে ছটা! যা বাব্বা। ওই সময় তো লোকে হয় ‘মিট টি’ খায়, অথবা ইংরেজি নভেল পডে। সাতটা কর অন্তত। রাত্রি সাতটার আগে কোনো ভদ্রলোকই ডিনার খেতে বেরোয় না। এর মধ্যে বেসিলের সঙ্গে কি দেখা হবে তোমার? না, আমি তাকে চিঠি লিখে ডানিয়ে দেব?

প্ৰিয় বেসিল। সাত-সাতটা দিন তাকে আমি দেখিনি। কাডটা আমার খুব খারাপ হয়েছে। এর মধ্যে একটি অদ্ভুত সুন্দর ফ্রেমে বাঁধাই করে, ফ্রেমের ডিজাইন কী হবে সেটা সে নিজেই ঠিক করে দিয়েছে–সে আমার প্রতিকৃতিটা পাঠিয়ে দিয়েছে। যদিও আমার বয়স একমাস বেড়ে যাওয়ার ফলে ছবিটাকে আমি হিংসে করি তবু একথাও আমি স্বীকার না করে পারব না যে ছবি দেখে আমি আনন্দ পেযেছি। তুমি ও বরং তাকে চিঠি দিয়ে দাও একটা। একা তার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই না। তার কথা শুনতে বিরক্ত লাগে আমারা। সে আমাকে কেবল সৎ উপদেশ দেয়।

লর্ড হেনরি হাসলেন, নিজেদের যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেইটাই বিলিয়ে দিতে মানুষ বড়ো আনন্দ পায। এই অভ্যাসটাকে আমি বলি বদান্যতার গভীরতা।

কিন্তু বেসিল আমাদের বন্ধু হিসাবে সেরা। তবে আমার মনে হয় চরিত্রের দিক থেকে মানুষটি একেবারে গোঁয়ার গোবিন্দ। তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরেই হ্যারি এ জিনিসটা আমি। বুঝতে পেরেছি।

বেসিলের সব কিছু মাধুর্য সবই তুমি তার কাজের মধ্যে দেখতে পাবে। ফলে নিজের বলতে কুসংস্কার, নীতিবোধ, আর যাকে আমরা কমনসেন্স’ বুলি এগুলি ছাড়া তার আর কিছু নেই। ব্যক্তিগত পরিচযের ফলে আমি জানি নিম্নমানের আর্টিস্টরাই হচ্ছে সত্যিকারের আলাপী। তাদের সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। সত্যিকার ভালো আর্টিস্টরা বেঁচে থাকে তাদের সৃষ্টির মধ্যে, ফলে ব্যক্তিগত জীবনে তারা কাউকেই আকর্ষণ করতে পারে না। বড়ো কবি, অর্থাৎ যাঁকে আমরা সত্যিকার বড়ো কবি বলি-হচ্ছেন ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বের সবচেয়ে অকবি। কিন্তু নিম্নমানের কবিদের সঙ্গে মিশলে চমৎক্ত হতে হয়। তাদের ছন্দ যত খারাপ, ৩৩ই তারা সুন্দর করে নিজেদের প্রকাশ করে। যে কবি একটিমাত্র দ্বিতীয মানের চতুর্দশপদী কবিতার বই ছাপিয়েছেন, নরকুলে বাহবা পাওয়ার যোগ্য একমাত্র তিনিই। যে কাব্য-সৌরভ পরিবেশন করা তাঁর সাধ্যাতীত, মজার কথা হচ্ছে সেই সৌরভের মধ্যে তিনি নিজে বাস করেন। অপরে কবিতা লেখে বটে, কিন্তু সেই কাব্যরস পান করার মতো সাহস তাদের নেই।

টেবিলের ওপরে বড়ো একটা বোতলে আতর ঢালা ছিল, রুমালে সেই আতর কিছুটা ছিটিযে ডোরিয়েন বললেন, হ্যারি, তুমি যা বললে তাই কি সত্যি? তুমি যদি বল, তাহলে তাই সত্যি হতে বাধ্য। আমি এখন চললাম। ইমোডেল আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আগামীকালের কথা ভুলে যেও না। বিদায়।

ডোরিয়েন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। লর্ড হেনরির ভারী ভারী চোখের পাতাগুলি নেমে এল। তিনি ভাবতে লাগলেন। সত্যি কথা বলতে কি ডোরিয়েন গ্রে তাঁকে যেমন করে আকর্ষণ করেছিলেন তেমন আকর্ষণ আর কেউ তাঁকে করতে পারেনি। তবু ছোকরা যে একজনকে পাগলের মতো প্রশংসা করে তা তিনি যেন সহ্য করতে পারছিলেন না, তাঁর মনের কোথায়। যেন একটা কাঁটা খচখচ করে বিধছিল। তিনি খুশিও হয়েছিলেন। এর ফলে, ডোরিয়েনকে আর ভালো করে বিশ্লেষণ করার সুযোগ হল তাঁর। প্রকৃতি বিজ্ঞানকে তিনি কোনোদিনই অস্বীকার করতে পারেননি, কিন্তু বিজ্ঞানের সাধারণ শাখাগুলি কোনোদিনই তাঁকে আকর্ষণ করতে পারেনি, সেগুলিকে তিনি অর্থহীন বলেই মনে করতেন। সেই জন্যে শুরু করেছিলেন তিনি নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করতে, শেষ করলেন অন্য লোককে ব্যবচ্ছেদ করে। মানুষের জীবন-তিনি মনে করতেন মানুষের জীবনটাই হচ্ছে বিচার করার, বিশ্লেষণ করার একমাত্র উপযুক্ত জিনিস। এর সঙ্গে তুলনা করলে আর সব বস্তুই তাদের ভেল্লা হারিয়ে ফেলে, হারিয়ে ফেলে তাদের মূল্যবোধ। এটা সত্যি যে মানুষ যখন এই বেদনা আর আনন্দের আধারটিকে বিশেষভাবে লক্ষ করল তখন মুখে কাঁচের মুখোশ পরে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি দগ্ধমান সালফারের ধোঁয়া সরিয়ে রাখা, সে ধোঁয়া কেবল মস্তিষ্ককেই জখম করে ক্ষান্ত হলি, আমাদের চিন্তার জগতে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, স্বপ্নকে করেছে বিকৃত। এমন কয়েকটি বিষয় রয়েছে তাদের চরিত্র কী ভালোভাবে জানতে গেলে নিজেদের অসুস্থ করতে হয়। এমন কয়েকটি ব্যাধি রয়েছে যাদের ভালোভাবে জানতে গেলে আপনাকে অসুস্থ হতে হবে। কিন্তু তবু কী পুরস্কারই না মানুষে পায়! তার কাছে পৃথিবী কী আশ্চর্য রকমের সুন্দরই না দেখায? মানুষের মনে কেন উচ্ছ্বাস ভাগে, তার চরিত্রটাই বা কী, বুদ্ধিজীবীদের রঙিন জীবনের উচ্ছ্বাস বলতেই বা কী বোঝা যায়, কোথায় তাদের মিল রয়েছে, অমিলটাই বা কোথায়, এই সব পর্যবেক্কণ করা, বিশ্বেষণ করার মধ্যে একটা আনন্দ রয়েছে। তার জন্যে মানুষকে কী দাম দিতে হবে তা নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। কোনো সংবেদনের জন্যেই মানুষ খুব বেশি একটা দাম দিতে পারে না।

তিনি তা জানতেন। যে চিন্তাটা তাঁর কটা চোখের মধ্যে আনন্দের সামান্য একটু রশ্মি ফুটিয়ে তুলল–ডোরিয়েনের যে মিষ্টি কথাগুলি তাঁর কানে গিয়েছিল সেইগুলি থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ডোরিয়েন গ্রে-র হৃদয় এই শ্বেতাঙ্গিনীর দিকে ঝুঁকেছে, তাকেই তিনি পুজো করছেন। ছেলেটি অনেকখানি তাঁর নিজেরই সৃষ্টি। তিনিই তাকে নাবালক করে রেখেছেন। এটা অবহেলার বস্তু নয়। জীবন তার রহস্য প্রকাশ করে না দেওয়া পর্যন্ত সাধারণ মানুষে অপেহষ্ক করে। কিন্তু এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই রয়েছে আর এরাই হচ্ছেন নির্বাচিত কিছু জনপ্রতিনিধি-যবনিকা তুলে নেওয়ার আগেই যাঁদের কাছে জীবনের রহস্য ফাঁস হয়ে যায়। কখনো কখনো জীবনের এই ব্যঞ্জনাটি ফুটে ওঠে চিত্রকলার মাধ্যমে, বিশেষ করে সাহিত্যকলায। কারণ, উচ্ছ্বাস এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সমন্বয় ঘটানোই সাহিত্যের কাভ। কিন্তু মাঝে মাঝে কখনো-সখনো কোনো জটিল ব্যক্তিত্ব বিচারকের স্থান অধিকার করে বসে এবং আর্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে। কবিতা, ভাস্কর্য অথবা চিত্রকলার মতো মানুষের জীবনও আর্টের একটি বিস্তৃত লীলাক্ষেত্র ছাড়া আর কী?

সত্যি কথাই। ছোকরাটির বুদ্ধি এখনো পর্যন্ত পোক্ত হয়নি। বসন্তকালেই সে শস্য কাটার আয়োজন মেতে উঠেছে। যৌবনের সমস্ত উন্মাদনা তাঁর মধ্যে রয়েছে, কিন্তু তিনি আজকাল আত্মসচেতন হয়ে উঠেছেন। তাঁর গতিবিধি লক্ষ করাটা বেশ আনন্দের। সেই সুন্দর মুখ, আর সুন্দর আত্মা-দুই-এ জড়িয়ে তাঁর যে সত্তাটি গড়ে উঠেছে তার দিকে অবাক হয়েই চেয়ে। থাকতে হয়। কী ভাবে এই জীবনের পরিণতি আসবে তা ভেবে লাভ নেই কিছু। অভিনয়ের মঞ্চে তিনি সেই ধরনের একজন আদর্শ অভিনেতা যাঁর ব্যক্তিগত সুখের সন্ধান রাখার কোনো সম্ভাবনা আমাদের নেই, অথচ যাঁর দুঃখবোধ আমাদের অভিভূত করে তোলে। যাঁর দেহের ক্ষত তাজা গোলাপের মতো লাল টকটকে।

আত্মা এবং দেহ, দেহ আর আত্মা–কী অদ্ভুত সৃষ্টি ভগবানের! আত্মার মধ্যে পশুত্ব রয়েছে দেহের মধ্যে মাঝে মাঝে অধ্যাত্ম জগতের প্রতিফলন ঘটে। আমাদের প্রবৃত্তিগুলি সুন্দর হতে পারে, এবং অধঃপতন ঘটতে পারে ধীশক্তির। জৈব উচ্ছ্বাসের সমাপ্তি কোথায় অথবা কোথা থেকে আমাদের দৈহিক সংবেদনের সৃষ্টি হয়–এ প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? সাধারণ। মনস্তত্ত্ববিদরা নিজেদের ইচ্ছামতো যে সব ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়েছেন সেগুলি কত অগভীর। এবং বিভিন্ন চিন্তাশীল ব্যক্তিরা যে বিভিন্ন মত আর পথের সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা সে কথা কে বলবে? পাপের ঘরে যে আত্মা বসে রয়েছে সেটা কি ছায়া মাত্র? অথবা দেহটা সত্যি সত্যিই আত্মার অন্তভ? বস্তু থেকে তার শক্তির বিচ্যুতি সত্যিই বড়ো রহস্যময। আর বস্তুর সঙ্গে তার শক্তির সংহতি একই রকম রহস্যে ঘেরা। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক এ সম্বন্ধে শেষ কথা কে বলবে।

আচ্ছা, মনস্তত্ত্বই কি শেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যার মধ্যে দিয়ে মানুষের অবচেতন মনের সমস্ত কিছু ছোটোখাটো চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়? তিনি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন। ব্যাপারটা যাই হোক, আমরা সব সময় নিজেদের আর সেই সঙ্গে অপরকে ভুল বুঝেছি, নীতির দিক থেকে অভিজ্ঞতার কোনো দাম নেই। মানুষ যে সমস্ত ভুল করে সেগুলিকেই তারা অভিজ্ঞতা বলে চালিয়ে দিয়েছে। নীতিবাগীশরা যথারীতি এটিকে সতর্কবাণা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের মতো চরিত্র গঠনে এর নৈতিক দক্ষতা অনস্বীকার্য, তাঁরা এর প্রশংসা করেছেন এই জন্যে যে কী করা উচিত আর কী বর্জন করা উচিত সে বিষয়ে এ আমাদের শিক্ষা দেয়। কিন্তু পরিচালনা করার মতো কোনো শক্তি অভিজ্ঞতার নেই। বিবেকের মতো এরও কর্মক্ষমতা। নেই বললেই হয়। এ যেটুকু বলে দেয় তা হচ্ছে এই যে আমাদের ভবিষ্যতের সঙ্গে অতীতের। কোনো পার্থক্য নেইষ যে পাপ আমরা একবার করেছি এবং অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গেই করেছি সেই পাপ ভবিষ্যতে আবার আমরা করব, আর বেশ আনন্দের সঙ্গেই।

এটা তাঁর কাছে বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল যে প্রায়োগিক পদ্ধতিটাই হচ্ছে একমাত্র পদ্ধতি যার সাহায্যে জীবনের সমস্ত আবেগ আর উচ্ছ্বাসের বৈজ্ঞানিক অনুশীলন সম্ভব। সেদিক থেকে ডোরিয়েনকে নিয়ে কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে পারে, এবং সম্ভবত সেই পরীক্ষায় বিশেষ ফলোভেরও সম্ভাবনা রয়েছে। সাইবিল ভেন্যকে তিনি যে হঠাৎ উন্মাদের মতো ভালোবেসে। ফেললেন, মনস্তত্ত্বের দিক থেকে এটা কম কৌতূহলোদ্দীপক নয়। অবশ্য এর মূল কারণ যে কৌতূহল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই কৌতূহলই নিছক নয়, নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের আকাঙ্খা বটে। তবু এটা সাধারণ উচ্ছ্বাস নয় এ উচ্ছ্বাস সত্যিই বড়ো জটিল। যে অনুভূতিটা প্রাথমিক পর্যায়ে নিছক শিশুসুলভ একটা কৌতূহল ছিল, সেইটাই হঠাৎ তার নিজের কাছেই ইন্দ্রিয় অনুভূতি থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল, পরিণত হল কামনায়, ভোগ-সম্ভাবনার অতৃপ্তিতে। এইটাই তার কাছে বিপজ্জনক। এই কামনাগুলিই আমাদের ওপর চিরকাল প্রভাব বিস্তার করে। এসেচ্ছে, অত্যাচার করে এসেছে আমাদের। অথচ এদের আসল বুপটি সম্বন্ধে আমরা সব সময় ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে প্রবঞ্চিত করেছি আমাদের।

লর্ড হেনরি যখন এই সব আলোচনা করছিলেন, এমন সময় দরজায় একটা টোকা পড়ল, তাঁর। চাকর ঘরে ঢুকে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিল যে ডিনারে যাওয়ার সময় হয়েছে। তিনি উঠে পড়লেন, তাকিয়ে দেখলেন রাস্তার দিকে। বিপরীত দিকে বাড়িগুলির ডানালার ওপরে। অস্তগামী সূর্যের লাল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। জানলার কাঁচগুলি আগুনে পোড়ানো ধাতুর মতো লাল টকটকে করছে। মাথার ওপরে আকাশের রঙ বিবর্ণ গোলাপের মতো। বন্ধুর আগুনের মতো রঙিন জীবনের কথা মেন পড়ে গেল তাঁর। কেমন করে কোথায় কোন পথ দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবন এগিয়ে চলবে তা কে বলবে?

রাত্রি সাড়ে বারোটার সময় বাড়ি ফিরলেন তিনি, দেখলেন, টেবিলের ওপরে একখানা টেলিগ্রাম পড়ে রয়েছে। তিনি সেটি খুললেন, দেখলেন টেলিগ্রামটি ডোরিয়েনের কাছ থেকে এসেছে। সংক্ষিপ্ত সংবাদ: ডোরিয়েন আর সাইবিল বিয়ে করার জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।

২. একটি বিবর্ণা শীর্ণকায়া মহিলা

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

মা, মা, আমি আজ খুশি–আনন্দে আমার মন-প্রাণ ভরে উঠেছে।

একটি বিবর্ণা শীর্ণকায়া মহিলার কোলের ওপরে মুখ লুকিয়ে মেয়েটি আনন্দে যেন ফেটে পড়ল। দেখে মনে হয়, ব্যস্থা মহিলাটি সংসার-যাঁতার মধ্যে পড়ে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ছোটো বসার ঘর, আলো-হাওযার বালাই সেখানে নেই বললেই ইয। সেই ঘরের একমাত্র আসবাব ছোটো একটি আর্মচেয়ারের ওপরে বসে ছিলেন। উজ্জ্বল আলোর ধকল সহ্য করতে পারছিলেন না বলেই হয়তো আলোর দিকে বসেছিলেন পেছন করে।

মেয়েটি আবার বলল, আনন্দ রাখার আর জায়গা পাচ্ছি না আমি তোমারও আনন্দ হচ্ছে নিশ্চয়।

মিসেস ভেন ভ্রূকু টি করলেন, কিন্তু তাঁর রক্তশূন্য ফ্যাকাশে রঙের একটি হাত তাঁর মেয়ের মাথার ওপরে রাখলেন।

আনন্দ! তোমাকে যখন অভিনয় করতে দেখি আমার আনন্দ হয় তখনি। অভিনয় ছাড়া বর্তমানে অন্য তোমার চিন্তা করা উচিত নয়। মিঃ আইস্যাকস আমাদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছেন। তিনি যে আমাদের ধার দিয়েছেন সে ধার এখনো শোধ হয়নি।

মেয়েটি ওপরের দিকে মুখ তুলে বলল, মা, টাকার কথা বলছ? টাকায় কি যায় আসে! ভালোবাসার টাকার চেয়ে অনেক বেশি।

ভুলে যেও না, ঋণ শোধ আর ভেমেস-এ পোশাক তৈরি করার জন্যে মি; আইসকস আমাদের পঞ্চাশ পাউন্ড অগ্রিম দিয়েছেন। সেকথা ভুলে যেও না সাইবিলা পঞ্চাশ পাউন্ড অনেক টাকা। এদিক থেকে মিঃ আইস্যাকসকে সুবিবেচক না বলে আমি পারছি না।

দাঁড়িয়ে উঠল মেয়েটি, তারপরে জানলার ধারে গিয়ে বলল, মা, ও ভদ্রলোক নয়। আমার সঙ্গে ও যেভাবে কথা বলে তাতে ওকে আমার ঘৃণা হয়।

স্বরে কিঞ্চিৎ ঝাঁকানি দিয়ে বর্ষীয়সী মহিলাটি বললেন, তাঁর সাহায্য ছাড়া কী করে যে আমাদের চলত তা আমি জানি না।

সাইবিল ভেন নিজের মাথাটা নাড়িয়ে হাসল, আর তাকে আমাদের দরকার নেই মা। এখন থেকে প্রিন্স চার্মিং-ই আমাদের সব ভার নেবেন।

এই বলে সে থামল। একটা লজ্জার ঢল নামল তার ধমনীতে, সে একটু কেঁপে উঠল, সেই রঙে ধীরে ধীরে রাঙা করে দিল তার দুটি কপোলকে। দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে তার পদ্মপাতার মতো নরম দুটি ঠোঁট বিভক্ত হল-কাঁপতে লাগল ঠোঁটের দুটি পাপড়ি দুহিষ্কণে বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপরে, সুন্দর পোশাকের ভাঁজগুলি দিল খুলে। সে শুধু বলল, আমি তাকে ভালোবাসি।

টিয়াপাখির মতো তাঁর মা চিৎকার করে উঠলেন–বোকা, বোকা মেয়ে! কথার সঙ্গে সঙ্গে নকল হিরে-বসালো আংটি পরা আঙুলটি তাঁর অদ্ভুতভাবে নড়তে লাগল।

মেয়েটি আবার হেসে উঠল। খাঁচায় পোরা পাখির আনন্দ তার স্বরে ধ্বনিত হল। সেই সুর ধরা। পড়ল তার চোখের মণিতে। দৃষ্টির আলোতে বিচ্ছুরিত হল তারই দ্যুতি। তারপরে তার। চোখের পাতাগুলি মুহূর্তের জন্যে বুজে এল, মনে হল, সে কিছু গোপন রহস্যকে ঢেকে রাখতে চায়। যখন সে চোখ খুলল তখন স্বপ্নের কুয়াশা কেটে গিয়েছে।

সেই জীর্ণ চেয়ার থেকে রগ্ন ভদ্রমহিলাটি তার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। তিনি তাকে বিত্ত হওয়ার উপদেশ দিলেন, উপদেশ দিলেন সমঝে চলার জন্যে। কাপুরুষদের জন্যে যে সব বই লেখা হয়েছে এবং যেখানে লেখক সাধারণ জ্ঞান’ বলে শব্দটা না বুঝে বারবার উচ্চারণ করেছেন, সেই বই থেকে কিছু উপদেশ বাণী উদ্ধৃত করে তিনি তাকে শোনালেন। মেয়েটি সেদিকে কান দিল না। কামনার কারাগারে সে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন। তার রাজকুমার প্রিন্স চার্মিং, তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে তখন। তাকে মনের মতো সৃষ্টি করার চেষ্টায় সে তখন মশগুল। তাকে খুঁজে বার করার জন্যে সে তার আত্মাকে দূত করে পাঠিয়েছে, সেই দূত তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। রাজকুমারের জ্বালাময় চুম্বন আবার তার ঠোঁট দুটিকে সম্পশ করেছে। তার নিশ্বাসে মেয়েটির চোখের পাতাগুলি গরম হয়ে উঠেছে।

তারপর বিজ্ঞতা চিন্তার পদ্ধতি পরিবর্তন করল। এই যুবকটি ধনী হতে পারে। তাই যদি হয়, বিয়ের কথা চিন্তা যেতে পারে। তার কানের উপকূলে সাংসারিক জ্ঞানের ঢেউ আছাড় খেয়ে। পড়ল। ছলনার তীর ছুঁডল মেয়েটি। সে দেখতে পেল পাতলা ঠোঁটগুলি তার নড়ছে। সে হাসল।

হঠাৎ কথা বলার তাগিদ এল তার। সে চেঁচিয়ে বলল, মা, মা, সে আমাকে এত ভালোবাসে কেন? আমি তাকে কেন ভালোবাসি তা আমি জানি। তাকে আমি ভালোবাসি এই জন্যে যে সে নিজেই ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক। কিন্তু আমার মধ্যে সে কী দেখেছে? আমি তো তার যোগ্য নই। কিন্তু তবু কেন জানি না, যদিও তার কাছে আমি অনেক ছোটো তবু তার প্রেমের অযোগ্য মনে হয় না নিজেকে। তার ভালোবাসা পেয়ে গর্বে আমার বুকটা ভরে ওঠে। মা, আমি যেমন আমার প্রিন্স চার্মিং-কে ভালোবাসি, তুমিও কি বাবাকে সেই রকমই ভালোবাসতে?

অল্প দামের প্রসাধনের নীচে বয়স্কা মহিলার গণ্ড দুটি হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল। একটা যন্ত্রণার আকস্মিক আবেগে তাঁর শুকনো ঠোঁট দুটি বিকৃত হল। সাইবিল ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরল এবং গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, মা আমাকে মা কর। বাবার সম্বন্ধে কোনো কথা বলতে গেলে যে তোমার কষ্ট হয় তা আমি জানি। কারণ, তুমি তাঁকে ভালোবাসতে, খুব ভালোবাসতে। দুঃখ করো না মা। বিশ বছর আগে তুমি একদিন যেমন সুখী হয়েছিল আড আমি তেমনি সুখী। আমাকে চিরকাল সুখী থাকতে দাও।

বৎসে, প্রেমে পড়ার কথা চিন্তা করার মতো ব্যস তোমার এখনো হয়নি। তাছাড়া এই ছেলেটির সম্বন্ধে কতটুকুই বা তুমি ডান? তার নামটা কি তা-ও পর্যন্ত তুমি জান না। এসব কথা আলোচনা করার এতটুকু সময়, বিশেষ করে জেমস এখন অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে কত জিনিস ভাবতে হচ্ছে আমাকে। আশা করেছিলাম ঠিক এখনি তুমি বুঝে শুনে চলবে। যাই হোক, তোমাকে আমি আগেই বলেছি, ছেলেটি যদি ধনী হয়…

মা, মা। টাকা-পয়সার কথা ছাড়, আমাকে সুখী হতে দাও।

মিসেস ভেন মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, এবং নকল নাটকীয় ভঙ্গিমায়, যে ভঙ্গিমাটি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের স্টেডের ওপরে স্ববাবসিদ্ধ কলাকৌশলের সঙ্গে প্রকাশ করতে হয়, তিনি মেয়েকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে দরজাটা খুলে গেল। ঘরের মধ্যে ঢুকে এল একটি যুবক, মাথার চুলগুলি তার উসকো-খুসকো, কটা রঙের। চেহারার বাঁধুনি শক্ত, হাত আর পা বেশ লম্বা, চলার ভঙ্গিমাটা বেশ সাবলীল নয়। বোনের মতো পরিচ্ছন্ন ভাবে সে মানুষ হয়ে ওঠেনি। দুজনের মধ্যে যে একটা নিকট সম্পর্ক রয়েছে হঠাৎ দেখলে তা বোঝা বেশ কষ্টকর। মিসেস ভেন ছেলেটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, মুখের ওপরে ছড়িয়ে। পড়ল সিটি। মনে মনে ছেলেটিকে তিনি রঙ্গমঞ্চের দর্শকদের ভূমিকাতে দেখতে লাগলেন। তিনি নিশ্চিত হলেন যে মূকনাটকটি ভালোই জমেছে।

ছেলেটি মিষ্টি সুরে একটু বিক্ষোভ জানিয়ে বলল, তোমার কয়েকটা চুমু আমার জন্যে রেখো, সাইবিল।

সাইবিল বলল, তাই বুঝি! কিন্তু কেউ তোমাকে চুমু খেলে তো তোমার ভালো লাগে না। তুমি। একটি দুষ্ট বৃদ্ধ ভালুক।

এই বলে মেঝের ওপর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরল।

জেমস ভেন তার বোনের দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, বলল, আমার সঙ্গে একটু বেড়িয়ে আসবে চল, সাইবিল। মনে হচ্ছে, এই বিতিকিচ্ছিরি লন্ডলে আমি ফিরব না। আমি তোমাকে নিশ্চয় করে বলতে পারি, এখানে ফিরে আসার ইচ্ছে আমার নেই।

একটা জমকালো থিয়েটারের পোশাক তুলে নিয়ে ভাঁজ করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস ভেন বললেন, ওরকম ভয়ংকর কথা বলো না বাচ্চা।

ছেলেটি যে থিয়েটারে নামল না এতে তিনি খুবই হতাশ হয়েছিলেন, নামলে নাটকটা জমত ভালোই।

কেন বলব না, মা? সত্যিই বলছি, ফিরে আসার ইচ্ছে আমার নেই।

তোমার কথা শুনলে আমার বড়ো কষ্ট হয় বাচ্চা। আমি বিশ্বাস করি প্রচুর অর্থ নিয়েই তুমি। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসবে। সমাজ বলতে কলোনিতে কিছু নেই, যা রয়েছে বলে শুনেছি তাকে আমরা সোসাইটি বলতে পারি না। সেই জন্যে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করার পর আর তোমার সেখানে থাকার দরকার নেই। এখানে ফিরে এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে তুমি।

ছেলেটি প্রতিবাদের সুরে বিড় বিড় করে বলল, সোসাইটি! ও নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানোর সময় আমার নেই। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে প্রচুর অর্থ রোজগার করা। তারপরে তোমাকে আর সাইবিলকে স্টেজ থেকে সরিয়ে আনা। স্টেজে অভিনয় করাকে আমি ঘৃণা করি।

সাইবিল হাসতে হাসতে বলল, ও জিম। কী নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছ তুমি? কিন্তু সত্যিই কি তুমি আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে? খুব খুশি হব আমি আমার ভয় হচ্ছিল তুমি হয়তো তোমার কিছু বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিতে বেরিয়ে গিয়েছ, বিশেষ করে টম হার্ডি। যে। তোমাকে ওই বিচ্ছিরি পাইপটা দিয়েছ, অথবা নেড ল্যাঙটল, সেই পাইপ টানার জন্যে যে তোমাকে সব সময় ঠাট্টা করে। বিকেলটা আমার সঙ্গে বেড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে তুমি যে আমাকে ভালোবাস তারই প্রমাণ দিয়েছ। কোথায় যাবে বল তো? চুল, পার্কে যাই।

ছেলেটি একটু চটেই বলল, আমার পোশাক নোংরা। ধনী লোকরাই কেবল পার্কে যায়।

তার জামার হাতটা চাপড়াতে চাপড়াতে সাইবিল বলল, বোকা কোথাকার, জিম।

এক মুহূর্ত দ্বিধা করল জিম, তারপরে বলল, ঠিক আছে। কিন্তু আজতে বেশি দেরি করো না। চটপট সেরে নাও।

নাচতে নাচতে ঘরের বাইরে চলে গেল সাইবিলা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সে সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। সেই গানের সুর নীচেও শোনা গেল। মাথার ওপরে তার ছোট্ট পা দুটি অস্থিরভাবে ছোটাছুটি করতে লাগল।

জিম দু-তিনবার ঘরের মধ্যে পায়চারি করল, তারপরে চেয়ারের ওপরে নিশ্চলভাবে যে মূর্তিটি বসেছিল তার দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করল, মা, আমার জিনিসপত্র সব ঠিক করে রেখেছ?

নিজের কাজের দিকে চোখ রেখে মা বললেন, হ্যাঁ, জিম। সব ঠিক রয়েছে।

এই রুক্ষ, কড়া মেজাজের পুত্রটির সঙ্গে যখনি তিনি একা থেকেছেন, বিশেষ করে শেষ কটি মাস, তখনি মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি ভোগ করেছেন। দুজনের চোখাচোখি হলেই, তাঁর গোপন সফরী-চরিত্রটা নিজেকে বিপদাপন্ন বলে মনে করত ছেলেটি কিছু সন্দেহ করছে নাকি এই কথাটাই প্রায় তিনি অবাক হয়ে ভাবতেন। ছেলেটি কথা বলত কম, চুপচাপ থাকত বেশি। এই সময়টাই তাঁর কাছে অসহ্য লাগত। ফলে তিনি অভিযোগ করতে শুরু করলেন। ওপরকে আক্রমণ করেই মহিলারা নিজেদের রক্ষা করে, ঠিক যেমন হঠাৎ এবং অদ্ভুতভাবে আত্মসমর্পণ করার উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে।

তিনি বললেন, জেমস, আমি আশা করি, নাবিকের জীবনে তুমি সন্তুষ্ট হয়েছা স্মরণ রেখ, এ-জীবন তুমি নিজেই বেছে নিয়েছ। তুমি কোনো সলিসিটরের অফিসে চাকরি নিতে পারতে, শ্রেণি হিসাবে সলিসিটরদের আমরা সম্মানাই বলে মনে করি, এবং এদেশে তারা বেশ উঁচু সম্প্রদায়ের সঙ্গে ডিনার খায়।

জেমস উত্তর দিল, চাকরির জীবনটাকে আমি ঘৃণা করি, বিশেষ করে কেরানির চাকরি। কিন্তু তুমি ঠিক কথাই বলেছ। নিজের পেশা আমি নিজেই ঠিক করে নিয়েছি। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, সাইবিলের ওপরে লক্ষ রেখো। তার যেন কোনো ক্ষতি না হয় মা, তার দিকে নজর রেখো।

জেমস, তোমার কথা শুনে অবাক হচ্ছি। তার ওপরে নিশ্চয় আমি লক্ষ রাখি।

শুনলাম একটি ভদ্রলোক নাকি প্রতিদিন থিয়েটারে আসেন, আর তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। স্টেডের পিছলে যান। এ সংবাদ কি সত্যি? এ বিষয়ে কী বল তুমি?

জেমস, তুমি কি বলছ তা তুমি নিজেই জান না। আমাদের পেশায় আমাদের যাঁরা গুণমুগ্ধ তাঁদের অভ্যর্থনা জানাতে আমরা অভ্যস্ত। একসময় আমি নিজেও অনেক ফুলের তোড়া। উপহার পেয়েছি। সে-যুগে সত্যিকার অভিনয় কাকে বলে মানুষ তা বুঝত। সাইবিলের কথা যদি বল, আমি জানি না ওদের এই আলাপ সত্যিকার সিরিয়াস, কি সিরিঘাস নয়। কিন্তু যুবকটি যে সত্যিকার ভদ্র সেদিক থেকে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমাকে সে খুব শ্রদ্ধা করে। তাছাড়া দেখলে মনে হয় ছেলেটি ধনী, যে সব ফুল সে আমাদের পাঠায় সেগুলিও খুব সুন্দর।

জেমস কর্কশ স্বরেই বলল, যদিও তুমি তার নাম জান না।

মুখের চেহারা কোনো রকম বিকৃত না করেই মা বললেন, না। ছেলেটি তার আসল নামটা পর্যন্ত আমাকে এখনো বলেনি। মনে হচ্ছে, এই না-বলাটাই তার একটা আনন্দ ছেলেটি সম্ভবত অভিজাত শ্রেণির

নিজের ঠোঁট কামড়াল জেমস, শুধুমাত্র বলল, ওর দিকে লক্ষ রেখো মা, ওর ওপরে লক্ষ রেখো।

বাছা, তোমার কথা শুনে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। সাইবিল সব সময় আমার বিশেষ নজরের মধ্যে রয়েছে। অবশ্য এই ছেলেটি যদি ধনী হয় তাহলে, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতেই বা সাইবিল ইতস্তত করবে কেন? আমার বিশ্বাস ছেলেটি অভিজাত সম্প্রদায়ের পাত্র হিসাবে সাইবিলের পহেল্ক ছেলেটি হবে পয়লা নম্বরের। দুজনে মিলবেও ভালো, যাকে বলে রাজযোটক মিলা ছেলেটি দেখতেও বেশ ভালো। সবাই তা লক্ষ করেছে।

নিজের মনে মনে বিড় বিড করতে লাগল জেমস, তারপরে জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে শার্সির ওপরে আঙুলের টোকা দিতে লাগল। কিছু বলার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতেই সে দেখল। দরজটা খুলে গিয়েছে, সেই খোলা দরজার ভেতর দিয়ে সাইবিল দৌড়ে আসছে।

সে বলল, তোমরা দুজেনি দেখছি বেশ গম্ভীর। বলি, ব্যাপারটা কী?

জেমস বলল, ও কিছু নয়। মাঝে মাঝে মানুষের কিছুটা সিরিয়াস হওয়া উচিত। মা, আমরা চললাম। সন্ধে পাঁচটার সময় আমি ডিনার খাব। একমাত্র শার্ট ছাড়া, আর সবই গোছানো হয়ে গেছে। তোমার কোনো অসুবিধে হবে না।

একটু কষ্টকল্পিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে মা বললেন, এস।

জেমস যে ভাষায় তাঁর সঙ্গে কথা বলছিল তাতে তিনি সত্যিই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তার চোখের মধ্যে এমন একটা জিনিস তিনি দেখছিলেন যেটা তাঁকে রীতিমতো শঙ্কিত করে তুলেছিল।

সাইবিল বলল, আমাকে একটা চুমু দাও, মা।

এই বলে সে তার ফুলের মতো নরম দুটি ঠোঁট দিয়ে তার মায়ের শুকনো গালের হাড়ের ওপর চুমু খেল। তাঁর ঠান্ডা গাল দুটিকে উষ্ক করে তুলল।

কাল্পনিক দর্শকের অন্বেষণে ওপরের দিকে তাকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিমায় মা বললেন, বাছা, বাছা আমার!

জেমস অস্থির হয়ে বলল, এস সাইবিল।

মায়ের এই স্নেহ প্রবণতাকে সে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারল না।

বাতাসে কাঁপানো সূর্যের আলোতে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, হাঁটতে লাগল। নিরানন্দ উসটন রোড ধরে। একটি সুন্দরী পোশাকে-চললে পরিচ্ছন রুচির মেয়ের পাশে ওই রকম। বেখাপ্পা পোশাক পরা গম্ভীর মোডের বিষণ্ণ একটি যুবককে হাঁটতে দেখে পথচারীরা একটু অবাক হয়েই তাদের দিকে তাকাতে লাগল। তাদের মনে হল যেন একটি গোলাপ ফুলের সঙ্গে একটা সাধারণ মালি হেঁটে চলেছে।

অপরিচিত কোনো মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টির ওপরে চোখ পড়ার ফলে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল জিম, মাঝে মাঝে কুটিও করল। অদ্ভুত চেহারার মানুষদের কৌতূহলী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকার অভ্যাস সাধারণ মানুষরা কোনো দিনই ছাড়তে পারে না। শেষ জীবনে জিনিয়াসরা এই দৃষ্টির জ্বালায তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠেন। সেই রকমের একটা অনুভূতি। জিমকেও আচ্ছন্ন করে ফেলল। সাইবিলের অবশ্য অন্য কথা। পথচারীদের ওপরে সে যে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে সে-বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না। প্রেমের আবেগ হাসির উচ্ছ্বাসে তার ঠোঁট দুটিকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। সে তখন প্রিন্স চার্মিং-এর কথাই ভাবছিল। তার সম্বন্ধে বেশি চিন্তা করার জন্যে তাঁকে নিয়ে মুখে কোনো আলোচনা করল না। সাইবিল। আলোচনা করল কেবল জিম-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে, যে-জাহাজে চড়ে সে যাবে সেই জাহাজ নিয়ে, বিদেশে গিয়ে সে যে প্রচুর সোনা রোজগার করবে সেই সোনা নিয়ে, দুষ্টপ্রকৃতির রেড-ইন্ডিয়ানদের হাত থেকে যে অপরুপ সুন্দরী রাজকুমারীকে সে উদ্ধার করবে–সেই ভাবনা নিয়ে। কারণ, একটি সাধারণ নাবিক অথবা সুপার-কারগো অথবা এখন সে যে কাজের জন্যে যাচ্ছে সেইটুকু নিয়েই সে জীবন কাটাবে না। না, না, নিশ্চয় না। নাবিকের ভীবন বড়ো কষ্টকর। একটা ডাহাড়ের খোলের মধ্যে বন্ধ হয়ে থাকটা কি ভীষণ কষ্টকর। চারপাশে সমুদ্রের তরঙ্গ, হাডার হাডার সেই তরঙ্গ বিরাট বিরাট ঝুটি বাগিয়ে ফুলে-ফুঁসে চারপাশে সমুদ্রের তরঙ্গ, হাজার হাজার সেই তরঙ্গ বিরাট বিরাট ঝুটি বাগিয়ে ফুলে-ফুঁসে চারপাশ থেকে ধাক্কা দিচ্ছে জাহাঙটাকে। কখনো কখনো বা কালো কালো দৈত্যদানব ঝড়ের ঝাপটায় পাল ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। নাবিকের জীবন সে যে কত ভয়ঙ্কর, কত বিপজ্জঙ্ক তা একবার ভেবে দেখুন। মেলবোর্নে সে ডাহাজ থেকে নামবে, ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা সোনার খনিতে হাজির হবে। এক সপ্তাহ কাটার আগেই একতাল খাঁটি সোনা সে পেয়ে যাবে। আজ পর্যন্ত অত বড়ো তাল কেউ খুঁজে পায়নি। ছ‘জন সশস্ত্র অশ্বারোহী পুলিশের তত্ত্বাবধানে সেই তালটা রেলগাড়িতে চাপিয়ে। সমুদ্রোপকূলে নিয়ে আসা হবে। বনে-বাদাড়ে যে সব ডাকাতরা লুকিয়ে থাকে সেই সোনা। ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে তারা অন্তত বার তিনেক গাড়িটাকে আক্রমণ করবে। কিন্তু তাদের আক্রমণ প্রতিহত হবে। অনেক হতাহতকে পেছনে গেলে পালিয়ে যাবে তারা।

অথবা, না। জিম আদৌ হয়তো সোনার খনির দিকে যাবে না। এই খনিগুলি বড়ো খারাপ জাযগা। এসব জায়গায় যারা কাজ করে তারা সব সময়ে মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকে। সেই মত্ত। অবস্থায় সরাইখানায় তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, মুখ খিস্তি করে। হয়তো সে যাবে কোনো মেষপালকের খামারে। কোনো কোনো এক সন্ধ্যায় যখন সে ঘোড়ায় চড়ে খামারে। ফিরবে এমন সময় সে হয়তো দেখতে পাবে কোনো দস্যু কালো পোশাক পরে একটা কালো ঘোড়ার পিঠে চডিযে একটি ধনীর অপরুপ সুন্দরী মেয়েকে চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছে। সেই দেখে সে দস্যুকে তাড়া করবে, উদ্ধার করে আনবে মেয়েটিকে। তারপরে নিশ্চয় মেয়েটি তার প্রেমে পড়ে যাবে, জিমও ভালোবেসে ফেলবে তাকে। শেষ পর্যন্ত সেই মেয়েটিকে বিয়ে করে প্রচুর সম্পদ নিয়ে ফিরে আসবে জিম, লন্ডনে বিরাট একটি প্রাসাদ নিয়ে বসবাস করবে। হ্যাঁ, নিশ্চয় অনেক প্রাচুর্য, অনেক আনন্দ জিমের জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছে কিন্তু তাকে চরিত্রের দিক থেকে ভালো হতে হবে, মেজাজটিকে রাখতে হবে শরিফ; মুখের মতো অর্থনষ্ট করলে তার চলবে না, জিমের চেয়ে সে মাত্র এক বছরের বড়ো; কিন্তু সাংসারিক অভিজ্ঞতা তার অনেক, অনেক বেশি। প্রতিটি ডাকে সে যেন তাকে চিঠি দে, আর প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে যেন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে। ভগবান খুব ভালো, তিনি নিশ্চয় তাঁর দিকে লক্ষ্য রাখবেন। সে নিজেও তার ভাই-এর জন্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাবে। কয়েকটা বছরের মধ্যে জিম বেশ ধনী আর সুখী হয়ে ফিরে আসবে।

ছেলেটি গম্ভীর হয়ে তার কথা শুনছিল; কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার চিন্তায় তার মনটা খুব খারাপ হয়েছিল।

তবু ওই একটা ব্যাপারই তাকে বিষণ্ণ করেনি। সাংসারিক অভিজ্ঞতা তার যথেষ্ট না থাকলেও, সাইবিলের পেশায় যে বিপদ রয়েছে সে-সম্ভাবনাটাও কেমন যেন তাকে বিব্রত করে তুলেছিল। ওই যে ভদ্রবেশধারী যুবকটি তার সঙ্গে প্রেম করে চলেছে সেটা তার কাছে মঙ্গলজনক না-ও হতে পারে। যুবকটি ভদ্রলোক; বিশেষ করে সেই জন্যেই জিম তাকে ঘৃণা করে, যদিও এর পেছনে ঠিক কী কারণ রয়েছে তা সে বুঝতে পারে না; হয়তো শ্রেণিবিদ্বেষই এর মূল কারণ। তার মায়ের বুদ্ধি আর চিন্তাশক্তি যে যথেষ্ট কম সে-বিষয়েও তার সন্দেহ কম ছিল না। বিশেষ করে সেই কারণে বিপদে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা সাইবিলের রয়েছে বলে সে মনে করত। শিশুরা তাদের বাবা-মাকে ভালোবেসেই জীবন শুরু করে। ব্যস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তাঁদের বিচার করতে শুরু করে; কখনো-কখনো তাঁদের দোষ তারা ক্ষমাও করে।

তার মা! একটা প্রশ্ন মাকে তার করার ইচ্ছা ছিল, অনেক দিন ধরে এই প্রশ্নটা সে মনের গভীরে লুকিয়ে রেখেছিল থিয়েটারে একদিন হঠাৎ কথাটা তার কানে গিয়েছিল, একদিন সে যখন থিয়েটারের দরজায় অপেক্ষা করছিল সেই সময় কিছু লোক কথাটা নিয়ে হাসাহাসি। করছিল। সেই হাসির টুকরো সে শুনতে পেয়েছিল। মনে হল, কে যেন তার মুখের ওপরে সুপাং করে একটা চাবুক কষিয়ে দিয়েছে। তার কপালে কুঞ্চিত হল এবং একটা মারাত্মক রকমের যন্ত্রণাকে সহ্য করার জন্যে সে তার নীচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল।

সাইবিল; আমার কথা কিছুই তোমার কানে ঢুকছে না, জিম। তোমার ভবিষ্যৎ জীবনের কী সুন্দর পরিকল্পনাই তোমার জন্যে আমি তৈর করে দিচ্ছি। কিছু বল।

কী শুনতে চাও তুমি?

সাইবিল ভাই-এর দিকে চেয়ে হেসে বলল: তুমি বেশ লক্ষ্মী ছেলে হবে, আর আমাদের ভুলে যাবে না।

জিম তার কাঁধে একট স্রাগ করল, তারপরে বলল: তুমিই বরং আমাকে তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে সাইবিল; অন্তত সেদিক থেকে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

সাইবিলের মুখ লাল হয়ে উঠল: তুমি ঠিক কী বলতে চাচ্ছ জিম?

শুনছি, তোমার একটি নতুন বন্ধু হয়েছে। সে কে? তার বিষয়ে তুমি আমাকে কিছু বলনি কেন? তাকে দিয়ে তোমার কোনো মঙ্গল হবে না।

সাইবিল চেঁচিয়ে উঠল: জিম, তুমি থাম, তার বিরুদ্ধে কোনো কথা তুমি বলবে না, আমি তাকে ভালোবাসি।

জিম বলল: ভালোবাসা? সাবাস! তুমি তার নামটা পর্যন্ত জান না। কে সে? তার পরিচয় কী? এসব জানার অধিকার আমার রয়েছে।

তাকে সবাই প্রিন্স চার্মিং বলে ডাকে। এ-নামটা তোমার পছন্দ হয় না? বোকা ছেলে কোথাকার। এ নামটা ভুলে যাওয়া তোমার উচিত নয়। তাকে একবার চোখে দেখলে তোমার মনে হত অমন সুন্দর, অপরূপ মানুষ পৃথিবীতে আর বুঝি নেই। একদিন তার সঙ্গে তোমার। দেখা হবে; অবশ্য অস্ট্রেলিয় থেকে ফিরে আসার পূরে; খুব ভালো লাগবে তোমার। সবাই তাকে পছন্দ করে; আর আমি…আমি তাকে ভালোবাসি। তুমি যদি আজ থিয়েটারে আসতে পারতে! সে আজ আসছে। আজ আমি ভুলিযেট-এর ভূমিকায় অভিনয় করব। উঃ, কী রকম অভিনয় করব বল তো? ডিমি, ভেব দেখ, সত্যিকার প্রেমে পড়ে জুলিয়েট-এর অভিনয় করব আমি। সে থিয়েটারে বসে আমার অভিনয় দেখবে তাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য অভিনয় করব আমি। ভয় হচ্ছে, আমি হয়তো দর্শকদের ভয় পাইয়ে দেব; প্রেমে পড়লেই মানুষ তার স্বাভাবিকতার বেড়া ডিঙিয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে যায়। আর ওই হতভাগ্য বদমেজাজী আইস্যাকস তার বার-এ যে সব তৃতীয় শ্রেণির মানুষরা মদ খেতে ঢোকে তাদের কাছে আমার অভিনয়ের প্রশংসা করে বলবে–একটি প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী। এতদিন সে আমাকে প্রচার করেছিল গোঁড়া বলে এখন সে প্রচার করে আমি একটি ঐশ্বরিক শক্তিধারিণী প্রতিভা বিশেষ। আমি তা বেশ বুঝতে পারছি। আর এ-সমস্তই কেবল তারই জন্যে–সেই প্রিন্স চার্মিং-এর। কিন্তু তার উপযুক্ত আমি নই? দরিদ্র আমি! দরিদ্র? তাতে কী যায় আসে? ঘরের। দরজা দিয়ে যখন দারিদ্র্য হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে আসে, প্রেম তখন ডানালার ভেতর দিয়ে উড়ে যায়। আমাদের এই প্রবাদ বচনটিকে নতুনভাবে লিখতে হবে। মানুষের দুঃখের দিনে এই প্রবচনটি রচিত হয়েছিল; এখন সুখের দিন আমার-বসন্তের মাতাল করা দিন; নীল আকাশের বুক ফুলের সমারোহ জাগার দিন।

জিম গম্ভীরভাবেই বলল: তিনি ভদ্রলোক…

গানের ঢঙে সাইবিল বলল: ভদ্রলোক কি বলছ–বল-রাজকুমার-প্রিন্স। আর বেশি তুমি কী চাও?

তিনি তোমাকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধতে চান।

তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আশঙ্কায় আমি কাঁপি।

আমি চাই তাঁকে তুমি এড়িয়ে চল।

তাকে দেখা পাওয়ার অর্থই হচ্ছে তাকে পুজো করা; তাকে যে ভানে সে তাকে বিশ্বাস না করে। পারে না।

সাইবিল, তুমি উন্মাদের মতো কথা বলছ।

সাইবিল হেসে তার একটা হাত ধরে বলল: ভাই জিম, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে বয়স। তোমার একশো বছরের কাছাকাছি সময় আসবে যেদিন তুমি নিজেকেই নিজে ভালোবেসে। ফেলবে। তখন তুমি বুঝতে পারবে ভালোবাসা কী বস্তু। অতটা মুখ গম্ভীর করে রেখো না। যদিও তুমি চলে যাচ্ছ, তবু যাওয়ার সময় এই কথাট ডেনে যাও যে আগের চেয়ে এখন আমি অনেক সুখী। তোমাকে এবং আমাকে দুজনকেই বেশ কষ্টের ভিতর দিয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে। কিন্তু এখন সেই কষ্টের সমাপ্তি। তুমি পেযে একটি নতুন জগতের সন্ধান, আমি পেযেছি একটি নতুন জীবনের সন্ধান। দুটি চেয়ার আমাদের সামনে রয়েছে পাতা। এস, আমরা এদের ওপরে বসে চালাক-চতুর মানুষদের আসা-যাওয়া দেখি।

একদল উৎসুক দর্শকদরে চোখের সামনে তারা দুটি চেয়ার দখল করে বসল। রাস্তার ওপরে একরাশ আগুন রঙের লাল ফুল গোল করে কাঁপছে। মহিলাদের চকচকে রৌদ্রনিবারণী ছাতাগুলি বাতাসে কাঁপছে দেখে মনে হচ্ছে যেন বিরাট-বিরাট প্রভাপতির দল নেচে-নেচে বেড়াচ্ছে।

সাইবিলের অনুরোধে জিম তার ভবিষ্যতের অনেক আশা-ভরসার কথা বলতে লাগল। বেশ কষ্ট করেই সে ধীরে-ধীরে মুখ খুলল। তারপরে দুজনেই কথায় মেতে উঠল। বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল সাইবিল। নিজের আনন্দের কথা কিছুতেই খুলে বলতে পারছিল না। ভাই-এর কাছ থেকে কোন সহানুভূতির কথা সে শুনতে পায়নি। তার কথা শুনে সে মাঝে-মাঝে একটু আধটু ভ্রূকুটি করছিল মাত্র। কিছুক্তণ পরে সাইবিল নিজেই চুপ করে গেল। হঠাৎ ডোরিয়েন গ্রে-র সোনালি চুল আর হাসিমাখা মুখখানা তার চোখ পড়ল। একটা খোলা গাড়িতে চেপে দুটি মহিলার সঙ্গে গ্রে তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল।

সাইবিল উত্তেজনায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বলল: ওই যে সে।

জিম জিজ্ঞাসা করল: কার কথা বলছ?

অপসৃয়মান গাড়িটির দিকে তাকিয়ে সাইবিল বলল: প্রিন্স চার্মিং।

জিম লাফিয়ে উঠল; তারপর সাইবিলের একটা হাত ধরে জোরে নাড়া দিয়ে বলল: কোথায়, কোথায়? কোনটি তোমার প্রিন্স চার্মিং? বল-বল। তাকে আমি দেখবই।

কিন্তু দেখা বা দেখানোর সুযোগ কোনোটাই হল না। ঠিক সেই মুহূর্তে বারউইকসএর ডিউকের চার ঘোড়ার গাড়িটি দু’দলের মাঝখানে এসে হাজির হল। পথ যখন পরিষ্কার হল তখন ডোরিয়েনের গাড়িটি পার্কের এলাকা ছাড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।

দুঃখের সঙ্গে সাইবিল বলল: সে চলে গিয়েছে। তাকে যদি তুমি দেখতে পেতে আমি তাহলে খুব খুশি হতাম।

দেখতে পাওয়া উচিত ছিল আমার, কারণ, ভগবানের দিব্যি করে বলছি, ওর হাতে যদি তোমার কোনো ক্ষতি হয় তাহলে ওকে শেষ করে ছাড়ব।

কথাটা শুনে সাইবিল তার ভাই-এর দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইল। জিম সেই কথাটাই আবার বলো ধারালো ছুরির মতো কথাগুলি বাতাসের বুকে কেটে-কেটে বসল। আশপাশের লোকেরা তাদের দিকে তাকিয়ে রইল হাঁ করে। সাইবিলের পাশে দাঁড়ানো একটি মহিলা তো মুখ চিপে ফিক ফিক করে হেসেই উঠল।

চারপাশের অবস্থা দেখে সাইবিল ফিসফিস করে বলল: জিম, চলে এস।

জিম ভিড়ের ভিতর দিয়ে সাইবিলের পিছু পিছু এগোতে লাগল। সে যে ওই কথাগুলি বলতে পেরেছে তাতেই সে খুশি।

অ্যাকিলিস-এর মূর্তির কাছাকাছি আসার পরে, সাইবিল ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখের মধ্যে এতক্ষণ করুণার একটা ছায়া লুকিয়ে ছিল; সেইটাই এবারে তার ঠোঁট দুটির ওপরে হাসির। ছটায় রূপান্তরিত হল। জিম-এর দিকে তাকিয়ে মাথায় ঝাঁকানি দিয়ে সে বলল: জিম, তুমি বোকা; শুধু বোকাই নও, একেবারে যাকে বলে নিরেট গর্দভ, বদমেজাজী। এসব কথা তুমি উচ্চারণ কর কেমন করে? কী বলছ তা তুমি জান না! তুমি কেবল হিংসুটেই নও, বড়ো কঠিন। আমি চাই তুমিও প্রেমে পড়া একমাত্র প্রেমই মানুষকে ভালো করে। এইমাত্র তুমি যা বললে সে-সব কথা দুষ্ট লোকেরা বলে থাকে।

জিম বলল: আমার বয়স ষোল। আমি কি বলছি তা আমি জানি। কোনোদিন দিয়ে মা তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারছে না। তোমাকে কী ভাবে মানুষ করতে হবে সে-সম্বন্ধে মায়ের কোনো ধারণা-ও নেই। ঠিক এই সময় অস্ট্রেলিযা না যেতে পারলেই খুশি হতাম আমি। সব জিনিসটা বেশ ভালো করে তলিয়ে দেখার ইচ্ছা ছিল আমার। কিন্তু কাগজপত্র সব সই হয়ে গিয়েছে। বিপদটা সেইখানেই।

না, না জিম। অত ভাববার দরকার নেই। মা যে সব রম্য-নাটক অভিনয় করতে ভালোবাসত, তুমি সেই সব নাটকেরই নায়কের মতো কথা বলছ তোমার সঙ্গে ঝগড়া আমি করব না। আমি তাকে দেখছি, তাকে দেখেই আমার মন-প্রাণ আনন্দে ভরে উঠেছে। কোনোদিনই আমরা ঝগড়া করব না। আশা করি, আমি যাকে ভালোবাসি তার কোনো ক্ষতি করবে, না। আমার এ ধারণা ঠিক তো?

জিম গম্ভীরভাবে বলল:অবশ্য যতক্ষণ তুমি তাকে ভালোবাসবে ততক্ষণ।

সাইবিল একটু চেঁচিয়ে আর বেশ জোর দিয়েই বলল; আমি তাকে চিরকাল ভালোবাসব।

আর সে?

সেও চিরকাল।

স্বার্থের খাতিরে তাই তার করা উচিত। সাইবিল তার কাছ থেকে একটু সরে গেল; তারপরে হেসে তার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে ধরলা ভিম সত্যিই বড়ো ছেলেমানুষ।

মার্বেল আর্চের কাছে এসে তারা একটা বাস ধরল। এসটেন রোড-এ বাডির কাছাকাছি একটা জায়গায় নেমে গেল তারা। বিকাল পাঁচটার পরেই তারা ফিরে এল। থিয়েটারে যাওয়ার আগে ঘন্টা-দুই সাইবিলকে বিশ্রাম নিতে হবে, স্রেফ বিছানার ওপরে গড়াগড়ি দিতে হবে তাকে। বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে জিমও বারবার তাকে চাপ দিল। সে বলল তার মা একটু সরে গেলেই সে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবে। অন্যথায়, মা কান্নাকাটি করে শেষ পর্যন্ত একটা কাণ্ড করে তুলবে। কান্নাকাটি করে হইচই করাটাকে সে একদম বরদাস্ত করতে পারে না।

সাইবিলের ঘরেই তারা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল। ছেলেটির মনের মধ্যে হিংসার একটা বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল, তাদের দুজনের মধ্যে এই তৃতীয় ব্যক্তিটির আগমন সে মোটেই বরদাস্ত করে উঠতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, আগন্তুকটির সঙ্গে দেখা হলে সে তাকে খুন করে ফেলতে পারত। তবু, যখন সাইবিল দুটি হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল, তার চুলের ভেতর দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকে চুমু খেল তখনই তার মনটা নরম হয়ে গেল; সত্যিকার ভালোবাসা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল; সেও আদুরে ভাই-এর মতো বোনকে চুমু খেল। সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল তারা; চোখের জলের ভেতর দিয়ে বিদায় নিল।

তার জন্যে নীচে তার মা অপেক্ষা করছিলেন। সে ঘরে ঢুকতেই, দেরি করার জন্যে মা গজ গজ করতে লাগলেন। কোনো উত্তর না দিয়ে জিম খেতে বসল। খাওয়ার আয়োজন এমন কিছু ছিল না। কিন্তু তা-ও তার খুব ভালো লাগল বলে মনে হল না। চারপাশে মাছি ভন ভন করতে লাগল; দু’চারটে টেবিলের ওপরে লাগল ঘুরতো রাস্তায় যানবাহনের হট্টগেল; এদের মধ্যে দিয়েই তার বিদাযের শেষ কটি মুহর্ত ধীরে-ধীরে নিঃশোষিত হতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে সে খাবারের থালাটা সরিয়ে রাখল; মাথাটাকে দুটো হাতের চেটো দিয়ে চেপে ধরল। তার মনে হল ওদের মধ্যে কী ঘটছে তা বিশেষভাবে জানার অধিকার তার রয়েছে এ ব্যাপারটা তাকে আরো আগেই ডানানো উচিত ছিল। তাহলে সে বুঝতে পারত সে যা সন্দেহ করেছে সেটা সত্যি কি না। ছেলের অকস্মাৎ এই ভাবালুতায় মা ভয় পেয়ে তার দিকে তাকিয়ে। রইলেন। যান্ত্রিকভাবেই তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গেল, একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ার রুমাল তিনি আঙুলে জড়াতে লাগলেন। ঘড়িতে ছটা বাজল। জিম ধীরে ধীরে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তারপরে সে ঘুরে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে তাকাল। চোখাচোখি হল দুজনের। জিম দেখল মা তাকে সব জিনিসটা হন্ডুমার চোখে দেখতে অনুরোধ করছেন। এই মনে হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সে চটে উঠল।

মা, তোমাকে কিছু বলার রয়েছে আমার।

মা-র চোখ দুটি ঘরের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কোনো উত্তর দিলেন না তিনি।

মা, আমাকে সত্যি কথা বলা কথাটা জানার অধিকার রয়েছে আমার বাবার সঙ্গে কি তোমার বিয়ে হয়েছিল?

ভদ্রমহিলা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। বুকের বোঝা অনেকটা হালকা হয়ে গেল তাঁর। এতদিন ধরে, দিনে আর রাতে, সপ্তাহ আর মাস ধরে সে মুহর্তটির জন্যে আতঙ্কিত হৃদয়ে তিনি অপেক্ষা করে দিন গুনছিলেন সেই চরম মুহূর্তটি তাঁর সামনে এসে হাজির হয়েছে। যতই কদর্য হোক, প্রশ্নটি সোডা, সোডা উত্তরই দিতে হবে তাঁকে। এই রকম একটি অবস্থার। জন্য কোনোরকম প্রস্তুতি ছিল না। জিম-এর প্রশ্নটি অকস্মাৎ; কেবল অকস্মাৎ-ই নয়, একেবারে যাকে বলে অমার্জিত; অনেকটা নাটকের খারাপ রিহার্সালের মতো।

ভীবনের সহজ বর্বর গতির কথা চিন্তা করে অবাক হয়েছিলেন তিনি। এটাই যেন জীবনের একমাত্র সত্য; কিন্তু কেন যে এই বর্বরতা মানুষ মেনে নেয়, বা মেনে নিতে বাধ্য হয়, তা ডানার মতো দই→তা তাঁর ছিল না, অনেক সহজ ডিলিসের মতো এটাও একটা বর্বর সত্য।

না; বিয়ে হয়নি।

দুটো হাত শক্ত করে ঘুষি পাকিযে ছেলেটি চিৎকার করে উঠল: আমার বাবা তাহলে একটি স্কাউনড্রেল।

ঘাড় নাড়লেন তিনি বললেন: না, আমি জানতাম, সামাজিকভাবে বিয়ে তিনি আমাকে করতে পারতেন না। সেদিকে থেকে যথেষ্ট অসুবিধে ছিল তাঁর। কিন্তু আমরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসতাম। বেঁচে থাকলে, নিশ্চয় তিনি আমাদের জন্যে ব্যবস্থা করে যেতে পারতেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করো না, বাছা; তিনি তোমার বাব এবং ভদ্রলোক। তাছাড়া, অভিজাত ছিলেন তিনি।

ভ্রুকুটি করল জিম: আমার জন্যে কিছুই আমি গ্রাহ্য করিনে। কিন্তু সাইবিলকে তুমি কিছুতেই…এও তো একজন ভদ্রলোক-তাই ন্য-ওই যে লোকটি সাইবিলকে।

ভালোবাসে–অথবা, বলে সে ভালোবাসে? তাছাড়া, মনে হচ্ছে–বেশ অভিজাত সমপ্রদায়ের মানুষ-তাই না?

হঠাৎ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। একটা ভয়ঙ্কর রকমের ক্লেদাক্ত অপমান তাঁকে স্তব্ধ করে দিল। লজ্জায় মাথাটা নুয়ে পড়ল তাঁর। হাত দুটো কাঁপতে লাগল। সেই কাঁপানো হাত দিয়ে চোখ দুটো তিনি মুছলেন, বললেন: সাইবিলের মা রয়েছে। আমার মা ছিল না।

মায়ের কথা শুনে জিমের মন নরম হয়ে গেল, সে তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে নীচু হয়ে তাঁকে চুমু খেল; বলল: বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে তোমাকে যদি কষ্ট দিয়ে থাকি তার জন্য আমি দুঃখিত, মা। কিন্তু জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না। এখন আমাকে যেতেই হবে। ভুলে যেয়ো না যে এখন থেকে লক্ষ রাখার মতো একটি সন্তানই তোমার কছে রইল; আর এটাও তুমি বিশ্বাস। করো যে সেই লোকটা আমার বোনের যদি এতটুকু ক্ষতি করে, আমি নিশ্চয় খুঁজে বার করব। তাকে, তারপর কুকুরের মতো গুলি করে মারা প্রতিজ্ঞা করছি আমি।

ভয় দেখানোর এই অনাবশ্যক মূর্খতা, উচ্ছ্বাস, আর উন্মত্ত নাটকীয় ঢঙ ভদ্রমহিলার কাছে জীবনটাকে আরো স্মৃষ্ট করে তুলল। এইরকম একটি আবহাওয়ার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। এই আবহাওয়ার তিনি আরো সহজ ভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারতেন; আর অনেক দিন পরে সেই প্রথম ছেলেকে তিনি সত্যি-সত্যিই প্রশংসা করলেন। উচ্ছ্বাসভরা এই পরিস্থিতি আরো কিছুক্ষণ কাটানোর ইচ্ছে ছিল তাঁর; কিন্তু সে-সুযোগ তিনি পেলন না; পুত্ৰই তাঁকে থামিয়ে। দিল। তখলো ট্রাঙ্কটা নামানো হয়নি; খোঁজা হয়নি ‘মাফলার’। বাস-করার অনেক টুকিটাকি জিনিস এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে ছিল। গাড়োযানের সঙ্গে দর কষাকষি করতে হল; খুঁটিনাটি কাজের অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গেল। ছেলে গাড়িতে উঠে চলে যাওয়ার পরে, নতুন ব্যর্থতায ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানালা থেকে ছেঁড়া রুমালের একটা টুকরো নিয়ে নাড়তে লাগলেন। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন একটা বড়ো রকমের সুযোগ নষ্ট হয়েছে। সাইবিলকে এই বলে তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন যে বর্তমানে তাঁর আর কাজ নেই, তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন; কারণ, এখন লক্ষ রাখার মতো একটি সন্তানই তাঁর কাছে রয়েছে। ছেলের কথাটা তাঁর মনে ছিল। কথাটা তাঁকে খুশিই করেছিল। ছেলে যে ভয় দেখিয়েছিল সে-বিষয়ে মেয়েকে তিনি কিছুই বলেননি। কথাটা জিম বেশ সপষ্ট করে আর নাটকীয় ভঙ্গিতেই বলেছিল। তাঁর মনে হয়েছিল এই কথাটা নিয়ে একদিন সবাই তাঁরা হাসাহাসি করবেন।

.

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ব্রিস্টল হোটেলের একটি ছোটো কামরায় সেদিন সন্ধ্যায় কেবল তিনজনের জন্যে ডিনার দেওয়া হয়েছিল। বেসিল হলওয়ারর্ডের সঙ্গে সেই ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে লর্ড হেনরি ডিজ্ঞাসা করলেন: বেসিল, তুমি নিশ্চয় খবরটা শুনেছ?

একজন ওয়েটার মাথা নীচু করে তাঁদের অভিবাদন জানাল; সেই ওযেটারের হাতে টপি আর কোটটা দিয়ে আর্টিস্ট হলওয়ার্ড বললেন; না, হ্যারি। কী খবর বল তো? আশা করি রাজনীতির ব্যাপার কিছু নয়? ও-সব খবরে আমার আগ্রহ নেই। হাউস-অফ-কমনস-এ এমন একজন সদস্যও নেই যার প্রতিকৃতি আঁকা চলতে পারে; যদিও অবশ্য, কিছুটা পালিশ করলে তাদের ভালোই দেখায়।

লর্ড হেনরি বললেন: ডোরিয়েন গ্রে বিয়ে করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

চমকে উঠলেন হলওয়ার্ড; তারপরে ভ্রুকুটি করলেন, বললেন: কী বললে! ডোরিয়েন গ্রে বিয়ে করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে? অসম্ভব, অসম্ভব!

না, সত্যি; যাকে বলে নির্ভেজাল সত্যি।

কাকে বিয়ে করবে?

একটি খুদে অভিনেত্রী বা ওই জাতীয় কোনো মেয়েকে।

আমি বিশ্বাস করতে রাজি নই। এসব ব্যাপারে ডোরিয়েন অনেক বেশি বুদ্ধিমান।

প্রিয় বেসিল, বরং বলতে পার মাঝে-মাঝে বোকার মতো কাজ না করার মতো ডোরিয়েন বুদ্ধিমান।

হ্যারি, মাঝে-মাঝে করার মতো কাজ বিয়েটা মোটেই নয়।

লর্ড হেনরি ক্লান্তভাবে বললেন: আমেরিকা ছাড়া। কিন্তু আমি বলিনি সে বিয়ে করেছে আমি বলেছি নিজের বিয়ে সে নিজেই ঠিক করে ফেলেছে। দুটোর মধ্যে পার্থক্য অনেক। আমার কথাই ধর না কেন। কবে আমার বিয়ে হয়েছে সেকথাটা আমার সপষ্ট মনে রয়েছে, কিন্তু কবে আমি বিয়ে করব বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম সেকথা আমি স্রেফ ভুলে গিয়েছি। আমার যেন। মনে হচ্ছে, বিয়ে করতে আমি কোনোদিনই চুক্তিবদ্ধ হইনি।

কিন্তু ডোরিয়েনের সম্পদ, জন্ম, আর সামাজিক প্রতিষ্ঠার কথাটা একবার চিন্তা করে দেখা তার সামাজিক পদমর্যাদার এত নীচের কাউকে বিয়ে করাটা তার পহেল্ক হাস্যকর হবে।

বেসিল, মেয়েটিকে সে বিয়ে করুক এটা যদি তুমি চাও, তাহলে সে কথাটা তাকে তুমি বলতে পার। তাহলে সে মেয়েটিকে নিশ্চয় বিয়ে করবে। যখনই মানুষ আকাট মূখের মতো কাজ করে তখনই বুঝবে তার পেছনে তার কোনো মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে।

আশা করি মেয়েটি ভালো। কোনো দুশ্চরিত্রাকে ডোরিয়েন বিয়ে করুক তা আমি চাই নে; তাতে তার চরিত্র নষ্ট হবে; নষ্ট হবে তার বুদ্ধি।

অরেঞ্জ-বিটার মেশানো ভারমুথের গ্লাসে চুমুক দিতে-দিতে লর্ড হেনরি বললেন: না, না; মেয়েটি ভালোর চেয়েও ভালো; সে সুন্দরী।ডোরিয়েন বলছে-মেয়েটি সুন্দরী। এসব ব্যাপারে সাধারনত তার ভুল হয় না। তুমি যে তার ছবিটি এঁকে তাই দেখে অন্য লোকের সৌন্দর্য তার চোখে ধরা পড়েছে। অনেক জিনিসের মধ্যে অপরের সৌন্দর্য উপলব্ধি করার মতো শক্তি তার রয়েছে। আর রাত্রিতে মেয়েটিকে দেখার কথা রয়েছে আমাদের, যদি অবশ্য ছোকরা এখানে আসার কথা বেমালুম ভুলে যায়।

তুমি কি সিরিয়াস?

নিশ্চয়, বেসিল। বর্তমানে আমি যতটা সিরিয়াস তার চেয়ে বেশি সিরিয়ান্স আর কখনো আমি হতে পারি একথা ভাবতেই আমার কষ্ট হচ্ছে

ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে-করতে ঠোঁটে কামড় দিয়ে বেসিল হলওয়ার্ড ডিজ্ঞাসা করলেন: কিন্তু এ-বিয়েতে কি তোমার মত রয়েছে? নিশ্চয় না। এটা একটা অর্থহীন মোহ ছাড়া আর কিছু নয়।

অনুমোদন অথবা অননুমোদন-বর্তমানে আমি কিছুই করিনে। জীবনের সম্বন্ধে এই ধরনের চিন্তা করাটা উদ্ভট। আমাদের নৈতিক কুসংস্কারকে ঢাক পিটিয়ে জাহির করার জন্যে পৃথিবীতে আমরা জন্মগ্রহণ করিনি। সাধারণে এ বিষয়ে কী বলে তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই নে; আর মনোহর মানুষেরা যা করে তার মধ্যে আমরা নাক গলাই নে। মনোমুগ্ধকারী ব্যক্তি যে কাজ যে ভাবেই করুক না কেন আমি তাতে আনন্দ পাই। ডোরিয়েন একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। মেয়েটি জুলিয়েট-এর ভূমিকায় অভিনয় করে। মেয়েটিকে সে বিয়ে করার প্রস্তাব। দিয়েছে। তাতে আপত্তি কী? সে যদি মেসালিনাকে বিয়ে করত তাতেই বা কী ক্ষতি হত। তুমি। ডান বিয়ের সমর্থক আমি নই। বিয়ের সবচেয়ে অসুবিধে হচ্ছে এই যে বিয়ে করলে মানুষ। নিঃস্বার্থপর হয়; আর যে সব মানুষ স্বার্থের কথা চিন্তা করে না, চরিত্রের দিক থেকে তারা। বিবর্ণ। তাদের ব্যক্তিত্ব বলে কোনো বস্তু নেই। তবু এমন কয়েকটি মানসিক বৃত্তি রয়েছে বিয়ে যাদের ভটিলতর করে তোলে। এই সব মানুষরা তাদের অহমিকা বজায় রাখে; আর সেই অহমিকার সঙ্গে আরো অনেক দম্ভ মিশিয়ে দেয়। বিবাহিত ব্যক্তিরা একাধিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। বিয়ের পরে তারা বেশ ভালোভাবেই সংঘবদ্ধ হয় এবং আমার মতে, এই সংঘবদ্ধতাই হচ্ছে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য। তা ছাড়া, প্রতিটি অভিজ্ঞতারই দাম রয়েছে; এবং বিয়ের বিরুদ্ধে যে যাই বলুক, নিঃসন্দেহে এটি একটি অভিজ্ঞতা। আমি আশা করি ডোরিয়েন এই মেয়েটিকে বিয়ে করবে, দু’মাস পাগলের মতো ভালোবাসবে-তারপরে আর কেউ তাকে মোহগ্রস্ত করে ফেলবে। অনুশীলনের জন্যে ডোরিয়েন একটি অদ্ভুত চরিত্রে পরিণত হবে।

হ্যারি, এতক্ষণ ধরে তুমি যা বললে তার একটি বর্ণ-ও তুমি নিজে বিশ্বাস কর না। বিশ্বাস যে কর না তা তুমি নিজেই জাল। ডোরিয়েন গ্রে-র জীবন যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তোমার চেয়ে বেশি দুঃখ আর কেউ পাবে না। তুমি যা দেখাও তার চেয়ে তুমি অনেক উঁচু।

লর্ড হেনরি হেসে বললেন: অন্য লোক যে ভালো একথা আমরা চিন্তা করি কেন জান? কারণ, নিজেরাই আমরা নিজেদের ভয় করি। অপরের ভালো দেখার ভিত্তি হচ্ছে নিছক ভীতি। আমাদের উপকারে আসতে পারে এই এইরকম কিছু গুণ অন্য লোকের মধ্যে খুঁজে বার করে আমরা তাদের প্রশংসা করি; ভাবি, এটাই আমাদের বিরাট একটা বদান্যতা। ব্যাঙ্কারকে আমরা প্রশংসা করি এই উদ্দেশ্যে যে আমরা প্রয়োজনমতো আমাদের সঞ্চিত অর্থের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে পারব। দস্যুদের বীরত্বের প্রশংসা করি এই ভরসায় যে তারা আমাদের পকেটটা রেহাই দেবে। আমি যা বললাম তা আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। মানুষের ভবিষ্যৎ উজ্জল–এই আশাবাদকে আমি যথেষ্ট ঘৃণা করি। আর জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা যদি বল তাহলে এটুকু আশ্বাস তোমাকে আমি দিতে পারি যে যে-জীবনের গতি রুদ্ধ হয়নি তার বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মানুষের প্রকৃতিকে যদি তুমি ধ্বংস করতে চাও তাহলে তাকে শুধু সংস্কার করে দাও। বিয়ের কথা যদি বল তাহলে অবশ্য মূর্খত হবে; কিন্তু বিয়ে বাদ দিয়েও নর-নারীর মধ্যে অনেক রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে; এই সম্পর্কগুলি। কেবল যে মনোরম তাই নয়, এগুলি আমাদের কৌতূহল-ও উদ্রেক করে যথেষ্ট। এইগুলি যারা গড়ে তোলে তাদের নিশ্চয়ই আমি উৎসাহিত করব। ফ্যাশানেবল বলে স্বীকৃতি পাওয়ার যথেষ্ট যোগ্যতা রয়েছে তাদের। কিন্তু ডোরিয়েন সশরীরে হাজির হয়েছে, আমার চেয়ে অনেক দক্ষতার সঙ্গে সে তোমাকে ব্যাপারটা বোঝাতে পারবে।

সার্টিনের পালক-দেওয়া টুপিটা মাথা থেকে খুলে এবং দুজনের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে করমর্দন করে ডোরিয়েন উৎসাহের আতিশয্যে বলে উঠল: প্রিয় হ্যারি, প্রিয় বেসিল, তোমরা নিশ্চয়। আমাকে অভিনন্দন জানাবে। এত আনন্দ জীবনে আর কোনোদিনই আমি পাইনি। অবশ্য এর জন্য কোনোরকম প্রস্তুতি ছিল না; সত্যিকার সুখের জিনিসগুলি এইরকম। আকস্মিকভাবেই আমাদের কাছে হাজির হয়। তবু মনে হয় এইরকম একটি আনন্দকেই আমি এতদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

উত্তেজনায় আর আনন্দে তার চোখমুখ লাল হয়ে উঠল; দেখতে তাকে অপরূপ দেখাল।

হলওয়ার্ড বললেন, আশা করি, ডোরিয়েন, সব সময়েই তুমি খুব সুখী হবে। কিন্তু তোমার বিয়ে যে ঠিক হয়ে গিয়েছে একথা তুমি আমাকে জানাওনি বলে আমি তোমাকে মা করতে পারব না। সে-সংবাদ হ্যারিকে তুমি দিয়েছ।

ছোকরাটির কাঁধে হাত রেখে হাসতে-হাসতে লর্ড হেনরি বললেন: এবং ডিনারে আসতে দেরি করার জন্যে আমি তোমাকে ক্ষমা করব না ডোরিয়েন। এখন এস, বসে পডি। এখানকার খাবার কীরকম খেতে তাই পরীক্ষা করি এস। তারপরে তোমার কাহিনি বলো।

ছোটো টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসতে-বসতে ডোরিয়েন বলল: বেশি বলার সত্যিই কিছু নাই। কী হয়েছিল সেইটাই সোজা কথায় বলছি। গতকাল সন্ধ্যায় হ্যারি তোমার ঘর থেকে বেরিয়ে আমি পোশাক বদলালাম; রুপার্ট স্ট্রিটের যে রেস্তোরাঁতে আমাকে তুমি নিয়ে গিয়েছিলে সেখানে ডিনার খেতে ঢুকলাম। ডিনার সেরে রাত প্রায় আটটা নাগাদ আমি থিয়েটারে হাজির হলাম। রোজালিনড-এর ভূমিকায় অভিনয় করছিল সাইবিলা অবশ্য দৃশ্যপট একদম জঘন্য ছিল; আর প্রায় সেইরকম ছিল অরল্যানডো। কিন্তু সাইবিল! সে-অভিনয় তোমরা দেখলে খুশি হতাম আমি। ছেলের পোশাক পরে সে যখন স্টেজে এসে নামল তখন তাকে যা দেখাচ্ছিল কী আর বলব! শ্যাওলা রঙের ফতুয়ার সঙ্গে সরু পায়জামা পরেছিল সে; মাথায় ছিল দামি পাথর বসানো বাজপাখির একটা পালক গায়ের ওপরে। উড়ানো ছিল ফিকে লাল লাইনটানা একটা ঢিলে জামা। এমন অপরুপ সাজে আর কখনো। তাকে আমি দেখিনি। বেসিল, তোমার স্টুডিওতে তানাগ্রা যুবতীর যে অপরুপ ছবি রয়েছে। ঠিক সেইরকম দেখতো একটা বিবর্ণ গোলাপের চারপাশে ঘন কালো পাতার আচ্ছাদনের মতো তার ভ্রমরকৃষ্ণ চুলের রাশি তার মুখের চারপাশে জড়ানো ছিল। তার অভিনয়ের কথা যদি বল তা সে নিজেদের চোখেই আজ তোমরা দেখতে পাবে। একেবারে ভাত আর্টিস্ট। বলতে যা বোঝা যায় সাইবিল সেই জাতীয় অভিনেত্রী। সেই ছোটো ঘিঞ্জি জাযগায় আমি তো একেবারে অভিভূতের মতো বসে রইলাম। আমি যে ঊনবিংশ শতাব্দীর লন্ডনে বসে রয়েছি সেকথা আমি একেবারে ভুলেই গেলাম। যে-অরণ্য কেউ কোনোদিন দেখেনি, মনে হল সেই অরণ্যের ভিতরে আমি আমার প্রেমিকার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অভিনয় শেষ হওয়ার পরে আমি নীচে নামলাম; তারপরে সাজঘরে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বললাম। আমরা যখন দুজনে পাশাপাশি বসেছিলাম তখন হঠাৎ তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অবাক হয়ে। গেলাম। তার চোখের ওই রকম চাহনি আগে কোনোদিন আমার চোখে পড়েনি। আমার ঠোঁট দুটি তার দিকে এগিয়ে গেল। দুজনেই দুজনকে গভীর আবেগের সঙ্গে চুমু খেলাম। সেই মুহূর্তে আমি যে কেমন বিভোর হয়ে গেলাম সে কথা তোমাদের আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। মনে হল, আমার সমস্ত জীবন, সমস্ত যৌবন গোলাপী আনন্দের একটি মুহূর্তে কেন্দ্রীভূত হল। সাদা নর্সিসাস ফুলের মতো সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। তরপরে সে হাঁটু মুড়ে বসে। আমার হাতে চুমু খেল। এসব কথা অবশ্য তোমাদের বলে লাভ নেই, তবু না বলে আমি পারছি নে। অবশ্য আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা এখনো খুব গোপন রয়েছে। এমন কি, সে তার মাকেও একথা জানায়নি। জানি নে, আমার অভিভাবকরাই বা কী বলবেন। লর্ড ব্র্যাডলি নিশ্চয় খুব চটে যাবেন। আমার তাতে কিছু আসে যায় না। সাবালক হতে আমার আর এক বছর-ও নেই; তারপরে খুশিমতো যা ইচ্ছে তাই করতে পারবা বেসিল, তোমার কি মনে হয় কাব্যলোক থেকে প্রেমিকাকে সরিয়ে এনে আমার স্ত্রীকে শেকসপীয়রের নাটকে অভিনয় করার সুযোগ দেওয়াটা আমার পষ্কে উপযুক্ত হবে না? শেকসপীয়রের বাণী যে গোপনে। আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে বলছে। রোজালিনড-এর দুটি বাহু যে আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে, আমি যে জুলিয়েটের ঠোঁটে চুমু খেয়েছি।

হলওয়ার্ড আস্তে-আস্তে বললেন: হ্যাঁ, ডোরিয়েন, মনে হয় তুমি ঠিক কথাই বলেছ।

লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন: তোমার সঙ্গে তার কি আড় দেখা হয়েছে?

ডোরিয়েন গ্রে মাথা নাড়লেন; আমি তাকে আর্ডেনের বনভূমিতে ছেড়ে এসেছি, ভেরোনার উদ্যানে আমি আবার তাকে খুঁজে পাব।

গভীর মনোনিবেশ সহকারে লর্ড হেনরি তাঁর শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিতে লাগলেন।

ঠিক কোন মুহূর্তে তুমি বিয়ের কথাটা উচ্চারণ করলে ডোরিয়েন? সেই বা কী উত্তর দিল? সম্ভবত, কিছুই মনে নেই তোমার।

প্রিয় হ্যারি, বিয়েটাকে আমি ব্যবসাদারী চোখে দেখিনি; আর এ-বিষয়ে কোনো প্রস্তাবও আমি তাকে দিইনি তাকে যে আমি ভালোবাসি এই কথাটাই কেবল তাকে আমি বলেছি। সে বলেছে, আমার স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। যোগ্যতা নেই! শোনো কথা! আমার কাছে পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যাকে আমি তার সঙ্গে তুলনা করতে পারি।

লর্ড হেনরি বিড়বিড় করে বললেন, বাস্তববুদ্ধিতে নারীজাতির সঙ্গে কারও তুলনাই চলে না। আমাদের চেয়ে তারা অনেক বেশি বুদ্ধিমতী। ওইরকম অবস্থায় বিয়ের কথাটা বলতে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই–তারা আমাদের সেই কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

হলওয়ার্ড তাঁর হাতের ওপরে একটা হাত চাপিযে বললেন: থাক হারি। ডোরিয়েনকে বিরক্ত করছ তুমি। অন্য পুরুষদের সঙ্গে ওর তুলনা করো না। ও কারো জীবনে দুঃখ ডেকে আনবে না। ওরে চরিত্রটি বেশ সুন্দর, মার্জিত।

টেবিলের উলটো দিকে তাকিয়ে লর্ড হেনরি বললেন: ডোরিয়েন কোনোদিনই আমার ওপরে বিরক্ত হয় না। আমার প্রশ্নের মধ্যে কোনোরকম কুটিলতা নেই; অথবা, প্রশ্নটা আমি করছি খোলা মনে। প্রশ্নের কারণটা হচ্ছে নিছক কৌতূহল। আমার ধারণা, বিয়ের ব্যাপারে মহিলারাই আমাদের কাছে প্রস্তাব তোলে প্রথম। আমরা তাদের কাছে কোনো প্রস্তাব রাখিনে। অবশ্য মধ্যবিত্ত সম্প্রদাযের কাছে এ-রীতিটা খাটে না। কিন্তু মধ্যবিত্ত সম্প্রদাযকে আমরা আধুনিক বলিনে।

হেসে মাথা নাড়লেন ডোরিয়েনঃ তোমাকে নিয়ে পারা গেল না, হ্যারি; কিন্তু তোমার কথায় আমি কিছু মনে করিলে। তোমার ওপরে রাগ করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। সাইবিল। ভেনকে দেখলে তুমি বুঝতে পারবে, একমাত্র জানোয়ার ছাড়া আর কেউ তাকে দুঃখ দিতে পারে না। আমি তাকে সোনার চৌকিতে দাঁড় করিয়ে দেখতে চাই আমার স্ত্রীকে বিশ্বের লোক পুজো করছে। বিয়েটা কী বল তো? একটা চুক্তি, একটা প্রতিজ্ঞা–যাকে কোনো অবস্থাতেই ভাঙা যায় না। তুমি আমার কথা শুনে হাসছ? না, না, হেস না। একটি অপরিবর্তনীয় চুক্তিই তার সঙ্গে আমি করতে চাই। ভালোবাসাকে মানুষ কী করে যে অপমান করে তা আমি। ভঘনিলে। আমি সাইবলি ভেনকে ভালোবাসি। তার আস্থা আমাকে বিশ্বাসী করে তুলেছে, করে তুলেছে সৎ। তার পাশে বসে থাকলে তুমি আমাকে যা শিখিযে তার জন্যে অনুতাপ করি আমি। তোমরা আমাকে যা জান আমি তখন আর ঠিক সে রকমটি থাকিনে। আমার সব কিছু পালটে যায়। সাইবিল ভেন-এর একটু ছোঁওযা আমাকে সব ভুলিয়ে দেয়; ভুলিয়ে দেয় তোমার মনোমুগ্ধকর চিত্তাকর্ষী, বিষাক্ত, মুখরোচক নীতিগুলি।

কিছু স্যালড নিজের দিকে টেনে নিয়ে লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, এবং ওগুলি কি…

ওই জীবন, প্রেম, এবং আনন্দের ওপরে তোমার নীতিগুলির কথাই বলছি। হ্যারি, কেবল ওইগুলি নয়, তোমার যাবতীয় নীতি।

আস্তে-আস্তে সুরেলা কণ্ঠে লর্ড হেনরি বললেন, আনন্দই হচ্ছে একমাত্র জিনিস যার সম্বন্ধে কিছু নীতিকথা বলা যায়। কিন্তু এ-নীতি আমার নিজস্ব নয–প্রকৃতির। প্রতি এই আনন্দের মারফতেই মানুষকে যাচাই করে যে আনন্দ করতে ভানে তাকেই প্রকৃতি সমর্থন করে। সুখী হলেই আমরা সৎ হব, কিন্তু সৎ হলেই যে আমাদের সব সময় সুখী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।

বেসিল হলওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করলেন; কিন্তু “সৎ হওয়া” কথাটার অর্থ কী বল তো?

টেবিলের ওপরে টবে রাখা ঘন ফুলগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে লর্ড হেনরির দিকে চোখ চিরে তাকাতে-তাকাতে চেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে ডোরিয়েন গ্রে বললেনঃ ঠিক, ঠিক, “সৎ হওয়া” বলতে কী বোঝ তুমি তাই আমাদের বল।

গ্লাসের পাতলা কাচের ওপরে নিজের সুন্দর একটি আঙুলের চাপ দিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, সৎ-হওয়া আর নিজের আত্মার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেওয়া একই কথা অন্য লোকের সঙ্গে যে একাত্মতা তারই মধ্যে বিভেদের বীজ লুকিয়ে থাকে। মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় হল তার নিজের জীবন। প্রতিবেশীদের কথা যদি ধর, তাহলে প্রযোভল হলে তাদের লক্ষ্ণ করে তুমি অনেক নৈতিক উপদেশের বাণী ছাড়তে পার। তা ছাড়া, উঁচু আদর্শ বলতে আমরা যা বুঝি। তা রয়েছে একমাত্র ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের। যুগের মাণদণ্ডই হচ্ছে আধুনিক নীতিজ্ঞানের মাপকাঠি। আমার মনে হয় কোনো মানুষের পহেই তার যুগের মাপকাঠি মেনে নেওয়াটা হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অনৈতিক কাজ।

বেসিল হলওয়ার্ড বললেনঃ অত্যি কথা বলতে কি হ্যারি, কেউ যদি নিছক নিজের জন্যেই, বেঁচে থাকে তাহলে কি তাকে যথেষ্ট মূল্য দিতে হয় না?

নিশ্চয়। আজকাল প্রতিটি জিনিসের জন্যই আমাদের অনেক মূল্য দিতে হয়। আমার ধারণা, দরিদ্রদের সত্যিকার ট্র্যাজিডি হচ্ছে নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকেই তারা বঞ্চিত করতে পারে না। সমস্ত কিছু সুন্দর জিনিসের মতোই সুন্দর পাপ করার অধিকার আর সুযোগ একমাত্র ধনীদেরই রয়েছে।

অর্থের কথা বাদ দিলেও, মানুষকে অন্যভাবে দাম দিতে হয়।

কী ভাবে, বেসিল?

ধর, অনুতাপের দাম, দুঃখ-যন্ত্রণার দাম… নৈতিক অবনতির দাম।

কাঁধে স্রাগ করে লর্ড হেনরি বললেন, প্রিয় বন্ধু, মধ্যযুগের কথা খুব মনোমুগ্ধকর। কিন্তু মধ্যযুগের অনুভূতিগুলি বর্তমান যুগে অচল অবশ্য, সেই অনুভূতিগুলিকে নভেল-নাটকে চালানো যায়। কিন্তু নভেল-নাটকে স্থান পায় কারা? বর্তমান যুগের বাস্তব পটভূমিকায় যারা অচল। বিশ্বাস কর, এমন কোনো সভ্য মানুষ নেই যে আনন্দের জন্যে অনুতাপ করে, আর এমন কোনো সভ্য মানুষ নেই সত্যিকার আনন্দ বলতে কী বোঝায় সে-বিষয়ে যার বিন্দুমাত্র জ্ঞান রয়েছে।

ডোরিয়েন গ্রে বললেন, আমি জানি আনন্দ কাকে বলে। আনন্দ হচ্ছে কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসা।

লর্ড হেনরি ফুল নাড়তে নাড়তে বললেন, ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে ভালোবাসা অবশ্যই ভালো। কারো পুজো পাওয়াটা হচ্ছে জঘন্য জিনিস। মানুষরা দেবতাদের যে চোখে দেখে, নারীরাও সেই চোখে পুরুষদের দেখে থাকে। তারা সব সময় আমাদের পুজো করে; আর সেই অজুহাতে তাদের জন্যে কিছু করার জন্যে সব সময় আমাদের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে।

ডোরিয়েন একটু গম্ভীরভাবেই বললেনঃ আমার ধারণা, আমাদের চরিত্রে প্রেমের প্রতিষ্ঠা করে তারা; আমাদের কাছ থেকে সেই প্রেম চাওয়ার পূর্ণ অধিকার তাদের রয়েছে।

হলওয়ার্ড বললেন; খাঁটি কথা, ডোরিয়েন।

লর্ড হেনরি বললেন, কোনো জিনিষই চিরকাল খাঁটি নয়, বেসিল।

বাধা দিলেন ডোরিয়েন; অর্থাৎ, এ কথাটা তোমাকে স্বীকার করতেই হবে হ্যারি, যে নারীরা তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ জিনিস পুরুষদের উপহার দেয়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লর্ড হেনরি বললেন, সম্ভবত, কিন্তু টুকরো টুকরো করে সেইটাই তারা ফিরে পেতে চায়। আমাদের দুশ্চিন্তাটা সেখানেই। কোনো একজন ধীসম্পন্ন ফরাসি ভদ্রলোক একবার বলেছেন-বড়ো কাজ করার জন্যে মহিলারা সব সময় আমাদের উৎসাহিত করে। কিন্তু সেই কাজ আমরা যখন করতে যাই তখনই চরম বাধা আসে তাদের কাছ থেকে।

হ্যারি, তোমার কথাগুলি বড়ো ভয়ঙ্কর। আমি জানি নে তোমাকে আমি এত পছন্দ করি কেন।

তিনি বললেন, তুমি আমাকে সব সময় পছন্দ করবে ডোরিয়েন। একটু কফি চলবে? ওয়েটার, কফি নিয়ে এস; সেই সঙ্গে নিয়ে এস সেরা শ্যাম্পেন আর সিগারেট না, না, সিগারেট থাক। আমার কাছে কয়েকটা রয়েছে। বেসিল, আমি তোমাকে সিগার খেতে হবে না। একটা সিগারেট খাওয়া নিখুঁত আনন্দ তোমাকে একটি নিখুঁত সিগারেটই দিতে পারে। এই জিনিসটি অপরূপা খেয়েও তৃপ্তি পায় না মানুষ। আর কী চাই আমরা? হ্যাঁ, ডোরিয়েন, আমাকে তুমি সব সময় পছন্দ করবে। আজ পর্যন্ত যে সব পাপ করার সাহস তোমার হয়নি, তোমার কাছে সেই সব পাপের প্রতীক আমি।

সিগারেট ধরাতে-ধরাতে ডোরিয়েন বললেন; কী সব আবোল-তাবোল বকছো হ্যারি! চল, এবারে আমরা থিয়েটারের দিকে এগোই, সাইবিল স্টেজে এসে দাঁড়ালেই নতুন জীবনের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে তোমরা। সে এমন একটি জীবন তোমাদের সামনে তুলে ধরবে যা তোমরা আগে কোনোদিন দেখনি।

ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে লর্ড হেনরি বললেন, আমি সব জানি, কিন্তু সব সময় আমি নতুন-নতুন অনুভূতি সংগ্রহ করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকি। অথচ, বলতে আমি ভয় পাচ্ছি, সেবকম। কোনো অনুভূতির সাক্ষাৎ আমি পাইনি। তবু হয়তো তোমার এই অপরুপা আমার মধ্যে কিছুটা উদ্দীপনার সৃষ্টি করতে পারে। আমি অভিনয় ভালোবাসি। বাস্তব জীবনের চেয়ে এ অনেক বেশি সত্য। চল, আমরা যাই। ডোরিয়েন, তুমি আমার সঙ্গে এস। আমি দুঃখিত। বেসিল, কিন্তু আমার গাড়িতে দুজনের বেশি জায়গা হবে না। গাড়িতে করে আমাদের পিছুপিছু এস।

তাঁরা উঠে পড়লেন, কোট চাপালেন গায়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কফি খেতে লাগলেন। ইল চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন; কী যেন ভাবছিলেন তিনি। একটা বিষাদের ছায়া তাঁর ওপরে নেমে এসেছিল। এই বিয়েটাকে কেমন যেন মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি; অথচ তাঁর মনে হল ডোরিয়েনের জীবনে যেসব ঘটনা ঘটতে পারত তাদের অনেকের চেয়ে এটা ভালো। কয়েক মিনিট পরে, তাঁরা সবাই নীচে নেমে এলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি একাই গাড়িতে। উঠলেন; সামনে দেখলেন লর্ড হেনরির গাড়িতে আলো চকচক করে উঠল। অদ্ভুত একটা। স্কৃতির অনুভূতি তাঁকে গ্রাস করে ফেলল। তাঁর মনে হল আগের মতো ডোরিয়েন আর তাঁর নিজের হবেন না। তাঁদের মধ্যে নতুন একটি জীবন এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁর চোখের দৃষ্টি কালো হয়ে এল; উজ্জ্বল আলোয় ভরা জনাকীর্ণ রাস্তাগুলি কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এল তাঁর চোখে গাড়িটা থিয়েটারে এসে হাজির হলে তাঁর মনে হল তিনি যেন অনেকগুলি বছর পেরিয়ে এসেছেন।

.

সপ্তম পরিচ্ছেদ

কী জানি কেন সেদিন রাত্রিতে প্রেক্ষাগৃহ লোকে গিজগিজ করছিল। মেদবহুল ইহুদি ম্যানেজার দরজার সামনে এসে তাঁদের অভ্যর্থনা জানাল; চাটুকারের ভীরু হাসি তার মুখের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত ঝলসে উঠল জোরে-ডোরে কথা বলতে-বলতে আর হিরের আংটি পরা হাত দোলাতে-দোলাতে বিনযের অবতার সেডে সে তাঁদের নির্ধারিত বকস-এ নিয়ে গেল। লোকটিকে ডোরিয়েন গ্রে-র কোনো দিনই ভালো লাগত না। সেদিন আরো খারাপ লাগল। তাঁর মনে হল মিরান্দার সন্ধানে এসে তিনি ক্যালিব্যানের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছেন। লর্ড হেনরির অবশ্য তাকে ভালোই লাগল। অন্তত সেই রকমের একটা ইঙ্গিত করে তার সঙ্গে করমর্দন করার বারবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। সেই সঙ্গে একথাটাও বলতে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না যে এমন একটি মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় তিনি গর্ববোধ করছেন যে সত্যিকার প্রতিভাময়ী একটি অভিনেত্রীকে আবিষ্কার করেছে এবং একজন কবির জন্যে যে দেউলিয়ার খাতায় নাম লিখিয়েছে। একতলায় গতে সমবেত দর্শকবৃন্দের মুখের দিকে তাকিয়ে হলওয়ার্ড দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মজা করতে লাগলেন। অতিরিক্ত গরম আবহাওয়াটা সহ্য করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তাঁদের; বিরাট সূর্যটিকে মনে হচ্ছিল গাঢ় পীত রঙের দানবীয় আকৃতির একটি ডালিয়া ফুলের পাপড়ির মতো। গ্যালারিতে যে যুবকগুলি বসেছিল তাদের কোট আর ওয়েস্ট কোট খুলে হাতলের ওপরে রেখে। দিল। থিয়েটারের ভেতরে তারা নিজেদের মধ্যে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে কথা বলাবলি করছিল, জমকালো পোশাক পরে তাদের পাশে যে সব মেয়েরা বসেছিল তাদের সঙ্গে তারা। কমলালেবু ভাগাভাগি করে খাচ্ছিল। গর্তের মধ্যে কয়েকটি মহিলা হাসছিল। তাদের গলার স্বর কেবল তীব্রই নয়, অনেকটা বেসুরো-ও মদের দোকান থেকে ছিপি খোলার শব্দও ভেসে আসছিল।

লর্ড হেনরি বললেনঃ প্রিয়তমা খুঁজে বার করার জায়গাই বটে! বাপরে, বাপ!

ডোরিয়েন গ্রে বললেনঃ ঠিকই বলেছ। এইখানেই তাকে আমি খুঁজে বার করেছি এবং আমার কাছে সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর চেয়ে সে অনেক বেশি স্বর্গীয়। তার অভিনয় দেখলে তোমরা সব ভুলে যাবে। সে স্টেজে নামলেই এই সব সাধারণকর্কশ স্বভাব এবং পাশবিক চরিত্রের মানুষগুলির হাবভাবও পালটিয়ে যাবে। তাদের চেঁচামেচি বন্ধ হয়ে যাবে; চুপ করে বসে তার

অভিনয় তারা দেখবো তারই ইচ্ছেমতো এই সব মানুষগুলি হাসবে, কাঁদবো সে তাদের বেহালার তারের মতো সুরময় করে তুলবে। তাদের আত্নিক ভাতে সে তুলবে সুর। নিজেদের রক্তমাংসের কথা ভুলে যাবে তারা।

অপেরা-কাচ চোখে বসিয়ে লর্ড হেনরি একতলার দর্শকদের দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন, ডোরিয়েনের কথা শুনে তিনি বললেন, ভুলে যাবে! অর্থাৎ নিজেদের রক্তমাংসের কথা।

এবিষয়ে তোমার সঙ্গে আমি একমত নই।

হলওয়ার্ড বললেনঃ ওর কথা শোনো না, ডোরিয়েন। তুমি কী বলছ তা আমি বুঝতে পারছি। এই মেয়েটির ওপরে আমার আস্থা রয়েছে। অপরূপা ছাড়া আর কাউকেই তুমি ভালোবাসতে পার না। মেয়েটির সম্বন্ধে এইমাত্র তুমি যা বললে সেই সমস্ত গুণ যার মধ্যে রয়েছে সে নিশ্চয় চরিত্রের দিক থেকে সুন্দরী এবং বুচিসম্পন্না। নিজের যুগকে উন্নত করা নিশ্চয় একটা সৎ কাভ। আত্মা বলে যাদের কিছু নেই তাদের মধ্যে মেয়েটি যদি আত্মার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যারা চিরকাল ঘৃণ্য আর কুসিত পরিবেশের মধ্যে বাস করে এসেছে তাদের মনে মেয়েটি

যদি সৌন্দর্যের পরশ বুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়, মেয়েটি যদি তাদের স্বার্থপরতার উর্ধে তুলে ধরতে, আর অপরের দুঃখে তাদের চোখে জল আনাতে পারে তাহলে বুঝতে হবে সে তোমার ভালোবাসার যোগ্য–শুধু তুমি নয়, সারা পৃথিবী। তোমাদের এই বিয়ের বিরুদ্ধে বলার কিছু নেই। প্রথমে এতটা আমি ভাবিনি; কিন্তু এখন আমি বেশ বুঝতে পারছি যে তোমার নির্বাচনের মধ্যে কোনো গলদ নেই। কেবল তোমার জন্যেই ভাবান সাইবিল ভেনকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। ওকে বাদ দিলে তোমার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেত।

তাঁর হাতের ওপরে চাপ দিয়ে ডোরিয়েন বললেনঃ ধন্যবাদ। আমি জানতাম যে তুমি আমাকে বুঝতে পারবে। হ্যারি বড়ো সিনিক। বিশ্বের কোনো ভালোই ওর চোখে পড়ে না। ওর। কথা শুনলে আমি কেমন ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু ওই অরকেস্ট্রা শুরু হয়েছে, বাপরে, বাপ; কী। ভয়ঙ্কর শব্দ! তবে পাঁচ মিনিটের বেশি নয়; তারপরেই ওটা থেমে যাবে। তারপরেই যবনিকা। উঠবে; স্টেডের ওপরে দেখতে পাবে সেই মেয়েটিকে যাকে আমার সমস্ত জীবন আর যৌবন সমপর্ণ করতে যাচ্ছি আমার মধ্যে যা কিছু ভালো আর সুন্দর রয়েছে যাকে আমি আগেই সব দিয়ে দিয়েছি।

মিনিট পনেরো পরে ঘন-ঘন করতালির মধ্যে সাইবিল ভেন স্টেজের ওপরে এসে দাঁড়াল। হ্যাঁ; কথাটা ঠিক। মেয়েটির বড়ো চমৎকার দেখতে লর্ড হেনরির মনে হল এমন সুন্দর মেয়ে। জীবনে তিনি খুব কমই দেখেছেন। তার সেই লাজুক ভঙ্গিমা আর চকিত চাহনির মধ্যে একটা মাদকতা রয়েছে। উৎসাহী দর্শকে পরিপূর্ণ প্রেক্ষগৃহের দিকে একবার তাকাতেই একটা মৃদু লজ্জার আভাস তার মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়ল; মনে হল, রুপোর আনার ওপরে একটা। গোলাপ ফুলের ছায়া পড়েছে। সামনে থেকে কয়েক পা সে পিছিয়ে গেল, মনে হল তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে। বেসিল হওয়ার্ড দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিতে লাগলেন। তার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন ডোরিয়েন গ্রে; মনে হল তিনি যেন স্বপ্ন দেখছেন। চশমার ভেতর দিয়ে তাকাতে-তাকাতে লর্ড হেনরি বলে উঠলেনঃ চমৎকার, চমৎকার!

দৃশ্যটা ছিল ক্যাপুলেত-এর বাড়ির বড়ো একখানা বসার ঘর। মারকসিযো আর কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে দরবেশের পোশাক পরে রোমিযা সেখানে ঢুকল। স্টেজের পেছনে বাজনা বেজে উঠল, শুরু হল নাচ। একদল অতি সাধারণ, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নোংরা মলিন। পোশাক পরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাঝখানে সাইবিল ভেন লোকান্তরের মানুষের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল। জলের মধ্যে বেতস লতা যেমনভাবে দোলে নাচের তালে-তালে, তার দেহটাও সেইরকম দুলতে লাগল, কখনো সামনে, কখনো পেছনে। তার গলার আদলটা সাদা শালুকের গলার মতো বাঁকানো; মৃদু হিল্লোলে দুলতে লাগল। মনে হল, হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি হয়েছে তার হাত দুটি।

তবু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল সাইবিল। রোমিযাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ডলিযেট-এর মলে যে আনন্দের সঞ্চার হয়েছিল সে রকম কোনো আনন্দ সাইবিলের চোখে-মুখে, চলনে-বলনে ফুটে উঠল না। কিছু কথা তাকে অবশ্য বলতে হল হে দরবেশ, হাত দুটির ওপরে তুমি যথেষ্ঠ অন্যায় করছ। এই হাত দুটি দিয়ে মানুষ তার মনের ভক্তি জানায়। কারণ, তাদের হাত দুটি সাধুদের হাত স্পর্শ করে এবং তীর্থযাত্রা শেষ করে এসে তীর্থযাত্রীরা সেই হাত ভক্তিভরে চুম্বন করে।

এর পরেও কয়েকটি কথা তার বলার ছিল; সেগুলি-ও সে বলল; কিন্তু সেই বলার মধ্যে আবেগ। দেখা গেল না–মনে হল সবটাই কৃত্রিম। কথাগুলি অপরূপ মিষ্টি; কিন্তু আবেগ প্রকাশের দিক থেকে সেগুলি ব্যর্থ, ব্যঞ্জনার দিক থেকে দ্যুতিহীন। কাব্যের সমস্ত মাধুর্যই নষ্ট হয়ে গেল তাতে, অবাস্তব মনে হল জুলিয়েতের উচ্ছ্বাস।

তার অভিনয়ে এই জড়তা দেখে ডোরিয়েনের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। কেমন যেন মাথাটা গুলিয়ে গেল তাঁর; উদ্বেগে ভরে উঠল তাঁর মূল। তাঁকে লক্ষ করে বন্ধুরাও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে সাহস করলেন না। তাঁদের মনে হল, জুলিয়েত-এর ভূমিকায় অভিনয় করার যোগ্যতা মেয়েটির নেই। নিরাশ হয়ে পড়লেন তাঁরা। এই রকম একটি অভিনয় দেখার জন্যে এখানে। আসার প্রয়োজন ছিল না তাঁদের।

তবু তাঁরা ভাবলেন যে জুলিয়েত-এর শ্রেষ্ঠ অভিনয় হচ্ছে দ্বিতীয় অংকের “বারান্দার দৃশ্যে”। সেই দৃশ্যটি দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁরা। সেই দৃশ্যটি যদি সাইবিল জমিয়ে তুলতে না পারে তাহলে তাকে কোনোমতেই অভিনেত্রী বলা যেতে পারবে না।

চাঁদের আলোতে জুলিয়েত-এর বেশে সাইবিল যখন বেরিয়ে এল তখন তাকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। সেবিষয়ে সন্দেহ করার অবকাশ ছিল না কিছু। কিন্তু তার অভিনয়ের ভডতা অসহ্য মনে হল। দৃশ্যটি যতই এগোতে লাগল ততই খারাপ হতে লাগল তার অভিনয়। তার চাল-চলন, হাত আর মুখ নাড়ার ভঙ্গিমা শুধু কৃত্রিমই হল না, হাস্যকর হয়ে দাঁড়াল। সব কথাই অনাবশ্যক জোর দিয়ে সে বলতে শুরু করল।

তুমি জান আমার মুখের ওপরে রাত্রির
ছায়া এসে নেমেছে; অন্যথায় কিশোরীর
কুমারী লজ্জা আমার মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়বে।
আজ রাত্রিতে আমার মুখ থেকে এই মাত্র তুমি যা শুনলে
তার পরে আমি আমার লজ্জা ঢাকব কেমন করে!

এমন সুন্দর কথাগুলি সে উচ্চারণ করল যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মনে হল সে কোনো বিদ্যালয়ের ছাত্রী; একটি দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষকের কাছে আবৃত্তি করার শিক্ষা নিয়েছে। তারপরে সে বারান্দার ওপরে ঝুঁকে পড়ে বললঃ

যদিও তোমাকে দেখে আমার আনন্দ হচ্ছে
তবু আমি বলব, আজকের এই মিলনে আমার
কোনো আনন্দ নেই, রাত্রির এই মিলন হঠকারী,
যুক্তিহীন এবং অকস্মাৎ এ-মিলন বিদ্যুতের মতো।
চমকপ্রদ, কিন্তু ক্ষণস্থায়ীঃ ‘অন্ধকার দূর হল’
বলতে না বলতেই আবার তা অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
প্রিয়তম, বিদায়;
আবার আমাদের যখন দেখা হবে তখন
এই বসন্তে প্রেমের যে কোরক অঙ্কুরিত হয়েছে।
তা যেন ভালোবাসার তাজা ফুল হয়ে ফুটে ওঠে।

প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার এই সংযত অথচ গভীর প্রেমোচ্ছাস মাখা কথাগুলি গড়গড় করে মুখস্থ বলে গেল সাইবিল; যেন কেবল বলার জন্যেই বলা; সেগুলি জুলিয়েত-এর নয়; সেগুলির মধ্যে প্রেমিকার হৃদয়-মাধুর্য নেই। দেখে মনে হল না, সে হঠাৎ ভয় পেয়ে নিজের ওপরে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে দেখে মনে হল, সে আস্থা, কী বলছে, কী করছে তা সে জানে। অভিনয়কলার দিক থেকে ব্যাপারটা কদর্য ছাড়া আর কিছু নয। অভিনয় করার কোনো যোগ্যতা তার নেই।

গ্যালারির দর্শক, এমন কি সস্তা দামের টিকিট কেটে নীচে যারা বসেছে সেই সব অশিক্ষিত মানুষরাও কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। নাটক জমছে না। কদর্য অভিনয়ের আলোচনায় মুখর হয়ে উঠল তারা, চেঁচামেচি করতে লাগল; দিতে লাগল শিসা ইহুদি ম্যানেজার এতক্ষণ সাজঘরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ব্যাপারটা দেখে রাগে গরগর করতে-করতে সে পা ঠুকতে লাগল। এত গোলমাল আর হই-চই-এর মধ্যে যে মানুষটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে হচ্ছে সাইবিল নিজে। প্রেক্ষাগৃহের কোনো বিশৃঙ্খলাই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

দ্বিতীয় অংক শেষ হওয়ার পরে চারপাশ থেকে আবার হিস-হিস শব্দ উঠল। লর্ড হেনরি উঠে দাঁড়ালেন, তারপরে কোটটা কাঁধে ফেলে বললেন, মেয়েটি দেখতে সুন্দরী–সেদিকে থেকে তোমার সঙ্গে আমি একমত; কিন্তু ও অভিনয় করতে জানে না। এবার আমরা চলে যাই–এস।

ডোরিয়েন বললেন; শেষ পর্যন্ত আমি নাটকটা দেখব।

স্বটা তাঁর তিক্ত কর্কশ।

তোমাদের সন্ধেটা নষ্ট করে দিলাম বলে আমি খুব দুঃখিত, হ্যারি। তোমাদের দুজনের কাছেই আমি ক্ষমা চাইছি।

হলওয়ার্ড বাধা দিয়ে বললেনঃ আমার বিশ্বাস, মিস ভেন অসুস্থ। আর এক রাত্রিতে আসব আমরা।

ডোরিয়েন বললেনঃ ও অসুস্থ হলেই খুশি হব আমি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে অভিনয়ে তার। আজ মন নেই। ও সম্পূর্ণভাবে পালটিয়ে গিয়েছে। গত রাত্রিতে ও একজন উঁচু দরের অভিনেত্রী ছিল। আজ সে অতি সাধারণের পর্যায়ে।

ডোরিয়েন, যাকে তুমি ভালোবাস তার সম্বন্ধে ওভাবে কথা বলো না; বলার চেয়ে ভালোবাসা অনেক উঁচু দরের।

লর্ড হেনরি বললেনঃ আঙ্গিকের দিক থেকে ও-দুটিই হচ্ছে অনুকরণের বিশেষ রূপ। কিন্তু চল। ডোরিয়েন, তোমারও এখানে ওর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত নয। খারাপ অভিনয় দেখা। নীতির দিক থেকে কারও উচিত নয়। তাছাড়া আমার ধারণা, তোমার স্ত্রী অভিনয় করুক এটা তুমি চাইবে না। সুতরাং কাঠপুতুলের মতো সে জুলিয়েতের অভিনয় করুক, বা না করুক, তাতে তোমার কি যায় আসে? মেয়েটি দেখতে বড়ো মিষ্টি। সুতরাং অভিনয়ের মতো। জীবনের সম্বন্ধেও যদি তার জ্ঞানটা না থাকে, তাহলে তাকে নিয়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। সঞ্চযের সুযোগ তুমি পাবে। সেই অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে তোমাকে আনন্দ দেবে। পৃথিবীতে দু’ভাতের মানুষ রয়েছে যারা সত্যিকারের আকর্ষণীয়ঃ একদল সব ডানে, একদল কিছুই জানে না। হায় ভগবান, তুমি এতটা বিষণ্ণ হয়ে উঠলে কেন? যৌবনের রহস্য কী জান? যৌবনের গোপন কথা হচ্ছে অশোভনীয় কোনো উচ্ছ্বাসকেই সে বরদাস্ত করে না। এস আমরা ক্লাবে যাই। সেখানে মেম্পন আর সিগারেট খেতে-খেতে সাইবিলের সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করিগে চলা মেয়েটি সত্যিকারের সুন্দরী। আর কি চাও তুমি।

ডোরিয়েন একটু চিৎকার করেই বললেনঃ হ্যারি তুমি যাও। আমি একা থাকতে চাই। বেসিল, তোমাকেও যেতে হবে। আমার হৃদয় যে ভেঙে যাচ্ছে তা কি তোমরা দেখতে পাচ্ছ না? তাঁর চোখ দুটি গরম অশ্রুতে ভরে উঠল, কাঁপতে লাগল দুটি ঠোঁট; বকস-এর পেছনে দৌড়ে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে তিনি চোখ দুটিকে হাতের চেটো দিয়ে ঢেকে দিলেন।

স্বরটাকে অদ্ভুতভাবে নরম করে লর্ড হেনরি বললেনঃ এস বেসিল।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন দুজনে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার মঞ্চের আলো জ্বলে উঠল; যবনিকা তোলা হল শুরু হল তৃতীয় অঙ্ক। ডোরিয়েন তাঁর নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন। তাঁকে তখন বিবর্ণ দেখাচ্ছিল; কেবল বিবর্ণ নয়, গর্বিত; সেই সঙ্গে উদাসীন। গড়িযে-গড়িয়ে নাটক চলতে লাগল; সময় যেন আর কাটতে চায় না। হাসতে হাসতে ভারী বুট ঠুকতে-ঠুকতে প্রায় অর্ধেক দর্শক নাটক শেষ হবার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সব জিনিসটাই শেষ পর্যন্ত পরিণত হল প্রহসনে। শেষ অংক অভিনীত হল শূন্য ঘরে। শেষ পর্যন্ত অভিনয় শেষ হল; অসন্তোষের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।

অভিনয় শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ডোরিয়েন ছুটে সাজঘরে গিয়ে হাজির হলেন। বিজয়িনীর মতো সাইবিল একাই দাঁড়িয়েছিল। তার চোখের ওপরে একটা অপরূপ জ্যোতি ফুটে উঠেছিল। তার চারপাশে একটা আলোর দ্যুতি খেলা করছিল। তার ঠোঁট দুটি কী জানি একটা গভীর রহস্যে বিমুক্ত হয়ে হাসছিল।

ডোরিয়েন ঘরে ঢুকতেই সে তাঁর দিকে তাকাল, একটা বিপুল আনন্দ তাকে নাড়া দিয়ে গেল। সে বললঃ ডোরিয়েন, আজ আমি কি রকম খারাপ অভিনয় করলাম দেখেছ?

তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে তিনি বললেনঃ ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ অভিনয় আজ তুমি করেছ। তুমি কি অসুস্থ? কী রকম জঘন্য অভিনয় আজ তুমি করেছ সে সম্বন্ধে। কোনো ধারণাই তোমার নেই। সেই অভিনয় দেখে আমি কত কষ্ট পেয়েছি তা-ও তুমি জান না।

মেয়েটি হেসে বললঃ ডোরিয়েন, কেন আমি খারাপ অভিনয় করেছি তা তোমার বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু এখন তুমি বুঝতে পারছ তাই না?

তিনি রেগেই জিজ্ঞাসা করলেনঃ কী বুঝব?

আজ রাত্রিতে আমি এত খারাপ অভিনয় করলাম কেন? কেন আমি সব সময় খারাপ অভিনয় করব? কারণ আর আমি অভিনয় করব না।

কাঁধে একটা স্রাগ করলেন তিনি; বললেনঃ আমার ধারণা তোমার শরীর আভ্য ভালো নেই। অসুস্থ শরীর নিয়ে অভিনয় করতে আসাটা উচিত হয়নি তোমার এইভাবে অভিনয় করে তুমি সকলের হাসির খোরাক জুগিয়েছ। আমার বন্ধুরা বিরক্ত হয়েছেন, বিরক্ত হয়েছি আমি।

মনে হল, এই সব কথা মেয়েটির কানে ঢুকল না; আনন্দে আবেগে সে তখন মাতোয়ারা। একটা অপরূপ আনন্দের উচ্ছ্বাস তাকে গ্রাস করে ফেলেছে।

তারপরে সে বললঃ ডোরিয়েন, তোমাকে জানার আগে অভিনয়টাই আমার জীবনে ছিল সত্য। এই থিয়েটারেই আমি বেঁচে ছিলেম। ভেবেছিলেম, এটাই পরম সত্য। এক রাত্রিতে

আমি রোজালিনড, আর এক রাত্রিতে পোশিয়া। পোর্শিয়ার আনন্দ, কোর্ডিলায়ার দুঃখ-সব আমার নিজস্ব। সবার উপরেই বিশ্বাস ছিল আমার। যারা আমার সঙ্গে অভিনয় করত সেই সব সাধারণ মানুষকে আমি দেবতার মতো মনে করতাম। স্টেডোর চিত্রিত দৃশ্যগুলিই ছিল আমার জগৎ। ছায়া ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। সেইগুলিকেই আমি বাস্তব বলে মলে। করতাম। তারপরে তুমি এলে–ভালোবাসলে আমাকে মুক্ত করে আনলে যার কারাগার। থেকে; বাস্তুব কী জিনিস তুমি আমাকে তাই শেখালে। আজকের রাত্রিতেই–আমার জীবনে এই প্রথম–আমি সপষ্ট বুঝতে পারলাম যে জীবনের মধ্যে দিয়ে আমি এতদিন কাটিয়েছি । কতটা অন্তঃসারহীন, লজ্জাকর এবং ঘৃণ্য। আজকের রাত্রিতেই এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম রোমিঘো কত ভয়ঙ্কর; কত বৃদ্ধ এবং প্রসাধনের আড়ালে যে মানুষটা লুকিয়ে রয়েছে তার দেহ কতটা কুৎসিত। আজকেই আমি প্রথম বুঝতে পারলাম বাগানের এই চাঁদের আলো কত মিথ্যে, দৃশ্যটি কত কদর্য এবং যে কথাগুলি আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। সেগুলি যে কেবল অবাস্তব তাই নয়, সেগুলি আমার মনের কথা নয়–সে কথাগুলি মন থেকে আমি বলতে চাইনি! তুমি আমার মধ্যে এমন একটা জিনিস এনে দিয়েছ যা অনেক উঁচু-যার কাছে সমস্ত কলাই প্রতিবিম্ব বিশেষ। ভালোবাসা কী তুমি আমাকে তা শিখিযে। প্রিয়তম, তুমিই আমার রূপকথার রাজকুমার। ছায়ার পেছনে ঘুরে-ঘুরে আমি ক্লান্ত। বিশ্বের সমস্ত কলার চেয়ে আমার কাছে তোমার দাম অনেক বেশি। মঞ্চে সাক্ষীগোপালের অভিনয় করে কী লাভ হবে আমার? আজকে যখন আমি অভিনয় করতে এলাম তখন আমি বুঝতেই পারিনি কেমন করে আমার ভেতর থেকে পূর্বের সব আবেগ আর আকাণ্ডহষ্কা নির্বাসিত হয়েছে। ভেবেছিলেম আমি অপরুপ অভিনয় করব; শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম যে কিছুই করার হুমতা আমার নেই। এই পরিবর্তন বা অমতার কারণটা কী তা যেন হঠাৎ আবিষ্কার করলাম। আবিষ্কারটি আমার কাছে নিঃসন্দেহে অপরুপ; কানের কাছে কেবলই সে গুনগুন করতে লাগল। আমি হাসলাম। আমাদের প্রেম যে কত গভীর তা তাছাড়া ডানবে কেমন করে? আমাকে তুমি নিয়ে চল ডোরিয়েন, যেখানে আমরা দুজনে একলা থাকতে পারি এমন। একটা জায়গায় আমাকে তুমি নিয়ে চলা রঙ্গমঞ্চকে আমি ঘৃণা করি। যে আবেগ আমাকে মাতায না, এখানে আমি তারই একটা ব্যর্থ অনুকরণ করতে পারি মাত্র কিন্তু যে আবেগ। আমার মনের মধ্যে আগুনের মতো জ্বলছে তাকে আমি অনুকরণ করতে পারিনে। ডোরিয়েন, ও ডোরিয়েন, এর অর্থকী তা কি তুমি বুঝতে পারছ? প্রকাশ করতে পারলেও, স্টেজে অন্য লোকের সঙ্গে সত্যিকার প্রেমের অভিনয় করাটা আমার কাছে নিছক ব্যভিচার ছাড়া আর। কিছু নয়। এই সহজ কথাটা বুঝতে শিখিয়েছ তুমি।

সোফার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ডোরিয়েন; তারপরে বিড়বিড় করে বললেন, আমার ভালোবাসাকে হত্যা করেছ তুমি।

তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সাইবিল; হাসল। কোনো উত্তর দিলেন না ডোরিয়েন। সাইবিল তাঁর কাছে এগিয়ে এসে তার ছোটো-ছোটো আঙুল দিয়ে তাঁর মাথার চুলগুলিকে আস্তে-আস্তে টানতে লাগল। হাঁটু মুড়ে বসে তার আঙুলগুলি দিয়ে তার ঠোঁটের ওপরে ধরল চেপে। তিনি হাতটাকে টেনে নিলেন; তাঁর দেহটা কাঁপতে লাগল।

তারপরেই তিনি লাফিয়ে উঠে দরজার ধারে দাঁড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ সত্যি কথা, তুমি আমার। প্রেমকে হত্যা করেছ। তুমি আমার কল্পনাকে উদ্বোধিত করেছিলে একদিন, আজ তুমি আমার মনে সামান্য কৌতূহল জাগাতেও অক্ষম হয়েছে। তুমি আমাকে আর নাড়া দিতে পারছ না। তোমাকে আমি ভালোবেসেছিলেম কারণ তুমি ছিলে অপরুপা, কারণ তোমার ছিল প্রতিভা, ছিল ধীশক্তি, মহান কবিদের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার মত ছিল তোমার এবং কলার যাকে আমরা ছায়া বলি তাকেই বাস্তবে রূপায়িত করতে তুমি পারতে–সেই সমস্ত ক্ষমতার অধিকারিণী হয়েও তুমি তাদের ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে। তোমার গভীরতা নেই, মূর্খ তুমি! হায় ভাবান, কত ভালোই না তোমাকে আমি বেসেছিলেম! কী মুখই না আমি ছিলেম! এখন থেকে তোমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই আমার। আর তোমার মুখ আমি দেখব না। আর তোমার কথা আমি চিন্তা করব না। আর তোমার নাম আমি উচ্চারণ করব না। একদিন তুমি যে আমার কাছে কি ছিলে তা তুমি জান না। ওঃ, আমি আর ভাবতে পারছিনো হারে, তোমার সঙ্গে আমার যদি কোনোদিন দেখা না হত! আমার জীবনের রোমান্স তুমি নষ্ট করে দিয়েছা ভালোবাসা তোমার আটকে নষ্ট করে দেয় এই যদি তোমার মত হয় তাহলে বুঝতে হবে ভালোবাসা কাকে বলে তা তুমি জান না। আমি তোমাকে দিঘিজয়িনী করিয়ে আনতে। পারতাম, তোমাকে বিশ্বের মানুষ পুজো করত এবং আমার স্ত্রী হিসাবে পরিচিতি পেতে তুমি, কিন্তু এখন তুমি কী? সুন্দর মুখধারিণী তৃতীয় শ্রেণির অভিনেত্রী ছাড়া আর কিছু নয়।

মেয়েটির মুখ সাদা হয়ে গেল; কাঁপতে লাগল সে; নিজের দুটো হাত মুচড়াতে লাগল। গলার মধ্যে স্বরটা তার আটকে গেল যেন; সে বলল, ডোরিয়েন, তুমি সিরিয়াস নও। তুমি অভিনয় করছ।

তিনি তিক্তভাবে বললেন: অভিনয়! ওটা আমি তোমার জন্যে রেখে দিলাম। ওটা তুমি ভালোই করা

সাইবিল উঠে দাঁড়াল; তারপর বিবর্ণ মুখে ডোরিয়েনের সামনে এসে হাজির হল; একটা হাত তাঁর হাতের ওপরে রেখে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল।

ডোরিয়েন তাকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন।

চিৎকার করে কেঁদে উঠল সাইবিল: আমাকে তুমি ছোঁবে না?

একটা অস্পষ্ট কান্নায় ভেঙে পড়ল সাইবিল, ডোরিয়েনের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। সেইখানে পায়ে মাড়ানো ফুলের মতো কিছুক্ষণ সে পড়ে রইল, তারপরে ফিস ফিস করে। বলল: ডোরিয়েন, আমাকে পরিত্যাগ করো না। ভালো অভিনয় করতে পারিনি বলে আমি দুঃখিত। অভিনয়ের সময় সারাটা দুষ্কণই আমি তোমার কথাই চিন্তা করছিলাম। কিন্তু আমি চেষ্টা করব–সত্যিই আমি চেষ্টা করব। তোমাকে ভালোবাসি বলেই হঠাৎ আমার এই ভাবান্তর ঘটেছিল। যদি তুমি আমাকে চুমু না খেতে, যদি আমি তোমাকে চুমু না খেতাম, তাহলে আমরা যে দুজনে দুজনকে ভালোবাসি তা আমি বুঝতে পারতাম না। আমাকে আবার চুমু খাও। আমার কাছ থেকে চলে যেয়ো না। আমার ভাই…না না, সেকথা থাক। সত্যি সত্যিই কিছু করবে বলে সে একথা বলেনি, ঠাট্টা করেই বলেছিল…কিন্তু তুমি… আজকের মতো তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পার না? আমি ভালো অভিনয় করার জন্যে আবার চেষ্টা করব। পৃথিবীর মধ্যে তোমাকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি বলে আমার ওপরে নিষ্ঠুর হয়ো না তুমি। মোট কথা, মাত্র একবারই আমি তোমাকে খুশি করতে পারিনি। কিন্তু। ডোরিয়েন, তুমিই ঠিক কথা বলেছ। আর্টিস্ট হিসাবেই নিজেকে আমার বেশ মনে করা উচিত ছিল। মূখের মতো কাজ করেছি আমি, না করে পারিনি বলেই করেছি। আমাকে তুমি ছেড়ে যেয়ো না, ছেড়ে যেয়ো না।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুলে-ফুলে কাঁদতে লাগল সাইবিল; ডোরিয়েন গভীর অনীহা নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, অপরূপ ঘৃণায় তাঁর কারুকার্যকরা ঠোঁট দুটি বি হল, ভালোবাসা নষ্ট হলে মানুষের সমস্ত উচ্ছ্বাসই কেমন যেন হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। সাইবিল ভেনকেও অদ্ভুত রকমের অতি নাটকীয় বলে মনে হল তাঁরা সাইবিলের ফোঁপানির শব্দ আর চোখের জল বিরক্ত করল তাঁকে।

শেষকালে পরিচ্ছন্ন স্বরে তিনি বললেন: আমি যাচ্ছি। আমি নিষ্ঠুর হতে চাই নে, কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। তুমি আমাকে নিরাশ করে।

মেয়েটি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল কোনো উত্তর দিল না; কিন্তু তাঁর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে। আসতে লাগল। তার ছোটো ছোটো হাত দুটি বিস্তারিত হয়ে অন্ধকারে কী যেন খুঁজতে লাগল, মনে হল তাঁকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তিনি পিছন ফিরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। কয়েক মিনিট পরেই থিয়েটারের বাইরে গিয়ে পড়লেন।

কোথায় যা যাচ্ছিলেন তা তিনি নিজেও জানতেন না। মনে হল, আলো-আঁধারের ভেতর দিয়ে, স্বল্প আলোকোজ্জ্বল রাস্তার ওপর দিয়ে, কালো-কালো গম্বুজ আর ভুতুড়ে বিরাট-বিরাট প্রাসাদের পাশ দিয়ে তিনি হেঁটে চলেছেন। কর্কশভাবে হাসতে-হাসতে স্ত্রীলোকেরা তাঁকে। চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল। মদ খেয়ে মাতালগুলো হনুমানের মতো কিচকিচ করতে-করতে আর গালাগালি দিতে দিতে রাস্তার ওপরে গড়াগড়ি দিচ্ছে। কিম্ভুতকিমাকার চেহারার বাচ্চাদের রকের ওপরে বসে থাকতে তিনি দেখলেন, ভেতরের উঠোন থেকে অশ্লীল ভাষায় যে সব। কথাবার্তা চলছিল সে-শব্দও শুনতে পেলেন তিনি।

ভোরের দিকে তিনি বুঝতে পারলেন কোভেনট গার্ডেন-এর খুব কাছে এসে পড়েছেন। অন্ধকার অপসারিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে একটা ফিকে আগুনে রঙ দেখা দিল। তারপরেই আকাশ মুক্তোর মতো হয়ে গেল। লিলি ফুলের বোঝা নিয়ে বড়ো-বড়ো গাড়িগুলি ফাঁকা। রাস্তার ওপর দিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ করতে-করতে এগিয়ে যেতে লাগলা ফুলের গন্ধে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। তাদের গন্ধে যন্ত্রণার কিছুটা উপশম হল তাঁরা বাজারের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি; বিরাট-বিরাট গাড়ি থেকে মাল খালাস করতে দেখলেন। সাদা পোশাক পরা একটি গাড়োয়ান তাঁকে কয়েকটা চেরি দিল। তিনি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন লোকটা তাঁর কাছ থেকে দাম নিল না কেন। সেই ফলগুলি নিয়ে অন্যমনস্কভাবে তিনি খেতে লাগলেন। ফলগুলিকে মধ্যরাত্রিতেই তোলা হয়েছে, রাত্রির ঠান্ডা ফলগুলির ভেতরে ঢুকে সেগুলিকে স্নিগ্ধ করে রেখেছে। একদল ছেলে টিউলিপ, বেগনে আর লাল গোলাপের টুকরি নিয়ে তাঁর পাশ দিয়ে শাকসজির দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। সূর্যের আলোকে চকচকে বড়ো বড়ো থাম দেওয়া গাড়িবারান্দার নীচে নিলাম ডাকা শেষ হওয়ার জন্যে একদল মেয়ে খোলা মাথায় অপেক্ষা করছে। আর সবাই পিয়াজার কফি-হাউসের ঠেলা দরজার কাছে কফি খাওয়ার জন্যে ভিড় করেছে। বড়ো-বড়ো শকটগুলো ঘন্টা বাজিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। কয়েকটা গাড়োয়ান খালি বস্তার ওপরে গড়াগড়ি দিচ্ছে, আবার রাস্তার ওপরে ছড়ানো খাবার খুটে খাওয়ার জন্যে পায়রার দল ঝাঁক বেঁধে উড়ছে।

কিছুক্ষণ পরে একটা গাড়ি ডেকে বাড়িতে ফিরে এলেন তিনি। কিছুক্ষণ তিনি বন্ধ দরজার সামনেই পায়চারি করতে লাগলেন; সামনেই পার্ক, পার্কের চারপাশের বাডিগুলি জানালা-দরজা বন্ধ করে তখলো ঘুমোচ্ছিল। সেইদিকে কয়েক মিনিট তিনি তাকিয়ে রইলেন।

ঘরের সামনেই বিরাট হলঘর। ওক-গাছের বিম দেওয়া তৈরি নীচের ছাদ থেকে ভেনিসের তৈরি বিরাট একটা বাতিদান ঝুলছিল। তার ভেতরে তিনটে বাতি তখনো জ্বলছিল মিটমিট করো বাতিগুলিকে নিবিয়ে দিলেন তিনি; টুপি আর ঢিলে জামাটা টেবিলের ওপরে খুলে রেখে লাইব্রেরির মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর শোওয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। নীচের তলার ঘরটি তাঁর বেশ বড়োই। জীবনে নতুন ভোগের আস্বাদ পেয়ে ঘরটিকে সুন্দরভাবে সাজিয়েছিলেন তিনি। ঘরের দরজা খোলার সময় হঠাৎ বেসিলের তৈরি তাঁর সেই প্রতিকৃতিটির দিকে নজর পড়ে গেল। সেটি তাঁর ঘরের দরজার সামনেই দাঁড় করানো ছিল। প্রতিকৃতিটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে একটু পিছু হটে গেলেন তিনি। একটু বিভ্রান্ত হয়ে তিনি ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। কোটটা খুলে একটু ইতস্তত করলেন; তারপরে বেরিয়ে এলেন। আবার প্রতিকৃতির সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঘি-রঙা মোটা সিল্কের পর্দা ভেদ করে যেটুকু আলো প্রতিকৃতিটির ওপরে এসে পড়েছিল সেই আলোতেই সেইদিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি। মনে হল কিছুটা যেন পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। প্রতিকৃতিটির আগেকার চাহনি আর নেই। মুখের ওপরে নিষ্ঠুরতার একটা ছাপ পড়েছে। ছাপটা স্পষ্ট; যে-কোনো লোকের চোখেই তা ধরা পড়ার কথা। নিশ্চয়, ওটা নিষ্ঠুরতার ছাপ ছাড়া আর কিছু নয়।

ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি, জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন, পর্দাটা দিলেন সরিয়ে। ভোরের উজ্জ্বল আলো ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল, ঘরের রহস্যময় অন্ধকার একপা<Hard copy issue> ছিটকে পড়ল। কিন্তু প্রতিকৃতিটির মুখের ওপরে যে অদ্ভুত ছাপটি তিনি প্রথমে লক্ষ। করেছিলেন, আলোর জ্যোতিতেও তা অপসারিত হল না; মনে হল, সেটি আরো ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। আরশির সামনে দাঁড়ালে মানুষ যেমন তার মুখের প্রতিটি অংশ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখতে পায়, প্রভাতের আলোর দ্যুতিতেও সেই রকম পরিচ্ছন্নভাবে দেখতে পেলেন। তিনি-প্রতিকৃতির মুখের ওপরে যে ছাপটা পড়েছে সেটা নিষ্ঠুরতার মনে হচ্ছে, এইমাত্র সে কোনো পাপ করে এসেছে।

ভ্রুকুটি করলেন ডোরিয়েন। লর্ড হেনরি তাঁকে অনেক উপহার দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটা। ছিল ডিম্বাকৃতি গ্লাস। তারই মসৃণ গায়ের ওপরে তিনি তাড়াতাড়ি নিজের মুখ দেখতে লাগলেন। না, তাঁর লাল ঠোঁট দুটির ওপরে তো কোনো চিহ্ন পড়েনি। তাহলে, এর অর্থ কী?

চোখ দুটো রগড়ে নিলেন তিনি? ছবিটির খুব কাছে এসে আবার পরীক্ষা করতে লাগলেন। ছবিটার ওপরে সত্যিকার কোনো দাগ পড়েনি, তবু মনে হচ্ছে ছবিটির মুখের চেহারাটা যেন পালটিয়ে গিয়েছে। এটা তাঁর নিছক কল্পনা নয়। পরিবর্তনটা স্পষ্ট-ভীষণভাবে স্পষ্ট।

একটা চেয়ারের ওপরে বসে ভাবতে লাগলেন।

ছবিটা শেষ হওয়ার দিন বেসিলের স্টুডিযোতে বসে একটা কথা বলেছিলেন। সেই কথাটা হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, সপষ্ট মনে রয়েছে তাঁর। তিনি একটি উন্মত্ত আশা পোষণ করেছিলেন। আশাটা হচ্ছে, তিনি চিরকাল তরুণ থাকবেন। বৃদ্ধ হোক ছবিটা। তাঁর নিজস্ব সৌন্দর্য যেন নষ্ট না হয়, তাঁর সমস্ত পাপ আর উচ্ছ্বাসের ছাপ ওই ক্যানভাসের বুকে প্রতিফলিত হোক। তাঁর সমস্ত দুঃখ আর চিন্তার রেখার জর্জরিত হোক ছবিটা। তিনি যৌবনের সমস্ত রস চিরকাল সঞ্জীবিত থাকুন। নিশ্চয় তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি। এ-আশা পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর সামনের ওই ছবিটির মুখে নিষ্ঠুরতার ছাপ পড়ল কী করে?

নিষ্ঠুরতা! সত্যিই কি তিনি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন? অপরাধ মেয়েটির; তাঁর নয়। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন মেয়েটি একজন বিরাট আর্টিস্ট, প্রতিভাময়ী ভেবেছিলেন বলেই তো তিনি তাকে ভালোবেসেছিলেন। সে তাঁকে নিরাশ করেছে। মেয়েটি সাধারণ; তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা তার নেই। তবু মেয়েটি যে একটা শিশুর মতো তাঁর পায়ের নীচে লুটিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল–এই দৃশ্যটা মনে পড়তেই তিনি দুঃখ আর তীব্র অনুশোচনায়। ভেঙে পড়লেন। তিনি যে কতটা নিরাসক্তভাবে সেই দৃশ্য দেখেছিলেন সেকথাটা তাঁর মনে। পড়ে গেল। ভগবান তাঁকে কেন এমন করে সৃষ্টি করলেন? কেন তিনি তাঁকে ওই ধরনের আত্মা দিয়েছেন? কিন্তু তিনিও কম যন্ত্রণা ভোগ করেননি। অভিনয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনটি ঘন্টা তাঁর মনে হয়েছিল তিনটি শতাব্দী; আর তাদের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। তাঁকে পাওয়া তো সাইবিলের পক্ষে কম পাওয়া ছিল না। তিনি তাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছেন এই কথাটা স্বীকার করে নিলেও তো অস্বীকার করা যায় না যে সেও তাঁকে মুহূর্তের জন্যে বিয়ে করেছিল। তাছাড়া, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা দুঃখভোগে বেশি অভ্যস্ত। প্রেমিকদের সঙ্গে কলহ করতেই মেয়েরা ভালোবাসে; একথা লর্ড হেনরি তাঁকে বলেছেন এবং মেয়েরা কী ধাতু দিয়ে গড়া তা লর্ড হেনরি ভালোভাবেই জানেন। সাইবিল ভেনের কথা চিন্তা করে তিনি এত কষ্ট পাচ্ছেন কেন? এখন থেকে মাইবিল ভেন তাঁর কাছে কেউ নয়।

কিন্তু তাঁর ছবি? ওটার সম্বন্ধে কী বলার রয়েছে তাঁর? ওই ছবিটাতেই তো তাঁর জীবনের রহস্য লুকিয়ে রেখেছে; ওই ছবিটাই তাঁর জীবনের আলেখ্য। এই ছবিটাই তাঁকে তাঁর নিজের সৌন্দর্যকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। নিজের আত্মাকে ঘৃণা করতেও কি ওই ছবি তাঁকে শেখাবে? আবার কি তিনি ছবিটিকে দেখবেন?

না। যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তিনি কাটিয়েছেন তারই জন্যে দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেছে তাঁরা যে ভয়ানক রাত্রিটি তিনি অতিক্রম করে এসেছেন সেই রাত্রিটিই তাঁর পিছনে ভৌতিক ছায়াগুলিকে লেলিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ তাঁর মাথার মধ্যে এমন একটা দুশ্চিন্তার বীজ উপ্ত হয়েছে সে দুশ্চিন্তা মানুষকে উন্মাদ করে দেয়। প্রতিকৃতিটির কোনো পরিবর্তন হয়নি; পরিবর্তন হয়েছে একথাটা ভাবাই তাঁর পক্ষে মূর্খতা হয়েছে।

তবু তার সুন্দর অথচ বিকৃত মুখ আর নিষ্ঠুর হাসি নিয়ে ছবিটি তাঁকে লক্ করছে। প্রভাতের সূর্যরশ্মিতে তার উজ্জ্বল চুলগুলি চিকচিক করছে। তার নীল চোখ দুটির সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হল। তাঁর নিজের জন্যে ন্য, তাঁর ওই প্রতিকৃতিটির জন্যে তাঁর একটা অদ্ভুত মায়া হল। ছবিটির মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, ভবিষ্যতে আরো দেখা দেবে। তার গোলাপী রঙটা। ফ্যাকাশে হয়ে যাবে, শুকিয়ে যাবে তার লাল আর সাদা গোলাপগুলি। তিনি যে সব পাপ কাজ করবেন তার প্রতিটি ছাপ ওই সুন্দর মুখের ওপরে পড়ে তাকে বিকৃত করবে। কিন্তু তিনি । কোনো পাপ কাজ করবেন না। পরিবর্তন হোক আর নাই হোক, তাঁর বিবেকের প্রতীক চিহ্ন হিসাবে ছবিটি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রলোভন তিনি এডিয়ে চলবেন। লর্ড হেনরির সঙ্গে আর তিনি দেখা করবেন না; অন্তত, আর কোনোদিনই তাঁর কথায় কান দেবেন না। এবং এই কথাগুলিই বেসিল হলওয়ার্ডের বাগানে প্রথম তিনি তাঁর মুখ থেকে শুনেছিলেন; এবং এইগুলিই বিষাক্ত নীতির মতো তাঁর অসম্ভব বাসনা-কামনাগুলিকে নাড়া দিয়েছিল। তিনি সাইবিল ভেনের কাছেই ফিরে যাবেন, তার কাছে হমা প্রার্থনা করবেন, তাকে বিয়ে করবেন, আবার তাকে ভালোবাসতে চেষ্টা করবেন। হ্যাঁ, এটাই তাঁর কর্তব্য হবে। তিনি যত কষ্ট ভোগ করেছে তার চেয়ে সাইবিল নিশ্চয় অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে। হতভাগ্য শিশু। স্বার্থপরের। মতো তিনি তার সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন। আইবিলের ওপরে তাঁর যে আকর্ষণ জন্মেছিল সে-আকঙ্কণ আবার ফিরে আসবে। তাকে নিয়ে সুখী হবেন তিনি। তাকে বিয়ে করে তাঁর জীবন সুন্দর আর পবিত্র হয়ে উঠবে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি; প্রতিকৃতির সামনে যে বিরাট পর্দাটা ঝুলছিল সেটাকে একপাশে টেনে দিলেন, তার দিকে তাকিয়ে ভয়ে কেঁপে উঠলেন। “কী ভয়ঙ্কর!”–বিড়বিড় করে বলতে-বলতে তিনি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে জানালাটা খুলে দিলেন। ঘাসের ওপরে বেরিয়ে এসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। প্রভাতের স্নিগ্ধ বাতাস তাঁর মনের সমস্ত অবসাদ দূর করে দিল। কেবল সাইবিলের কথাই তিনি ভাবতে লাগলেন। ভালোবাসার একটা হীণ রশ্মি আবার তাঁর চোখে পড়ল। সাইবিলের নাম তিনি বার বার উচ্চারণ করতে লাগলেন। শিশিরভেজা বাগালের মধ্যে পাখিরা যে গান গাইছিল সেই গান সাইবিলের কথাই তাঁকে শোনাচ্ছিল।

.

অষ্টম পরিচ্ছেদ

তাঁর ঘুম যখন ভাঙল তখন দুপুর অনেকটা গড়িয়ে গিয়েছে। তিনি জেগেছেন নাকি জানার জন্যে তাঁর চাকর অনেকবারই নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে ঢুকেছে; তার যুবক মনিব এত ঘুমোচ্ছেন কেন বুঝতে না পেরে অবাক হয়েছে যথারীতি। শেষ পর্যন্ত একসময় তাঁর ঘুম ভাঙল; তিনি বেল বাজালেন। ভিকটর এক কাপ চা আর পুরনো চিনেমাটির ট্রে-তে করে একগাদা চিঠি নিয়ে ধীরে-ধীরে ঘরে এসে ঢুকল; তিনটি জানালার ওপরে যে ওলিভ-সাটিনের পর্দাগুলি ঝুলছিল সেগুলি সে টেনে একপাশে সরিয়ে দিল।

ভিকটর হেসে বলল: মলিয়ে আজ অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছেন।

ঘুমচোখে ডোরিয়েন জিজ্ঞাসা করলেন: কটা বেজেছে, ভিকটর?

সওয়া একটা মঁসিয়ে।

সত্যিই বড়ো দেরি হয়েছে। উঠে বসলেন তিনি; চা খেয়ে তিনি চিঠিগুলি টেনে নিলেন। একটা চিঠি এসেছে লর্ড হেনরির কাছ থেকে। সেদিনই সকালে একটি পত্রবাহক এসে সেটি দিয়ে। গিয়েছে। খুলবেন কি খুলবেন না–একটু ইতস্তত করে তিনি সেটিকে সরিয়ে রাখলেন। অন্যগুলিকে তিনি খুললেন বটে কিন্তু পড়ার আগ্রহ তাঁর একেবারে ছিল না। চিঠিগুলির মধ্যে ছিল কার্ড, ডিনারের নিমন্ত্রণ, সিনেমা, কনসার্টের টিকিট, এই সময়টা লন্ডনের কর্মহীন ফ্যাশানেবল যুবকদের কাছে এই জাতীয় চিঠিপত্র প্রায়ই আসে। একটা অনেক টাকা দামের বিল-ও এসেছিল। তিনি একটা রুপোর লুই কুইনজ টয়লেট সেট কিনেছিলেন। এই কথাটা তখনো পর্যন্ত তিনি তাঁর অভিভাবকদের জানাতে সাহস করেননি। তার একমাত্র কারণ হচ্ছে তাঁর অভিভাবক একেবারে সেকেলে। তিনি কিছুতেই বুঝতে চান না আধুনিক যুগে আমাদের সবচেয়ে প্রযোজনীয় জিনিসের। ভারমিন স্ট্রিটের উত্তমর্ণদের কাছ থেকে চিঠিও এসেছিল। অনেকগুলি। তারা বেশ বিনীতভাবে জানিয়েছিল যে এক মিনিটের নোটিশে এবং সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত অথবা নামমাত্র সুদ নিয়ে তারা ধার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পাবে। ঘুম থেকে ওঠার প্রায় মিনিট দশেক পরে, সিল্কের পাড় বসানো দামি একটা বড়ো কাশ্মীরি উলের তৈরি ড্রেসিং গাউন গায়ে চড়িয়ে তিনি স্নানের ঘরে ঢুকলেন। দীর্ঘ নিদ্রার পরে ঠান্ডা জল তাঁর অবসাদ অনেকটা দূর করে দিল। আগের দিন রাত্রি থেকে যে সব যন্ত্রণা আর হতাশার মধ্যে। দিয়ে তাকে কাটাতে হয়েছিল, স্নানের পরে সে সমস্ত তাঁর মন থেকে মুছে গেল। দু’একবার অবশ্য বিয়োগান্ত নাটকের অদ্ভুত স্মৃতিগুলি তাঁর মনের কোণে উঁকি দেয়লি সেকথা সত্যি নয়; কিন্তু তাঁর মনে হল সেগুলি সব স্বপ্ন, তাদের মধ্যে বাস্তবের কোনো ছোঁয়াচ নেই।

স্নান সেরে তিনি লাইব্রেরিতে গেলেন। এই ঘরেই খোলা জানালার ধারে ছোটো একটি টেবিলের ওপরে তাঁর জন্যে অল্প পরিমান ফ্রেঞ্চ ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছিল। সেই টেবিলের পাশে গিয়ে তিনি বসলেন। দিনটি বড়ো চমৎকার। মনে হল, গরম বাতাসের মধ্যে সুগন্ধি মশলার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। গুনগুন করতে-করতে একটা মৌমাছি ঘরের মধ্যে ঢুকে এল; তাঁর সামনে নীল ভেস-এর মধ্যে রাখা বেগনে গোলাপ ফুলের চারপাশে ঘুরতে লাগল। আর তাঁর কোনো দুঃখ নেই। মন তাঁর আনন্দে ভরে উঠেছে।

প্রতিকৃতির সামনে যে পর্দা ঝোলানো ছিল হঠাৎ তাঁর চোখ দুটো তার ওপরে গিয়ে পড়ল। চমকে উঠলেন তিনি।

টেবিলের ওপরে একটা ওমলেটের প্লেট দিয়ে তাঁর পরিচারক জিজ্ঞাসা করল: খুব ঠান্ডা লাগছে, মঁসিয়ে? ডানালাটা বন্ধ করে দেব?

মাথা নাড়লেন ডোরিয়েন বললেন: না, না, ঠান্ডা লাগছে না।

ব্যাপারটা কি সত্যি? সত্যিই কি প্রতিকৃতিটার ওপরে পরিবর্তন দেখা দেয়েছে? প্রতিকৃতিটির মুখের যে জায়গাটায় আগে আনন্দের জ্যোতি ফুটে উঠেছিল সেইখানে একটা কলঙ্কের রেখা দেখা দিয়েছে। এটা কি সত্যি, না, তাঁর মতিভ্রম? ক্যানভাসে আঁকা চেহারার মধ্যে নিশ্চয়। কোনো পরিবর্তন দেখা দিতে পারে না। ব্যাপারটা একেবারে অসম্ভব ঘটনা। বেসিলকে তিনি গল্প বলার ছলে এ-কাহিনি একদিন বলতে পারেন। গল্প শুনে নিশ্চয় তিনি হাসবেন।

কিন্তু তবু কত স্পষ্টই না তাঁর সব মনে রয়েছে। প্রথমে প্রত্যুষের অস্পষ্ট আলোতে তারপরে প্রভাতের উজ্জ্বল আলোতে ওই ছবিটির ঠোঁটের ওপরে নিষ্ঠুরতার একটি বাঁকা ভঙ্গি তিনি দেখেছেন। তাঁর পরিচারক ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি একটু ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন যে ঘরে একা থাকলেই ওই প্রতিকৃতিটিকে পরীক্ষা করার জন্যে আবার তাঁকে উঠতে হবে। পরীক্ষা করতে তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু সেই নির্মম ব্যঙ্গের ছায়াটি যে তিনি দেখতে পাবেন সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না তাঁর। কফি আর সিগারেট দিয়ে লোকটি যখন চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল তখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে না যাওয়ার জন্যে তাকে অনুরোধ জানানোর একটা উদগ্র কামনা জাগল তাঁর। লোকটি বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দরজা ভেড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গে তিনি তাকে ডাকলেন। তাঁর নির্দেশ কী শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে। রইল লোকটি ডোরিয়েন তার দিকে এ তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন: কেউ এলে বলে দিয়ো আমি বাড়িতে নেই।

মাথাটা একটু নুইয়ে বেরিয়ে গেল লোকটি।

তারপরে তিনি উঠলেন, একটা সিগারেট ধরালেন, পর্দার দিকে মুখ করে যে ভালো গদি দিয়ে মোড়া সোফাটি পাতা ছিল তার ওপরে বসে পড়লেন। পর্দাটা পুরনো, স্পেনদেশীয় চামড়া দিয়ে তৈরি; তার ওপরে লুই কোয়টজ জাতীয় চকচকে স্ফটিক মণির নক্সা কাটা। বিশেষ কৌতূহল নিয়ে তিনি পরীক্ষা করলেন সেটিকে। সত্যিই কি মানুষের হৃদয়ের গোপন কোনো রহস্য এর আগে কোনোদিন সে লুকিয়ে রেখেছে?

যাই হোক, এটাকে কি তিনি সরিয়ে রাখবেন? কী দরকার? ওখানেই থাক না। ও-কথা জেনে লাভ কী? ব্যাপারটা যদি সত্যিই হয় তাহলে নিশ্চয় তা ভয়ানক; যদি সত্যি না হয়, তাহলে বিষয়টা নিয়ে এত চিন্তা করে লাভ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আর কারো চোখে যদি হঠাৎ এই পরিবর্তনটি ধরা পড়ে? বেসিল হলওয়ার্ড এসে যদি এই ছবিটির দিকে তাঁকে তাকিয়ে দেখতে বলেন তাহলে তিনি কী করবেন? বেসিল সেকথা যে তাঁকে বলবেন সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। না; জিনিসটাকে ভালো করে দেখতে হবে, এবং এখনই। এই ভয়ঙ্কর সন্দেহ মনের মধ্যে পুষে রাখার চেয়ে অন্য যে কোনো কাজ করা ভালো।

এই ভেবে তিনি উঠে পড়লেন; বন্ধ করে দিলেন দুটি দরজা। এই লজ্জার কালিমা একমাত্র তিনি নিজেই দেখবেন। তারপরে তিনি পর্দাটাকে সরিয়ে দিলেন, প্রতিকৃতিটির মুখোমুখি দাঁড়ালেন। না, ব্যাপারটা সত্যি-যাকে বলে নির্ভেজাল। প্রতিকৃতিটির চেহারায় পরিবর্তন এসেছে।

ভবিষ্যতে ঘটনাটিকে নিয়ে মনে-মলে তিনি অনেকবারই আলোচনা করেছেন এবং আলোচনা করতে-করতে কম অবাক হননি। প্রথমে ছবিটির দিকে তিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়েই তাকিয়ে ছিলেন। এইরকম একটা পরিবর্তন যে ঘটতে পারে তা তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু তবু ঘটনাটা সত্যি। রাসায়নিক অণু-পরমাণুগুলির মধ্যে কি চোখে দেখা যায়। না এমন কোনো সংযোগ রয়েছে? তার তারই ফলে কি ক্যানভাসের ওপরে প্রতিকৃতির। অবয়ব, রঙ, আর তার আত্মাটি প্রতিফলিত হয়? এটা কি সম্ভব যে সেই আত্মা যা চিন্তা করে সেইটাই পরমাণুগুলি বাইরে প্রকাশ করে? সেই আত্মা যা স্বপ্ন দেখে সেইটাকেই তারা পরিণত করে সত্যে? অথবা, এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে এবং সে কারণগুলি ভয়ঙ্কর? ভাবতে-ভাবতে তিনি ভয়ে কেঁপে উঠলেন; তারপরে, সোফার ওপরে ফিরে গিয়ে তিনি বিহ্বল নেত্রে ছবিটির দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন চুপচাপ।

একটি জিনিস অবশ্য ছবিটি তাঁর কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছে। সেটা সাইবিল ভেনের ওপরে তিনি কী অত্যাচার করেছেন, তার সঙ্গে কত নির্মম ব্যবহার করেছেন সেটা তিনি বুঝ পেরেছেন। এই অন্যায়ের প্রতিকার করার সময় যায়নি এখনো। সাইবিল তাঁর স্ত্রী হতে পারে। তাঁর এই অবাস্তব আর স্বার্থপরের মতো ভালোবাসা কোনো মহৎ আদর্শের কাছে মাথা নীচু করবে, বেসিল হলওয়ার্ড তাঁর যে প্রতিকৃতিটি তৈরি করেছেন সেটি ভবিষ্যতে তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে; সন্মার্গ বলতে কিছু লোকে যা বোঝে, বিবেক বলতে কিছু লোকের কাছে যা মনে হয় এবং ভগবৎ-ভীতি বলতে সকলের কাছে যা প্রতীয়মান, ছবিটিকে সেইভাবে মেনে নিয়ে তিনি চলার পথে এগিয়ে যাবেন। অনুশোচনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আফিও রয়েছে, নৈতিক প্রবৃত্তিগুলিকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে রয়েছে ওষুধ। কিন্তু পাপের জন্যে তাঁর যে অধঃপতন ঘটেছে তা এখানে সপষ্ট। তিনি যে তাঁর আত্মাটিকে ধ্বংস করে ফেলেছেন তারই চির ভাস্বর নিদর্শন এইখানে জলজ্বল করে জ্বলছে।

তিনটে বাজল, চারটে বাজল; সাড়ে চারটে বাডঘর দ্বৈত সংকেত শোনা গেল ঘড়িতে। কিন্তু একইভাবে বসে রইলেন গ্রে। বসে বসে জীবনের পীতাভ-লালচে সুতোগুলিকে একসঙ্গে গুটিয়ে তিনি একটি নতুন প্যাটার্ন তৈরি করছিলেন। আশা আর আবেগের যে অন্ধ গলির মধ্যে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তারই মধ্যে থেকে পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। এর পরে কী তিনি করবেন সে। সম্বন্ধে কিছুই তিনি ভেবে পেলেন না। ভাবতে-ভাবতে তিনি টেবিলের ধারে উঠে গেলেন; যে-মেয়েটিকে তিনি ভালোবাসতেন তাকে উদ্দেশ্য করে একটি দীর্ঘ আবেগমাখা প্রেমপত্র লিখলেন; তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে জানালেন যে সেদিন তিনি তার সঙ্গে অপ্রকৃতিস্থর মতো ব্যবহার করছেন। দুঃখ, যন্ত্রণা, আর অনুশোচনায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ের উচ্ছ্বাস দিয়ে। তিনি পাতার পর পাতা ভরিয়ে তুললেন। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত চিঠিটি আত্ম-তিরস্কারে ভরাট হয়ে গেল। নিজেরাই যখন আমরা নিজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলি তখন আমরা ভাবি আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার আর কারো অধিকার নেই। পাদরী নয়, এই স্বীকারোক্তিই আমাদের মুক্তি দেয়। চিঠিটি শেষ করার পরে ডোরিয়েন সহজভাবে নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন তিনি যে অন্যায় করেছেন সেই অন্যায়ের প্রতিকার সুসম্পন্ন হয়েছে।

হঠাৎ দরজায় একটা টোকা পড়ল; বাইরে থেকে লর্ড হেনরির কথা শোনা গেল ডোরিয়েন, তোমার সঙ্গে দেখা আমাকে করতেই হবে। দরজা খোল। এইভাবে দরজা বন্ধ করে তুমি বসে থাকবে এটা আমি সহ্য করতে পারব না।

প্রথমে কোনো উত্তর দিলেন না তিনি; চুপচাপ বসে রইলেন। দরজার ওপরে ধাক্কার পর ধাক্কা পড়তে লাগল; ঠিক, ঠিক–তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়াই ভালো। তিনি যে নতুন জীবনের পরিকল্পনা করেছেন সেটা তাঁকে খুলে বলতে হবে; তিনি যদি তার বিরোধিতা করেন তাহলে প্রয়োজনবোধ কলহের আসরেও নামতে হবে তাঁকে; আর সেই কলহের ফলে দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ যদি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেই বিচ্ছেদকেও তাঁকে মেনে নিতে হবে। এই ভেবে তিনি দাঁড়িয়ে উঠলেন এবং তাড়াতাড়ি পর্দাটি ছবির সামনে টেনে দিয়ে তিনি দরজাটা খুলে দিলেন।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে লর্ড হেনরি বললেন: যা ঘটেছে তার জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত, ডোরিয়েন; কিন্তু ও-সম্বন্ধে বেশি কিছু চিন্তা করো না তুমি।

ডোরিয়েন জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি সাইবিল ভেনের কথা বলছ?

চেয়ারের ওপরে বসে ধীরে ধীরে হাতের দস্তানাগুলি খুলতে খুলতে লর্ড হেনরি বললেন: হ্যাঁ, নিশ্চয়। একদিন থেকে ঘটনাটা ভয়ঙ্কর, সন্দেহ নেই, কিন্তু তার জন্যে তুমি দায়ী নও। বল দেখি, অভিনয় শেষ হওয়ার পরে তুমি কি নীচে নেমে তার সঙ্গে দেখা করেছিলে?

করেছিলাম।

আমিও তাই ভেবেছিলাম। তার সঙ্গে কোনো ঝগড়া-ঝাঁটি তোমার হয়েছিল?

আমি খুব নিষ্ঠুরের মতো ব্যবহার করেছিলেম হ্যারি-পশুর মতো ব্যবহার করেছিলেম। কিন্তু সে সব এখন মিটে গিয়েছে। যা ঘটে গিয়েছে তার জন্যে আমি দুঃখিত নই। এই ঘটনার মাধ্যমে নিজেকে আমি ভালো করে বোঝার সুযোগ পেয়েছি।

বাঁচালে ডোরিয়েন। গোটা ব্যাপারটাকেই তুমি যে এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে পেরেছ এতেই আমি খুশি হয়েছি। তুমি হয়তো গভীর অনুশোচনায় ডুবে নিজের মাথার সুন্দর চুলগুলি ছিডছ এই ভেবে আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেম।

মাথায় একটা ঝাঁকানি দিয়ে এবং একটু হেসে ডোরিয়েন বললেন: সে অবস্থা আমি পেরিয়ে এসেছি। এখন আমি খুশি। প্রথম কথাটা হচ্ছে, বিবেক বলতে কী বোঝায় তা আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি আমাকে যেভাবে বুঝিয়েছিলে বিবেক তা নয়; আমাদের মধ্যে যা কিছু রয়েছে। বিবেক হচ্ছে তাদের সকলের চেয়ে স্বর্গীয়। নাক সিটকিয়ো না, হ্যারি; অন্তত আমার কাছে না; আমি ভালো হতে চাই আমার আত্মা ভয়ঙ্কর হবে, বিকৃত হবে তা আমি সহ্য করতে পারব না।

নীতির ভিত্তি হিসাবে তোমার কথাটি কেবল মনোরমই নয়, সত্যিকার কলাবিদের মতো ডোরিয়েন। এই কথা বলার জন্যে তোমাকে আমার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। কিন্তু শুরু করবে কোথায়?

সাইবিল ভেনকে বিয়ে করে।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলেন লর্ড হেনরি; হতভম্বের দৃষ্টি তাকিয়ে তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। কী, কী বললে? সাইবিল ভেনকে বিয়ে করে! কিন্তু প্রিয় ডোরিয়েন…

হ্যাঁ, হ্যারি; এর পরে তুমি কী বলবে তা আমি জানি। বিয়ের বিরুদ্ধে নিশ্চয় কোনো ভয়ঙ্কর কথা। না, না, ওসব কথা বলো না। আমার কাছে আর কোনোদিন বিয়ের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করো না তুমি। দু’দিন আগে সাইবিলকে বলেছিলেম আমাকে বিয়ে করতে। সে কথা ভাঙতে আমি রাজি নই। সেই আমার স্ত্রী হবে।

তোমার স্ত্রী হবে! ডোরিয়েন…তুমি কি আজ সকালে আমার চিঠি পাওনি? নিজের হাতে সেই চিঠি আমি তোমার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।

তোমার চিঠি। হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়ছে বটে। আমি সেটা এখনো পড়িনি। ভঘ হচ্ছিল হয়তো সেই চিঠিতে এমন কিছু রয়েছে যা আমার পড়ে ভালো লাগবে না। তোমার বক্রোক্তিগুলি একটা। আস্তো জীবনকে কেটে টুকরো-টুকরো করে ফেলে।

তাহলে তুমি কিছুই জান না?

কী বলছ তুমি?

লর্ড হেনরি ঘরের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে ডোরিয়েন গ্রে-র পাশে গিয়ে বসলেন; তারপরে তাঁর। একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে শক্ত করে ধরে বললেন: ডোরিয়েন, ভয় পেয়ো না; আমার চিঠিতে লেখা ছিল সাইবিল ভেন মারা গিয়েছে।

যন্ত্রণার একটা তীব্র আর্তনাদ ডোরিয়েনের ঠোঁটের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এল; চট করে দাঁড়িয়ে উঠলেন তিনি; লর্ড হেনরির মুঠো থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললেন–মারা গিয়েছে! সাইবিল আর নেই! না, এ সত্যি নয়; এ একটা জঘন্য মিথ্যা কথা। একথা বলতে তোমার সাহস হল কেমন করে?

লর্ড হেনরি গম্ভীরভাবে বললেন: কথাটা সত্যি, ডোরিয়েন। সকালের কাগজেই এই সংবাদটা বেরিয়েছে। আমার সঙ্গে দেখা করার আগে আর কারো সঙ্গে তুমি দেখা করো না–বিশেষ। করে এই কথাটাই সেখান লেখা ছিল এবং অবশ্যই একটা অনুসন্ধান এর হবে–যাকে বলে ময়না তদন্ত; সেই তদন্তের সঙ্গে তোমার জড়িয়ে পড়া চলবে না। এই রকম ব্যাপার ফ্রান্সে মানুষকে ফ্যাশনেবল করে তোলে, কিন্তু লন্ডনে সাধারণ লোকেরা ছি-ছি করে। দুর্নাম রটনা হতে পারে এমন কোনো কাউকেই এখানে আমাদের প্রচারযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা উচিত নয়। বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতিচারণার সঙ্গে ওগুলিকে সঞ্চয় করে রাখা উচিত। আমার মনে হয়, থিয়েটার কেউ তোমার নাম জানে না। যদি না জেনে থাকে তো ভালোই। তার ঘরের দিকে যেতে কেউ কি তোমাকে দেখেছিল? এইটিই একটা জরুরি জিনিস।

কয়েক মিনিট কোনো কথা বললেন না ডোরিয়েন; মনে হল, হতভম্ব হয়ে পড়েছেন তিনি। তাঁর চোখ আর মুখের ওপরে ভয়ের একটা ছায়া পড়েছে। অবশেষে বুদ্ধ কণ্ঠের ভেতর থেকে একটা জড়ানো, অসপষ্ট স্বর বেরিয়ে এল তাঁর: ও, হ্যারি, ময়না তদন্তের কথা তুমি বলবে না? কেন ময়না তদন্ত? সাইবিল কি তাহলে…ও, হ্যারি, আমি সহ্য করতে পারছিলেন। তাড়াতাড়ি কী ঘটেছে সব আমাকে তাড়াতাড়ি বলা

ডোরিয়েন, আমার ধারণা ব্যাপারটা নিছক দুর্ঘটনা ন্য; যদিও সেইভাবেই বাইরের লোকের কাছে ঘটনাটা সাজাতে হবে। মনে হচ্ছে রাত্রি সাড়ে বারোটা অথবা তারই কাছাকাছি কোনো এক সময়ে তার মা যখন তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে থিয়েটারে এসেছিলেন সেই সময় কিছু। একটা জিনিস আনার জন্যে সাইবিল দোতলায় যায়। জিনিসটা নাকি ভুলে সে সেখানে ফেলে এসেছিল। কিছুক্ষণ তাঁরা নীচে অপেক্ষা করেছিলেন; কিন্তু সাইবিল আর নীচে নামেনি। খুঁজতে-খুঁজতে তাঁরা শেষ পর্যন্ত সাজঘরের মেঝের ওপরে তার মৃতদেহটিকে পড়ে থাকতে দেখেন। ভুল করে বিষ জাতীয় কিছু একটা সে খেয়ে ফেলেছিল। ওই জাতীয় কিছু জিনিস থিয়েটারের কাজে লাগে। ঠিক ডানিনে বস্তুটি কী, হয়তো প্রুশিক অ্যাসিড; শ্বেত পারা-ও হতে পারে। আমার বিশ্বাস প্রুশিক অ্যাসিড-ই হবে; কারণ, খাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তার মৃত্যু হয়েছিল।

চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন ডোরিয়েন: হ্যারি, হ্যারি, ভয়ঙ্কর এই সংবাদ!

হ্যাঁ, ঘটনাটা অবশ্যই বড়ো করুণ। কিন্তু এর সঙ্গে তোমার জড়িয়ে পড়লে চলবে না। স্ট্যান্ডার্ড কাগজ পড়ে বুঝলাম মেয়েটির বয়স সতের। আরো কম ব্যস বলেই মনে হয়েছিল আমার। দেখতে মেয়েটি ছিল বাচ্চা; আর অভিনয় করতে সে কিছুই জানত না। ডোরিয়েন, এটা নিয়ে তুমি বেশি ভেবো না। তুমি আমার সঙ্গে চল রাত্রির খাওয়াটা আমরা দুজনে একসঙ্গে সারব: তারপরে আমরা অপেরাতে যাবা আজকে পার্টির সম্মানার্থে সেখানে অভিনয়ের আয়োজন হয়েছে। গণ্যমান্য সবাইকেই সেখানে তুমি দেখতে পাবে। আমার বোনের আসনে তুমি বসবে; তার সঙ্গে কিছু অভিজাত ঘরণী রয়েছে। তার টিকিট পেতে কোনো অসুবিধে হবে না।

অনেকক্ষণ নিজের মনে-মনে বিড়বিড় করতে-করতে ডোরিয়েন গ্রে বললেন: সুতরাং সাইবিল ভেনকে আমি খুন করলাম। তার ছোটো কণ্ঠটি ছুরি দিয়ে কেটে ফেলার মতন করেই তাকে আমি হত্যা করে ফেললাম। তবুও গোলাপ ফুলকে এখনো আমরা কম ভালোবাসছিনে। আমার বাগানে পাখিরা এখনো সেই আগের মতোই মিষ্টি সুরে গান করছে এবং আজ রাত্রিতে তোমরা সঙ্গে আমি ডিনার খেতে চলেছি, সেখান থেকে যাব অপেরাতে অপেরা। ভাঙলে আর কোনো জায়গায় খেতে যাব। জীবন কি অসম্ভব রকমেরই না নাটকীয। হ্যারি, এই কাহিনি কোনো বই-এ পড়লে নিশ্চয় আমি কাঁদতাম। যে-কোনো কারণেই হোক ঘটনাটি সত্যি-সত্যি ঘটেছে বলেই, অথবা, আমাকে কেন্দ্র করে ঘটেছে বলেই হয়তো চোখের জল ফেলার চেয়েও অনেক বেশি চমৎকার বলে মনে হচ্ছে। জীবনে এই প্রথম আমি একটি উজ্জ্বল প্রেমপত্র লিখেছিলাম সত্যিই এটা একটা আশ্চর্যের ব্যাপার যে আমার প্রথম প্রেমপত্র একটি মৃতা প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। আমি অবাক হয়ে ভাবি, ওই শ্বেত পোশাক পরা। মানুষগুলি, যাদের আমরা মৃত বলি, তাদের কি অনুভব করার শক্তি রয়েছে? সাইবিল সে কি অনুভব করতে পারে, জানতে পারে, শুনতে পায়? হায হ্যারি, তাকে আমি কত ভালবাসতাম! মনে হচ্ছে সে যেন কত বছর আগেকার কথা। আমার সমস্ত মন আর প্রাণ। জুড়ে বসেছিল সে। তারপরে সেই ভয়ঙ্কর রাত্রিটি হাজির হল। সেটই কি সত্যিই গত রাত্রি? সে খারাপ অভিনয় করল; সেই দেখে আমার হৃদয় গেল ভেঙো খারাপ অভিনয় সে কেন করেছিল সে-কথা সে আমাকে বুঝিয়ে বলেছিল। কী করুণ সেই দৃশ্য! কিন্তু আমার হৃদয় তাতে একবিন্দু-ও গলেনি। আমি ধরে নিয়েছিলাম অভিনয় করার ক্ষমতা তার নেই। অকস্মাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটল যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কী যে ঘটল তা ঠিক জানি নে, কিন্তু এটা। বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি যে সেটি ভয়ঙ্কর। আমি বললাম তার কাছে আমি ফিরে যাব। আমি বুঝতে পারলাম তার ওপরে আমি অন্যায় করেছি এবং এখন সে মৃত। ভগবান, এখন। আমি কী করব? তুমি জান না কী বিপদে আমি পড়েছি। নিজেকে শক্তি করে ধরে রাখার মতো অন্য কোনো অবলম্বন আমার নেই। আমাকে একমাত্র সেই ধরে রাখতে পারত। আত্মহত্যা করার কোনো অধিকার তার ছিল না। সে নিতান্ত স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে।

সিগারেটের বক্স থেকে একটা সিগারেট বার করলেন লর্ড হেনরি, সোনালি দেশলাই-এর খোল থেকে কাঠি বের করে সেটি ধরালেন, তারপরে বললেন: প্রিয় ডোরিয়েন, পুরুষকে সৎপথে আনার একটি কৌশলই নারীদের জানা রয়েছে, সেটি হচ্ছে তাদের তিতিবিরক্ত করে তোলা; তাতেই বাঁচার সমস্ত আকাঙ্খা পুরুষদের নষ্ট হয়ে যায়। এই মেয়েটিকে বিয়ে করলে নিজেকে তুমি হতভাগ্য বলে মনে করতে। অবশ্য তার সঙ্গে তুমি সদ্য ব্যবহার করতে পারতে। কিন্তু করা সঙ্গে মানুষ সদ্য ব্যবহার করে জান? যার ওপরে তার বিন্দুমাত্র দরদ নেই। কিন্তু মেয়েটির বুঝতে দেরি হত না যে তুমি তার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। কোনো মহিলা যদি বুঝতে পারে যে তার স্বামী তার প্রতি উদাসীন তাহলে সে কী করে বল তো? হয় সে ভয়ঙ্কর রকমের কদর্য হয়ে যায়, নতুবা, সে এমন জাঁকালো পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায় যার খরচ অন্য মহিলাদের স্বামীদের যোগান দিতে হয়। সামাজিক ভুল নর কথা আমি অবশ্য এখানে তুলছিনে-কারণগুলি মানুষের নীচতা প্রকাশ করে, এবং ওগুলিকে। কোনোদিনই আমি হমার চোখে দেখতে পারিনে; কিন্তু একটা বিষয়ে আমি তোমাকে নিশ্চিন্ত করতে পারি যে বিয়ে করলে তোমার সারা জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যেত।

ঘরের মধ্যে বিবর্ণ মুখে পায়চারি করতে-করতে ডোরিয়েন বললেন: সম্ভবত, তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু ভেবেছিলেম এটাই আমার কর্তব্য। এই ভয়ঙ্কর মৃত্যু যে আমার সেই কর্তব্যের পথে বাধার সৃষ্টি করল তার জন্যে আমার কোনো অপরাধ নেই। আমার মনে রয়েছে তুমি একবার বলেছিলে সমস্ত সৎ পরিকল্পনার মধ্যেই কোথায় যেন ধ্বংসের একটা উপকরণ লুকিয়ে রয়েছে। তুমি আরো বলেছিলে সৎ প্রচেষ্টাগুলিকে কার্যকরী করতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে যায়। আমার পক্ষে সেটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

সৎ সংকল্পগুলি সব সময় বৈজ্ঞানিক নীতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। তাদের উৎসই হচ্ছে নির্ভেজাল দাম্ভিকতা। সেইজন্যে আমদানির ঘরটা তাদের একেবারে শূন্য থাকে। মাঝে-মাঝে তারা অবশ্য কিছু দান করে; সেগুলি হচ্ছে বন্ধ্যা উচ্ছ্বাসের প্রাচুর্য। সেই দেখে দুর্বলরা কখনো কখনো যে মুগ্ধ হয় সেকথা মিথ্যা নয়। এছাড়া সৎ সংকল্পের পহে আর কিছুই বিশেষ বলার নেই। ব্যাঙ্কে টাকা না থাকা সত্ত্বেও চেক কাটলে ব্যাপারটা যে রকম দাঁড়ায় এও অনেকটা সেই জাতীয় ব্যাপার।

লর্ড হেনরির কাছে এসে পাশে বসলেন ডোরিয়েন; তারপরে বললেন, হ্যারি, বলতে পার। দুঃখটাকে যতটা গভীরভাবে আমি অনুভব করতে চাই ততটা অনুভব করতে পারছিনে কেন? আমি যে হৃদয়হীন সেকথা তো আমার মনে হয় না। তোমার কী মনে হয়?

মিষ্টি সুরে এবং বিষণ্ণ হাসি হেসে লর্ড হেনরি বললেন: বিগত পনেরোটি দিন ধরে তুমি এত বোকার মতো কাজ করে যার ফলে ওই বিশ্লেষণটি অর্জন করার যোগ্যতা তোমার হয়নি।

ভ্রূকুটি করে ডোরিয়েন বললেন: হ্যারি, তোমার বিশ্লেষণটা আমার ভালো লাগছে না; কিন্তু আমি নির্মম নই একথাটা যে তুমি স্বীকার করে এতেই আমি খুশি। সত্যিই আমি নির্মম নই। আমি তা জানি। তবু আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে যতটা আঘাত করা উচিত ছিল দুর্ঘটনাটি ততখানি আঘাত আমাকে করেনি। মনে হচ্ছে একটি অপরূপ সুন্দর নাটকের একটি অপরূপ সুন্দর সমাপ্তি ঘটেছে। গ্রীক ট্র্যাজিডির সব কিছু ভয়াল সৌন্দর্যই এখানে রয়েছে; মনে হচ্ছে, সেই নাটকে অনেকটা প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে আমাকে অথচ, একটুকুও আহত হইনি আমি।

যুবকটির অবচেতন মনের দাম্ভিকতা নিয়ে খেলা করতে বেশ মজা লাগল লর্ড হেনরির; তিনি বললেন: সমস্যাটা কৌতূহলোদ্দীপক, সন্দেহ নেই, সত্যিই বড়ো কৌতূহলোদ্দীপক। আমার ধারণা তুমি যে প্রশ্নটি রেখেছ তার যে প্রশ্নটি রেখে তার আসল উত্তর হচ্ছে এই জীবনের সত্যিকারের ট্রাজিডিগুলি প্রায়ই এমন অশিল্পীসুলভ প্রক্রিয়ায় ঘটে যে তাদের নগ্নতায় আমরা আহত হই, আহত হই তাদের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যহীনতায়, তাদের হাস্যকর অর্থহীনতায এবং আঘাত করার অসুন্দর আঙ্গিকে। অশ্লীলতা যেভাবে আমাদের আঘাত করে ঠিক সেইভাবেই আঘাত করে এই ট্রাজিডিগুলি। তাদের সেই আক্রমণে পশুশক্তির গন্ধ পাই বলেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করি। মাঝে-মাঝে অবশ্য অতি সুন্দর ভাবেই আমাদের জীবনে ট্র্যাজিডি দেখা দেয়; এই সৌন্দর্যের অবদানগুলি বাস্তব হলে তারা আমাদের নাটকীয় অনুভূতিগুলিকে স্পর্শ করে। হঠাৎ আমাদের মনে হয় আমরা আর অভিনেতা নয়, দর্শকমাত্র। অথবা, আমরা দুইই। নিজেদের লক্ষ করি আমরা এবং দৃশ্যাবলির চমৎকারিত্ব আমাদের দাসত্বে পরিণত করে, অর্থাৎ একেবারে সম্মোহিত করে ফেলে আমাদের। বর্তমান ক্ষেত্রে আসল ঘটনাটা কী বল তো? তোমার ভালোবাসা হারানোর ভয়ে একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। এরকম একটা অভিজ্ঞতা আমার হলে খুব খুশি হতাম। তাহলে আমার বাকি জীবনটার সঙ্গে আমি নিজেই প্রেমে পড়ে যেতাম। যারা আমাকে ভালোবাসত, আমার সঙ্গে মেলামেশা না করলে যারা অস্থির হয়ে উঠত–যদিও তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয–সামান্য তাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক আমি ছিন্ন করার পরেও, অথবা, আমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক তারা শেষ করে দেওয়ার পরেও অনেকদিন তারা বেঁচে রয়েছে, আত্মহত্যা অথবা আত্মনির্যাতনের কথা তারা কল্পনাও করেনি। তাদের স্বাস্থ্য ফিরেছে–একঘেয়েমি বেড়েছে তাদের। হঠাৎ দেখা হলে তারা সেই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে শুরু করেছে। নারীদের স্মৃতিশক্তি কি ভয়ানক! কি ভয়ঙ্কর! চিন্তার জগতে তারা একেবারে স্থবির। জীবনের সৌন্দর্যে মানুষের ডুবে থাকা উচিত, জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে মেতে থাকা উচিত নয়। খুঁটিনাটি সবসময়েই অশ্লীল।

ডোরিয়েন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন: আমার বাগানে পপি বুনতেই হবে।

লর্ড হেনরি বললেন: কোনো প্রয়োজন নেই। জীবনের হাতে সব সময়েই পপি অর্থাৎ আফিও রয়েছে। মাঝে-মাঝে অবশ্য কিছু স্মৃতি বেশিদিন ধরে বেঁচে থাকে। একটি রোমান্সের মৃত্যু না হওয়ায় শিল্পীসুলভ দুঃখ প্রকাশ করার জন্যে পুরো একটা ঋতু ধরে ভায়লেট ছাড়া অন্য কোনো ফুলই আমি ব্যবহার করিনি। শেষ পর্যন্ত সেই রোমান্সের অবশ্য মৃত্যু হয়নি; মৃত্যু কী করে হল সেকথা আজ আর আমার মনে নেই। আমার ধারণা যেদিন মেয়েটি ঘোষণা করল। যে আমার জন্যে সে পৃথিবীর সব কিছু পরিত্যাগ করতে রাজি সেই দিনই আমাদের রোমান্সের পরিসমাপ্তি ঘটেছে এই সময়টাই মানুষের জীবনে সবচেয়ে সঙ্কটময়; কারণ, অনন্তের ভীতি আমাদের তখন গ্রাস করে ফেলে। এক সপ্তাহ আগে লেডি হ্যাম্পশায়ারের বাড়িতে ডিনারের নিমন্ত্রণ ছিল আমার। ভদ্রমহিলার পাশেই আমি খেতে বসেছিলাম। তুমি কি বিশ্বাস করবে ভদ্রমহিলা আবার সেই পুরনো দিনগুলির কথা তুলে ভবিষ্যতের অসহনীয় দিনগুলির সম্ভাব্য এবং অসম্ভাব্য কাহিনি কপচাতে শুরু করলেন। অ্যাসফোডল ফুলের বিছানায় আমাদের রোমান্স আগেই আমি কবর দিয়ে ফেলেছিলেম তিনি আবার তাকে খুডে বার করে আমাকে সস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে আমি তাঁর জীবন নষ্ট করে দিয়েছি। আমি একথা বলতে বাধ্য যে সেদিন ডিনারে তাঁর কিছু অরুচি আমার চোখে পড়েনি; সোডা কথায় ভুরিভোজনই তিনি সেদিন করেছিলেন। সেই জন্যে তাঁর সেই অভিযোগে আমার মলে কোনো আশঙ্কা জাগেলি। কিন্তু কী কুরুচির পরিচয়ই সেদিন তিনি দিয়েছিলেন বল তো! অতীতের একমাত্র সৌন্দর্য এই যে সে অতীত। কিন্তু কখন যে যবনিকা পড়ে সে-সংবাদ নারীরা রাখে না। তারা সব সময় নাটকে ষষ্ঠ অংকের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে এবং নাটকের অভিনয় যখন শেষ হয়ে যায় তখনো তারা সেটিকে চায় আরো টেনে নিয়ে যেতে। তাদের যদি সে-সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে সব কমেডিই ট্র্যাজিডিতে পরিণত হবে; আর সব ট্র্যাজিডি পরিণত হবে ফার্স-এ। কৃত্রিমতার দিক থেকে তারা সত্যিই বড়ো চমৎকার, ‘আর্টিস্টিক সেনস’ বলতে সত্যিই তাদের কিছু নেই। আমার চেয়ে এদিক থেকে তুমি অনেক। ভাগ্যবান। আমি তোমাকে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ডোরিয়েন, যে সাইবিল ভেন তোমার যে উপকার করেছে সেরকম উপকার আমার কোনো প্রেমিকাই আমার করতে পারেনি। সাধারণ মহিলারা সব সময়েই নিজেদের সান্ত্বনা দেয়। কিছু মহিলা রয়েছে যারা নিজেদের সান্ত্বনা দেয় রেগে হইচই করে। যে মহিলা ফিকে লাল রঙের পোশাক পরে, তাদের বয়স যাই হোক, কোনোদিন তাদের বিশ্বাস করো না, বিশ্বাস করো না সেই সব মহিলাদের যাদের বয়স পঁয়ত্রিশের ওপরে, যারা ফিকে লাল ফিতে দিয়ে চুল বাঁধতে ভালোবাসে। এই জাতীয় মহিলাদের দেখলেই ভেবে নিযো যে তাদের প্রত্যেকে কছু ইতিহাস রয়েছে। আর একদল মহিলা রয়েছে যারা হঠাৎ তাদের স্বামীদের সদগুণগুলি আবিষ্কার করতে পেরেছে বলে নিজেদের সান্ত্বনা দেয়। লোকের নাকের ডগায় তারা তাদের বিবাহিত জীবনের সুখ এবং আড়ম্বরের সঙ্গে প্রকাশ করে যে মনে হবে জিনিসটা চমৎকার একটা পাপ ছাড়া আর কিছু নয়। কেউ-কেউ আবার ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে পায়। একটি মহিলা একবার আমাকে বলেছিলেন যে রঙিন বাক-চাতুর্যের মধ্যেই নারীদের সান্ত্বনা পাওয়ার রহস্যটি লুকিয়ে রয়েছে এবং কথাটা যে সত্যি তা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। তা ছাড়া নিজেকে পাপী বলে চিহ্নিত করার মধ্যে মানুষের দম্ভ ছাড়া আর কিছু প্রকাশ পায় না। বিবেক বলে বস্তুটা আমাদের সবাইকেই আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। হ্যাঁ, আধুনিক ভাতে সান্ত্বনার উপায় খুঁজে পাওয়ার সত্যিই কোনো শেষ নেই মহিলাদের। সত্যি কথা বলতে কি এখনো আমি সবচেয়ে দামি কথাটাই বলিনি।

ডোরিয়েন কিছুটা অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞাসা করলেন: সেটা কী হ্যারি?

ওই সান্ত্বনার সম্বন্ধেই বলছি। নিজের প্রেমিককে হারিয়ে ওরা সব সময় অপরের প্রেমিককে ছিনিয়ে নেয়। সভ্য সমাজ ছিনতাইকারিণীদের চরিত্র চকচকে করে তোলে ব্যাপারটা। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ডোরিয়েন, আমাদের পরিচিত মহিলাদের কাছ থেকে সাইবিল ভেনের পার্থক্য কত। তার মৃত্যুর মধ্যে এমন একটা জিনিস বুয়েছে যা আমার চোখে বড়ো। সুন্দর লাগছে। এই শতাব্দীতে যে এমন সুন্দর এবং আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে পারে তা ডেনে আমি আনন্দিত হয়েছি। রোমান্স, কামনা আর ভালোবাসা যা নিয়ে আমরা খেলা করি সেগুলি যে কতখানি বাস্তবএই থেকে তা প্রমাণিত হয়।

তুমি ভুলে যাচ্ছ, তার সঙ্গে আমি খুব নির্মম ব্যবহার করেছি।

কিছু মনে করো না, আমি বলতে বাধ্য যে পুরুষের কাছ থেকে নির্মম ব্যবহার নারীরা বেশ উপভোগ করে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রবৃত্তিগুলি তাদের মধ্যে অদ্ভুতভাবে অতো রয়েছে। দাসত্ব থেকে আমরা তাদের মুক্তি দিয়েছি বটে, কিন্তু চরিত্রের দিক থেকে দাসত্বটাই তারা পছন্দ করে বেশি; তাইতো তারা সব সময় মনিব খুঁজে বেড়ায়। অপরের কর্তৃত্বে থাকতে তারা ভালোবাসো তোমার ব্যবহার যে চমৎকার সেদিক থেকে আমার কোনো সন্দেহ নেই। সত্যিকার রাগতে তোমাকে আমি কোনোদিনই দেখিনি। কিন্তু তোমার ব্যবহারটা যে কত আমেডিছ তা আমি লক্ষ করেছি। তাছাড়া গতকালের আগের দিন তুমি আমাকে একটা কথা বলেছিলো তখন আমি বিশেষ গুরুত্ব দিইনি কথাটার ওপরে। কিন্তু এখন দেখছি তুমি যা বলেছিলে তা সত্যি; আর সেইটাই হচ্ছে তোমার সব।

কী কথা, হ্যারি?

তুমি বলেছিলে বিশ্বের সমস্ত রোমান্টিক নায়িকাকে একসঙ্গে করলে যা দাঁড়ায় তোমার কাছে সাইবিল তাই। এক রাত্রিতে সে দেসদিমনা, আর এক রাত্রিতে সে ওফিলিয়া; যদি জুলিয়েট হয়ে সে মারা যায়, ইমোজেন হয়ে সে বেঁচে ওঠে। দুটি হাতের মধ্যে মুখটা ঢেকে ডোরিয়েন বললেন: এখন আর সে বেঁচে উঠবে না।

না; আর কোনোদিনই সে বেঁচে উঠবে না। সে শেষবারের মতো তার ভূমিকা অভিনয়। করেছে। কিন্তু সেই নোংরা আডঘরে তার নিঃসঙ্গ মৃত্যুকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে হবে। তোমাকে ভাবতে হবে ভ্যাকবিয়ান কোনো ট্রাজিডির বিবর্ণ কোনো দৃশ্যের অভিনয় দেখছ। তুমি, ওয়েবস্টার, ফোর্ড অথবা সিরিল টুরনারের কোনো নাটকের কোনো একটি অপরূপ দৃশ্য তুমি অভিনীত হতে দেখছ। তাছাড়া, কোনোদিনই মেয়েটি বেঁচে থাকেনি; সুতরাং তার মারা যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তোমার কাছে অন্তত সে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিল না; তোমার কাছ তাকে অশরীরী বলে মনে হত–যে শেকসপীয়রের নাটকের মধ্যে দিয়ে নিঃশব্দে পদসঞ্চারে ঘুরে বেড়াত-যার উপস্থিতিতে নাটকগুলি সুন্দর হয়ে উঠত, তোমার কাছে সে ছিল একটি শর গাছের মতো, যার ভেতর দিয়ে শেকসপীয়রের সঙ্গীত হয়ে উঠত মধুক্ষরা এবং আনন্দময়। যে মুহূর্তে সে বাস্তবের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল সেই মুহূর্তেই সে। সেই জীবনটাকে করে তুলল বিকৃত আর সেই জন্যেই সে মারা গেল। ইচ্ছে হলে ওফিলিয়ার জন্যে তুমি শোক করতে পার। কর্ডিলিকে কণ্ঠরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল বলে মাথার ওপরে ছাই ঢেলে তুমি শোকদিবস পালন করতে পার; ব্রাবনসিয়োর কন্যা মারা গিয়েছিল। বলে তুমি ভগবানের বিরুদ্ধে চিৎকার করে অভিযোগ জানাতে পার; কিন্তু সাইবিল ভেনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তোমার চোখের জল বৃথা নষ্ট করো না। তাদের চেয়ে সে অনেক বেশি অবাস্তব।

কিছুক্ষণের জন্যে নিস্তব্ধতা নেমে এল। ঘরের মধ্যে নেমে এল সন্ধ্যার অন্ধকার। নিঃশব্দে আর খালি পায়ে বাগান থেকে এগিয়ে এল ছায়ারা। দৃশ্যমান জিনিসগুলি ধীরে ধীরে তাদের জেল্লা হারিয়ে ফেলল।

কিছুক্ষণ পরে ডোরিয়েন গ্রে মুখ তুললেন, তারপরে কিছুটা সান্ত্বনা পেয়েছেন এই ধরনের একটি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যারি, যে কথাটা নিজেকে আমি নিজে বলতে চেয়েছিলেম সেটা তুমিই আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো তুমি যা বললে সেই সব কথা আগেই আমি ভেবেছিলেম কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক নিজের কাছে প্রকাশ করার সাহস আমার হয়নি। আমার চরিত্রটা কী সুন্দরই না তুমি বুঝতে পেরেছ। কিন্তু যা ঘটে গিয়েছে তা নিয়ে তুমি আর আলোচনা করো না কখনো। এ থেকে একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা হল আমার। এই-ই যথেষ্ট। আমি জানি নে আমার জন্যে এই রকম চমৎকার আরো কোনো অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে কি না।

ডোরিয়েন, তোমার জন্যে জীবন অনেক কিছু নিয়েই অপেক্ষা করছে। তোমার এই অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে করতে পারবে না পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই।

কিন্তু ধর হ্যারি, আমি যদি কুৎসিত, বৃদ্ধ হয়ে যাই, আমার দেহের ওপরে যদি বার্ধক্যের ছাপ পড়ে? তখন কী হবে?

বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আ, তখন! প্রিয় ডোরিয়েন, তখন লড়াই করে পাওনাগণ্ডা ছিনিয়ে নিতে হবে তোমাকে। বর্তমানে, তারাই তোমার কাছে এগিয়ে। আসবে। না না। এই সুন্দর চেহারাটি বজায় রাখতে হবে তোমাকে। আমরা এমন একটা যুগে বাস করি যখন মানুষ বিজ্ঞ হওয়ার জন্যে অতিরিক্ত পড়াশুনা করে, সুন্দর হওয়ার জন্যে চিন্তা করে বেশি। আমরা তোমাকে ছেড়ে দিতে পারিনে। এখন ভালো পোশাক পরে ক্লাবে যাই চল। এমনিতেই আমাদের দেরি হয়ে গিয়েছে।

হ্যারি, তোমার সঙ্গে বরং আমি অপেরাতেই দেখা করব। বড়ো ক্লান্ত আমি, খাবার বিশেষ ইচ্ছে নেই আমার। তোমার বোনের ‘বকস’ নম্বরটা কত?

সম্ভবত সাতাশা গ্রালড টায়ার-এর ওপরে তার বকস। দরজার ওপর তার নাম লেখা থাকবে। কিন্তু আমার সঙ্গে বেরোতে আর ডিনার খেতে পারছ না বলে সত্যিই আমি দুঃখিত।

ডোরিয়েন ক্লান্তভাবে বললেন, ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তুমি আমাকে যা বললে তার জন্যে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। নিঃসন্দেহে তুমি আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু তোমার মতো আজ পর্যন্ত আর কেউ আমাকে বুঝতে পারেনি।

তাঁর সঙ্গে করমর্দন করে লর্ড হেনরি বললেন: ডোরিয়েন, আমাদের বন্ধুত্ব সবে শুরু হয়েছে। বিদায়। আশা করি, রাত্রি সাড়ে নটার আগেই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। মনে রেখ, প্যাটি আজ গান করছেন।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন লর্ড হেনরি। দরজাটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ডোরিয়েন বেল টিপলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভিকটর একটা বাতি নিয়ে ঘরে ঢুকল, তারপরে ঘরের। পর্দাগুলি সব নামিয়ে দিল। ভিকটরের চলে যাওয়ার জন্যে অস্থিরভাবে তিনি অপো করতে লাগলেন। সব কাজেই লোকটা কেমন যেন মাঠো।

লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি পর্দার দিকে দৌড়ে গেলেন; তারপরে একপাশে টেনে দিলেন সেটি। না, ছবির ওপরে আর কোনো পরিবর্তনের চাপ পড়েনি। তাঁর আগেই সাইবিল ভেনের মৃত্যসংবাদ ও জানতে পেরেছে। জীবনের ঘটনাগুলি কী ভাবে ঘটছে সে বিষয়ে ও সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। ঠিক যে-সময়ে সাইবিল বিষ অথবা ওই জাতীয় কিছু খেয়েছিল ঠিক সেই সময়ের নিষ্ঠুরতার সেই বিশেষ ছাপটি ওর মুখের ওপরে পড়েছিল। অথবা ফলাফলের বিষয়ে ও সম্পূর্ণ উদাসীন? আত্মার ভিতরে যা ঘটে ও কি কেবল সেইটুকুই গ্রাহ্য করে? তিনি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন হয়তো একদিন তিনি চোখের ওপরেই ওর ওপরে পরিবর্তন দেখতে পাবেন; সেই সম্ভাবনায় তিনি ভয়ে পিছিয়ে এলেন।

হতভাগিনী সাইবিল! তাঁদের দুজনের মধ্যে কী অদ্ভুত রোমান্সই না গড়ে উঠেছিল! স্টেডের ওপরে প্রায়ই সে মৃতের অনুকরণ করত। তারপরে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই তাকে ছুঁয়ে গেল, সঙ্গে করে নিয়ে গেল তাকে। তার জীবননাট্যের সেই ভয়ঙ্কর শেষ দৃশ্যটি সে কী ভাবে অভিনয় করল? মৃত্যুর সময় সে কি তাঁকে অভিশাপ দিয়েছে? না; তাঁর প্রতি ভালোবাসা নিয়েই সে মৃত্যুবরণ করেছে এবং এখন থেকে ভালোবাসা তাঁর কাছে পবিত্র জিনিস ছাড়া আর কিছু নয়। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে সে সব কিছুর জন্যে প্রাঘশ্চিত্ত করে গিয়েছে। থিয়েটারে সেই বীভৎস রাত্রিটিতে তার জন্যে তিনি কত কষ্ট পেয়েছেন সে-সব কথা আর তিনি মনে রাখবেন না। তার কথা যখন তিনি চিন্তা করবেন তখন মনে হবে একটি নির্ভেজাল প্রেমের প্রতীক করে ভগবান তাকে সংসার রঙ্গমঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেই প্রতীকটি সম্পূর্ণভাবে ট্রাডিক। মেয়েটির শিশুর মতো সরল চাহলি, তার চিত্তাকর্ষক রোমান্টিক চালচলন আর ভীরু লাবণ্যের কথা মনে হতেই তাঁর চোখ দুটি ভলে ভরে উঠল। সেই জল তাড়াতাড়ি মুছে ফেলে তিনি ছবির দিকে আবার তাকিয়ে দেখলেন।

তাঁর মনে হল এখন থেকে তাঁর চলার পথটা তাঁকেই ঠিক করে ফেলতে হবে। অথবা তা কি আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছে? হ্যাঁ, ভীবনই তা ঠিক করে দিয়েছে জীবন, আর জীবন সম্বন্ধে তাঁর অনন্ত কৌতূহল। অনন্ত যৌবন, অনন্ত কামনা, ইঙ্গিতময় এবং গোপন আনন্দ, উদ্যম, উদামতর পাপ–এই সব কটির সঙ্গে মোলাকাৎ করতে হবে তাঁকে। তাঁর লজ্জা আর। অপমানের সমস্ত জ্বালা আর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ছবিটিকে। এ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেননি তিনি।

ক্যানভাসের ওপরে আঁকা ছবিটির সুন্দর মুখের ওপরে ভবিষ্যতে যে কলঙ্করেখাগুলি পড়ে সেটিকে হতবিষ্কত করে তুলবে একথা ভাবতে গিয়েই তিনি আতঙ্কিত হলেন। একবার নার্সিসাসকে ব্যঙ্গ করার শিশু-চাপল্যে যে ঠোঁট দুটি তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছিল সেই ঠোঁট দুটিকে তিনি চুম্বন করলেন, অথবা চুম্বন করার ভান করলেন। অনেকদিন প্রভাতে এই ছবিটির দিকে তাকিয়ে তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থাকতেন। এখন থেকে তাঁর প্রতিটি কাজের প্রতীক চিহ্ন হিসাবে কি ছবিটির পরিবর্তন হবে? এই ছবিটা কি শেষ পর্যন্ত দানবীর আর সেই সঙ্গে ঘৃণ্য হয়ে দাঁড়াবে? শেষ পর্যন্ত কি ছবিটিকে সূর্যকিরণ থেকে সরিয়ে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রাখতে হবে? হায়রে, কী দুর্ভাগ্য, কী দুর্ভাগ্য।

ছবি আর তাঁর মধ্যে যে ভয়ানক একটি আত্মিক সংযোগ দেখা দিয়েছে সেটি ছিঁড়ে ফেলার জন্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করার কথা একবার তিনি চিন্তা করলেন। প্রার্থনা করার ফলে ছবিটির ওপরে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। সম্ভবত সেই প্রার্থনার ফলেই ছবিটি আর ভোল পালটাবে না। কিন্তু তবু যতই আজগুবি হোক, অথবা যত ভয়ানক পরিণতিই আসুক, জীবন। সম্বন্ধে এতটুকু জ্ঞান আছে এমন মানুষ কে রয়েছে যে চির যৌবন ভোগ করার সুযোগ ছাড়তে পারে? তা ছাড়া, ছবির প্রতিটি নিয়ন্ত্রিত করার সত্যিই কি কোনো ক্ষমতা রয়েছে তাঁর? প্রার্থনা করার জন্যেই কি ছবিটি তার প্রথম পরিবর্তনকে বর্জন করেছে? এর পেছনে কি অদ্ভুত কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ নেই? জীবজগতের ওপরে চিন্তার যদি কোনো প্রভাব থাকে, তাহলে মৃত আর জডের ওপরেও কি তা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না? অর্থাৎ, গভীরভাবে চিন্তা। অথবা কামনা করলে বাইরের কোনো বস্তু কি আমাদের মনের গভীরে নিহিত বাসনা-কামনার অজস্র সম্পন্দনের মধ্যে তার অণু-পরমাণুগুলিকে সমান তালে নাচাতে পারে না? কিন্তু কারণটা নিয়ে চুলচেরা বিচার করার প্রয়োজন নেই তাঁর। আর কখনো ভয়ঙ্কর কোনো শক্তির কাছে তিনি প্রার্থনা জানাবেন না, প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করবেন না। প্রতিকৃতিটা যদি তার মর্জিমতো রঙ বদলায় তো বদলাক। তাঁর কিছু করার নেই। অত খুঁটিয়ে দেখে লাভ কী?

কারণ এটিকে লক্ষ করার মধ্যেই তো আসল আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে। একেই অনুসরণ করে তিনি তাঁর মনের গভীরে লুকানো অনেক কিছুই জানতে পারবেন। ঐন্দ্রজালিক আরশীর মতো ছবিটি তাঁকে সাহায্য করবে। এটি যেমন তাঁর দেহটাকে ফুটিয়ে তুলেছে, তেমনি প্রকাশ করে দেবে তাঁর আত্মাটিকে। এবং যখন ওর ওপরে শৈত্যের জড়তা এসে দেখা দেবে তখনো তাঁর দেহের ওপরে বসন্তের হিল্লোল থাকবে জেগে। যখন ওর মুখের ওপর থেকে রক্ত শুকিয়ে যাবে, যখন ওর চোখ দুটি তাদের জ্যোতি হারিয়ে কোটরের মধ্যে আশ্রয় নেবে তখনো তিনি ভরা যৌবনের জোয়ারে ভেসে বেড়াবেন। তাঁর সৌন্দর্যের একটি কণাও নষ্ট হবে না; তাঁর ধমনীর একটি সম্পন্দনও গতিহীন হবে না; গ্রীক দেবতাদের মতো তিনি শক্তিবান হয়ে থাকবেন, গতি আর আনন্দের আমেজে থাকবেন মেতো ক্যানভাসের ওপরে আঁকা ওই রঙিন প্রতিকৃতিটার কী হবে তাতে তাঁর কী আসে যায়? তিনি তো নিরাপদে থাকবেন। এ-ছাড়া, আর কিছু ভাববার নেই তার।

হাসতে-হাসতে ভারী পর্দাটা আবার তিনি প্রতিকৃতির মুখের ওপরে টেনে নিলেন; তারপরে, শোওয়ার ঘরে ঢুকলেন। সেইখানে তাঁর পরিচারক ভিকটর তাঁরই জন্যে অপেষ্কা করছিল। এক ঘন্টা পরে তিনি অপেরাতে হাজির হলেন; লর্ড হেনরি তাঁর চেয়ারের ওপরে ঝুঁকে বসেছিলেন।

.

নবম পরিচ্ছেদ

পরের দিন সকালে-সকালে তিনি বসে-বসে প্রভাতকালীন ডালযোগ করছিলেন এমন সময় বেসিল হলওয়ার্ড ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন। ঢুকেই গম্ভীরভাবে বললেন: তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব খুশি হয়েছি, ডোরিয়েন। কাল রাত্রিতে এসে শুনলাম তুমি অপেরাতে গিয়ে। অবশ্য আমি জানতাম কথাটা সত্যি নয় তবু তুমি ঠিক কোথায় গিয়েছ সে-সম্বন্ধে যদি সপষ্ট ভাবে। বলে যেতে তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হতাম। আর একটা বিপদ ঘটতে পারে এই আশঙ্কায় কাল সন্ধেটা আমার খুব খারাপ গিয়েছিল। সংবাদটা প্রথম পাওয়ার পরে আমাকে তোমার টেলিগ্রাফ করা উচিত ছিল। ক্লাবে ‘গ্লোব’ কাগজের শেষ সংস্করণটার ওপরে চোখ বুলোতে-বুলোতে হঠাৎ সংবাদটা আমার নজরে পড়ে গেল। সংবাদটা পড়েই আমি এখানে। ছুটে এসেছিলেম। তোমাকে না পেয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। সমস্ত ঘটনাটা পড়ে আমি যে কত কষ্ট পেযেছিলেম তা আর তোমাকে কী বলব? আমি জানি নিশ্চয় তোমার কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু তুমি কোথায় গিয়েছিলে? তুমি কি মেয়েটির মায়ের সঙ্গে দেখা করতে তাদের। বাড়ি গিয়েছিলে? একবার ভাবলাম সেই দিকে আমিও এগিয়ে যাই। কাগজেই তাদের বাড়ির ঠিকানাটা দেওয়া ছিল। এসটোন রোডের কাছাকাছি একটা জায়গা, তাই না? কিন্তু যে দুঃখকে আমি এতটুকু কমাতে পারব না সেখানে অনাবশ্যক যেতে আমার কেমন সঙ্কোচ লাগছিল। হতভাগিনী নারী! নিশ্চয় তাঁর মনের অবস্থা খুব খারাপ। ওই তাঁর একমাত্র সন্তান। এ বিষয়ে তিনি কী বললেন?

ভেনিশিয়াল গ্লাস থেকে ফিকে বেগলে রঙের মদ চাকতে-চাকতে ডোরিয়েন আস্তে আস্তে বললেন: প্রিয় বেসিল, তা জানব কেমন করে?

তারপর অত্যন্ত ক্লান্ত স্বরে বললেন: আমি অপেরাতেই গিয়েছিলেম। তোমারও সেখানে যাওয়া। উচিত ছিল। কালই প্রথম হেনরির বোন লেডি গিনদোলেন-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হল, আমরা দুজনে একটা বকস-এ বসেছিলেম। ভদ্রমহিলা সত্যিকার সুন্দরী। প্যাটিও অদ্ভুত সুন্দর গান গাইলেন। ভয়ানক ঘটনা নিয়ে আর আলোচনা করো না। কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা না করলেই সেটা যে সত্যিই ঘটেছে তা আমাদের মনে হবে না। হ্যারি বলে, আলোচনা করলেই যে-কোনো জিনিসই বাস্তব হয়ে দাঁড়ায়। আমি কেবল তোমাকে এইটুকুই জানাতে পারি যে ভদ্রমহিলার ওই একমাত্র সন্তান নয়। একটি ছেলেও রয়েছে। সেটি-ও বড়ো চমৎকার ছেলে কিন্তু সে অভিনয় করে না। পেশার দিক থেকে সে নাবিক বা ওই জাতীয় কিছু একটা হবে। এখন তোমার কথা, আর বর্তমানে তুমি কী আকছ তাই আমাকে বল।

ধীরে-ধীরে এবং বেদনার্ত স্বরে হলওয়ার্ড বললেন: অপেরাতে গিয়েছিলে? একটা নোংরা ঘরে সাইবিল ভেনের মৃতদহটা যখন পড়েছিল তখন তুমি বসেছিলে অপেরাতে! যে মেয়েটিকে তুমি ভালোবাসতে সেই মেয়েটিকে নির্বিঘ্নে কবরস্থ করার আগেই অন্য মহিলারা যে কত। সুন্দরী, প্যাটি যে কেমন স্বর্গীয় গান গাইলেন সেই সব কথা আমাকে তুমি বলতে পারলে? তুমি কি জান না, সাইবিলের শ্বেতশুভ্র সেই শরীরটা নিয়ে এখনো অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে?

চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলেন ডোরিয়েন: বেসিল, চুপ কর, চুপ কর! ওসব কথা শুনতে চাই লে। আমাকে ওসব কথা তুমি বলো না। যা হয়েছে তা হয়ে গিয়েছে। যা অতীত তা অতীতেই মিলিয়ে যাক।

গতকাল যা ঘটেছে তাকে তুমি অতীতে বলতে চাও?

ঘন্টা-মিনিট ধরে সময়ের প্রকৃতি ঠিক করা যায় না; যারা মূর্খ, মনের নদীতে যাদের চড়া পড়ে গিয়েছে, বিশেষ কোনো অনুভূতিকে ভুলে যেতে তাদেরই অনেক বছর সময় লাগে। নিজের প্রবৃত্তিগুলিকে যে আয়ত্তে রাখতে পেরেছে সে যেমন অতি সহজে নতুন আনন্দের আয়োজন। করতে পারে তেমনি সহজে ভুলে যেতে পারে দুঃখ প্রবৃত্তির দাস হতে আমি রাজি নই। আমি চাই তাদের খাটাতে, আনন্দ পেতে এবং তাদের ওপরে প্রভুত্ব করতো।

ডোরিয়েন, তুমি যে কথা বলছ সেগুলি নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। এমন কিছু ঘটেছে যা তোমার চরিত্রকে একেবারে পালটিয়ে দিয়েছে। যে অদ্ভুত সুন্দর ছেলেটি দিনের পর দিন আমার স্টুডিযোতে এসে বসে থাকত, এখনো বাইরে থেকে সেইরকমই সুন্দর তুমি দেখতে। কিন্তু তখন তুমি ছিলে সাদামাঠা, স্বাভাবিক এবং স্নেহশীল। সারা দুনিয়ায় তোমার মতো নিষ্পাপ মানুষ আমার চোখে আর পড়েনি। কিন্তু এ কী কথা শুনছি! জানি না, কী হল তোমার। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে হৃদ্য বলতে কোনো পদার্থ তোমার নেই। নেই কোনো দয়া, মায়া, অনুভূতি। বেশ বুঝতে পারছি, হ্যারির প্রভাব তোমার ওপরে পড়েছে।

লাল হয়ে উঠল ডোরিয়েনের মুখ, তিনি জানালার ধারে গিয়ে সূর্যকরোজ্জ্বল বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ; তারপরে বললেন: বেসল, হ্যারির কাছে আমি অনেক ঋণী; তোমার চেয়েও বেশি। তুমি আমাকে কেবল অনাবশ্যকভাবে দাম্ভিক হতে শিখিয়েছিলে।

সেই জন্যে আমি শাস্তি পেয়েছি, ডোরিয়েন-অথবা ভবিষ্যতে পাব।

ঘুরে দাঁড়িয়ে ডোরিয়েন বললেন: তোমার কথাটা আমার মাথায় ঢুকছে না বেসিলা তুমি কী চাও তাও আমি বুঝতে পারছি না। কী চাও বল তো?

দুঃখের সঙ্গে আর্টিস্ট বললেন, আমি চাই সেই ডোরিয়েন গ্রে-কে যার ছবি আমি এঁকেছি।

তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে এবং একটি হাত তাঁর কাঁধের ওপরে রেখে ডোরিয়েন বললেন: বড়ো দেরি হয়ে গিয়েছে বেসিল। গতকাল যখন আমি শুনলাম সাইবিল আত্মহত্যা করেছে…

তাঁর দিকে তাকিয়ে বিহ্বল নেত্রে হলওওযার্ড বললেন; আত্মহত্যা! হায় ভগবান! এ বিষয়ে আমারও কোনো সন্দেহ নেই।

প্রিয় বেসিল, এটা যে একটা নিছক দুর্ঘটনা তা নিশ্চয় তুমি মনে করনি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আত্মহত্যাই সে করেছে।

বয়স্ক মানুষটি নিজের হাতের মধ্যে মুখটা ঢেকে বললেন: ওঃ, কী ভয়ানক!

দেহটা তাঁর কাঁপতে লাগল।

ডোরিয়েন গ্রে বললেন: না, না। ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই এতো এ-যুগের এটাই হচ্ছে একটি বড়ো রোমান্টিক ট্রাজিডি। যারা অভিনয় করে তারা সাধারণত সাধারণ ভাবেই বেঁচে থাকে। তাদের স্বামী থাকে, থাকে বিশ্বাসী স্ত্রী; জীবনটা তাদের একঘেয়ে, গতানুগতিকের বেড়া দিয়ে ঘেরা। আমি কী বলতে চাই তা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছ? আমি বলতে চাই শ্রেণি আর । সাংস্কৃতির দিক থেকে তারা সবাই মধ্যবিত্ত ধর্ম, আচার-ব্যবহার–সব দিক থেকেই তাদের সঙ্গে সাইবিলের পার্থক্য কত। তার জীবনটাই হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর, মধুর একটি ট্র্যাজিডি সব সময়েই সে নায়িকা। গত রাত্রিতে, অর্থাৎ তোমরা তাকে যেদিন দেখেছিলে–সে খুব। খারাপ অভিনয় করেছিল, কারণ সত্যিকার ভালোবাসা বলতে কী বোঝায় তা সে বুঝতে পেরেছিল। যখন সে বুঝতে পারল এটা কতখানি অবাস্তব তখনই সে মারা গেল। ঠিক এই ভাবেই জুলিয়েট মারা গিয়েছিল। সত্যিকার আর্টের জগতে প্রবেশ করল সে তার মত্যুর মধ্যে আমি কী দেখতে পাচ্ছি? দেখতে পাচ্ছি শহিদ হওয়ার কবুণ ব্যর্থতা, বিনষ্ট সৌন্দর্যের ব্যর্থতা। কিন্তু যা তোমাকে বলছিলাম, ভেব না যে আমি কম দুঃখ ভোগ করেছি। গতকাল যদি বিশেষ একটি মুহূর্তে তুমি এখানে আসতে–ধর সাড়ে পাঁচটা অথবা পৌনে ছটার। কাছাকাছি-তাহলে আমার চোখ ভরা জল তুমি দেখতে পেতে। হ্যারি-ই এই সংবাদটা নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। খবরটা পেয়ে আমার মনের কী অবস্থা হয়েছিল এমন কি সেও তা। বুঝতে পারেনি। দুঃখ আর অনুশোচনায় সাময়িকভাবে ভেঙে পড়েছিলেম আমি। তারপরে সেই অবস্থাটা আমার কেটে গেল। সেই অনুভূতিকে আর আমি ফিরিয়ে আনতে পারব না; একমাত্র ভাবপ্রবণ মূর্খ ছাড়া কেউ তা পারে না। সেদিক থেকে, বেসিল, আমার ওপরে সত্যিই তুমি অবিচার করা আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে তুমি এখানে এসে খুব ভালো কথা। তুমি দেখলে আগেই আমি শান্ত হয়ে গিয়েছি। দেখেই তুমি ক্ষেপে উঠলো এই কি তোমার সহানুভূতির নমুনা? হ্যারি আমাকে একটা গল্প বলেছিল। তুমি আমাকে সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলে। গল্পটা হচ্ছে, একজন পরোপকারী ব্যক্তির একটি অন্যায়ের প্রতিকার করার। অ কোনো একটি আইনের ধারা পালটানোর জন্যে, ব্যাপারটা আমার ঠিক মনে নেই, তাঁর জীবনের কুড়িটি বছর তিনি নষ্ট করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর চেষ্টা সফল হয়েছিল; তার। পরেই কিন্তু তিনি নিরাশ হয়ে পড়লেন; আর কিছু করার ছিল না তাঁর; মনের এই বেকারত্ব সহ্য করতে পারলেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত অপরের ক্ষতি করার উৎসাহে মেতে উঠলেন। তা ছাড়া প্রিয় বেসিল, তুমি যদি সত্যিই আমাকে সান্ত্বনা দিতে চাও তাহলে কেমন করে ওই তিক্ত ঘটনাটিকে আমি ভুলে যেতে পারি সেই পথটাই তুমি আমাকে বাতলিয়ে দাও; অথবা, কেমন করে সমস্ত জিনিসটাকে আমি আর্টিস্টের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে পারি সেই উপদেশই আমাকে দাও। সেদিন মারলো হোটেলে একটি যুবকের সঙ্গে তুমি আলাপ করিয়ে দিয়েছিলে তিনি সেদিন কথায়-কথায় বলেছিলেন জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট পীতাভ মাটিন ভুলিয়ে দিতে। পারে। আমি অবশ্য সে-মতে বিশ্বাসী নই। আমি সুন্দর জিনিস ভালোবাসি; সুন্দর আর। বাস্তব–যেগুলিকে আমি স্পর্শ করতে পারি। পুরনো ব্রোকেড, সবুজ ব্রোঞ্জের জিনিস, ল্যাকারের কাজ, খোদাই করা হাতির দাঁত, সুন্দর পারিপার্শ্ব, প্রাচুর্য, উচ্ছ্বাস, আর আনন্দ–এদের সকলের কাছ থেকেই কিছু না কিছু পাওয়ার রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে যে আর্টিস্টিক মানসিকতা রয়েছে, অথবা, যে আটিস্টিক রুচি তারা প্রকাশ করে, আমার বেশি আকর্ষণ সেই দিকে হ্যারির মতে নিজের জীবনটাকে মানুষ যদি দর্শকের ভূমিকা থেকে দেখতে পারে তাহলেই সে নিজের জীবনের দুঃখ ভুলে যায়।

কেমন করে আমি হঠাৎ বড়ো হয়ে উঠলাম তা তুমি জান না। তুমি যখন আমায় চিনতে তখন আমি ছিলাম স্কুলের ছাত্রএখন আমি পূর্ণাঙ্গ মানুষ। কিন্তু তার জন্যে আমাকে তুমি কম পছন্দ করতে পারবে না। আমি এখন অন্য জাতের আমার ভাবনা নতুন, চিন্তা নতুন, আদর্শ নতুন। এক কথায় খোলনলচে আমার পালটিযে গিয়েছে। পরিবর্তন আমার যে হয়েছে সেটা ঠিকই কিন্তু তুমি সব সময়েই আমার বন্ধু থাকবে-ঠিক আগের মতনই। অবশ্য। হ্যারিকে আমার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু বন্ধু হিসাবে হ্যারির চেয়ে তুমি অনেক উঁচু স্তরের শক্তির দিক থেকে তার মতো সবল তুমি নও, জীবনটাকে বেশি ভয় কর তুমি কিন্তু তুমি। তার চেয়েও উঁচু মনের। আমরা দুজনে কী সুখেই না ছিলাম। বেসিল, আমাকে তুমি পরিত্যাগ করো না; আমার সঙ্গে ঝগড়া করো না তুমি এখন আমাকে যা তুমি দেখছ, আমি তাই। এছাড়া আর কিছু আমার বলার নেই।

চিত্রকরকে অদ্ভুতভাবে বিচলিত হতে দেখা গেল। ছেলেটিকে তিনি বড়ো ভালোবাসতেন এবং তাঁর চিত্রকরের জীবনে ওই ছেলেটিই বিরাট একটি সাফল্য এনে দিয়েছে। তাকে বেশি। তিরস্কার করতে কেমন যেন কষ্ট হল তাঁর। তাছাড়া, জীবনের ওপরে তার যে বিরাট নৈরাশ্য দেখা দিয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে সাময়িক কিছুণের ভেতরেই তার এই মনোভাব নষ্ট হয়ে যাবে। তার মধ্যে অনেক ভালো জিনিস রয়েছে, এমন অনেক কিছু রয়েছে যাদের মহতের পর্যায়ে ফেলা যায়।

শেষ পর্যন্ত একটা বিষণ্ণ হাসি হেসে তিনি বললেন: ঠিক আছে, ডোরিয়েন, আজকের পর এই ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে আর কোনোদিনই আমি তোমার সঙ্গে আলোচনা করব না। আশা করি, এর মধ্যে তোমাকে কেউ ভজড়াবে না। আজ বিকেলেই হত্যার তদন্ত শুরু হবে তারা কি তোমাকে সাল্কী দেওয়ার জন্য ডেকেছে?

মাথা নাড়লেন ডোরিয়েন; তদন্ত কথাটা শুনে তাঁর মুখের ওপরে বিরক্তির রেখা ফুটে বেরোল; সেই রেখার মধ্যে ফুটে উঠল একটা রুক্ষ ভাব, একটা অশ্লীল অনুভাব। তিনি শুধু বললেন: তারা আমার নাম জানে না।

কিন্তু মেয়েটি নিশ্চয় জানত?

শুধু আমার খৃস্টান নামটাই সে জানত। আমি নিশ্চিত যে এ কথাটাও সে কাউকে বলেনি। সে। একবার আমাকে বলেছিল আমার আসল পরিচয় জানার জন্যে ওখানে অনেকেই বিশেষ কৌতূহলী ছিল। সে তাদের সবাইকেই বলেছিল আমার নাম “প্রিন্স চার্মিং”, ভালোই করেছিল। বেসিল, সাইবিলের একটা ছবি এঁকে দিও আমাকে। কয়েকটি চুম্বন, করুণ কয়েকটি ভাঙা-ভাঙা কথার স্মৃতি ছাড়া তার আরো কিছু আমি সঞ্চযের ঘরে জমা করে রাখতে চাই।

তুমি চাইলে কিছু করার চেষ্টা করব, ডোরিয়েন। কিন্তু তুমি এসে আবার আমার কাছে বস তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না।

হঠাৎ চমকে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে ডোরিয়েন চিৎকার করে বললেন: না; আর আমি তোমার মডেল হতে পারব না–না, না; অসম্ভব।

চিত্রকর তাঁর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন; কী পাগলের মতো কথা বলছ! তুমি কি বলতে চাও তোমার জন্যে আমি যা করেছি তা তোমার ভালো লাগেনি? দেখতে পাচ্ছি, ছবিটার সামনে তুমি একটা পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছা দেখতে দাও আমাকে আজ পর্যন্ত আমি যা এঁকেছি এটি তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ডোরিয়েল, পর্দাটাকে সরিয়ে দাও। আমার ছবিকে এইভাবে ঢেকে রাখাটা তোমার চাকরদের খুব অন্যায় হয়েছে। ভেতরে ঢোকার সময় তোমার ঘরের চেহারাটাও যেন কেমন-কেমন লাগছে।

ওর সঙ্গে আমার চাকর-বাকরদের কোনো সম্পর্ক নেই, বেসিলা ভেব না, আমার ঘর কী ভাবে সাজানো হবে সে বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমি কোনো পরামর্শ করি না। এক কিছু ফুল সাজিয়ে রাখা ছাড়া আর কিছুতে হাত দেয় না তারা। না; ছবিটাকে আমিই ঢেকে রেখেছি। ছবিটার ওপরে বেশি আলো পড়ছিল।

বেশি আলো! নিশ্চয় নয়। এই জায়গাটাই ছবিটা রাখার সবচেয়ে ভালো জায়গা। দেখি ছবিটা।

এই বলে হলওয়ার্ড ঘরের সেই বিশেষ কোণটির দিকে এগিয়ে গেলেন।

একটা ভয়ার্ত আর্তনাদ ডোরিয়েনের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল। তিনি দৌড়ে ছবি আর চিত্রকরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন।

বিবর্ণ মুখে তিনি বললেন: বেসিল, ছবিটাকে তুমি দেখো না। আমি চাইলে তুমি দেখ।

হলওয়ার্ড হাসতে হাসতে বললেন: বল কী হে! আমার নিজের আঁকা ছবি আমি দেখব না? তুমি সিরিয়াস নও, কেন দেখব না?

আমার দিব্যি, যদি তুমি ছবিটা দেখ তাহলে জীবনে আর আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব না। এদিক থেকে আমি তোমাকে খাঁটি কথাই বলছি। এর কোনো কৈফিয়ৎ তোমাকে আমি দেব না; তুমিও তা চেয়ো না। কিন্তু মনে রেখ, পর্দাটা একবার চুয়েছ কি আমাদের মধ্যে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে।

বজ্রাহতের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন হলওয়ার্ড। অবাক বিস্ময়ে ডোরিয়েনের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। ডোরিয়েনের এই রকম মানসিক অবস্থার সঙ্গে তাঁর আগে কোনোদিন পরিচয় ছিল না। ডোরিয়েন সত্যি-সত্যিই রাগে টগবগ করে ফুটছিলেন। তাঁর হাত দুটি ছিল মুষ্টিবদ্ধ, দুটো চোখ আগুনের গোলার মতো বনবন করে ঘুরছিল। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক কাঁপছিলেন তিনি।

ডোরিয়েন!

কোনো কথা নয়।

কিন্তু ব্যাপারটা কী বল তো?

পিছু ঘুরে জানালার দিকে ফিরে যেতে-যেতে বেশ বিরক্তির সঙ্গেই তিনি বললেন, অবশ্য তোমার আপত্তি থাকলে আমি ছবিটা দেখব না। কিন্তু আমার নিজের হাতে আঁকা ছবিটা আমি দেখতে পাব না–ব্যাপারটা নেহাতই হাস্যকর, বিশেষ করে এই শরৎ কালে প্যারিসের চিত্র প্রদর্শনীতে ছবিটা যখন আমি পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। পাঠানোর আগে সম্ভবত ছবিটার ওপরে আর এক পোঁচ রঙ বুলাতে হবে। সেইজন্যেই ছবিটা একবার আমার দেখা দরকার। আডকে দেখার আপত্তিটা কী?

এই ছবিটাকে তুমি প্রদর্শনীতে পাঠাবে!

চিৎকার করে উঠলেন ডোরিয়েন। একটা অদ্ভুত ভীতির ছায়া তাঁর সারা শরীরের ওপরে গুঁডি দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। তাঁর জীবনের গোপন রহস্যটি সকলের কাছে দেখানো হবে? সারা বিশ্ব সেই রহস্যের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে? না না; সে অসম্ভব। ঠিক কী তাঁর করা উচিত তা তিনি বুঝতে পারলেন না বটে; কিন্তু এটা বুঝতে তাঁর অসুবিধে হল না যে একটা কিছু তাঁর করা দরকার এবং এখনই।

হ্যাঁ। আমার ধারণা তাতে তোমার কোনো আপত্তি হবে না। রু দ্য সিজের বিশেষ প্রদর্শনীতে দেখানোর জন্যে জর্জ পেটিন্ট আমার শ্রেষ্ঠ ছবিগুলিকে সংগ্রহ করছেন। প্রদর্শনীটা শুরু হচ্ছে অকটোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে। মাত্র একমাসের জন্য ছবিটা আমি নিয়ে যাব। আমার ধারণা, এই কটা দিন ছবিটাকে যদি সব সময় তুমি পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখ তাহলে ওর উপরে যত্ন নেওয়াও তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

কপালের ওপরে হাত বুলোলেন ডোরিয়েন। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে সেখানে। তাঁর মনে হল একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির একেবারে শেষ ধাপে তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

তিনি বেশ জোর গলাতেই বললেন: ছবিটা তুমি কোনোদিনই প্রদর্শনীতে পাঠাবে না এই রকম একটা কথা মাসখানেক আগে আমাকে তুমি বলেছিলো তোমার মত পরিবর্তন করলে কেন? তোমাদের মতো যারা নিডদের এক কথার মানুষ বলে মনে করে তাদের সঙ্গে অন্য লোকদের কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য যদি কিছু থাকে তা হচ্ছে এই যে তোমাদের উচ্ছ্বাস অর্থহীন। তুমি যে আমাকে বলেছিলে যে পৃথিবীর কোনো কিছুর লোভেই তুমি ছবিটি প্রদর্শনীতে পাঠাবে না সেকথাটা নিশ্চয়ই তুমি ভুলে যাওনি। হ্যারিকেও তুমি ঠিক ওই কথাই বলেছিলে।

এই বলেই হঠাৎ তিনি চুপ করে গেলেন। হঠাৎ তাঁর একটা কথা মনে পড়ে গেল। কিছুটা সিরিয়াস আর আর কিছুটা উপহাসের ভঙ্গিতে লর্ড হেনরি একবার তাঁকে বলেছিলেন: যদি মিনিট পনেরো সময় পাও তো বেসিলকে বলতে বলো কেন সে ছবিটি প্রদর্শনীতে পাঠাবে না। সে আমাকে বলেছিল সে পাঠাবে না। কথাটা শুনে অবাক লেগেছিল আমার। হ্যাঁ, তাই। বেসিলেরও তাহলে কোনো গোপন রহস্য রয়েছে। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করবেন, জানার চেষ্টা করবেন কারণটা।

তাঁর কাছে এগিয়ে এসে এবং সোজাসুজি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ডোরিয়েন বললেন: বেসিল, আমাদের দুজনেরই একটা গোপন রহস্য রয়েছো তুমি যদি তোমার কথা আমাকে বুল…আমার কথা আমি তোমাকে বলবা কেন তুমি আমার ছবিটা প্রদর্শনীতে পাঠাতে চাওনি তখন?

নিজের অজান্তে চিত্রকর একটু কেঁপে উঠলেন; বললেন: ডোরিয়েন, সে কথা বললে তুমি হয়তো আগের মতো আর আমাকে পছন্দ করবে না; চাই কি উপহাস-ও করতে পারা ও দুটির একটাও যদি তুমি কর আমি তা সহ্য করতে পারব না। তুমি যদি ওই ছবিটি আর কোনোদিনই আমাকে দেখাতে না চাও তাতেও আমি খুশি। আমি চাই তুমিই ওটিকে সব সময় দেখা তুমি যদি মনে কর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবিটিকে তুমি লুকিয়ে রাখবে তাতেও আমি সন্তুষ্ট। যশ বা খ্যাতি-দুটোর কোনোটাকেই আমি তোমার বন্ধুত্বের ওপরে স্থান দিইনে।

ডোরিয়েন গ্রে ছাড়লেন না; বললেন: না বেসিলি; তোমাকে বলতেই হবে। মনে হয় সেকথা ডানার অধিকার আমার রয়েছে।

তাঁর আতঙ্ক সরে গেল; তার জায়গা দখল করল একটা কৌতূহল। বেসিল হলওয়ার্ডের রহস্যটা কী তা জানার জন্যে তিনি বদ্ধপরিকর হলেন।

হলওয়ার্ডের চোখমুখের চেহারা দেখে মনে হল তিনি বেশ একটা অসুবিধায় পড়েছেন।

ডোরিয়েন, এস আমরা বসি। আমি তোমাকে একটি মাত্র প্রশ্ন করব। তার উত্তর দাও। ছবির ভেতরে কোনো অদ্ভুত জিনিস কি তুমি লক্ষ করেছ? এমন একটা জিনিস যা প্রথমে তোমার নজরে পড়েনি; কিন্তু হঠাৎ একদিন ধরা পড়েছে তোমার কাছে?

কম্পিত হাতে চেয়ারের একটা হাতল জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলেন তিনিঃ বেসিল!

চমকে উঠে ভয়-বিহ্বল চোখে তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বুঝতে পারছি তোমার চোখে তা ধরা পড়েছে। চুপ কর। এ-বিষয়ে আমি যা বলতে চাই তা তুমি মন দিয়ে শোন, ডোরিয়েন তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার পর থেকেই, তুমি। অদ্ভুতভাবে আমাকে প্রভাবান্বিত করেছিলো আমার আল্ল, মস্তিষ্ক আর শক্তি সকলের ওপরেই প্রভুত্ব বিস্তার করেছিলে তুমি। অনবদ্য স্বপ্নের মতো অদৃশ্য আদর্শের যে স্মৃতিটি আমাদের মতো আর্টিস্টদের অস্থির করে তোলে তুমি আমার কাছে ছিলে তার একটি মূর্ত প্রতীক। আমি তোমাকে পূজা করতাম। তুমি কারো সঙ্গে কথা বললে আমি তাকে করতাম হিংসা। আমি তোমার সমস্ত সত্তাকে নিজের মধ্যে পেতে চেয়েছিলাম। তুমি যখন আমার কাছে বসে থাকতে কেবলমাত্র তখনই আমি সুখী হতাম। তুমি যখন চলে যেতে, আমার শিল্পের মধ্যে তখনও তোমার উপস্থিতির সপর্শ পেতাম। অবশ্য এ ব্যাপারটা তোমাকে কখনো আমি জানতে দিইনি। জানতে দেওয়াটা সম্ভব ছিল না। তুমি তা বুঝতে পারতে না। আমি নিডোও কি তা পেরেছিলাম? আমি কেবল বুঝতে পেরেছিলাম, একটি নিখুঁত বাস্তব সৌন্দর্যের মুখোমুখি আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি এবং পৃথিবীটা আমার চোখে অদ্ভুত সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। সম্ভবত এটাও আমি জানতাম যে এই যুক্তিহীন পূভায় বিপদ লুকিয়ে। রয়েছে–সেই বিপদটা হচ্ছে হারানোর, ঠিক যেমন বিপদ রয়েছে সেটিকে নিজস্ব করে ধরে রাখার মধ্যে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে গেল; তোমার মধ্যে নিজেকে আমি হারিয়ে। ফেললাম। বিশ্বের সমস্ত রোমান্টিক নায়কের বেশে তোমাকে আমি কল্পনা করে সাজিয়ে দিলাম। সমস্ত আর্টেরই শেষ করা তাই অবচেতন মনের সমস্ত সৌন্দর্য আর রসবোধকে রঙ-তুলি দিয়ে ক্যানভাসের ওপরে ধরে রাখা। একদিন এল, যে দিনটি আমার মতে বিপদজ্জনক, আমি তোমার ছবি আকতে মনস্থ করলাম–প্রাচীন মৃত যুগের রঙে নয়, তোমার আসল রঙো তুমি যা সেই ভাবে। এটাই শিল্পকলার বাস্তব রীতি। না, তোমার অপরুপ ব্যক্তিত্বের কোনো প্রভাব আমাকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা আমি জানিলে। কিন্তু এটা আমি জানি যে তোমার প্রতিকৃতি আঁকার সময় প্রতিটি রঙ আর তুলির আঁচড় আমার মনের গোপন রহস্যটি আমার কাছে প্রকাশ করে দিয়েছিল। পাছে অন্য লোকে আমার এই মূর্তিপূজার কথা জানতে পারে এই ভয়ে শঙ্কিত ছিলাম আমি। ডোরিয়েন, আমার মনে হয়েছিল প্রতিকৃতিটির মধ্যে আমার নিজস্ব সত্ত্বার অনেকখানি আমি ঢেলে দিয়েছিলেম। তখনই আমি ঠিক করে ফেলেছিলেম এ-ছবি কোনোদিনই আমি কোনো প্রদর্শনীতে পাঠাব না। তুমি কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলে কিন্তু ছবিটা আমার কাছে কী জিনিস তা তুমি তখন। ডানতে না। হ্যারিকে বলেছিলেম। সে আমাকে উপহাস করেছিল। সেই উপহাসে আমি কিছু মনে করিনি। ছবিটি শেষ হওয়ার পরে যখন আমি একা সেটির কাছে বসে থাকতাম তখন। আমার মনে হত আমি ঠিকই করেছি। ছবিটি আমার স্টডিযও থেকে চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে আমার মোহ কেটে গেল। আমার মনে হল ছবিটির মধ্যে অপরূপ কিছুর সন্ধান পাওয়াটা আমার পক্ষে মূর্খতা হয়েছে; আমার কেবলই মনে হতে লাগল যে অপরূপ অঙ্গসৌষ্ঠভ ছাড়া। আর কিছু নেই তোমার। কেবল এইটুকু ভেবেই সান্ত্বনা পেলাম যে ছবি আঁকার ক্ষমতা আমার রয়েছে। এমন কি এখনো আমার মনে হয় যে কল্পনায় আমরা যা ভাবি তা কোনোদিন বাস্তবে রূপায়িত হয় না। আমাদের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি অবাস্তব হচ্ছে আর্ট। আঙ্গিকটা আঙ্গিক সাডা আর কিছু নয়। আমার ধারণা, আট যতখানি আটিস্টকে লুকিয়ে রাখে ততটা প্রকাশ করে না। সেই জন্যে প্যারিস থেকে ছবি পাঠানোর যখন আমন্ত্রণ পেলাম তখনই আমি ঠিক করলাম ওই ছবিটাকেই আমি প্রদর্শনীতে পাঠাবা তুমি যে রাজি হবে না সে কথা আমি ভাবিনি। এখন বুজতে পারছি তুমিই ঠিক। প্রতিকৃতিটাকে লোকচহস্কৃতে প্রকাশ করা উচিত হবে না। আমি তোমাকে যা বলেছি তার জন্যে রাগ করো না ডোরিযেলা হ্যারিকে যা বলেছি তোমাকেও তাই বলছি–বিশ্বের পূভা পাওয়ার জন্যেই তোমার সৃষ্টি হয়েছে।

দীর্ঘ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ডোরিয়েন গ্রে। তাঁর দেহের স্বাভাবিক রঙ ফিরে এল; মুখের ওপরে ফুটে উঠল হাসি। যাক, বিপদটা কেটে গিয়েছে, আপাতত তিনি নিরাপদ। কিন্তু তবু ওই যে চিত্রকরটি তাঁর কাছে একটি স্বীকারোক্তি করলেন, তারই জন্যে বেসিলের ওপরে তাঁর বুড়ো মায়া হল। তাঁর ওপরেও কি তাঁর কোনো বন্ধুর এতখানি প্রভাব রয়েছে? প্রশ্নটা অবাক হয়েই ভাবতে লাগলেন তিনি। লর্ড হেনরির প্রভাবের মধ্যে মনোহারিত্ব রয়েছে এবং সেই প্রভাবটি নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। কিন্তু তাঁকে নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই। সত্যিকার ভালোবাসা বলতে কিছু তাঁর ভেতরে নেই। মানুষের ওপরে অনাস্থাও তাঁর যথেষ্ট। এমন কেউ কি রয়েছে যে তাঁকে পূজা করে? ভাগ্য কি তাঁর জন্যে পূজার উপকরণ সাজিযে রেখেছে?

হলওয়ার্ড বললেন; ছবির ওপরে এই বিশেষ ডিজনিসটা যে তোমার চোখে পড়েছে তাতেই আমি খুব আশ্চর্য হচ্ছি, ডোরিয়েন। সত্যিই কি তুমি দেখতে পেয়েছ?

তিনি বললেন: দেখেছি। এমন একটা জিনিস দেখেছি যা আমাকে অবাক করে দিয়েছে।

যাই হোক, এখন ছবিটা একবার দেখতে দিতে নিশ্চয় তোমার আপত্তি নেই?

ডোরিয়েন মাথা নেড়ে বলেন: আর ওকথা নয়, বেসিল ছবিটার সামনে দাঁড়াতে তোমাকে আমি দেব না।

আজ না দাও, আর একদিন নিশ্চয় দেবে?

কোনোদিন দেব না।

হয়তো তুমি ঠিকই করছ। এখন আমি চলি ডোরিয়েন। আমার জীবনে একমাত্র তুমি এসেছ। যে আমার চিত্রকলাকে প্রভাবান্বিত করেছে। যত ভালো ছবি আমি এঁকেছি সেগুলির জন্যে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তোমাকে আমি যা বললাম সেটা বলতে আমাকে কত খেসারৎ দিতে হয়েছে তা হয়তো তুমি জান না।

ডোরিয়েন বললেন: প্রিয় বেসিল, কীই ব মি আমাকে বলে? শুধু বলেছ, আমাকে তোমার খুব ভালো লাগে। শালীনতার দিক থেকে ওটা এমন একটা উঁচুদরের নয়।

ভদ্রতা দেখানোর জন্য ওকথা আমি বলিনি। ওটাই আমার স্বীকারোক্তি ওই স্বীকারোক্তি করার পরে মনে হচ্ছে আমি কিছু হারিয়ে ফেলেছি। পূজা করার কথাটা সম্ভবত মুখ ফুটে বলতে নেই।

এই স্বীকারোক্তি মানুষের মনে আশা জাগায় না বন্ধু।

তা ছাড়া আর কী তুমি আশা কর, ডোরিয়েন? ছবির মধ্যে আর কিছু তুমি দেখনি। দেখেছ কি? আরো কিছু দেখার জিনিস সেখানে রয়েছে?

না। আর কিছু নেই। একথা তুমি জিজ্ঞাসা করছ কেন? কিন্তু পূজার কথা বলো না। কথাটাই বোকার মতো। আমরা পরস্পরের বন্ধু বেসিল, চিরকাল আমরা বন্ধুই থাকব।

বিষণ্ণ সুরে চিত্রকর বললেন: বন্ধু হিসাবেই তুমি হ্যারিকে পেয়েছ।

ছোটো ছোটো হাসির ঢেউ-এ ভেঙে পড়ে, ডোরিয়েন বললেন: ও, হ্যারির কথা বলছ? অবিশ্বাস্য কথা বলে সে সারাদিন কাটায়, রাত্রিতে এমন সব কাজ করে যেগুলি অবাস্তব, আমিও ঠিক ওই রকম জীবনই যাপন করতে চাই। তবু আমার মনে হয়, বিপদে পড়লে। কোনোদিনই আমি হ্যারির কাছে যাব না; তার আগে যাব তোমার কাছে।

আবার তুমি আমার মডেল হবে?

অসম্ভব।

আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আমার চিত্রকরের জীবনটা তুমি নষ্ট করে দিলে, ডোরিয়েন। কোনো মানুষের জীবনে দু’বার আদর্শ আসে না; একবারই খুব কম মানুষই তার আদর্শের সংবাদ পায়।

কারণটা তোমাকে আমি বুঝিযে বলতে পারব না, বেসিল। কিন্তু তোমার ছবির মডেল হতে আর আমি পারব না। ছবিটার মধ্যে বিপজ্জনক কিছু রয়েছে। মনে হচ্ছে ছবিটা জীবন্ত। চল, তোমার সঙ্গে চা খাইগে। এ আলোচনা মধুরেণ সমাপয়েৎ করা যাক।

হলওয়ার্ড বললেন: তোমার দিক থেকে মধুরেণ হতে পারে। এখন চলি। ছবিটা যে আর তুমি আমাকে দেখতে দেবে না এই কথা শুনে দুঃখই পেয়েছি। কিন্তু উপায় নেই। ছবিটার সম্বন্ধে তোমার মনোভাব কী তা আমি বেশ বুঝতে পারছি।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন হলওয়ার্ড। মনে-মনে হাসলেন ডোরিয়েন গ্রে। হতভাগ্য বেসিল। ছবিটা দেখতে না দেওয়ার আসল কারণটা তিনি জানতেই পারলেন না। আর কী আশ্চর্যের কথা, তাঁর নিজের রহস্য ফাঁস না করে কী অদ্ভুত উপাযেই না তিনি বেসিলের মনের গোপন কথাটি বার করে নিলেন চিত্রকরের হাস্যোদ্দীপক হিংসা, তাঁর উদ্দাম ভক্তি, অনাবশ্যক স্তুতি,–বেসিলের মনের অনেক অবচেতন মনের রহস্যই তিনি জানতে পারলেন। বেসিলের উন্যে দুঃখ হল তাঁর। রোমান্সের রঙে রঙিন বন্ধুত্বের মধ্যে কোথায় যেন একটা বিষাদের সুর লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে হল তাঁরা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ‘বেল’ টিপলেন তিনি। যেমন করেই হোক প্রতিকৃতিটাকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আর কেউ এটিকে দেখতে পারে এ-ঝুঁকি আর তিনি নিতে চাইলেন না। যে ঘরে তাঁর বন্ধুরা আসা-যাওয়া করেন সেই ঘরে ছবিটাকে এক ঘন্টার জন্যেও রাখাটা তাঁর। পাগলামি হয়েছে।

৩. চাকরটি ঘরে এসে ঢুকতে

দশম পরিচ্ছেদ

চাকরটি ঘরে এসে ঢুকতেই একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোকটা কি পর্দার পেছনে আড়ি পেতে শুনছিল এতক্ষণ? লোকটির মুখের ওপরে কোনোরকম ভাবান্তর দেখা গেল না। সে নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। একটা সিগারেট ধরিয়ে আরশীর দিকে এগিয়ে গেলেন ডোরিয়েন। তাকিয়ে দেখলেন। ভিকটরের মুখটা বেশ সপষ্টই দেখা যাচ্ছিল আরশীর ওপরে। চাকরের মুখের মতনই সে মুখ নিবাত-নিষ্কম্পা ভয় করার মতো কিছু নেই সেখানে। তবু তাঁর মনে হল সাবধানে থাকাই ভালো।

ধীরে-ধীরে কথা বললেন ডোরিয়েন: রাঁধুনিকে পাঠিয়ে দাও, তারপরে তুমি ছবির যারা ফ্রেম তৈরি করে সেই দোকানে দুজন মিস্ত্রিকে এখনই আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলা তাঁর মনে হল, লোকটি চলে যাওয়ার সময় পর্দার দিকে একবার তাকিয়ে গেল। অথবা এটা তাঁর মতিভ্রম?

কিছুক্ষণ পরে কালো পোশাক পরে মিসেস লিফ লাইব্রেরিতে হাজির হল, স্কুলঘরের চাবিকাঠিটা তিনি চাইলেন।

মিসেস লিফ বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল, পুরনো স্কুলঘরের চাবি চাইছেন, মিঃ ডোরিয়েন? ঘর তো একেবারে ধুলোয় বোঝাই হয়ে রয়েছে। আপনি ঢোকার আগে ঝেড়ে-মুছে ঘরটাকে চলনসই করতে হবে। ওঘরে এখনই আপনি ঢুকতে পারবেন না। স্যার; না, না, নিশ্চয় না।

ঘর ঝাড়-পোঁচ করতে আমি চাইনে, লিফ, আমি যা চাই সেটা হচ্ছে চাবিকাঠি।

কিন্তু স্যার, ঘরের মধ্যে মাকডশার ডাল গিজ গিজ করছে। ঢুকলেই আপনার গোটা গা ভর্তি হয়ে যাবে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে ঘরটা খোলা হয়নি, সেই যেদিন হিজ লর্ডশীপ দেহত্যাগ করেছেন।

দাদামশায়ের কথা উঠতেই তিনি ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। দাদামশায়ের সম্বন্ধে তাঁর যে স্মৃতি রয়েছে তার মধ্যে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু নেই। তিনি বললেন: তাতে কিছু যাবে আসবে না। ডাযগাটা আমি কেবল দেখতে চাই। চাবিটা আমাকে দাও।

কাঁপা হাতে চাবির বান্ডিল ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা চাবি বার করে বৃদ্ধা লিফ বলল: এই যে। গোছা থেকে এখনই এটা আমি বার করে দিচ্ছি। কিন্তু ওখানে আপনি থাকবেন ঠিক করেননি তো? এ ঘরে তো আপনি ভালোই রয়েছেন।

না, না, রাত্রিবাস করার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই। ধন্যবাদ, এবার তুমি এস।

কিন্তু তখনই সে চলে গেল না; দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সাংসারিক ব্যপার নিয়ে কিছুটা বকবক করল। তিনি মনে-মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন: বেশ তো; তোমার যেটা ভালো মনে হবে সেইভাবেই সংসার চালাও।

মিসেস লিফ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। চাবিকাঠিটা পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলেন ডোরিয়েন; ঘরের ভেতরে চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখলেন।

দেখতে-দেখতে লাল সাটিনের বিরাট একটা চাদরে তাঁর চোখ এসে পড়ল, চারপাশটা তার সোনালি বুটির কাজ, সপ্তদশ শতাব্দীর ভেনিস্যি কারুকলার একটি অপূর্ব নিদর্শন। বোলোচানার কনভেনট থেকে তাঁর দাদামশায় সেটি সংগ্রহ করেছিলেন। হ্যাঁ, সেই ভয়ানক বস্তুটাকে ওই চাদর দিয়ে স্বচ্ছন্দে ঢাকা দেওয়া যাবে। ওটা দিয়ে প্রায় মৃতদেহগুলিকে ঢাকা দেওয়া হত। এখন ওটা দিয়ে এমন একটা জিনিসকে চাপা দেওয়া হবে যেটা আপনা থেকে বিকৃত হয়ে ওঠে; মৃতদেহের বিকৃতির চেয়েও যার বিকৃতি অনেক বেশি ভয়ঙ্কর-যে নিজে না মরেও চারপাশে মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়িয়ে দেয়। মৃতদেহের ওপরে পোকারা যে বিকৃতি ঘটায়, তাঁর পাপ ক্যানভাসের ছবিটির ওপরেও সেই রকম বিকৃতি ঘটাবে তাঁর পাপগুলি ছবিটির সৌন্দর্য নষ্ট করবে, ধ্বংস করে দেবে তার লাবণ্য। একেবারে কদর্য হয়ে যাবে জিনিসটা তবু তর মৃত্যু হবে না; তবু সে চিরকাল বেঁচে থাকবে।

ভাবতে-ভাবতে তিনি শিউরে উঠলেন। প্রতিকৃতিটাকে ঢেকে রাখার আসল কারণটা তিনি যে বেসিলকে বলেননি সে-জন্যে অনুশোচনা হল তাঁর। লর্ড হেনরির প্রভাব অথবা তাঁর নিজের প্রবৃত্তি থেকে যে সব পঙ্কিল চিন্তাগুলি বেরিয়ে তাঁকে পাপের পথে টেনে নিয়ে যেতে চায় সেগুলির প্রভাব থেকে বেসিল হয়তো তাঁকে বাঁচাতে পারতেন। তাঁর ভালোবাসার মধ্যে এমন কিছু নেই যা মহৎ নয়, মননশীলতা যার মধ্যে নেই। কারণ, কোনো খাদ নেই বেসিলের। ভালোবাসার ভেতরে। এই ভালবাসা দেহজ নয়। প্রবৃত্তিগুলি ক্লান্ত হয়ে উঠলেই দেহ ভলোবাসা নষ্ট হয়ে যায়। মাইকেল এঞ্জেলো, মনতেন উইনকিলম্যান এবং শেকসপীয়ন–এঁরা সবাই সেই আসল ভালোবাসারি পূজারী। হ্যাঁ, বেসিলই তাঁকে বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন আর সে সময় নেই। অতীতকে সব সময় বিনষ্ট করা। যায়। অনুশোচনা, আত্মাহুতি আর বিস্মৃতির মধ্যেই কবরস্থ করা যায় অতীতকে। কিন্তু ভবিষ্যতকে এড়ানো যায় না। তাঁর কামলা আর ভোগের উচ্ছ্বাসই তাঁর সামনে বিপদের নতুন পথ খুলে দেবে, আজ যে বিপদ অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে একদিন তাই রূপায়িত হবে ভয়ঙ্কর বাস্তব সত্য।

সোফার ওপর থেকে তিনি সোনালি কারুকার্য করা বিরাট চাদরটিকে হাতে করে তুলে নিলেন; তারপরে সেটি নিয়ে পর্দার পেছনে চলে গেলেন। ক্যানভাসের ওপরে যে মুখটি আঁকা রয়েছে, আগের সেটি কি আরো কুৎসিত রূপ ধারণ করেছে? দেখে তো মনে হল কোনোরকম পরিবর্তন দেখা দেয়নি, কিন্তু ছবিটির ওপরে তাঁর ঘৃণার মাত্রাটা যেন আরো বেড়ে গেল। সোনালি চুল, নীল চোখ, গোলাপ রাঙা দুটি ঠোঁট–সবই সেই আগের মতোই রয়েছে। নেই যা তা হচ্ছে মুখের ভাবটা একটা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার ছাপ মুখের ওপরে পড়েছে। সাইবিল ভেনকে নিয়ে বেসিল তাঁকে যে তিরস্কার করেছেন তার তুলনায় এই মুখের তিরস্কার কত বেশি, কত তীব্র। এই ছবির ভেতর থেকে তাঁর নিজের আত্মাই যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলছে–এই অন্যায়ের বিচার চাই। একটা যন্ত্রণায় তিনি আর্তনাদ করে চাদরটা ছবির ওপরে ছুঁড়ে দিলেন। ঠিক এমনি সময়ে দরজায় টোকা পড়ল। তিনি বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঘরে চাকরটি ঢুকে এসে বলল: জনকয়েক লোক এসেছেন মঁসিয়ে।

তাঁর মনে হল চাকরটিকে এখনই কোথাও সরিয়ে দিতে হবে। ছবিটা কোথায় রাখা হবে সে সংবাদ তাকে জানতে দেওয়া হবে না। এই উদ্দেশ্যে একটু চালাকি খেলতে হল তাঁকে। লেখার টেবিলে ধীরে সুস্থে বসে তিনি একখানা পত্র লেখার কাগজ টেনে নিলেন; লর্ড হেনরিকে উদ্দেশ্য করে কয়েকটি লাইন খসখস করে লিখেও ফেললেন; সেই চিঠিতে পড়ার জন্যে কিছু বই তাঁকে পাঠাতে বলেলন, সেই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিলেন সেদিন রাত আটটা পনেরোর সময় তাঁদের বিশেষ একটি জায়গায় মিলিত হওয়ার কথা রয়েছে।

চিঠিটা চাকরের হাতে দিয়ে বললেন: এটা তুমি লর্ড হেনরির কাছে নিয়ে যাও। তাঁর উত্তরটা নিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করো। ভদ্রোলোকদের আসতে বলে যাও।

দু’তিন মিনিটের মধ্যে আর একটা টোকা পড়ল। হাজির হলেন সাউথ অডলি স্ট্রিটের মিঃ হবার্ড স্বয়ং। পেশার দিক থেকে বেশ নামকরা ফটো ফ্রেম বাঁধাইকারী। তিনি একলা । আসেননি; সঙ্গে এসেছেন রুক্ষ চেহারার একটি যুবক সহকারীকে। চেহারার দিকে ভদ্রলোক বেঁটে; গোঁফ জোড়াটি লাল, পোশাক বেশ জাঁকালো আর্টের ওপরে। তাঁর যে শ্রদ্ধা তার উৎস হচ্ছে যে সব আর্টিস্টের সঙ্গে তাঁর লেনদেনের ব্যাপার ছিল তাঁদের অনেকেরই চরম দারিদ্র্য। নীতিগতভাবে কোনোদিনই তিনি দোকান ছেড়ে বেরোতেন না। খরিদ্দার বা অন্য লোকদের ডজন্যে তিনি দোকানেই অপেক্ষা করতেন। কিন্তু ডোরিয়েন গ্রের ব্যাপারে সব সময়েই তিনি এই নিয়ম ভেঙে চলতেন। ডোরিয়েন গ্রে-র মধ্যে এমন একটা জিনিস ছিল যা মানুষকে মুগ্ধ না করে পারত না। তাঁকে চোখে দেখেও আনন্দ পেত মানুষ।

তাঁর স্থূল হাত দুটিকে কচলিয়ে তিনি বললেন: আপনার জন্যে কী করতে পারি মিঃ গ্রে? ভেবেছিলেম আপনার এখানে আমি একাই আসব। আমার দোকানে অদ্ভুত সুন্দর একটা ছবির ফ্রেম রয়েছে, স্যার। এটাকে একটা সেল-এ কিনেছি আমি। মনে হয়, ফ্রন্টহিল থেকে আমদানি হয়েছে। ধর্ম সংক্রান্ত কোনো কিছু ছবির পক্ষে এই ফ্রেম খুব জুৎসই, স্যার।

মিঃ হুবার্ড, আপনি যে কষ্ট করে নিজেই এসেছেন তার জন্যে আমি দুঃখিত। যদিও ধর্ম। সম্বন্ধীয় কোনো আর্ট নিয়ে বর্তমানে আমি মাথা ঘামাইনে তবু আপনার দোকানে একদিন গিয়ে নিশ্চয় আমি ফ্রেমটি দেখে আসব,কিন্তু আজকে আমার একটি ছবিকে বাড়ির ওপরতলায় নিয়ে যেতে হবে। ছবিটা বেশ ভারী, আপনি যদি ডনে দুই লোক পাঠিয়ে দিতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।

তাতে আর অসুবিধে কী রয়েছে, মিঃ গ্রে? আপনার কোনো সাহায্যে আসতে পারলে আমি খুশিই হবা কোন ছবিটার কথা বলছেন, স্যার?

পর্দাটাকে সরিয়ে ডোরিন বললেন: এইটা। চাপানসুদ্ধ, ঠিক যেমনটি রয়েছে, এটাকে নিয়ে যেতে পারবেন? ওপরে নিয়ে যাওয়ার সময় এর গায়ে কোথাও কোনো ঠোক্কর লাগুক তা আমি চাইলে।

কোনো অসুবিধে হবে না স্যার।

এই বলে সেই লোকটি তাঁর সহকারীকে নিয়ে যে পেতলের শেকল দিয়ে ছবিটি টাঙানো ছিল। তার পেরেকটা খুলতে লাগলেন।

এখন কোথায় এটিকে নিয়ে যাব, মিঃ গ্রে?

আপনি দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন। জায়গাটা আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, মিঃ হুবার্ড। তার চেয়ে আপনিই বরং আগে-আগে চলুন। যেতে হবে বাড়ির একেবারে ওপরতলায়। চলুন আমরা সামনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই। সিড়িঁটা বেশ চওড়া।

তাঁদের যাতে বেরিয়ে যেতে অসুবিধে না হয় সেইজন্যে দরজাটা তিনি ফাঁক করে দিলেন। হলঘরের মধ্যে ঢুকে তাঁরা সিঁড়িতে উঠতে লাগলেন। বিশেষ এবং বিশদ খুঁটিনাটির দিকে লক্ষ রাখার ফলে ছবিটা বেশ ভারী হয়ে পড়েছিল। পাচ্ছে সেটা ঠোক্কর লেগে ভেঙে যায় এই ভয়ে মাঝে-মাঝে ডোরিয়েন ছবিটাকে ধরছিলেন। কিন্তু মিঃ হুবার্ড বিনয়-নম্রভাবে নিষেধ করছিলেন তাঁকে তাঁর বোধ হয় কারণটা এই যে সত্যিকার ব্যবসাদারের মতো তিনি চাইতেন না কোনো ভদ্রলোক কোনো প্রয়োজনীয় কাজ করুক।

সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠে সেই খুদে লোকটি হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন: সত্যিকাল ভারী, স্যার।

এই বলে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি।

ঘরের চাবি খুললেন ডোরিয়েন; এই ঘরেই তিনি তাঁর জীবনের একটি অদ্ভুত গোপন রহস্যকে লুকিয়ে রাখতে এসেছেন। সেই সঙ্গে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখবেন নিজের আত্মাটিকেও। দরজাটা খুলে দিয়ে তিনি বললেন, হ্যাঁ, তা বেশ ভারীই বটে।

এই ঘরে জীবনে তিনি বারো বছরের মধ্যে ঢোকেননি। শৈশবে এই ঘরে তিনি খেলতেন; কিছুটা বড়ো হওয়ার পরে এখানে তিনি পড়াশুনা করতেন। ঘরটি বিরাট এবং উপযুক্ত। মাপের। বাচ্চা নাতির জন্যেই মৃত লর্ড কেলসো ঘরটিকে তৈরি করিয়েছিলেন। ছেলেটির। মধ্যে তার মায়ের চেহারার দুপ থাকায় এবং অন্যান্য কারণে, ছেলেটিকে সূব সময় তিনি ঘৃণার চোখে দেখতেন। বিশেষ করে সেইজন্যেই ছেলেটিকে তিনি তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। ডোরিয়েনের মনে হল ঘরটির কিছুই পরিবর্তন হয়নি। তার গঠন, আসবাবপত্র–সব একইরকম রয়েছে। সাটিনের তৈরি বুককেসের মধ্যে এখনো তাঁর স্কুলের বইগুলি সাজানো রয়েছে। তার পেছনে দেওয়াল। সেই দেওয়ালের ওপরে অপরিচ্ছন্ন একটা পর্দা। পর্দায় গায়ে একটি বাজা আর রানির অস্পষ্ট ছবি; বাগানে বসে তাঁরা দাবা খেলছেন। পাশের রাস্তা দিয়ে কয়েকটি ফিরিওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। তাদের কব্জির ওপরে শেকল। বাঁধা কয়েকটা ঝুঁটিওয়ালা পাখি। সব মনে রয়েছে তাঁর স্পষ্ট মনে রয়েছে। ঘররে চারপাশে তিনি তাকিয়ে দেখলেন। শৈশবের প্রতিটি নিঃসঙ্গ মুহূর্ত তাঁর মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল তাঁর শৈশবের নিষ্পাপ দিনগুলির কথা। সেই ঘরের মধ্যে এই ধরনের যে একটা বিষাক্ত ছবিকে লুকিয়ে রাখতে হবে এটা ভাবতেই তাঁর মনটা আঁতকে উঠল। তাঁর কপালে এই লেখা রয়েছে–একথা কি কোনোদিন তিনি ভাবতে পেরেছিলেন?

কিন্তু কৌতূহলী দৃষ্টি থেকে কোনো জিনিস লুকিয়ে রাখার মতো এর চেয়ে ভালো জায়গা আর নেই। চাবিটা তাঁর কাছে রয়েছে সেই জন্যে অন্য কেউ সেখানে ঢুকতে পারবে না। এই লাল চাদরের নীচে প্রয়োজন মনে করলে ছবির মুখটা তার খুশি মতো পাশবিক মূর্তি গ্রহণ করতে পারে। তাতে কার কী যায় আসে? কেউ তা দেখতে আসবে না। নিজেও তিনি তা দেখবেন না। তাঁর আত্মার এই ভয়ঙ্কর বিকৃতি কেনই বা তিনি লক্ষ করবেন? তাঁর যৌবন বেঁচে থাকবে এইতো যথেষ্ট। তাছাড়া, তাঁর চরিত্র কি শেষ পর্যন্ত সুন্দর হয়ে উঠবে না? তাঁর ভবিষ্যৎটাও যে এই রকমেরই ক্লেদাক্ত থেকে যাবে এর পেছনেও তো কোনো কারণ নেই। নতুন কোনো প্রেম তাঁর ভেতরে দেখা দিতে পারে সেই প্রেম তাঁকে পবিত্র করে তুলবে এং যে পাপ তাঁর দেহ আর মনকে এমনভাবে ঝাঁকানি দিয়েছে–সেই অদ্ভুত অদৃশ্য পাপ যাকে আমরা বুঝতে পারিনি বলেই মনোহর বলে মনে করি–সেই পাপ থেকে তাঁকে রহস্কা করতে পারে। সেই রক্তিমাভ সপর্শকাতর মুখ থেকে হয়তো একদিন সেই নির্মম চাহনিটি মুছে যাবে এবং বেসিল হলওয়ার্ডের জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তিটিকে তিনি বিশ্বকে দেখাতে পারবেন।

না, সে অসম্ভব। ঘন্টার পর ঘন্টা, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, ছবিটির ওপরে বার্ধক্যের ছাপ পড়বে। পাপের ভয়ঙ্কর বিকৃতি থেকে ও মুক্তি পেতে পারে, কিন্তু বয়সের বিকৃতি থেকে ওর কোনো মুক্তি নেই। গাল দুটি চুপসে যাবে, হবে থলথলে; হলদে রঙের ছায়া নেমে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়বে নিষ্প্রভ দুটি চোখের কোটরে, বীভৎস দেখাবে তাদের। চুলগুলি হারিয়ে ফেলবে তাদের। উজ্জল বর্ণ, মুখের চোয়াল পড়বে ঝুলে, বৃদ্ধদের মুখের মতো সেই মুখ বোকাটে-বোকাটে দেখাবে। কণ্ঠে জাগবে কুঞ্চন, ঠান্ডা হাত দুটির ওপরে নীল শিরাগুলি জেগে উঠবে; দেহটা ভেঙে কুঁজো হয়ে যাবে। শৈশবে যে দাদামশায় তাঁর চোখে অত কঠোর প্রকৃতির ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে তিনিও ঠিক ওই জাতীয় প্রাণীতে পরিণত হয়েছিলেন। বেশ মনে রয়েছে তাঁর। সুতরাং ছবিটাকে লুকিয়ে ফেলতেই হবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই তাঁর।

ঘুরে দাঁড়িয়ে বেশ ক্লান্ত স্বরেই তিনি বললেন: ওটাকে ভেতরে নিয়ে আসুন, মিঃ হুবার্ড, আপনাদের অনর্থক দাঁড় করিয়ে রাখরা জন্যে দুঃখিত, আমি অন্য কথা ভাবছিলাম।

মিঃ হুবার্ড পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছিলেন, তিনি বললেন: একটু বিশ্রাম পেয়ে ভালোই হয়েছে, মিঃ গ্রে। এটাকে কোথায় রাখব বলুন তো?

যে কোনো জায়গায়। এখানে, এখানে-ও রাখা যেতে পারে। আমি এটাকে ঝুলিয়ে রাখতে চাই নে। দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখুন। ধন্যবাদ।

কিন্তু ছবিটা কেউ দেখতে চাইতে পারে স্যার!

কথাটা শুনে চমকে উঠলেন মিঃ ডোরিয়েন; লোকটির দিকে চোখ রেখে বললেন: ওটা দেখতে আপনার ভালো লাগবে না।

যে জাঁকালো পর্দাটা তাঁর জীবনের একটি গোপন রহস্যকে ঢেকে রেখেছে, লোকটি যদি সেই পর্দাটা একটু সরিয়ে ছবিটি দেখার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে তাহলে তাঁকে আচ্ছা করে ধোলাই দেওয়ার একটা বাসনা তাঁর মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে গেল।

আর আপনাকে কষ্ট দেব না। আপনি যে দয়া করে এসেছেন তার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মোটেই না, মোটেই না, মিঃ গ্রে। আপনার জন্যে সব সময়ে সব কাজ করতে আমরা প্রস্তুত।

এই বলে মিঃ হুবার্ড তাঁর সহকারীকে পেছনে নিয়ে নামার পথ ধরলেন। নামার পথে সহকারীটি তার সেই রুক্ষ আর বিশ্রী মুখ ঘুরিয়ে লজ্জা আর সেই সঙ্গে কিছুটা বিস্ময় মখালো। দৃষ্টি দিয়ে পেছনে ফিরে ডোরিয়েনের দিকে একবার তাকাল। এমন অপরূপ চেহারার মানুষ, আর কোনো দিন তার চোখে পড়েনি।

তাদের পদশব্দ নীচে মিলিয়ে যাওয়ার পরে, দরজায় চাবি দিয়ে চাবিকাঠিটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন ডোরিয়েন। এখন অনেকটা নিরাপদ মনে হল তাঁরা এই ভয়ঙ্কর জিনিসটা আর কারও চোখে পড়বে না। নিজের ছাড়া আর কারও চোখ তাঁর এই লজ্জার ওপরে পড়বে না।

লাইব্রেরিতে নেমে আসার পরে তিনি দেখলেন পাঁচটা বেড়ে গিয়েছে। টেবিলের ওপরে চা-এর সরলাম সাজানো রয়েছে। প্রচুর পরিমাণে ঝিনুক দিয়ে গাঁথা সুগন্ধী কাঠের তৈরি ছোট্ট একটা টেবিলের ওপরে লর্ড হেনরির একটা চিঠি চাপা রয়েছে। তাঁর অভিভাবকের পত্নী লেডি ব্যাডল টেবিলটি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা গত শীতে কায়রোতে ছিলেন। লর্ড হেনরির চিঠির পাশে হলদে কাগজে মোড়া একখানা বই রয়েছে। বইটির মলাট সামান্য ছেঁড়া, বাঁধাইটা নোংরা। চা-এর ট্রের ওপরে দি সেন্ট জেমস গেজেটের তৃতীয় সংস্করণের একটি কপি চাপা দেওয়া। স্পষ্টতই বোঝা গেল যে ভিকটর ফিরে এসেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে দুজনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কিনা এবং হলে তাদের কাছ থেকে সে কোনো তথ্য সংগ্রহ করেছে কি না এটাই তিনি ভাবতে লাগলেন। ঘরের মধ্যে চা-এর সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখার সময় সম্ভবত ছবিটিকে সে দেখতে পায–সম্ভবত নয়, নিশ্চয়। পর্দাটাকেও সে ঠিক করে রাখেনি। ফলে দেওয়ালের সামনের জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। হয়তো কোনো রাত্রিতে লোকটা খুঁড়ি দিয়ে ওপরে গিয়ে দরজাটা ভাঙার চেষ্টা করবে। ঘরের ভেতরে গুপ্তচর। রাখাটা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। তিনি এমন কিছু ধনী মানুষদের কথা শুনেছেন যাদের বাড়ির চাকর চিরকাল তাঁদের ব্ল্যাকমেইল করেছে, কারণ তাঁদের কোনো গোপন চিঠি তারা পড়ে। ফেলেছিল, অথবা, মনিবের কিছু কথা তারা আড়ি পেতে শুনেছিল, অথবা ঠিকানা লেখা কোনো কার্ড তাদের হাতে পড়েছিল, অথবা বালিশের তলায় পাক বাঁধা কোনো চুলের ফিতে আবিষ্কার করে ফেলেছিল। এই জন্যে চাকরদের অনেক ঘুষ খাওয়াতে হয়েছে তাঁদের। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। তারপরে চা ঢেলে লর্ড হেনরির চিঠিটা খুললেন। চিঠিতে কেবল লেখা ছিল যে সন্ধ্যার কাগজটা তিনি পাঠিয়ে দিলেন, সেই সঙ্গে পড়তে যদি ভালো লাগে এই আশায একখানি বই-ও পাঠালেন। তিনি যে তাঁর জন্যে ক্লাবে আটটা পনেরোতে অপেক্ষা করবেন সেকথা লিখতেও ভোলেননি তিনি। খবরের কাগজের পাতাগুলি উদাসীনভাবেই উলটোচ্ছিলেন তিনি; হঠাৎ পঞ্চম পৃষ্ঠার একটি কলামে লাল পেনসিলের দাগ কাটা থাকায় তাঁর কৌতহল কেমন বেড়ে গেল। তিনি সেটা পড়ে গেলেন।

“একটি অভিনেত্রীর মৃত্যুর সম্বন্ধে তদন্ত: হক্সটন রোডে বেল ট্রাভার্ণ-এ ডিস্ট্রিক্ট করোনার মিঃ ডানবি আজ সকালে সাইলি ভেন নাম্নী একটি যুবতী অভিনেত্রীর মৃত্যুর কারণ বার করার জন্যে অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। অভিনেত্রীটি হলবর্ন-এ রয়্যাল থিয়েটারে অভিনয় করতেন। নিছক একটা দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে যে তাঁর মৃত্যু হয়েছে এই মতই তিনি দিয়েছেন। মৃতার মা যখন সান্ধী দিতে এসেছিলেন তখন এই বিযোগের জন্যে অনেকেই তাঁর দুঃখে সহানুভুতি দেখান। ডঃ বিরেল ময়না তদন্ত করেন। তাঁর সাক্ষী দেওয়ার সময়েও শ্রোতারা গভীর দুঃখে ভেঙে পড়েন।”

লেখাটা পড়ে ভ্রুকুটি করলেন তিনি, কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে ডানালার কাছে এগিয়ে গেলেন, তারপরে জানালার বাইরে সেগুলি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। কী কুৎসিত! কী ভয়ঙ্কর রকমের। কদর্য! সংবাদটা তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে লর্ড হেনরির ওপরে তাঁর রাগ হল। তাছাড়া। সংবাদটার চারপাশে লাল পেনসিল দিয়ে দাগ কেটে দেওয়াটাও নেহাৎ বোকামো হয়েছে। ভিকটর নিশ্চয় তা পড়েছে। ওটা পড়ে বোঝার চেয়ে অনেক বেশি ইংরেজি সে জানে।

সম্ভবত সে ওটি পড়েছে এবং পড়ে কিছু সন্দেহ করতে শুরু করেছে। কিন্তু তাতেই বা কী আসে যায়? সাইভিল ভেনের মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর সমপর্ক কী? না, কোনো ভয় নেই। ডোরিয়েন গ্রে তাকে মারেননি।

লর্ড হেনরি যে হলদে বুইটা পাঠিয়েছেন। সেই বইটার ওপরে নজর পড়ল তাঁরা বস্তুটা কী? তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন। ধূসর বর্ণের ছোটো অষ্টভুজা দাঁড়ানো বই রাখার জায়গাটার দিকে তিনি এগিয়ে গেলেন। দেখে সব সময় তাঁর মনে হত ইজিপ্টের কোনো শ্রমশীল মিস্ত্রি ওটিকে তৈরি করেছেন। গ্রন্থটিকে তুলে নিয়ে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিলেন তিনি, তারপরে পড়ায় গেলেন ডুবো ওরকম অদ্ভুত বই জীবনে আর কখনো তিনি পড়েননি। তাঁর মনে হল বাঁশীর মিষ্টি সুরের সঙ্গে তাল দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত পাপ নির্বাকভাবে নাচতে নাচতে তাঁর সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে জিনিসগুলি তিনি কল্পনায় দেখতেন সেগুলি যেন হঠাৎ রূপ পরিগ্রহ করে তাঁর সামনে উপস্থিত হল। যে জিনিসটা কোনোদিন তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি সেই জিনিস ধীরে ধীরে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করল।

ওটি একটি উপন্যাস কিন্তু প্লট বলে কিছু ওর নেই। চরিত্র বলতে একটিই–সেটি হচ্ছে প্যারিসের একটি যুবকের। ওটিকে একটি মনস্তত্ত্বমূলক গ্রন্থ বললেই বোধ হয় ঠিক বলা হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই যুবকটি একমাত্র তার নিজের যুগ ছাড়া অন্য সমস্ত যুগের ভাবধারা অনুধাবন করার চেষ্টা করেছিল। অর্থাৎ সেই সব কৃত্রিম আত্মত্যাগ যেগুলিকে মানুষ চিরকাল পুণ্য বলে ভুল করেছে অথবা মানুষের সেই সব স্বাভাবিক বিদ্রোহ যাদের মানুষ অবিবেচকের মতো পাপ বলে প্রচার করেছেন সেইগুলি আসলে কী তাই নিয়ে সে সারাজীবনটা গবেষণা। করেছিল। ভাষাটি মুক্তোর ঝালরের মতো তা প্রাচীন ব্যঞ্জনা আর আঙ্গিকে খোদাই করা। মাঝে-মাঝে বিশেষ অর্থে বিশেষ শব্দ প্রয়োগের চেষ্টা বেশ স্পষ্ট। সেই সঙ্গে রয়েছে বিশদ ব্যাখ্যা। জগতের শ্রেষ্ঠ লেখকরা বিশেষ করে ফ্রান্সে যাঁদের সিম্বোলিস্ট বলা হয়, এই জাতীয় দুর্বোধ্য রচনার ভেতর দিয়েই স্বীকৃতি লাভ করেছেন। অতীন্দ্রিয় দর্শনের মধ্যে দিয়ে রক্তমাংসের প্রবৃত্তিগুলিকে প্রকাশ করার চেষ্টা হয়েছে এখানে। পাঠক বুঝতে পারে না সে। মধ্যযুগের কোনো সাধুর আধ্যাত্মিক কোনো বক্তৃতা পড়ছে, না আধুনিক কোনো রুগ্ন পাপীর স্বীকারোক্তি পড়ছে। গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে বিষাক্ত ঘরের মধ্যে ধূপের ভারী গন্ধ বইটির পাতার। মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর চিন্তাধারাটিকে কিছুটা বিপর্যস্ত করে তুলেছিলা ভাষার ছন্দ আর বর্ণনার ঝঙ্কার তাঁর মনে এমন একটি সুর ভাগিয়ে তুলেছিল যে তিনি সব ভুলে একটি পরিচ্ছেদের পর আর একটি পরিচ্ছেদ অবলীলাক্রমে পড়ে যেতে লাগলেন।

মেঘমুক্ত আকাশ থেকে ধীরে-ধীরে অন্ধকার নেমে এল, জানালার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করল ঘরের মধ্যে সেই অস্পষ্ট আলোতে তিনি আরো কিছুক্ষণ পড়তে চেষ্টা করলেন; শেষ পর্যন্ত আর পারলেন না। এর মধ্যে তাঁর চাকরটি বারবার এসে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে সচেতন করে দিয়ে গিয়েছে। শেষকালে একসময় তিনি উঠে পড়লেন এবং বইটি তাঁর শোওয়ার ঘরে রেখে ডিনারের জন্যে তৈরি হলেন।

ক্লাবে গিয়ে পৌঁছতে তাঁর প্রায় রাত নটা বেজে গেল। তিনি দেখলেন লর্ড হেনরি যথারীতি সেখানে বসে রয়েছে। মুখে তাঁর বেজারের চিহ্ন।

তিনি বললেন: দেরি হওয়ার জন্যে আমি সত্যিই বড়ো দুঃখিত, হেনরি। কিন্তু তুমি যে বইটা আমাকে পাঠিয়েছ সেটি পড়তে গিয়ে আমি কেমন যেন মশগুল হয়ে পড়েছিলাম। সময়ের জ্ঞান আমার ছিল না।

চেয়ার থেকে উঠে লর্ড হেনরি বললেন: আমি জানতাম, বইটি তোমার ভালো লাগবে।

ভালো লেগেছে সেকথা আমি বলিনি, হ্যারি; বলেছি আমাকে বইটি একেবারে অভিভূত করে তুলেছিল। দুটি কথার মধ্যে প্রভেদ রয়েছে।

দুজনে ডাইনিং রুমের দিকে যেতে-যেতে লর্ড হেনরি বললেন: তাই বুঝি! তুমি তাহলে তফাৎটা বুঝতে পেরেছ?

.

একাদশ পরিচ্ছেদ

তারপরে দীর্ঘ কয়েকটি বছর বইটির প্রভাব থেকে ডোরিয়েন গ্রে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি; নিজেকে মুক্ত করতে চাননি বললেই হয়তো কথাটা ঠিক বলা হবে। বইটির প্রথম সংস্করণের বড়ো-বড়ো প্রায় নটি কাগজের মোড়াই কপি তিনি প্যারিস থেকে আনলেন বিভিন্ন রঙের কভার দিয়ে সেগুলিকে বাঁধালেন। যে-সব বাসনা-কামনার হাতে নিজেকে তিনি বন্দী করে ফেলেছিলেন, বিভিন্ন ঋতুতে তাদেরই খুশি করার জন্যে তাঁর এই প্রচেষ্টা তাঁকে বেশ কিছুদিন একেবারে মশগুল করে রেখেছিল। প্যারিসের অধিবাসী সেই নায়কের রোমান্টিক এবং বৈজ্ঞানিক ভাবধারার মধ্যে তিনি তাঁর নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, তাঁর জন্মের অনেক আগে থাকতেই তাঁরই জীবনের কাহিনি নিয়ে কে যেন উপন্যাসটি রচনা করে গিয়েছেন।

উপন্যাসের সেই অদ্ভুত নায়কের চেয়ে একদিন থেকে তিনি বেশি ভাগ্যবান ছিলেন। আয়না, পালিশকরা চকচকে ধাতব জিনিস, অথবা শান্ত পরিষ্কার ভল খুব অল্প বয়স থেকেই ওই নায়কের মনে কেমন একটা অদ্ভুত ভীতির সৃষ্টি করেছিল। তাঁর দেহের সৌন্দর্য হঠাৎ নষ্ট হয়ে যাওয়াটাই এই ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এসব দিক থেকে ডোরিয়েন নির্ভয। দিলেন। বইটির শেষ দিকের অংশটি তিনি একটা নির্দয় আনন্দের সঙ্গে পড়তেন–সম্ভবত, প্রতিটি আনন্দে আর আমোদ-প্রমোদের মধ্যেই কিছু-না-কিছু নির্মমতা রয়েছে; অথচ, কিছুটা আতিশয্য থাকা সত্ত্বেও, এই অংশটিই সত্যিকার বড়ো করুণ। এইখানেই নায়ক একটি। অবশ্যম্ভাবী বস্তুর সত্যের সামনা-সামনি এসে পড়েছেন সেই সত্যটি হচ্ছে সৌন্দর্যের মৃত্যু। বিশ্বের সকলেই যে বস্তুটিকে সবচেয়ে মূল্যবান বলে মনে করে সেই বস্তুটিই তিনি যে। দিন-দিন হারিয়ে ফেলছেন এই নিষ্ঠুর সত্যটা নায়ককে নৈরাশ্যের অন্ধকারে দিশেহারা করে তুলেছে।

কারণ, যে অপরূপ সৌন্দর্য বেসিল হলোয়ার্ড এবং অনেক মানুষকেই মুগ্ধ করেছিল সেই সৌন্দর্য তাঁর অটুট ছিল। কুৎসাই বলুন অথবা ফিসফিসানিই বলুন, লন্ডন শহরে, ক্লাবে, বারে তাঁকে নিয়ে যারা দিনরাত মুকরোচক আলোচনা করত, তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র সেই সব মানুষরা সব ভুলে যেত; তারা ভাবতেই পারত না যে এমন একটি অপরুপ মানুষ কোনোরকম নিন্দনীয় কাজ করতে পারেন। তাঁর চেহারা দেখলে মনে হত তিনি একটি নিষ্পাপ কুসুম ছাড়া আর কিছু নন। কালিমার কোনো ছাপই তাঁর মুখের ওপরে পড়েনি। বরং একটা পবিত্রতার ছায়া তাঁর মুখটিকে স্নিগ্ধ করে রেখেছিল। সেই দেখেই কুৎসা রটনাকারীরা লজ্জিত হত, কেমন করে ওই রকম অপরূপ চেহারার একটি যুবক পৃথিবীর হাজার ক্লেদাক্ত পরিবেশ থেকে মুক্ত থাকতে পারে একথা ভেবেই তারা অবাক হয়ে যেত।

মাঝে-মাঝে অনেক দিন ধরে শহর থেকে টানা তিনি অনুপস্থিত থাকতেন। কোথায় যেতেন, কী করতেন সে-বিষয়ে কেউ কিছু জানত না। ওই নিয়ে নানান লোকে নানান গুজব ছড়াত, বিশেষ করে তাঁর বন্ধু আর বান্ধবীরা। তারপর হঠাৎ একদিন তিনি ফিরে আইসতেন, প্রায়। নিঃশব্দে ওপরে উঠে দরজার চাবি খুলতেন। তারপরে একটা আয়না নিয়ে তিনি বেসিলের আঁকা সেই প্রতিকৃতিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। প্রতিকৃতিটির মুখের ওপরে পাপের যে ক্লেদাক্ত চিহ্নগুলি ফুটে উঠেছে, একবার তিনি সেইগুলির দিকে তাকিয়ে দেখতেন, একবার দেখতেন আনার মধ্যে প্রতিফলিত নিপাপ সুন্দর তার নিজের মুখটাকে দেখে হাসতেন। দুটির মধ্যে তীব্র পার্থক্য তাঁর আনন্দ বাড়িয়ে দিত। ক্রমশ তিনি যেমন নিজের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে পড়লেন, তেমনি আগ্রহী হলেন নিজের আত্মার অধঃপতনে। পাপের এবং বয়সের যে ছাপগুলি প্রতিকৃতিটির কুঞ্চিত কপালের ওপরে বীভৎস হয়ে ফুটে উঠেছিল, বিকৃত করেছিল মুখের আদলটিকে সেইগুলি তিনি বেশ খুঁটিযে-খুঁটিয়ে দেখতেন, দেখে মাঝে-মাঝে একটা পাশবিক আনন্দে তাঁর মন নেচে উঠত। ছবিটির খসখসে মোটা হাতের পাশে নিজের পরিচ্ছন্ন হাত রেখে তিনি হাসতেন। সেই বিকৃত দেহ এবং বিবশ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখে বিদ্রূপ করতেন তিনি।

রাত্রিতে মাঝে-মাঝে তাঁর ঘরে সুন্দর বিছানায় যখন তিনি একা শুয়ে থাকতেন অথবা ডকের পাশে নোংরা ছোটো বস্তীর ঘরে নিজের নাম ভাঁড়িয়ে এবং গোপনে যখন তিনি রাত্রিবাস করতেন, প্রায়ই বেশ্যালয়ে যাওয়াটা যখন তাঁর কেমন একটা অভাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তখন মাঝে-মাঝে আত্মার অধঃপতনে তাঁর কেমন যেন একটা দুঃখ হত; এই দুঃখে তাঁর একান্ত ব্যাক্তিগত বলেই তা এত তিক্ত। কিন্তু এ রকম চিন্তাও তাঁর মনে খুব একটা বেশি আসত না। বেসিলের বাগানে বসে লর্ড হেনরি তাঁর মলে জীবনের যে কৌতূহল । ভাগিয়ে তুলেছিলেন সেই কৌতূহলই তাঁর বাড়তে লাগল আর সেই কৌতূহল যত তাঁর মিটতে লাগল ততই তিনি খুশি হতে লাগলেন। যতই তিনি জানতে লাগলেল ততই তাঁর জানার আগ্রহ বাড়তে লাগল। সেই বাসনার পূর্তির সঙ্গে-সঙ্গে নতুন বাসনা দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল।

কিন্তু তবু সত্যি কথা বলতে কি সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার দিক থেকে তিনি মোটেই উদাসীন ছিলেন না। শীতকালে মাসে দু’বার কি একবার এবং বুধবার সন্ধ্যার সময় বাড়িতে তাঁর গানের জলসা বসত; সেই জলসাঘ কেবল বিদগ্ধ মানুষদেরই তিনি আপ্যায়িত করতে না, সে-যুগের বিখ্যাত এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ সঙ্গীতকারদেরও নিমন্ত্রণ জানাতেন; তাঁরা তাঁদের সঙ্গীতে শ্রোতুবর্ণকে মুগ্ধ করতেন। মাঝে-মাঝে তিনি ছোটোছোটো ভোজ দিতেন। এই কাজে লর্ড হেনরি অবশ্য সব সময়েই তাঁকে সাহায্য করতেন। এখানেও সেই একই ব্যাপার। নিমন্ত্রিত থেকে শুরু করে খাবার টেবিল, ঘর সাজানো এবং খাদ্যের তালিকা প্রস্তুতিতে তিনি যথেষ্ট সুরুচি এবং শিল্পকলার পরিচয় দিতেন। সেই নিমন্ত্রিতদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন বিশেষ করে যুবক সম্প্রদায় তাঁর মধ্যে ইটন অথবা অক্সফোর্ডের আভিজাত্য খুঁজে পেতেন।

এবং একথা বললে অযৌক্তিক হবে না যে জীবনটাই তাঁর কাছে ছিল প্রথম আর শ্রেষ্ঠ-সকল কলার শ্রেষ্ঠ কলা; অন্য সমস্ত কলা সেই জীবনকে পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করার প্রস্তুতি মাত্রা সত্যিকার আজগুবি জিনিস ফ্যাশানের মাধ্যমেই সর্বজনীন হয়ে দাঁড়ায়; আধুনিক সৌন্দর্যকে জোর করে জাহির করাকেই বলা হয় বাবুগিরি। এই দুটি জিনিসই তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল। তাঁর পোশাকের গঠন এবং পোশাক পরার রীতিটি তখনকার “মেফেযার বল” এবং “পল মল” ক্লাবের যুবক সম্প্রদায়ের মনে বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। তারা সবাই তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ, চলন-বলন অনুকরণ করার ব্যর্থ চেষ্টায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াত।

জনসাধারণের দেওয়া এই সম্মান তিনি গ্রহণ করেছিলেন। লন্ডনের বিভিন্ন ক্লাবে তিনি যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন এই ভেবে তিনি বেশ আনন্দ পেতেন। জীবনের সম্বন্ধে তিনি কিছু নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছিলেন, প্রচার করেছিলেন কিছু নতুন নীতি এবং এদেরই মাধ্যমে পূর্ণ সম্ভোগের প্রযোভনে কী করে প্রবৃত্তিগুলিকে আধ্যাত্মিকতার পথে। পরিচালিত করা যায় সে পথও বাতলে দেওয়ার চেষ্টা তিনি করেছিলেন।

প্রায় এবং ন্যায়তভাবেই প্রবৃত্তির পূজাকে মানুষ প্রশ্রয় দেয়নি; কারণ, ভোগলালসা মানুষকে তার দাসে পরিণত করে, খর্ব করে তাদের ব্যক্তিত্বকে। এরই জন্যে তার ওপরে মানুষের একটা ভীতি জন্মেছে। তাছাড়া, তারা মনে করে অশঙুল সামাজিক জীবনযাপনের পথে এই ভোগলালসা বিপজ্জনক একটা অন্তরাযের সৃষ্টি করে। কিন্তু ডোরিয়েনের মতে প্রবৃত্তির আসল রূপ আর চরিত্র বলতে ঠিক কী বোঝায় তা অনেকেই জানে না। অভুক্ত রেখে পৃথিবী মানুষকে তার দাস করতে চায় বলেই সে চিরকালই বন্য পশুই রয়ে গেল; তার মনে আধ্যাত্মিক। জ্ঞানের আলো না জ্বালিয়ে, সৌন্দর্য উপভোগ করাটাই যে মানুষের শ্রেষ্ঠ আকাঙ্খা হওয়া উচিত এই শিক্কা না দিয়ে পৃথিবী তাকে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করতে চায় বলেই না তার পাশবিক প্রবৃত্তিটা এত প্রবল হয়ে উঠেছে। মানুষের ইতিহাস আলোচনা করে তিনি ক্ষতির অনুভূতিতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কত অর্থহীন ক্ষুদ্র উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে কত বড়ো জিনিসই না মানুষকে পরিত্যাগ করতে হয়েছে। ইচ্ছা করে মানুষ উন্মাদের মতো অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে, অনেক নির্যাতন করেছে নিজেকে; তাদের মধ্যে সুস্থ কোনো জীবনবেদ অথবা বোধ নেই যে-সব কাজ করলে তার অধঃপতন ঘটতে পারে বলে সে মনে করে তার চেয়ে অনেক বড়ো অধঃপতনকে সে মনে নিয়েছে জীবনের এই নেতিবাচক উপলব্ধিতো যে অজ্ঞতাকে সে এড়াতে চেয়েছে ভীবলের বিরাট ভাঁওতাকে পাকে-প্রকারে তাকে সেই অজ্ঞতার কুপে লিপে করেছে। যারা ঘরে থাকতে চায় প্রকৃতি তাদের পাঠিয়েছে মরুভূমিতে–সেইখানে তারা বন্য ভক্তদের সঙ্গে বাস করেছে; আবার সঙ্গীর অভাব পূর্ণ করার জন্যে ঋষির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে বন্য প্রাণীদের। একে প্রকৃতির এক নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কী বলা যায়?

হ্যাঁ, পূর্ণ উপভোগরে জন্যে, লর্ড হেনরিও সেই রকমই আশা করেন, জীবনটাকে নতুনভাবে। ঢেলে সাজাতে হবে: সেই নির্মম, অশোভনীয় কৃচ্ছসাধনা, আধুনিক যুগে যে আবার মানুষের সমাজে কাযেমী হয়ে বসেছে, তাকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। বোধের দিক থেকে, যুক্তিবাদের দিক থেকে এর প্রয়োজনীয়তা কিছুটা স্বীকৃতি পেলেও, এমন কোনো নীতি মানুষের থাকা। উচিত নয যা তার স্বাভাবিক কামানাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে অভিজ্ঞতা সঞ্চয; সেই সঞ্চযের ফল ভালো কি মন্দ তা যাচাই করা নয়। কৃচ্ছসাধন মানুষের প্রবৃত্তিগুলিকে বিনষ্ট করে বলেই, অথবা ব্যভিচার মানুষের সূক্ষম অনুভূতিগুলিকে ভোঁতা। করে দেয় বলেই, ওই দুটি জিনিসকেই মানুষের সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করা উচিত। জীবন নশ্বর-মহাকালের একটি মুহূর্ত। সত্যিকার সুস্থ জীবনবোধের নীতি হবে এই সহজ কথাটা তাকে জানিয়ে দেওয়া। দান্তের মতে সৌন্দর্যের পূজা করে যাঁরা পূর্ণতা অর্জন করেছেন তিনি। নিজেকে জনসাধারণের কাছে সেইভাবে আত্মপ্রকাশ করলেন। গযতিয়ারের মতো দৃশ্যমান ডগৎটিকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি।

আমাদের মধ্যে এমন কেউ-কেউ রয়েছেন যাঁরা প্রভাতের আগে ভাগে না। জানে না যে তার কারণ হচ্ছে হয় তাঁরা স্বপ্নহীন অবস্থায় সারা রাত মরার মতো ঘুমোন, অথবা সারা রাতই তাঁরা ভীতির আতঙ্ক মাঝে-মাঝে আঁতকে ওঠেন, বিকৃত আনন্দে মুষড়ে থাকেন। এই সময়ে তাঁদের মাথার মধ্যে বাস্তবের চেয়ে অনেক বিপজ্জনক ভৌতিক যারা ঘুরে বেড়ায়, প্রবৃত্তিগুলি সারা রাত ধরে তৈরি করে কল্পনার মিনার। দিবাস্বপ্ন দেখার লেশা যাঁদের ব্রেয়েছে তাঁদেরই মন এইভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে। সাদা আঙুলগুলি ধীরে-ধীরে মশারির ভেতর দিয়ে নড়তে থাকে; ভয়ে-আশঙ্কায় কাঁপতে থাকেন তাঁরা। কিম্ভুতকিমাকার কালো কালো চেহারার ছায়াগুলি ঘরের এক কোণে গুঁড়ি দিয়ে ঢেকে, চুপচাপ বসে অপেক্ষা করে। বাইরে তখন পাখির কাকলি জেগে ওঠে, মানুষ কাজকর্ম শুরু করে, পাহাড়ের গা বেয়ে মৃদু বাতাসের তরঙ্গে কার যেন ফোঁপানির শব্দ শোন যায়; নিস্তব্ধ ঘরটির চারপাশে তারা ঘুরে বেড়ায়; যেন ঘুমন্ত মানুষটিকে জাগিয়ে দিতে তারা ভয় পাচ্ছে। তবু তাকে ভাগাতেই হবে। কর্মমুখর জগতে আর বেশিক্ষণ তাদের ঘুমিয়ে থাকাটা ভালো দেখায় না। ধীরে-ধীরে চারপাশের কুয়াশা কেটে যায়, রাত্রির অন্ধকার কেটে গিয়ে জেগে ওঠে প্রকৃতি প্রাচীন ঢঙে পৃথিবীটাকে আমরা চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। নিষ্প্রভ আয়নার বুকে জীবনের প্রতিবিম্ব ফুটে বেরোয়। নিবে-যাওয়া বাতিগুলি যে জায়গায় আমরা রেখেছিলেন ঠিক সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে। রয়েছে। তাদের পাশে অনাদরে খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে বই। ঘুমিয়ে পড়ার আগে এই বই হয়তো তাঁরা পড়ছিলেন। রাত্রির আসরে যে ফুলগুলি নিয়ে আমরা আনন্দ করেছিলেম সেই ফুলগুলি শুকিয়ে গিয়েছে, যে চিঠি আমরা পড়তে ভয় পাই অথবা অনেকবার পড়েছি সেটি হয়তো বিছানার ওপরে পড়ে রয়েছে। রাত্রির অবাস্তব ছায়ার মধ্যে থেকে আমাদের পরিচিত ডদগংটি ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। যেখান থেকে আমরা চলে এসেছিলেম আবার সেখান থেকে শুরু করি। আবার আগের মতোই গতানুগতিকভাবে দৈনন্দিন জীবন আমাদের যাপন করতে হবে এই অনস্বীকার্য সত্যটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় অথবা আমরা এই ভেবে চোখ খুলি যে নতুন একটি পৃথিবী নতুন আশা নিয়ে আমার কাছে প্রতিভাত হবে অথবা । আমাদের আনন্দের জলেই সেই পুরনো আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি নতুন রঙে সাজিয়ে তুলবে নিজেদের।

এই রকম একটি জগৎই ডোরিয়েনের কাছে সত্য ছিল অথবা জীবনে যা-যা আমরা পেতে চাই তাদের মধ্যে ছিল একটি এবং এই নতুল অথচ মেজাজি অনুভূতির সন্ধালে তিনি এমন কয়েকটি চিন্তার আশ্রয় নিলেন যেগুলি তাঁর কাছে একেবারে অপরিচিত ছিল। তিনি তা ডানতেনও কিন্তু তাদের প্রভাবের মধ্যে তিনি নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপরে কৌতূহল চরিতার্থ হওয়ার পরে তিনি সেগুলিকে চরম ঔদাসীন্যে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। মানসিক অবস্থার দিক থেকে এইটাই ছিল তাঁর মতো চরিত্রের মানুষের কাছে একমাত্র স্বাভাবিক জিনিস; অন্তত কিছু আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদেরা সেই কথাই বলেন।

একবার গুজব রটে গেল যে তিনি রোমান ক্যাথলিক প্রার্থনায় আসা-যাওয়া করছেন। সত্যি কথা বলতে কি রোমান ক্যাথলিক ধর্মীয় রীতিনীতিগুলি তাঁকে যথেষ্ট আকর্ষণ করেছিল। কেন? কারণ একানকার ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিতে প্রতিদিন যে আহুতি দেওয়া হত, প্রাচীন যুগের সমস্ত নির্মম বলিদানের চেয়েও ত কঠোর; তাছাড়া, এখানে যাতায়াত করার পেছনে আরো । একটা উদ্দেশ্য তাঁর ছিল। সেটাই হচ্ছে, মানুষের জীবনের যে অনন্তু ট্রাজিডি প্রকাশ করার জন্যে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে–এখানে তার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। এখানে গিয়ে তিনি মার্বেলে বাঁধাই মেঝের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে ভালোবাসতেন; ভালোবাসতেন পাদরীদের ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করতে ফুলের নক্সা কড়া ইস্ত্রিকরা ঢিলে জামা পরে পাদরী তাঁর সাদা হাত নেডে-নেডে মন্দিরের পর্দার পাশে ঘুরে বেড়ান; মাঝে-মাঝে। যিশুকে উদ্দেশ্য করে নিজের পাপের ভলো নিজের বুকের ওপরে তিনি আঘাত করেন–এই সব দেখতে তিনি ভালোবাসতেন। গির্জা থেকে বেরিয়ে আসার সময় কখনো বা কালো পোশাক পরা মানুষদের অবাক হয়ে তিনি দেখতেন, কখনো-কখনো ছায়াছন্ন জায়গায় তাদেরই পাশে বসে তাদের জীবনের অসংলগ্ন টুকরো টুকরো কাহিনি শুনতেন।

কিন্তু কোনো বিশেষ নীতি অথবা রীতির পরিপোষক হয়ে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে নষ্ট করার মতো ভুল তিনি করতেন না। নিজের বাড়িটিকে কিছুতেই তিনি দু’দণ্ডের পান্থশালা বলে ভাবতে পারতেন না; অতি সাধারণ বস্তুকে আমাদের কাছে অদ্ভুতভাবে প্রকাশ করার। পরমাশ্চর্য ক্ষমতা অতীন্দ্রিয়বাদরে রয়েছে। কিছুদিনের জন্যে তিনি এর কবলে পড়েছিলেন; আবার কখনো-কখনো বা ডারউইনের বস্তুতান্ত্রিক নীতির পরিপোষক হয়ে মানুষের চিন্তা আর উচ্ছ্বাসের মধ্যে একটা অপরূপ সামঞ্জস্য খুঁজে বার করার চেষ্টায় তিনি মশগুল হয়ে থাকতেন। তবু যে কথা আগেই বলেছি, কোনো বিশেষ নীতিকেই তিনি বাস্তব জীবনের চেয়ে বড়ো করে দেখতে চাইতেন না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাইরে মানুষের সমস্ত ধীশক্তি যে কতটা মূল্যহীন তা তিনি বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি জানতেন আধ্যাত্মিক রহস্য উন্মোচনের ব্যাপারে আত্মার চেয়ে প্রবৃত্তির অবদান কম নেই।

আর সেই জন্যেই তিনি সুগন্ধী জিনিসের প্রকৃতি আর গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করতেন। এই গবেষণার ফলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মনের এমন কোনো অনুভূতি নেই আত্মিক জীবনের অনুভূতির সঙ্গে যার অমিল রয়েছে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনি তাদের আসল রূপটি খুঁজে বার করার চেষ্টা করতেন; বার করার চেষ্টা করতেন কেন বিশেষ একটি উপাদান আমাদের কাছে বিশেষ একটি ভাবের প্রতীক হয়ে দেখা দেয়।

অন্য সময় নিজেকে তিনি গানের জলসার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ডুবিয়ে দিতেন। লম্বা জাফরি টানা ঘরের মধ্যে মাঝে-মাঝে তিনি অদ্ভুত ধরনের কনসার্ট-এর আয়োজন করতেন। এই ঘরের ভেতরে ছাদটির রঙ সোনালি দেওয়ালগুলি অলিভ-সবুজ বানিশ করা। এখানে বসে। উন্মত্ত ডিজপসিরা ছোটো-ছোটো তারের যন্ত্রে উদ্দাম ঝংকার তুলে গান করত, আবার কখনো। বা সবুজ শাল জড়িয়ে গম্ভীর মেজাজের টিউনিশিযান গাযকরা বিরাট বীণাযন্ত্রের কালে মোচড দিয়ে গান গাইত; সেই সঙ্গে নিগ্রোরা দাঁতে দাঁত চিপে তামার ঢাকের ওপরে একটানা কাঠি পিটিয়ে যেত, আর ঘন লাল মাদুরের ওপরে হাঁটু মুড়ে বসে মাথায় পাগড়ি বেঁধে রোগাটে ইডিমানরা পেতল অথবা শরকাঠির তৈরি লম্বা সানাই ফুকত; মনে হত বিরাট ফণাওয়ালা সাপও যেন তাদের সেই গান শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত। সেই অনার্য সঙ্গীতের রুক্ষ বিরতি আর কর্কশ অসঙ্গতি মাঝে-মা মন বিরক্তিতে ভরিয়ে দিত; তখন স্কুবার্ট, চোপিন অথবা বিটোফেন-এর বিরাট সুর-সঙ্গতিও তাঁর কাছে নেহাৎ জলো বলে মনে হত। প্রাচীন অবলুপ্ত ভাতির কবরখানা থেকে অথবা পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে যে-সব জাতির সম্পর্ক তখনো একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাযনি তাদের কাছ থেকে অনেক অদ্ভুত-অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। সেই যন্ত্রগুলিকে বাজাতে বেশ ভালো লাগত তাঁরা বাযযা নিগ্রো ইনডিযানদের অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। এই যন্ত্রটির দিকে চোখ মেলে তাকালো কোনো অধিকার ওদের মহিলাদের ছিল না; এমন কি রীতিমতো উপবাস এবং বিশুদ্ধ না হয়ে ওখানকার যুবকরাও ওই বাদ্যযন্ত্রটি সপর্শ করতে পারত না; পেরুভিযা থেকে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন মাটির পাত্র যেগুলি থেকে পাখির কর্কশ কণ্ঠের স্বর শোনা যেত অথবা চিলিতে আলফনসো মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি যে ফুটের সুর শুনেছিলেন সেই ফুট সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। কুমড়োর খোলের মধ্যে ছোটো-ছোটো নুডি বোঝাই করে সেই খোলগুলিকে তিনি রঙ মাখিয়ে দিয়েছিলেন। এগুলি ছাড়া আরো কত রকমের যে অদ্ভুত আর অপরিচিত, অর্ধপরিচিত বাদ্যযন্ত্র তিনি সংগ্রহ করেছিলেন তাদের একটি নিখুঁত তালিকা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। মেকসিকো থেকে লম্বা ‘ক্ল্যারিন’, আমাজন থেকে কর্কশ ‘তুরে’, সাপের চামড়ায় মোড়া লম্বা সিলিন্ডারের মতো ঢাক–ইত্যাদি ইত্যাদি। এই বাদ্যযন্ত্রগুলির অদ্ভুত চরিত্র তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এই সব দেখে তাঁর কেমন যেন মনে হয়েছিল প্রকৃতির মতো। আর্টের উদগতেও দৈত্য-দানো, রাক্ষস-খোক্ত রয়েছে। তাদের স্বরও বেশ ভয়ঙ্কর। তবু কিছুদিনের মধ্যে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। সেই ক্লান্তি দূর করার জন্যে তিনি ছুটে যেতেন অপেরাতে; কখনো একা, আবার কখনো বা লর্ড হেনরির সঙ্গে। তানহাউসাররে নাটক দেখে কেমন যেন তন্ময় হয়ে যেতেন; সেই মহান নাটকের প্রস্তাবনায় নিজের জীবনের ট্র্যাজিডি দেখতে পেতেন।

একবার তিনি রত্ন আহরণে মনোযোগী হলেন, ফ্রান্সের অ্যাডমিরাল আনে দ্য ডায়যে যেমন তাঁর পোশাকে পাঁচশো ষাটটি রত্ন বসিয়েছিলেন সেই রকম একটা উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি একবার একটি নাচের পোশাক তৈরির কারখানায় হাজির হলেন। এই বাতিকটা তাঁকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলেছিল যে শেষ পর্যন্ত এটা থেকে মুক্তি পাননি তিনি। সারাদিন ধরে রত্নগুলিকে নানান ভাবে তিনি সাড়াতেন, গুছোতেন, খুলতেন, আবার বসাতেন; এগুলির মধ্যে ছিল অলিভ রঙের ক্রিসোবেরিল মণি; আলোর সামনে ধরলে এগুলি লাল হয়ে যায়; সিমোফেন; গোলাপ-রঙা বা মদের মতো হলুদ রঙের পোখরাজ; লাল টকটকে দারুচিনি পাথর; কমলা আর বেগনে রঙের সপাইনেল, সেই সঙ্গে ছিল নীলকান্ত আর পদ্মরাগ মণি। সানস্টোনের রক্তিমাভা, আর মুনস্টোনের মুক্তার মতো শ্বেত আভা অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি। আমস্টার্ডাম থেকে বিরাট মাপের তিনটি পান্না তিনি সংগ্রহ করেছিলেন।

এই রত্নগুলির সম্পর্কে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্পও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। অ্যালফেনসোর ‘ক্লেরিক্যালিস ডিসিপ্লিনা’তে একটি সাপের উল্লেখ রয়েছে। তার চোখের মণি দুটি সত্যিকারের মণি দিয়ে তৈরি; রঙ তার লালচে-কমলালেবুর মতো, ইমাথিয়া-বিজয়ী আলেকজান্দারের যে ব্রোমান্টিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে তাতে শোনা যায়, ডর্ডন উপত্যকায় এই ধরনের সাপ দেখা যায—’সত্যিকারের পাল্লা দিয়ে তাদের পিঠগুলি মোড়া’। ফিলোট্র্যাটাসের কাহিনি থেকে জানা যায় একরকমের ড্রাগন রয়েছে যাদের মাথায় সত্যিকারের হিরে বসানো রয়েছে। সোনালি অষ্কর আর লাল পোশাক দেখিযে এদের ঘুম পাড়িয়ে হত্যা করা হয়। প্রখ্যাত অপরসায়নবিদ পেরে দ্য বোনিফেস-এর মতে ওই হিরে মানুষকে অদৃশ্য করে দেয়; আর ভারতে অকীক নামে যে একরকম কঠিন আর মূল্যবান পাথর পাওয়া যায় তার সম্বন্ধে ভূয়সী প্রশংসা তিনি করেছেন। কর্নেলিয়ান নামে একরকম দামি পাথর রয়েছে যা মানুষের ক্রোধ নষ্ট করে, আর ঘুমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। হাসিনথ। সুরার মাদকতা নষ্ট করে পদ্মরাগ মণি। গারনেট জাতীয় মণি দৈত্য-দানোদের তাড়িয়ে দেয়, হাইড্রোপিকাসের ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যায় চাঁদ। চাঁদের তিথি অনুযায়ী সেলেনাইট পাথরের বাড়া-কমা চলো মেলোসিস নামে একরকমের পাথর রয়েছে চোর খুঁজে বার করার দুষ্কমতা যার অদ্ভুত বাচ্চাদের রক্ত গায়ে লাগলে এর গুণ নষ্ট হয়ে যায়। সদ্য নিহত একটা কোলাব্যাণ্ডের মাথার খুলি থেকে লিওনার্ডাস ক্যামিলা একটা দামি পাথর বার করতে দেখেছিলেন, বিষের ক্রিয়া প্রতিহত করার ক্ষেত্রে এর শক্তি যথেষ্ট। আরব দেশের হরিণের বুকের ভেতরে একভাতীয় পাথরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যার সম্পর্শেই প্লেগ সেরে যায় আরব দেশের পাখির বাসায় একরকমের পাথর রয়েছে, ডেমোক্রিটাসের মতে যা ধারণ করলে আগুন থেকে পোড়ার কোনো ভয় মানুষের থাকে না।

রাজ্যাভিষেকের সময় সিলেন-এর রাজা বড়ো একটা রুবি হাতে পরে শহরের মধ্যে দিয়ে ঘোড়ায় চেপে গিয়েছিলেন। ভন দি প্রিস্ট-এর প্রাসাদের তোরণ দুটি ছিল সার্ডিয়াস পাথরের তৈরি। কোনো মানুষ যাতে বিষ নিয়ে ভেতরে আসতে না পারে এই জন্যে তাদের গায়ে। শিংওয়ালা সাপের ছবি আঁকা রয়েছে। ঢালু ছাদ দিয়ে ঘেরা দেওয়ালের ওপরে ঝুলত দুটো সোনার আপেল, তাদের গায়ে বসানো ছিল দুটো পদ্মরাগ মণি। এর ফলে দিনের বেলায় চকচক করত সোলা; রাত্রিতে শোভা পেত নীলকান্ত মণি। এ মার্গারাইট অফ অ্যামেকি’ নামে লজ-এর একটি নামকরণ রোমান্টিক গ্রন্থে লেখা আছে যে রানির অন্তঃপুরে ক্রোসিলাইট, কারবাঙ্কালস প্রভৃতি যে সব মূল্যবান পাথর অথবা ধাতুর আয়না রয়েছে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলে পৃথিবীর সতী-সাবিত্রীদের দেখতে পাওয়া যায়। জিপাংপুর অধিবাসীরা মৃতদের মুখের মধ্যে গোলাপী রঙের মুক্তো খুঁজে দেয়। মার্কো পোলো তা দেখেছেন। একটি ডুবুরি একটা সামুদ্রিক দৈত্যের কাছ থেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে একটা মুক্তো সংগ্রহ করে রাজা। পেরোজকে দ্যে। সেই মুক্তো চুরি হয়ে গেলে রাজা চোরকে হত্যা করে সাতদিন শোক করেন। প্রোকোপিয়ান্সের কাহিনি থেকে বোঝা যায় হুনেরা সেই মুক্তো ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে রাজাকে ভুলিয়ে বিরাট একটা গর্তের সামনে নিয়ে আসে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সেই মুক্তোটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। সেইটাকে খুঁজে বার করার জন্যে সম্রাট আনাস-টেসিয়াস পাঁচশ সোনার মোহর পুরস্কার দেবেন বলে ঘোষণা করেন, কিন্তু সেটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মালাবারের রাজাকে একজন ভেনিসবাসী একটা মুক্তোর মালা দেখিয়েছিলেন। সেই মালাতে তিনশ চারটি মুক্তো ছিল। প্রতিটি মুক্তোর দেবতা ছিল একটি। রাজা সেই সব দেবতাদের পূজা করতেন।

ব্রাতোর মতে ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই-এর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় ষষ্ঠ আলেকজান্দারের পুত্র ডিউক দ্য ভ্যালেনটিন-এর ঘোড়ার পিঠ সোনার পাত দিয়ে মোড়া ছিল। তাঁর মাথার টুপিতে গাঁথা ছিল দু’আর রুবি। সেই রুবিগুলি থেকে আলোর রোশনাই ফুটে বেরোত। ইংলন্ডের চার্লস-এর ঘোড়ার পাদানি থেকে চারশ কুডিটা হিরে ঝুলত। তিরিশ হাজার মার্কস দামের দ্বিতীয় রিচার্ড-এর একটি কোট ছিল; তার চারধারে বসানো ছিল রুবি। রাড্যাভিষেকের পূর্বে টাওয়ারে যাওয়ার পথে অষ্ঠম হেনরি যে সোনার ঝালর দেওয়া, অসংখ্য হিরে আর দামি-দামি পাথরে চুমকি বসানো পোশাক পরেছিলেন সেকথা হল’ সাহেব আমাদের জানিয়েছেন। প্রথম জেমস-এর প্রিয়পাত্রেরা কানে সোনার তারের সঙ্গে পাল্লা। বসানো দুল পরতেন। দ্বিতীয় এডওয়ার্ড পিয়ারস গ্যাভেস্টোনকে টকটকে লাল সোনার তৈরি কিছু যুদ্ধাস্ত্র দান করেছিলেন। সেই অস্ত্রগুলির গায়ে নীলকান্ত মণি বসানো। দ্বিতীয় হেনরি কব্জি পর্যন্ত যে দস্তানা পরতেন তাতে বসানো থাকত দামি-দামি পাথর, তাঁর একটি বিশেষ রকমের দস্তানা ছিল যার সঙ্গে গাঁথা ছিল বারোটি রুবি আর বাহান্নটি বেশ দামি পাথর। বার্গেন্ডি বংশের শেষ ডিউক চার্লস দি ব্লাশ-এর টুপিতে গাঁথা ছিল নাশপাতির গড়নের মুক্তো; তার মধ্যে বসানো ছিল অনেকগুলি নীলকান্ত মণি।

সেযুগের জীবনযাত্রা কী অপরূপই না ছিল! কত প্রাচুর্য আর আড়ম্বরই না ছিল সে যুগে! এমন কি মৃতদের বিলাস-বৈভবের কাহিনি পড়তেও ভালো লাগে কত।

তারপরে তিনি সূচীশিল্পের দিকে ঝুঁকলেন। উত্তর ইওরোপ দেশগুলির ঠান্ডা ঘরের দেওয়ালে যে-সমস্ত প্রাচীরচিত্র আঁকা রয়েছে সেগুলি পর্যবেক্ষণ করার জন্যে তিনি উঠে পড়ে লাগলেন। গুণই বলুন আর অপগুণটি বলুন তাঁর চরিত্রের একটা অসামান্য বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে কোনো কিছু ধরার সঙ্গে-সঙ্গে সেটার একেবারে ভেতরে তিনি তলিয়ে যেতেন। সূচীশিল্পের মধ্যেও তিনি ঠিক তেমনিভাবেই ডুবে গেলেন। দেখলেন সেই অপরূপ প্রাচীরচিগুলিকে মহাকাল কী ভাবেই না নষ্ট করে দিয়েছে। দেখে মনে-মনে বেশ কষ্ট পেলেন তিনি। যে কোনোরকমেই হোক, তিনি কালের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। গ্রীষ্মের পর গ্রীষ্ম আসচ্ছে; ড্যাফোডিল ফুলগুলি ফুটছে আর বারবার শুকিয়ে যাচ্ছে। রাত্রির বিভীষিকা বারবার তার ঘৃণ্য কাহিনির পুনরাবৃত্তি করছে। কিন্তু তাঁর কোনো পরিবর্তন নেই। কোনো শীতই তাঁর মুখের আদল বিকৃত করতে পারেনি, স্নান করতে পারেনি তাঁর ফুলের মতো দেহ-লাবণ্যকে বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁর প্রার্থক্য কত! কোথায় তারা বিলীন হয়ে গিয়েছে? এথেনাকে খুশি করার জন্যে অল্পসীরা নব-বসন্তের রঙে ছুপিযে যে বিখ্যাত পোশাকটি তৈরি করেছিল, যার জন্যে দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল দেবতাদের–সেই পোশাকটা আজ কোথায়? সেই বিরাট ফিকে লাল নৌকার। পালটি কোথায়? রোমের কলোসিয়ামে নেরো এই পালটিকে বিছিয়ে রেখেছিলেন। এর গায়ে আঁকা ছিল তারকা খচিত আকাশ আর ছিল রথী অ্যাপোলোর ছবি, সোনালি লাগাম গলায় পরে সাতটি ঘোড়া সেই রথ টানছিল, সূর্যের খাবার টেবিলে পাতা সেই অদ্ভুত রুমালগুলি তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। এই টেবিলের ওপরে বিশ্বের সেরা রসালো খাবার পরিবেশন করা। হত। রাজা কিলপেরিকের শবাধারের ওপরে তিনশ সোনার মৌমাছি বসানো যে আচ্ছাদনটি সেইটাই বা আজ কোথায়? এই অদ্ভুত পোশাক দেখে পটান্সের বিশপ ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। এর ওপরে আঁকা ছিল সিংহ, মঘাল সাপ, ভালুক, কুকুর, অরণ্য, ছোটো-ছোটো পাহাড়া, শিকারি–এক কথায় চিত্রকর প্রকৃতির যা কিছু অনুকরণ করতে পারেন–সেগুলির সব ছবি। আর সেই কোট–যে কোট অরলিনস-এর চার্লস একবার পূরেছিলেন–যার হাতের ওপরে। সুন্দর একটি গান লেখা ছিল। শুদু গানই নয়, তার স্বরগ্রামও। প্রতিটি স্বরগ্রাম লেখা ছিল সোনালি সুতো দিয়ে–প্রতিটির ছেদের মধ্যে গাঁথা ছিল চারটি করে মুক্তা। রানি যোয়ান অফ বারগেনডির ব্যবহারের জন্য রিমস-এ যে প্রাসাদটি তৈরি হয়েছিল সেই প্রাসাদের একটি ঘরের কথা তিনি পড়লেন। সুতোয় বোনা তেরোশ একুশটা টিয়াপাখি দিয়ে এই ঘরটি সাজানো ছিল, সাজানো ছিল রাজার অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে, আর ছিল একুশটি প্রভাপতি তাদের প্রতিটি ডানায আঁকা ছিল রানির হাত; এই সৰ নকশাগুলি আগাগোড়া সোনা দিয়ে তৈরি। ক্যাথারিন দ্য মেডিসির কালো ভেলভেটের একটি শোকশয্যা ছিল, তার ওপরে আঁকা ছিল। অসংখ্য বাঁকা চাঁদ আর সূর্য বুটিদার কাপড় দিয়ে তৈরি ছিল এর মশারি। সোনা আর রুপোর জমির ওপরে লতা আর ফুলের মালা ছিল আকা; তাদের ধারে-ধারে বসানো ছিল মুক্তোর। চিকন। রানির রুচিমতো রুপোর ঝালরের ওপরে কালো ভেলভেটের সারি-সারি পর্দার মধ্যে বিছানাটি পাতা ছিল। চতুর্দশ লুই-এর ঘরে পনেরো ফুট উঁচু অনেকগুলি নারীমূর্তি ছিল। তাদের ওপরে ছিল সোনার কারুকার্য। পোলান্ডের রাজা সোবিয়েস্কির রাজকীয় শয্যাটি তৈরি হয়েছিল নীলকান্ত মণির নকশা দিয়ে সঙ্গে সুতো দিয়ে লেখা ছিল কোরানের বাণী। এর। পাগুলো ছিল রুপোর; পা-দানিগুলি হিরে দিয়ে মোড়া। এটা নিয়ে আসা হয়েছিল তুর্কীদের শিবির থেকে এর বিরাট মশারির ছাউনির নীচে মহম্মদের পতাকা ছিল আঁটা।

এইভাবে পুরো একটি বছর ধরে তনুজ আর সূচীশিল্প নিয়ে তিনি অনেক গবেষণা করলেন, সংগ্রহ করলেন অনেক প্রাচীন স্মারক চিহ্ন, দিল্লির সূষ্ক মসলিন থেকে ঢাকার সুচারু। ফিনফিনে বস্ত্র–প্রতীচ্যে যার নাম ছিল ‘বাতাসৰষন’ এবং সন্ধ্যার শিশিব’–অদ্ভুত ছবি আঁকা ভয়ভার কাপড় চিনদেশের বেগলে পর্দা, সিসিলির বুটি, স্পেনের ভেলভেট, সবুজ সোনার জাপানি ব্যন শিল্প আর চমৎকার পালকের পাখি

গির্জা সংক্রান্ত অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতোই ধর্মী সাজপোশাক সম্বন্ধেও তাঁর বিশেষ একটা আগ্রহ জন্মেছিল। তাঁর বাড়ির পশ্চিম দিকের গ্যালারিতে অনেকগুলি সিডার কাঠের বাক্স সারিবন্দিভাবে সাজান ছিল সেইখানে অনেক দুষ্প্রাপ্য আর সুন্দর প্রাচীন স্মারক চিহ্ন তিনি সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি ওগুলি ব্রাইড অফ ক্রায়েস্ট-এর। পোশাকের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর উপবাসসর্দিষ্ট শীর্ণ দেহ এবং স্ব-নির্বাচিত দুঃখ আর হস্কৃত যে দেহটিকে জর্জরিত করে ফেলেছিল সেই দেহটিকে ঢেকে রাখার জন্যে কালো আর সাদায় মেশানো লাল রঙের পোশাক পরার প্রয়োডনীয়তা ছিল তাঁর। শুধু তাই নয়; সেই পোশাকটি সূম বস্ত্র দিয়ে তৈরি এবং হীরামণিমুক্তা খচিত। পাদরীরা ধর্মীয় । শোভাযাত্রার সময় যে রকম ফিকে লাল সিল্ক আর গোলাপী রঙের সোনার সুতো দিয়ে কাড করা জমকালো ঢিলে জামা পরতেন সেই জাতীয় কিছু পোশাকও সংগ্রহশালায় তাঁর ছিল। সেই সব ঢিলে জামার ধারে-ধারে ভার্জিনের জীবন থেকে নেওয়া কিছু কিছু টুকরো ঘটনার ছবিও ছিল আঁকা। মাথার টুপিতে রঙিন সিল্ক দিয়ে আঁকা ভার্কিলের অভিষেকের ছবিটিও সুচারুরূপে আঁকা ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর একটি ইতালিয়ান ভাস্কর্য এটি। আর একটি ওই জাতীয় জামার ধারে সবুজ ভেলভেটের আঁকা অ্যাকানথাস পাতরা কয়েকটি ছবিও ছিল। এই সব পাতার বিশদ নকশা আঁকা হয়েছিল রুপালি সুতো আর রঙিন ক্রিমট্যাল দিয়ে লাল আর সোনালি সিল্কের সুতো দিয়ে ঢিলে জামাগুলি বোনা হয়েছিল; তাদের ওপরে আঁকা ছিল। অনেক সাধু-সন্তের ছবি। তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে সেন্ট সিবাসটিনেরপ্যাশন এবং ক্রায়েস্টের ক্রুশিফিকেশন-এর প্রতীক চিহ্ন হিসাবে তিনি যে ধর্মীয় পোশাকটি পরেছিলেন সেটি সবুজ রঙের সিল্ক দিয়ে তৈরি তার সঙ্গে মেশানো ছিল নীল সিন্ধ সোনার বটি গীত রঙের দামাস্কাস সিল্ক আর সোনার জাজিম। সেই সঙ্গে ছিল সিংহ, ময়ূর এবং অন্যান্য প্রতীক চিহ্ন।

এই সমস্ত এবং আরো অনেক অধুনা দুষ্প্রাপ্য রত্নগুলি তিনি যে সংগ্রহ করেছিলেন তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর নিজের মানসিক বিপর্যয় ভুলে যাওয়ার চেষ্টা। মাঝে-মাঝে যে। আতঙ্কটা তাঁর পক্ষে সহ্য করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াত সেই আতঙ্ক থেকে তাঁকে সাময়িকভাবে মুক্তি দিত ওই রত্নগুলি। তালাবন্ধ যে নির্জন ঘরটিতে তিনি তাঁর শৈশব কাটিয়েছিলেন সেই ঘরের দেওয়ালে নিজের হাতে তিনি সেই ভয়ানক প্রতিকৃতিটিকে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর জীবনের সত্যিকারের অধঃপতন পরিবর্তনশীল ওই প্রতিকৃতিটির ওপরেই প্রতিফলিত হত। এরই সামনে তিনি সেই সোনালি পর্দাটা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। পরপর কয়েকটি সপ্তাহ তিনি ও-ঘরে ঢুকতেন না। না ঢোকার ফলেই তিনি তাঁর সহড, আনন্দময় জীবনযাত্রায় ফিরে আসতেন। তারপরে হঠাৎ একদিন রাত্রিতে তিনি নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে “ব্লু গেট ফিলড”-এর কাছাকাছি সেই সব ভয়ানক পাড়ায় গিয়ে ঢুকতেন, বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতেন। ফিরে এসে তিনি সেই প্রতিকৃতিটির সামনে বসতেন; মাঝে-মাঝে ছবিটিকে তিনি নিজের মতোই ঘৃণা করতেন; অন্য সময়, ব্যক্তিত্বের গর্বে তাঁর বুক ফুলে উঠত, পাপের অর্ধেক মোহই বোধ হয় এই গর্বে। যে বিকৃতি তাঁকে সহ্য করতে হত সেই বিকৃতির সমস্ত জ্বালা আর যন্ত্রণা যে ওই প্রতিকৃতিটাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এই দেখে গোপনে আনন্দে তিনি হাসতেন।

কয়েক বছর পরে ইংলন্ডের বাইরে বেশি দিন থাকাটা তিনি সহ্য করতে পারলেন না। ত্রোভিল আর আলজিয়ার্সে লর্ড হেনরির সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা একসঙ্গে কয়েকবার শীতকালে বাস করেছিলেন। সেই দুটি বাড়ি তিনি ছেড়ে দিলেন। যে ছবিটি তাঁরই জীবনের একটি অঙ্গ তার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে হ্যাঁ ভালো। লাগত না। তাছাড়া, একটা কেমন ভয়ও ভন্মেছিল তাঁর মনে। যদিও দরজাটিকে সুরক্ষিত করার জন্যে তিনি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, দরজার গায়ে শক্ত মজবুত লোহার বেড়া দিয়েছিলেন, তবু তাঁর ভয় হচ্ছিল কেউ যদি তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে সেই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

একথা তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে ঘরে ঢুকেও কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। কথাটা সত্যি যে মুখের চেহারাটা কুৎসিত এবং কদাকার হওয়া সত্ত্বেও, ছবিটার ওপরে তাঁর। চেহারাটাই প্রতিফলিত হয়েছিল; কিন্তু ছবিটা দেখে কী বুঝবে তারা? কেউ তাঁকে এ নিয়ে বিরক্ত করার চেষ্টা করলে তিনি উপহাস করে তাদের উড়িয়ে দেবেন। তিনি এ ছবি আঁকেননি। সুতরাং সেটা কদাকার দেখালেই বা তাঁর কী? তাছাড়া সত্যি কথাটা বললেও কি তারা তাঁকে বিশ্বাস করবে?

তবু তিনি ভয় পেয়েছিলেন। নটিংহামশায়ারে তাঁর নিজস্ব প্রাসাদে সমগ্রোত্রীয় যুবকদের ভূরিভোজনে আপ্যায়িত করতে-করতে তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে যেতেন। তাঁর জীবনযাত্রার সেই অহেতুক উজ্জ্বলতা অথবা আড়ম্বর দেখে সবাই যখন অবাক হয়ে হ্যাঁ দিকে তাকিয়ে থাকত ঠিক সেই সময় হয়তো তিনি অতিথিদের পরিত্যাগ করে তাড়াতাড়ি শহর ছেড়ে বেরিয়ে আসতেন; তাঁর ভয় হত হয়তো বা কেউ দরজার তালা ভেঙে সেই ঘরে ঢুকে ছবিটি নিয়ে চম্পট দিয়েছে। কেউ যদি ওটিকে চুরি করে নিয়ে যায় তাহলে কী হবে? এই চিন্তা করার সঙ্গে তিনি ভয়ে হিম হয়ে যেতেন। তাহলে নিশ্চয় পৃথিবীর লোক তাঁর জীবনের গোপন রহস্যটি ডেনে যাবে। হয়তো তারা তাঁকে সন্দেহ করতে শুরুই করে দিয়েছে।

কারণ, তাঁকে অনেকেরই খুব ভালো লাগত–এই কথাটা সত্যি বলে ধরে নিলেও, তাঁকে অবিশ্বাস করত এমন মানুষের সংখ্যাও কম ছিল না। তাঁর জন্ম এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে ‘ওয়েস্ট এনড’ ক্লাবে প্রবেশাধিকার পাওয়ার পূর্ণ অধিকার তাঁর ছিল, সেখানে। একবার প্রায় তিনি ধাক্কা খেয়েছিলেন। শোনা যায় একবার তাঁর একটি বন্ধু ধূমপান করার জন্যে তাঁকে নিয়ে ‘চার্চচিল’ ঘরে ঢোকেন। তাঁদের ঢুকতে দেখেই বারউইক-এর ডিউক এবং আর একটি ভদ্রলোক হঠাৎ উঠে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। ব্যাপারটা তাঁর চোখ এড়ায়নি। পঁচিশ বছর অতিক্রম করার পরে তাঁর সম্বন্ধে অদ্ভুত-অদ্ভুত কাহিনি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। গুজব রটল হোয়াইট চ্যাপল-এর মতো দূরে একটা ভাটিখানায় কতকগুলি বিদেশি নাবিকের সঙ্গে মদ খেয়ে হুল্লোড় করতে তাঁকে দেখা গিয়েছে। গুজব রটল, চোর-ডাকাত আর মুদ্রা জালকারীদের সঙ্গে তাঁর নাকি দোস্তি রয়েছে এবং তাদের ব্যবসার গোপন রহস্য কী তা তিনি জানেন। শহর থেকে দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি তাঁর চরিত্রে কলঙ্কলেপন করেছিল; যখন তিনি ফিরে আসতেন তখন তাঁকে নিয়ে চারপাশে বেশ কানাঘুষা চলত, দেখা হলে তারা একটা অবজ্ঞার দৃষ্টি দিয়ে আড়চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে যেত। ভাবখানা এই যে তাঁর গোপন রহস্যটা বার তারা করবেই।

অবশ্য এই সব ঔদ্ধত্য আর পরিকল্পিত উপহাসকে তিনি গ্রাহ্য করতেন না; এবং অধিকাংশ লোকের মতে তাঁর সহজ চালচলন, তাঁর পরিচ্ছন্ন নিরপরাধ হাসি, তাঁর অনবদ্য শাশ্বত। যৌবন তাঁর সমস্ত কুৎসার উপযুক্ত জবাব বলে মনে হত। লোকের মুখে শোনা যেত যে যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তাঁরাও কিছুদিন তাঁর সঙ্গে মেলামেশার পরে তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন। যে সমস্ত মহিলারা তাঁকে পাগলের মতো পছন্দ করত এবং তাঁর সঙ্গে নিবিড়ভাবে মেশার জন্যে কোনো সামাজিক কুৎসাকেই গ্রাহ্য করেনি এবং সমস্ত রীতিনীতি বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেনি, কিছুদিন পরে ডোবিয়েন গ্রে তাদের ঘরে ঢুকলে তারাও আতঙ্ক কিম্বা অপমানে বিবর্ণ হয়ে যেত।

তবু এই চাপা কুৎসা অনেকের চোখে তাঁর অদ্ভুত এবং বিপজ্জনক আকর্ষণটিকে বাড়িয়ে তুলেছিল। প্রচুর সম্পদ তাঁর অর্থনৈতিক জীবনে কিছুট নিশ্চয়তা এনেছিল। সমাজ, অন্তত যাকে আমারা সভ্য সমাজ বলি, যাঁরা ধনী এবং সেই সঙ্গে অপরকে মুগ্ধ করার হস্কৃমতা যাঁদের রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা শুনতে খুব বেশি একটা রাজি নয়। স্বভাবতই সে মনে করে যে চালচলনটাই যে কোনো মানুষের কাছে তার নীতির চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। তার মতে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্ভ্রম তার একটা ভালো রাঁধুনি থাকার চেয়ে কম দামি। আর তা ছাড়া, মানুষকে খারাপ খানা আর খারাপ মদ খাওয়ানোর পরেও কাউকে সমাজে তিরস্কার করা যাবে না। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার সময় লর্ড হেনরি একবার বলেছিলেন অনেক ভালো গুণ থাকা সত্ত্বেও, মানুষ যদি নিমন্ত্রিতদের গরম খাবার দিতে না পারেন তাহলে তাঁর দোষ তুমার্য নয়। কারণ আর্টের নীতি আর সৎ সমাজের নীতি একই অন্তত তাই হওয়া উচিত। এর প্রযোজনীয় অঙ্গ হচ্ছে আদিকা যা কিছু আমরা করি তার মধ্যে চাই নিখুঁত আয়োজনের মর্যাদা; সেই সঙ্গে চাই একটা অবাস্তব আবহাওয়া। কপটতা, সৌন্দর্য আর বুদ্ধি যেগুলির দৌলতে রোমান্টিক নাটক আমাদের আনন্দে দেয়-এর মধ্যেও সেগুলি থাকা চাই। প্রবঞ্চনা কি এতই বিপজ্জনক? আমার মনে হয় তা নয়। আমাদের বহুমুখী ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করার এটা একটা আঙ্গিক মাত্র।

অন্তত ডোরিয়েন গ্রে-র মতবাদ সেই রকমই। যারা মানুষের অহং বোধকে সহজ, সাধারণ, শাশ্বত এবং একই ধাতু দিয়ে গঠিত মনে করে তাদের সেই অগভীর মনস্তত্ত্বর কথা ভেবে তিনি অবাক হয়ে যেতেন। তাঁর মনে হত মানুষ নিজের মধ্যেই বহু জীবন যাপন করে, তার অনুভূতির সীমা নেই-তার চিন্তাধারা অদ্ভুত, তার উচ্ছ্বাস বাঁধনহারা; তার দেহ মৃতের বিপজ্জনক রুগ্ন বীজাণু দিয়ে গড়া। দেশের বিভিন্ন ডানহীন শীতল ছবির গ্যলারিতে তিনি ঘুরে বেড়াতেন এবং তাঁর ধমনীতে যে সব বংশের রক্ত প্রবাহিত ছিল সেই সব বংশের বিরাট-বিরাট প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখতেন। রানি এলিজাবেত এবং রাজা জেমস-এর রাজত্বের স্মৃতিচারণ” গ্রন্থে ফ্রান্সিস অসবর্ন ফিলিপ হারবার্ট-এর যে বিবরণ দিয়েছেন, সেই হারবার্টের প্রতিকৃতি সেখানে রয়েছে। এই সুন্দর যুবক ফিলিপ হারবার্টের জীবনই কি তিনি যাপন করছেন? কোনো বিষাক্ত বীডাণু কি দেহ থেকে দেহে সংক্রামিত হয়ে তাঁর শরীরে এসে উপস্থিত হয়েছে? সোনার জল দিয়ে আঁকা আঁটো জামার ওপরে আর হীরার বুটি দেওয়া বর্ম পরে স্যার অ্যানথলি শেরাজ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সাদা আর কালো রঙের অস্ত্রশস্ত্রের স্তূপ তাঁর পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে। এই মানুষটি ভবিষ্যৎ বংশধরদের। উন্যে কী রেখে গিয়েছেন? নেপলস-এর ডিযোভানার প্রেমিক কি তাঁর জন্যে পাপ আর লজ্জা গিয়েছেন দিয়ে? এই মৃত ব্যক্তিটি সাহস করে যা চিন্তা করতে পারতেন না, তাঁর নিজস্ব কাগুলি কি তারই স্বপ্ন? এইখানে রঙচটা ক্যানভাসের ওপরে লেডি এলিজাবেথ দেবার তাঁর জমকালো পোশাক আর মুক্তাখচিত কাঁচুলি পরে হাসছেন। তাঁর ডান হাতে একটি ফুল, বাঁ হাতে দামাস্কাস গোলাপের বন্ধনী। পাশে একটি টেবিল। সেই টেবিলের ওপরে একটি ম্যানডোলিন এবং একটি আপেল। সবুজ ফিতে দিয়ে তৈরি করা কয়েকটি বড়ো-বড়ো গোলাপ ফুল তাঁর সূচলো জুতোর ওপরে সেলাই করা ছিল তাঁর জীবনের কথা তিনি ডানতেন; তাঁর প্রেমিকদের সম্পর্কে যে অদ্ভুত কাহিনি লোকের মুখে-মুখে ঘুরে বেড়াত তাও তাঁর অজানা ছিল না। এলিজাবেথের চঞ্চল মানসিকতার কিছুটা কি তিনি নিজেও পেয়েছেন? সেই অণ্ডাকৃতি ভারী-ভারী চোখ দুটি গভীর কৌতুকের সঙ্গে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। জর্জ উইলোবির প্রতিকৃতির কথাই ধরা যাক। কী ভয়ঙ্কর দেখতে মানুষটি! চুলে তাঁর পাউডারের প্রলেপ; মুখের ওপরে তাঁর অদ্ভুত ধরলের দাগ। তাঁর মুখের চেহারা কুর; রঙ কালো। কামনায ভরা তাঁর ঘৃণায় বঙ্কিম হয়ে উঠেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মার্কনি বলে তিনি পরিচিত ছিলেন। যৌবনে তিনি ছিলেন লর্ড ফেরারস-এর দোস্ত। দ্বিতীয় লর্ড। বেকেনহাম-এর সম্বন্ধেই বা তিনি কী বলবেন! প্রিন্স রিজেন্টের উদ্দাম উচ্ছল দিনের বন্ধু। ছিলেন তিনি; মিসেস ফিটডারবার্ট-এর সঙ্গে যুবরাজের গোপনে যে বিবাহ হয়েছিল তারও সাক্ষী ছিলেন তিনি। কী গর্বিত, সুন্দর চেহারা তাঁর। কী উদ্ধত তাঁর ভঙ্গিমা! তাঁর সেই উচ্ছ্বাসের কিছু অংশ কি তিনি ডোরিয়েনকে উইল করে দিয়ে গিয়েছেন? বিশ্বের লোক তাঁকে দুষ্ট চরিত্রের বলে জানে। কার্লটন হাউস-এ তিনিই রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর পাশে কালো পোশাক পরা বিশীর্ণ চেহারার আর একটি প্রতিকৃতি। এটি তাঁর স্ত্রীর। তাঁর রক্তের শিহরনও ডোরিয়েলের শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে কী অদ্ভুত! আর তাঁর মায়ের ছবি! ভদ্রমহিলার মুখটি ছিল লেডি হ্যামিলটনের মুখের মতো। তাঁর কাছ থেকে কী পেয়েছেন তিনি তা। জানেন। তিনি পেয়েছেন দেহের সৌন্দর্য, আর পেয়েছেন অপরের সৌন্দর্য উপভোগ করার তীব্র কামনা। ব্যাকানন্টি পোশাক পরে তিনি যেন তাঁকে উপহাস করছেন। তাঁর চুলে। আঙুলের পাতা জড়ানো। ছবির রঙটা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তাঁর অদ্ভুত চোখ দুটি তাঁর পিছু পিছু এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

তবু নিজের জাতের মতো সাহিত্যেও মানুষ তার পূর্বপুরুষদের সন্ধান পেত, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সম্ভবত বেশি নৈকট্য অনুভব করত সে এবং নিশ্চয় তাদের প্রভাব যে তার ওপরে পড়ত সেকথা সে জানত। মাঝে-মাঝে ডোরিয়েন গ্রের মনে হত যে সমস্ত ইতিহাসটাই যেন তাঁর জীবনের কর্মতালিকাযা তিনি করতেন সেগুলির নয়; যা তিনি করবেন বলে মনে করতেন। যে সমস্তু অদ্ভুত এবং বিপজ্জনক অভিনেতারা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে পাপকে এমন রমণীয় করে তুলেছে, অমঙ্গল করেছে সূক্ষম কারুকার্যের সামিল যাকে ব্যাখ্যা করা সত্যিকার দুরুহ, তাঁর মনে হত তিনি যেন তাদের বেশ ভালোভাবেই চেনেন। তিনি ভাবতেন কোনো এক দুযে রহস্যের মাধ্যমে তাঁর জীবন তাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে।

অনবদ্য উপন্যাসের যে নায়ক তাঁর জীবনের ওপরে অতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তিনি তাঁর সেই অদ্ভুত খেয়ালের কথা জানতেন। উপন্যাসের সপ্তম পরিচ্ছেদ তিনি। বলেছেন-বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ভয়ে, ফুলের মুকুট পরে তাইবেরিয়াস-এর মতো তিনি ক্যাপ্রিয় বাগানে বসেছিলেন, বসে-বসে এলিফ্যানটিস-এর জঘন্ন বইগুলি পড়ছিলেন। বামন আর ময়ূরের দল তাঁর চারপাশে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আর বাঁশীর সুরের রেশ সুগন্ধী ধূপের বক্ৰগতিকে উপহাস করছিল। তার পরে ক্যালিগুলার মতো আস্তাবলে সবুজ শার্ট পরা ডাকিদের আদর করে ভাগিয়ে দিলেন এবং হিরে বসানো জিম দিয়ে মোড়া ঘোড়াটার সঙ্গে হাতির দাঁতের তৈরি গামলায় তিনি ভোজন করলেন। মার্বেল পাথরে বাঁধানো সারি-সারি আয়নার ধার দিয়ে ডোমিতিযেনের মতো লম্বা বারান্দার ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন; ভোগের আয়োজনে জীবনের পাত্র উপছে পড়ার ফলে যার জীবনে বাঁচার সমস্ত আনন্দে নষ্ট হয়ে যায় সেই রকম মানুষের মতো নিজের দেহটাকে নষ্ট করার জন্যে শীর্ণ দুটো চোখ দিয়ে সেই সারিবদ্ধ আয়নাগুলির মধ্যে তিনি ছোরার ছায়া খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। পরিষ্কার পান্নার ভেতর দিয়ে সার্কাসের রক্তাভ ধ্বংসাবশেষের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলেন; তারপরে সাদা খচ্চরবাহিত লাল মুক্তাখচিত পালকিতে চড়ে পমে গ্রনেটের রাস্তার ওপর। দিয়ে তিনি স্বর্ণ মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ইলোব্যালাস-এর মতো নিজের মুখ তিনি। রঙ দিয়ে ছাপিয়ে নিলেন, মহিলাদের মধ্যে বার বার অবিশ্বাস ছড়ালেন, কার্থেজ নিয়ে এসে সূর্যের সঙ্গে বিয়ে দিলেন তাঁরা কী করে দিলেন সে রহস্য আডও কেউ বুঝতে পারেনি।

এই আজগুবি পরিচ্ছেদটি ডোরিয়েন বার-বার পড়তেন; তার ঠিক পরের দুটি পরিচ্ছেদ তাঁকে যথেষ্ট আকর্ষণ করেছিল। পরিচ্ছেদ তো নয়; সূক্ষ্ণ কারুকার্য করা জাজিমের মতো। তার ওপরে নিপুণ চাতুর্যের সঙ্গে আঁকা ছিল কতকগুলি ভীতিপ্রদ আর সেই সঙ্গে সুন্দর মূর্তি, সেই মূর্তিগুলিকে পাপ, রক্ত, আর ক্লান্তি দানবীয় অথবা উন্মত্ত করে তুলেছিল; সেই মূর্তিগুলির চরিত্রগুলির বলাই ভালো, একটি হচ্ছে মিলানের ডিউক ফিলিপোর। তিনি তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করে তাঁর ঠোঁটের ওপরে লাল রঙের বিষ মাখিয়ে রঙিন করে রেখেছিলেন। উদ্দেশ্য যে দেহটিকে তিনি আদর করতেন সেই স্ত্রীর মৃত ঠোঁট দুটি চুম্বন করে তাঁর প্রেমিক যেন মৃত্যু বরণ করেন। আর একটি চরিত্র হচ্ছে ভেনিসবাসী পিঘাত্রো বারবি-ইনি পরিচিত ছিলেন দ্বিতীয় পল নামে। দম্ভের বশবর্তী হয়ে তিনি ফরমোসাস-এর খেতাব গ্রহণ করতে। চেয়েছিলেন। তাঁর মুকুটের দাম দু’হাজার ফ্লোরিন। ওই মুকুটটি সংগৃহীত হয়েছিল ভয়ঙ্কর পাপের পথে আর একটি চরিত্র হচ্ছে গ্যিাঁ মারিযা ভাইকেতি। জীবন্ত মানুষের পেছনে তিনি ডালকুত্তা ছেড়ে দিতেন। তাঁর নিহত দেহটিকে তাঁর প্রেমিকা বারবনিতা গোলাপ ফুলে ঢেকে দিয়েছিলেন। সাদা ঘোড়ার পিঠে বর্জিয়াকেও দেখা যাবে সেখানে। তাঁর পাশে ঘোড়ার পিঠে চলেছেন ফ্রাট্রিসাইড। তাঁর বড়ো ঢিলে জামাটি পেরোত্তোর রক্তে ভেজা। আর রয়েছেন ফ্লোরেন্স-এর যুবক কার্ডিনেল আর্কবিশপ পিয়েত্রা রিয়েরিযো-ইনি হচ্ছেন চতুর্থ। সিক্সতাস-এর পুত্র এবং প্রিয়পাত্র। তাঁর সৌন্দর্য যেমন অপরূপ, লাম্পট্যও তেমনি সীমাহীন। সাদা এবং গাঢ় লাল সিল্কের তাঁবুতে আরাগনের লিওনোরাকে তিনি অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। সেই তাঁবুতে ছিল অপ্সরীর দল, আর ছিল একরকমের জীব-প্রাচীন গ্রীক কাহিনিতে যারা ছিল অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ঘোড়া। গ্যানিমিড অথবা হাইলাস-এর মতো ভোডের সভায় উৎসর্গ করার জন্য একটি ছেলেকে তিনি সাজিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ছিলেন এভেলিন। মৃত্যুর দৃশ্য ছাড়া তাঁর বিষাদকে নষ্ট করা যেত না। মানুষের যেমন লাল মদের দিকে ঝোঁক থাকে তাঁর তেমনি ঝোঁক ছিল লাল রক্তের ওপরে। শয়তানের বাচ্চা বলে পরিচিত ছিলেন তিনি আরো শোনা যায় নিজের আত্মার সদগতির জন্যে নিজের বাবাকে পাশা খেলায় তিনি হারিয়ে দিয়েছিলেন। সেই জন্যে ছিলেন গিয়ামবাতিস্তা সিবো। মানুষটি রসিকতা করে নিজের নাম নিয়েছিলেন ‘ইনোসেন্ট’ বলে। তাঁর অসাড় শিরার মধ্যে একজন জুইস ডাক্তার তিনটি ছেলের দেহের রক্ত ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ইসোতার প্রেমিক এবং রামিনির লর্ড সিগিসমনদো মালাতেস্তাকেও দেখা যাবে সেখানে। দেবতার শত্রু হিসাবে রোমে তাঁর কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়। গলায় একখানা রুমাল বেঁধে তিনি পলিসেনাকে হত্যা করেছিলেন, পান্নার কাপে করে বিষ দিয়েছিলেন জিনেভ্রাকে এবং লজ্জাকর ভাবের আবেশে খৃশ্চানদের পূজা করার জন্যে একটি অখৃস্টান ধর্মমন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। ষষ্ঠ চার্লসকেও সেখানে আপনারা খুঁজে পাবেন। তিনি তাঁর ভাই-এর স্ত্রীকে এমন উন্মত্তের মতো ভালোবাসতেন যে তাই দেখে একজন কুষ্ঠরোগী তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল এই বলে যে উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হওয়ার বেশি দেরি তাঁর নেই। সেই চার্লস যখন সত্যি-সত্যিই পাগল হয়ে গেলেন তখন তাকে সান্ত্বনা দিতে পারত একমাত্র সারালেন তাস; সেই তাসের ওপরে আঁকা থাকত প্রেম, মৃত্যু, আর উন্মাদের ছবি। সেই সঙ্গে দেখতে পাওয়া যাবে ফিটফাট পোশাক পরা গ্রিফোনেতা ব্যাগলিযোনির ছবি; মাথায় তাঁর মণিমুক্তা খচিত টুপি, অ্যাকানথাসের মতো কোঁকড়ানো চুলের স্তবক। তিনি সস্ত্রীক অ্যাসটোরিকে খুন করেছিলেন, সিমোনেতোকে হত্যা করেছিলেন তাঁর চাকর সমেত। সিমোনেতে তাঁর মৃত্যুকে এমন সহজভাবে গ্রহণ করেছিলেন যে পেরুগিযায় মৃত্যুশয্যায় তাঁকে নির্লিপ্তভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কেউ চোখের জল না ফেলে পারেনি; আর যে আটালানটা তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন তিনিই শেষ পর্যন্ত আশীর্বাদ করেছিলেন তাঁকে।

এঁদের সকলেরই একটা ভয়ঙ্কর আকর্ষণ ছিল। রাত্রিতে ডোরিয়েন এঁদের ছবি দেখতেন; দিনের বেলায় এঁরা তাঁর কল্পনাকে বিব্রত করে তুলত। রেনাসাঁর যুগে অদ্ভুত-অদ্ভুত উপায়ে মানুষকে বিষ খাইয়ে মারা হত; কোথাও শিরস্ত্রাণে বিষ মাখিযে, কোথাও জ্বলন্ত টর্চ বিষাক্ত করে, কোথাও নকশাকাটা দস্তানা কোথাও মুক্তাখচিত পাখা দিয়ে। ডোরিয়েন গ্রে বিষাক্ত হয়েছিলেন বই পড়ে। এমন মুহর্তও তাঁর এসেছিল যখন নিছক সৌন্দর্য উপভোগের উপায়। হিসাবেই অমঙ্গলকে তিনি গ্রহণ করতেন।

.

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দিনটা হল নভেম্বর মাসের ন’তারিখ। যেদিন তিনি আটতিরিশ বছরে পড়লেন তার আগের রাত্রি। পরে এই দিনটির কথাই তাঁর বেশি মনে দিল।

রাত্রি প্রায় এগারোটা হবে। লর্ড হেনরির বাড়ি থেকে ডিনার খেয়ে ফিরছিলেন তিনি। রাত্রিটা ঠান্ডা কনকনে। ঘন কুয়াশা জমেছিল আকাশে। মোটা ফারের কোট ছিল তাঁর গায়ে। গ্রসভেনর স্কোয়ার আর সাউথ অডলি স্ট্রিটের কোণে সেই অন্ধকারে একটি লোক তাঁর পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেলেন। লোকটি বেশ দ্রুতই হাঁটছিলেন; ধূসর রঙের আলেস্টারের কলারটা তাঁর ওলটানো ছিল। তাঁর হাতে ছিল একটা ব্যাগ। চিনতে পারলেন ডোরিয়েন পথচারী হচ্ছেন বেসিল হলওয়ার্ড হঠাৎ কী ডানি কেন ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। পথচারীকে চেনার কোনো লক্ষণ না দেখিযে তিনি নিজের বাড়ির দিকে হন-ইন করে এগিয়ে চললেন।

কিন্তু তুলওযার্ড তাঁকে দেখতে পেলেন। ডোরিয়েন বেশ বুঝতে পারলেন হলওয়ার্ড ফুটপাতের ওপরে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তারপরেই তিনি দ্রুতগতিতে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাঁর হাত ডোরিয়েলের হাত সস্পর্শ করল।

ডোরিয়েন, কী ভাগ্য! প্রায় ন’টা থেকে তোমার লাইব্রেরিতে তোমার জন্যে আমি অপেক্ষা করছিলাম। শেষ পর্যন্ত তোমার চাকরের ওপরে কেমন যেন দয়া হল আমার বেরিয়ে আসার সময় সে দরজা খুলে দিল। আমি তাকে শুয়ে পড়তে বললাম। আজ রাত্রির ট্রেনেই আমি প্যারিসে চলে যাচ্ছিা যাওয়ার আগে বিশেষ করে তোমার সঙ্গেই আমি দেখা করতে। চেয়েছিলাম। আমার পাশ দিয়ে পেরিয়ে যেতে মনে হল তোমাকে আমি দেখেছি-অথবা, তোমার ওই ফার কোটটাকে। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। তুমি কি চিনতে পারনি আমাকে?

প্রিয় বেন্সিল, এই কুয়াশায়? কী যে বল! গ্রসভেনর স্কোয়ারটাকেও চিনতে পারছি নো মনে হচ্ছে আমার বাড়িটা এরই কাছাকাছি একটা ভাযায হবে; কিন্তু ঠিক কোন ভাষায় সেটা ঠাহর হচ্ছে না। অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি। তাই তুমি চলে যা বলে বেশ কষ্ট হচ্ছে আমার। কিন্তু মনে হচ্ছে, তাড়াতাড়িই ফিরে আসছ তুমি!

না, ছ’মাসের জন্যে ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি। ঠিক করেছি প্যারিসে একটা স্টুডিযো নেব, সত্যিকার বিরাট একটা কিছু কাজ করার ইচ্ছে হয়েছে আমার। যতদিন না সেকাজ শেষ হয়। ততদিন পর্যন্ত স্টুডিয়ো ছেড়ে আমি বাইরে বেরোব না। যাই হোক, নিজের কোনো কথা । তামাকে আমি বলতে চাই তো তোমার বাড়ির সামনে এসে গিয়েছি আমরা। চল, একটু বসে যাই, তোমাকে কিছু বলার রয়েছে আমার।

খুব খুশি হব আমি। কিন্তু তুমি ট্রেন ফেল করবে না?

সিঁড়িতে উঠে “ল্যাচ কী” দিয়ে দরজাটা খুলতে-খুলতে বেশ ক্লান্ত স্বরেই প্রশ্ন করলেন ডোরিয়েন।

ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে বাতির আলো বেশ কষ্ট করেই বেরিয়ে এল বাইরে। সেই আলোতে হাত-ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হলওয়ার্ড বললেন; এখনো অনেক সময় রয়েছে। বারোটা পনেরোর আগে ট্রেন ছাড়ছে না। সত্যি কথা বলতে কি তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্যেই আমি ক্লাবের দিকে যাচ্ছিলাম; হঠাৎ রাস্তায় তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দেখতেই পাচ্ছ ভারী লাগেজ পাঠাতে আমার দেরি হবে না; সেগুলি আমি আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার কাছে রয়েছে কেবল এই ব্যাগটা। ভিকটোরিযা স্টেশনে পৌঁছতে আমার কুড়ি মিনিটের বেশি সময় যাবে না।

তাঁর দিকে তাকিয়ে ডোরিয়েন একটু হাসলেন।

তোমার মতো একজন শৌখিন চিত্রকরের এইভাবে বেড়াতে যাওয়ার রীতিটি নিঃসন্দেহে চমৎকার। একটা গ্লাডস্টোন ব্যাগ আর একখানা আলেস্টার। ভেতরে এস; দরজা খুলে রাখলে কুয়াশা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়বে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখা কোনো সিরিয়ান্স আলোচনা তুমি করবে না। আজকাল সিরিয়াস বলে কোনো জিনিসেরই অস্তিত্ব নেই। অন্তত, থাকা উচিত নয়।

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে হলওয়ার্ড নিজের মাথাটা নাড়লেন; তারপরে ডোরিয়েলের পিছু পিছু লাইব্রেরিতে হাজির হলেন। বড়ো খেলা উনুনে কাঠের আগুন গনগন করছিল। বাতি। জ্বালানো হল। একটা রুপোর ডাচ সিপরিট কেস-এর ওপরে সোডার বোতল, বড়ো গ্রাম। কয়েকটা বসানো ছিল।

ডোরিয়েন, তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার চাকর আমার যথেষ্ট সেবা করেছে। আমার সব কিছু প্রয়োজন সে স্বেচ্ছাতেই মিটিয়েছে; এমন কি তোমার সবচেয়ে দামি সিগারেট পর্যন্ত আমাকে দিতে সে কোনোরকম কুণ্ঠাবোধ করেনি। অতিথিবৎসল হিসাবে সে পয়লা নম্বরী। তোমার আগের সেই ফরাসি চাকরের চেয়ে একে আমার বেশি ভালো লেগেছে। আচ্ছা, সেই লোকটি কোথায়?

কাঁধ কুঁচকে ডোরিয়েন বললেন: মনে হচ্ছে, সে লেডি ব্রাডিলির ঝিকে বিয়ে করেছে। বৌকে সে প্যারিসে ইংরেজ দজি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, ওখানে এই জাতীয় ফ্যাশনের বেশ দাম রয়েছে। ফরাসিরা কী বোকা, তাই না? কিন্তু তুমি কি জান, চাকর হিসাবে লোকটি মোটেই খারাপ ছিল না। আমি তাকে কোনোদিনই পছন্দ করতাম না সত্যি কথা; কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো কিছু আমার ছিল না। মানুষে প্রায় এমন অনেক জিনিস কল্পনা করে থাকে যেগুলি চরিত্রের দিক থেকে উদ্ভট। সেও আমার খুব অনুরক্ত ছিল। চলে যাওয়ার সময় বেশ কষ্টই হয়েছিল তার। আর একটু ব্র্যানডি আর সোডা নাও। না, “হক আর সেলডার” নেবে? আমার কিন্তু হক আর সেলটজারই ভালো লাগে বেশি। পাশের ঘরে নিশ্চয় কেউ রয়েছে।

টুপি আর ওভারকোট খুললেন চিত্রকর; সেগুলিকে ব্যাগের ওপরে রাখলেন, ব্যাগটিকে তিনি আগেই একটা কোণে রেখেছিলেন। তারপরে বললেন: ধন্যবাদ। না; আর কিছু আমার চাই নে। এখন বন্ধু, তোমার সঙ্গে কিছু সিরিয়াল আলোচনা আমি করতে চাই। ওভাবে কুটি করো না। ওইরকম করার জন্যেই সত্যি কথাটা তোমাকে বলা আমার কাছে বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

সোফার ওপরে বসে তাঁর স্বাভাবিক খিটখিটে মেজাজের সঙ্গেই ডোরিয়েন বললেন: ব্যাপারটা কী বল তো? আশা করি, আমার বিষয়ে কিছু নয়। আজ রাত্রিতে আমি বড়ো ক্লান্ত, মেজাজটা বেশ ভালো নেই।

বেশ গম্ভীর ভাবেই হলওয়ার্ড বললেন: কথাটা তোমারই সম্বন্ধে, আর সে-কথা তোমাকে আমার বলতেই হবে। আধঘণ্টার বেশি সময় তোমার আমি নেব না।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন ডোরিয়েন; তারপরে একটা সিগারেট ধরিযে বললেন: আধঘন্টা!

ডোরিয়েন, বেশি কিছু বলার নেই আমার। তবে আমি যা বলছি সেটা তোমার নিজেরই ভালোর জন্যে। লন্ডনে তোমার সম্বন্ধে নানারকম গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। গুজবগুলি নোংরা। আমার মনে হয় সেগুলি কী তা তোমার জানা উচিত।

সেগুলি কী তা জানার কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। অন্য লোকের কুৎসা শুনতে আমার ভালো লাগে; কিন্তু নিজের কুৎসা শোনার কোনো আগ্রহ নেই আমার। এদের মধ্যে নতুন কিছু নেই।

সেগুলি জানার আগ্রহ তোমার থাকা উচিত ডোরিয়েন। সুনাম বজায় থাকুক এটা প্রতিটি ভদ্রলোকই চায়। লোকে তোমাকে নোংরা অশ্লীল ভাবুক এটা নিশ্চয় তুমি চাও না। অবশ্য সমাডে তোমার প্রতিষ্ঠা রয়েছে, রয়েছে সম্পদ-অভিজাত সম্প্রদায়ের আরো অনেক কিছু রয়েছে সম্ভবত। কিন্তু সামাজিক প্রতিষ্ঠা আর সম্পদই মানুষের পক্ষে যথেষ্ট নয়। মনে রেখো, এসব গুজবে আমি কান দিই নে। তোমাকে দেখলে সে-সব গুজব বিশ্বাস করতে পারি লে আমি। পাপ এমন একটা জিনিস যা মানুষের মুখের ওপরে নিজের অস্তিত্বের সমস্ত চিহ্ন ফুটিয়ে তোলে। পাপকে লুকিয়ে রাখা যায় না। অনেক সময় মানুষে গোপল পাপের কথা বলে; কিন্তু ওরকম কোনো বস্তু নেই। চোখ, মুখ, এমন কি হাতের বলিরেখার ওপরেও পাপের সমস্ত চিহ্ন ফুটে ওঠে। একটি ভদ্রলোক–তাঁর নাম আমি করব না-কিন্তু তুমি তাঁকে জান–গত বছর আমার কাছে এসেছিলেন তাঁর একটি প্রতিকৃতি এঁকে দেওয়ার জন্যে। ওর আগে কোনোদিনই তাঁকে আমি দেখিনি। দেখা দুরের কথা, কোনোদিন লামও পর্যন্ত শুনিনি তাঁর যদিও তার পরে তাঁর সম্বন্ধে অনেক কথা আমার কানে এসেছে। প্রতিকৃতিটি তৈরি করার পারিশ্রমিক হিসাবে অনেক টাকা তিনি আমাকে দিতে চাইলেন। রাজি হইনি আমি। তাঁর আঙুলের ওপর এমন একটা চিহ্ন ফুটে উঠেছিল যা দেখতে আমার ভালো লাগেনি। এখন আমি জানি তাঁর সম্বন্ধে তখন আমি যা সন্দেহ করেছিলাম সেগুলি সব সত্যি মানুষটির ব্যবহারিক জীবন ক্লেদাক্ত, পঙ্কিল। কিন্তু ডোরিয়েন, তোমার কথা স্বতন্ত্র। তোমার চরিত্র পবিত্র উজ্জ্বল, নিষ্পাপ, তোমার যৌবন বিকৃত ন্য। তোমার বিরুদ্ধে কোনো কুৎসাই বিশ্বাস করতে আমি রাজি নই। তবু তোমার সঙ্গে আজকাল আমার খুব কমই দেখা হয়; তুমি আজকাল আমার স্টুডিযোতে যাওয়া ছেড়েই দিয়ে। ঠিক এইকম একটি পরিস্থিতিতে তোমার বিরুদ্ধে যে-সব কুৎসা রটছে তাদের জবাব যে আমি কী দেব তা আমি নিজেই বুঝতে পারছিলো আচ্ছা ডোরিয়েন, তুমি ক্লাবে ঢুকলে ডিউক অফ বারউইকের মতো ভদ্রলোক কেন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান বলতে পার? লন্ডনের এতগুলি ভদ্রলোক কেন তোমাকে তাঁদের। বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন না, বা কেন তোমার বাড়িতে আসেন না সেকথা কি তুমি জান? লর্ড স্টেভিলির বন্ধু ছিলে তুমি। গত সপ্তাহে একটা ডিনারে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ডাডলির প্রদর্শনীতে তুমি যে কিছু টুকরো ছবি ধার দিয়েছিলে সেই প্রসঙ্গেই তোমার কথা উঠেছিল। স্টেভিলি তাঁর ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন–কিছু আর্টিস্টিক রুচি হয়তো তোমার রয়েছে; কিন্তু কোনো নিরপরাধ যুবতীর তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়াটা বাঞ্ছনীয় নয; অথবা, তোমার সঙ্গে একই ঘরে বসে থাকাট কোনো ভদ্রমহিলার পক্ষেই শোভনীয় দেখাবে না। তাঁকে আমি স্মরণ করিয়ে দিলাম যে তুমি আমার বন্ধু তাঁর মন্তব্যের গূঢ় অর্থ কী সেটাও জানতে চাইলাম আমি। কেন তিনি ওই মন্তব্য করলেন সেকথা তিনি আমাকে বললেন, কেবল আমাকেই নয়। সেখানে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সকলের সামনেই তিনি বললেন। তাঁর বক্তব্য শুনে। আমার খুব খারাপ লাগল। যুবকদের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব এতটা মারাত্মক কেন? সেপাই দলের সেই হতভাগ্য ছেলেটা সেদিন আত্মহত্যা করে বসল। তুমি তার খুব প্রিয় বন্ধু ছিলে। কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে স্যার হেনরি অ্যাসটনকে ইংলন্ড ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তোমরা দুজনে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলে। আদ্রিয়ান সিঙ্গ লটন আর তাঁর ভয়ঙ্কর পরিণতির কথাই বা কেন না জানে? লর্ড কেন্দ্রের একমাত্র পুত্র আর তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও ওই একই কথা খাটো সেন্ট ডেমস স্ট্রিটে তার বাবার সঙ্গে গতকাল আমার দেখা হয়েছিল। লজ্জা আর দুঃখে, মনে হল। ভদ্রলোক ভেঙে পড়েছেন। পার্থ-এর যুবক ডিউকের কথাই বা কী বলব? কী ভাবে সে জীবন কাটাচ্ছে তা তুমি জান? কোন ভদ্রলোক তার সঙ্গে মেলামেশা করবে?

দুটো ঠোঁট কামড়িয়ে ঘৃণার সঙ্গে ডোরিয়েন বললেন: বেসিল, চুপ করা এমন সব বিষয় নিয়ে তুমি আলোচনা করছ যাদের সম্বন্ধে তুমি কিছুই জান না। আমি ঘরে ঢুকলে বারউইক মেই ঘর ছেড়ে উঠে যায় কেন সে প্রশ্ন তুমি আমাকে করেছ। তার কারণ এই নয় যে সে আমার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে, তার কারণ হচ্ছে এই যে তার সম্বন্ধে আমি সব কিছু ভানি। ধমনীতে তার যে বিষাক্ত রক্ত বইছে তারপরেও সে কেমন করে পরিষ্কার থাকবে? হেনরি অ্যাসটন আর যুবক পার্থের কথা তুমি আমাকে বলেছ। আমি কি প্রথম লোকটিকে পাপ কাজ করতে শিখিযেছি না, লমপট হওয়ার মদত দিয়েছি দ্বিতীয় মানুষটিকে? যদি কেন্টের মুখ। ছেলে বন্তীর মেয়েকে বিয়ে করে তাতে আমার কী যায় আসে? যদি আদ্রিয়ান সিঙ্গলটন বিলের ওপরে তার বন্ধুর নাম ভাল করে তার জন্যে কৈফিযৎ দেওয়ার কথা কি আমার? ইংলন্ডের লোকেরা সব বিষয়েই কী রকম হইচই করে তা আমি জানি। নোংরা খাবার টেবিলের ধারে বসে এখানকার মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নিজেদের নৈতিক কুসংস্কার নিয়ে মহা আড়ম্বরে ঢাক-ঢোল পেটায; অভিজাত সম্প্রদায়ের লাম্পট্য নিয়ে তারা দেদার আলোচনা করে এইটা প্রমাণ করার জন্যে যে তারা অতিশয় চতুর, আর যাদের তারা কুৎসা করছে তাদের সঙ্গে তারা ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। এদেশে পরের কুৎসা কুড়ানোর যোগ্যতা তাদেরই রয়েছে যারা অভিজাত আর বুদ্ধিমান। যারা নিজেদের নীতি নিয়ে এত বড়াই করছে তাদের দৈনন্দিন জীবনটাই বা কী? বন্ধুবর, তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমরা সবাই কপট মানুষের সমাজে বাস করছি।

হলওয়ার্ড একটু জোরেই বললেন: ডোরিয়েন, কথাটা তা নয়। সেদিক থেকে ইংলন্ড যে যথেষ্ট খারাপ, আর এখানকার সমাজ যে ভুল ছাড়া কিছু ঠিক করে না তা আমি জানি। সেই জন্যেই আমি চাই তুমি পরিচ্ছন্ন হও। কিন্তু তুমি তা হতে পারনি। প্রভাব বিস্তারের ফলে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তারই পরিপ্রেস্কিতে মানুষকে বিচার করার অধিকার আমাদের রয়েছে। মনে হচ্ছে সম্ভ্রমবোধ, সততা, আর চারিত্রিক নিষ্কলুষতা সবই তুমি হারিয়ে ফেলেছে। তুমি তাদের ভোগের উন্মাদনায় উন্মত্ত করে তুলেছ, অধঃপাতের অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছে তারা। তুমি তাদের সেই পথে পরিচালিত করে। হ্যাঁ, তুমি তাদের পরিচালক। তবু তুমি হাসতে পার, ঠিক এখন যেমন তুমি হাসছ। কিন্তু বিপদটা এখানেই শেষ নয়। আমি জানি তুমি আর হেনরি অচ্ছেদ্য। অন্য কোনো কারণ না থাকলেও, ঠিক সেই কারণেই তার বোনের কলক রটনা করাটা তোমার উচিত হয়নি।

সাবধান বেসলি; তোমার কথার ঝাঁঝটা বড়ো বেশি তীব্র হয়ে পড়ছে।

তাহলেও, আমাকে তা বলতেই হবে; আর তোমাকে সেকথা শুনতেই হবে। শুনতে তুমি বাধ্য। তোমার সঙ্গে লেডি গিয়েনদোলেনের যখন প্রথম পরিচয় হয় তখন তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসার একটি বাণীও কারও মুখ থেকে বেরোয়নি। আডকে লন্ডনে এমন একটি ভদ্রমহিলাকেও কি খুঁজে পাওয়া যাবে যিনি তাঁর সঙ্গে গাড়িতে পাশাপাশি বসে পার্কে বেড়াতে যেতে রাজি হবেন? অপরের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকতে দেওয়া হয় না। তাছাড়া, তোমার সম্বন্ধে আরো অনেক কুৎসিত কথা প্রচারিত হয়েছে সেগুলির সম্পর্কেই বা বলার কী রয়েছে তোমার? শোনা যায় খুব সকালে নাকি বেশ্যাবাডি থেকে সে ঢাকা দিয়ে তুমি বেরিয়ে আস; আবার সন্ধের পরে লোকের চোখে ধুলো দিয়ে তুমি বারবনিতাদের বাড়িতে ঢুকে পড়া এসব কথা কি সত্যি? এসব কাহিনি কি সত্যি হতে পারে? এসব কথা যখন প্রথম আমার কানে এল তখন আমি হেসেছিলাম। এখন সে-সব কথা শুনে আমি ভয়ে কেপে উঠি। শহরের বাইরে যে বাগানবাড়ি রয়েছে সেটাই বা কী? সেখানে তুমি যে জীবন যাপন কর তার সম্বন্ধেই বা। বলার কী রয়েছে তোমার? ডোরিয়েন, লোকে তোমার নামে কী বলে তা তুমি জান না। তোমার কাছে আমি সৎ ভাষণ দেব না এমন কোনো কথা আমি বলব না। মনে আছে হেনরি একবার বলেছিল দু’দিনের যোগীরা সব সময়েই ওইরকম কথা বলেই এগিয়ে আসে; তারপরে প্রথম চোটেই সেটা তারা ভেঙে ফেলে। আমি তোমাকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনতে চাই। আমি চাই তুমি এমন জীবন যাপন কর যাতে সবাই তোমাকে সম্মান করতে পারে তোমার নামের সঙ্গে যে কলঙ্ক জড়িয়ে রয়েছে, আমি চাই সেই কলঙ্ক মুছে ফেলে তুমি একটি পরিচ্ছন্ন। জীবনের পথে এগিয়ে এস। যে সমস্ত নোংরা লোকের সঙ্গে তুমি মেলামেশা করছ, আমি চাই তাদের সঙ্গ তুমি পরিত্যাগ কর। ওভাবে উপহাস করো না আমাকে। নিজের সম্বন্ধে অতটা উদাসীন হয়ো না। মানুষের ওপরে তোমার প্রভাব নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য কিন্তু সেই প্রভাব কুপথে পরিচালিত না করে মানুষকে সুপথে পরিচালিত করুক। লোকে বলে যাদের সঙ্গেই তোমার হৃদ্যতা জন্মায় তাদেরই তুমি খারাপ পথে নিয়ে যাও; আর কারও বাড়িতে তুমি পা। দিলেই লোকে ধরে নেবে যে এবারে সেখানে একটা নোংরা জিনিস ঘটবে। এটা সত্যি কি না। তা আমি জানি নে কী করেই বা জানব? কিন্তু তোমার সম্বন্ধে এই রকমেরই একটা ধারণা। জন্মেছে সকলেরই মুনে। আমি এমন সব ঘটনার কথা শুনেছি যেগুলিকে মিথ্যা বলে উড়িযে দেওয়া অসম্ভব। সেই অক্সফোর্ড থেকেই লর্ড গ্লসেস্টার আমার একজন প্রিয় বন্ধ। তিনি। আমাকে একটি চিঠি দেখালেন। চিঠিটি তাঁর স্ত্রীর। মেনটোল-এর বাগানবাড়িতে নিঃসঙ্গ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তিনি তাঁর স্বামীকে সেই চিঠিটি লিখেছিলেন। সেখানে তিনি যে স্বীকারোক্তি করেছেন তার মধ্যে তোমার নাম কুৎসিত ভাবে জড়ানো রয়েছে। এরকম ভযানক স্বীকারোক্তি জীবনে আর কখনো আমি পড়িনি। আমি প্রতিবাদ করে। বলেছিলাম–এ কথা অসম্ভব, আমি বিশ্বাস করি নে, আমি তাকে ভালোভালেই জানি এরকম কাজ সে কোনোদিন করতে পারে না। তোমাকে কি আমি জানি? আমার অবাক লাগে ভাবতে তোমাকে সত্যিই আমি জানি কি না। এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে তোমার আত্মাটাকে আমার দেখা উচিত।

সোফা থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন ডোরিয়েন; ভয়ে মুখটা তাঁর প্রায় সাদা হয়ে উঠল, তিনি বিড়বিড় করে বললেন: আমার আত্মাকে দেখা!

গম্ভীরভাবে আর বেশ গভীর দুঃখের সঙ্গে হলওয়ার্ড বললেন, হ্যাঁ, তোমার আত্মাকে আমি দেখতে চাই কিন্তু একমাত্র ভগবানই তা পারেন।

ডোরিয়েনের ঠোঁটের ভেতর থেকে উপহাসের একটা তিক্ত হাসি বেরিয়ে এল।

তুমি নিজেই তা দেখবে এস, আজই, আজ রাত্রেই–টেবিল থেকে বাতিটা নিয়ে চিৎকার করে বললেন তিনি এস। এটা তোমার নিজের হাতেই তৈরি হয়েছে। তুমি তা দেখতে পাবে না। কেন? ইচ্ছে হলে পরে একথা তুমি বিশ্বাবাসীকে জানাতে পার। কেউ তোমাকে বিশ্বাস করবে না। যদি তারা তা করে তাহলে তারা আমাকে আরো বেশি পছন্দ করবে। এই যুগের পহষ্ক যত সাফাই-ই তুমি গাও না কেন আমি একে ভালো করেই চিনি। আমি বলছি, আমার সঙ্গে তুমি এস। ব্যভিচারের বিরুদ্ধে অনেক বকবক করেছ তুমি। এবার তুমি তা নিজের চোখে দেখতে পাবে।

তাঁর প্রতিটি কথার মধ্যে একটা গর্বের আবেগ ঝরে পড়ল। ছেলেমানুষের মতো দম্ভভরে তিনি মাটিতে পা ঠুকলেন। দ্বিতীয় কেউ তাঁর জীবনের গোপন রহস্যের অংশীদার হবে এই চিন্তায় তিনি একটা ভয়ঙ্কর আনন্দ পেলেন। তাঁর লজ্জা আর অপমানের মূলাধার সেই প্রতিকৃতিটি যিনি নিজের হাতে এঁকেছেন সেই কীর্তির ভয়ঙ্কর স্মৃতিটা তাঁকেও যে বাকি জীবনটা বযে। বেড়াতে হবে এই ভেবে ডোরিয়েনের মন পৈশাচিক উল্লাসে নেচে উঠল।

তাঁর কাছে সরে এসে এবং তাঁর কঠোর চোখ দুটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডোরিয়েন আগের কথারই পুনরুক্তি করলেন; হ্যাঁ। আমার আত্মা আমি তোমাকে দেখাব। যা একমাত্র ভগবানের দেখার কথা বলে তোমার মনে হয়েছিল সেই জিনিসটাই নিজের চোখে তুমি দেখতে পাবে।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন হলওয়ার্ড বললেন: ডোরিয়েন, ভগবানের কুৎসা করছ তুমি। ওরকম কথা বলা তোমার উচিত নয় কথাগুলি কেবল বিপজ্জনকই নয়, অর্থহীন।

আবার হাসলেন ডোরিয়েন: তাই মনে হচ্ছে তোমার?

হ্যাঁ। আজ রাত্রে তোমাকে যে-সব কথা বললাম সেগুলি তোমারই মঙ্গলের জন্যে। তুমি জান, আমি চিরদিনই তোমার সত্যিকার বন্ধু।

আমাকে ছুঁয়ো না। তোমার বলা শেষ কর।

চিত্রকরের মুখের ওপরে বেদনার একটা জ্বালা তড়িৎগতিতে ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। একটু থামলেন তিনি। কেমন যেন মায়া হল তাঁর। ঘটনা যাই হোক, ডোরিয়েন গ্রের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামানোর কী অধিকার তাঁর রয়েছে! তাঁর সম্বন্ধে যে-সব কুৎসা ছড়িয়েছে তার কিছুটাও যদি সত্যি হয় তাহলেই কি কম কষ্ট তিনি পেয়েছেন? তারপরেই তিনি সোজা। হয়ে দাঁড়ালেন, এগিয়ে গেলেন ফায়ার প্লেসের কাছে; তাকিয়ে রইলেন জ্বলন্ত কাঠ, কুয়াশার মতো ছাই, আর কেঁপে-কেঁপে ওঠা আগুনের শিখাগুলির দিকে।

শক্ত এবং পরিচ্ছন্ন সুরে ডোরিয়েন বললেন, আমি অপেক্ষা করছি, বেসিল।

ঘুরে দাঁড়ালেন বেসিল, বললেন: তোমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উঠেছে সেগুলির উপযুক্ত জবাব তুমি আমাকে দেবে আমি কেবল এইটুকুই বলতে চাই। তুমি যদি বল গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত অভিযোগগুলি একেবারে মিথ্যা, আমি তাই বিশ্বাস করবা ডোরিয়েন, অভিযোগগুলি। অস্বীকার কর তুমি, কী গভীর উৎকণ্ঠায় আমি ভুগছি তা কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না? ভগবানের দিব্যি, তুমি আমাকে বলো না যে তুমি খারাপ, ব্যভিচারী, আর ঘৃণ্য।

ডোরিয়েন গ্রে হাসলেন। তাঁর ঠোঁটের ওপরে ঘৃণার বাঁকা রেখা ফুটে বেরোল। তিনি শান্তভাবে বললেন: ওপরে চল বেসিল। প্রতিদিনের রোজনামচা আমি লিখে রাখি। যে-ঘরে এটি লিখি সে-ঘরের বাইরে সেটি যায় না। আমার সঙ্গে এলে আমি সেটি তোমাকে দেখাব।

তুমি যদি তাই চাও, আমি যাব ডোরিয়েন। মনে হচ্ছে ট্রেন ফেল করেছি আমি। তাতে কিছু যায় আসে না। কাল যেতে পারি। কিন্তু আজ রাত্রিতে কিছু পড়তে আমাকে বলো না। আমি যা চাই তা হচ্ছে আমার প্রশ্নগুলির সোজা উত্তর।

উত্তর আমি ওপরেই দেব। এখানে সে উত্তর আমি দিতে পারব না। বেশি পড়তে হবে না তোমাকে

.

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। তাঁর পিছু পিছু চললেন বেসিল হলওয়ার্ড। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলেন তাঁরা। জ্বলন্ত বাতি থেকে বেরিয়ে ভূতুড়ে ছায়াগুলি সিঁড়ি আর দেওয়ালের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। বাইরের ঝড়ো বাতাসে জানালার খড়খড়িগুলো খটখট করে শব্দ করতে লাগল।

সিঁডির শেষ ধাপে উঠে ডোরিয়েন বাতিটাকে মেঝের ওপরে নামিয়ে রাখলেন; তারপর চাবি বার করে তালাটা খুলে ফেললেন। দরজা খুলে আস্তে-আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন তিনিঃ তুমি জানতে চাও, এই না বেসিল?

চাই।

হেসে বললেন ডোরিয়েন: তোমার কথা শুনে আমি খুশি হয়েছি।

তারপরে একটু রূঢ়ভাবেই তিনি বললেন: পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র মানুষ আমার সম্বন্ধে সব কিছু জানার যার অধিকার রয়েছে। তুমি যতটুকু ভাবছ আমার জীবন নিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করার প্রয়োজন তোমার রয়েছে।

এই পর্যন্ত বলে বাতিটা তুলে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন তিনি। একতাল ঠান্ডা বাতাস তাঁদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিশ্রী রকমের লাল হয়ে শিখাটা হঠাৎ কেঁপে একবার উঁচু হয়ে উঠল। শিউরে উঠলেন তিনি। বাতিটা টেবিলের ওপরে রেখে তিনি ফিসফিস করে বললেন: দরজাটা বন্ধ করে দাও।

ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে হলওয়ার্ড তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। চারপাশে বন্ধ ঘরটার অবস্থা দেখে মনে হল অনেক দিন সেখানে কেউ বাস করেনি।

একটি বিবর্ণ ফ্লেমিশ গালচে, পর্দা দিয়ে ঢাকা একখানা বড়ো ছবি, একটি পুরনো ইটালিয়ান ক্যাসোনি, আর প্রায় খালি একটা বুক-কেস-ঘরের আসবাবপত্র বলতে মোটামুটি এই; তা ছাড়া রয়েছে একটা চেয়ার আর একটা টেবিল। কুলুঙ্গির ওপরে আধপোড়া একটা বাতি ছিল; ডোরিয়েন সেটা জ্বালানোর সঙ্গে-সঙ্গে দেখা গেল সারা ঘরটার ওপরে পুরু ধুলো জমেছে, মাঝে-মাঝে কার্পেটটা ফুটো হয়ে গিয়েছে। তাঁদের শব্দ পেয়েই একটা ইঁদুর ছুটে পর্দার পেছলে লুকিয়ে পড়ল। ব্যাঙের ছাতার ভিড়ে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে।

বেসিল, তোমার ধারণা একমাত্র ভগবানই মানুষের আত্মা দেখতে পান? তাই না? ওই পর্দাটা একপাশে টেনে দাও; তুমি আমার আত্মাটা দেখতে পাবে।

স্বরটা কেবল নিরুত্তাপই নয়, যথেষ্ট নিষ্ঠুর।

তাঁর দিকে ভ্রুকুটি করে হলওয়ার্ড বললেন: ডোরিয়েন, হ্য তুমি উন্মাদ হয়ে গিয়ে; না হয় তো, অভিনয় করছ।

ডোরিয়েন বললেন: পর্দাটা তুমি সরাতে চাও না? তাহলে আমি নিজেই তা সরিয়ে দিচ্ছি। এই বলে একটা হেঁচকা টান দিয়ে পর্দাটা খুলে ফেললেন তিনি; তারপরে মেঝের ওপরে ছুঁড়ে দিলেন সেটাকে।

ভয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন হলওয়ার্ড। সেই স্বল্প আলোতে মনে হল ক্যানভাসের ওপর থেকে একটা বীভৎস মুখ তাঁর দিকে কুটিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সেই দৃষ্টির মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যা তাঁর মন ঘৃণা আর বিরক্তিতে ভরিয়ে তুলল। হায় ভগবান, যা তিনি দেখছেন তা কি ডোরিয়েন গ্রের মুখ? খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। সেই বীভৎসতার মধ্যে, চেহারা তার যত বিকৃতই হোক, সেই অপরূপ সৌন্দর্যকে একেবারে নষ্ট করতে পারেনি। ক্ষীয়মান কেশগুলির ওপরে এখনো কিছু রঙিন আভা ছড়িয়ে রয়েছে। ঠোঁট দুটির রঙ এখনো বিবর্ণ হয়ে যায়নি। ব্যভিচারে নিষ্প্রভ চোখ দুটি থেকে নীলাক্সন ছায়াটুকু এখনো একেবারে মুছে যায়নি; পাথরে কুঁদাই করার মতো সুন্দর নাক আর মসৃণ কণ্ঠ থেকে বঙ্কিম ভঙ্গিটির সৌন্দর্য এখনো নষ্ট হয়নি। হ্যাঁ, ডোরিয়েনের প্রতিকৃতিই বটে। কিন্তু কে একাজ করলে? এই রঙ-তুলি তো তাঁরই নিজের প্রেমের পরিকল্পনাও তো তাঁরই নিজস্ব। জ্বলন্ত বাতিটা তুলে নিয়ে প্রতিকৃতিটির সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ফ্রেমের বাঁ দিকের কোণে তাঁর নিজেরই নাম খোদাই করা রয়েছে।

ব্যাপারটা কেবল নিম্নশ্রেণির প্রহসনই নয়, ঘৃণ্য, নীচ বিদ্রূপও বটে। ঠিক এইরকম একটি ছবি তিনি আঁকতে পারেন না। তবু এ ছবি তাঁরই। তিনি তা জানতেন। মনে হল, মুহূর্তের মধ্যে তাঁর শরীরের সমস্ত গরম রক্ত জমে বরফ হয়ে গেল। এই কি তাঁর নিজের আঁকা ছবি? এর অর্থ কি? এর পরিবর্তন হল কেন? রুগ্ন মানুষের দৃষ্টি দিয়ে ডোরিয়েন গ্রের দিকে তিনি ফিরে তাকালেন। তাঁর মুখ বিকৃত হল; শুকিয়ে এল জিব। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোতে চাইল না। তাঁর। কপালের ওপরে তিনি হাত বুলোলেন। চিটচিটে ঘামে ভিজে গিয়েছে কপালটা।

কোনো বড়ো অভিনেতার অভিনয় দেখার সময় মানুষে যেরকম একাগ্র দৃষ্টি দিয়ে বমঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকে, কুলুঙ্গিতে ঠেস দিয়ে ডোরিয়েনও সেইভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে বইলেন। সেই দৃষ্টির মধ্যে সত্যিকার কোনো দুঃখ অথবা আনন্দ বলে কিছু ছিল না। দর্শকের দৃষ্টি দিয়ে তাঁকে দেখছিলেন; সেই দৃষ্টির মধ্যে বিজয় অভিযানের কিছু ইঙ্গিতও যে একেবারে ছিল না সে কথাও সত্যি নয়। কোটের বোতাম থেকে একটা গোলাপ ফুল তুলে নিয়ে তিনি তা দেখছিলেন অথবা মনে হল যেন শুকছিলেন।

শেষ পর্যন্ত হলওয়ার্ডই চিৎকার করে উঠলেন: এ সবের অর্থ কী?

সেই তীক্ষ্ণ স্বর তাঁরই কানে কেমন যেন বেখাপ্পা শোনাল।

ফুলটা হাতের ভেতরে চটকে ডোরিয়েন বললেন: অনেক দিন আগে, আমি তখন ছেলেমানুষ দিলাম, তোমার সঙ্গে যখন আমার প্রথম আলাপ হল সেই সময় আমার নিজের দেহের সৌন্দর্য সম্বন্ধে সজাগ থাকতে তুমি আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলো একদিন তোমার একটি বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলে। যৌবনের বিস্ময় বলতে কী বোঝায় সে-কথা আমাকে। বুঝিয়ে দিয়েছিল। তুমি আমার প্রতিকৃতি শেষ করলে। আমি যে কত সুন্দর সে কথা তখনই আমি বুঝতে পারলামা মুহূর্তের উত্তেজনায়, আমি এখনো ভানি নে তার জন্যে আমি দুঃখিত কি না, আশা করেছিলেম, তুমি সেটাকে প্রার্থনাও বলতে পার…

আমার তা মনে আছে। খুব ভালোভাবেই মনে রয়েছে। না, না, সে অসম্ভব। এই ঘরটা। স্যাঁতসেঁতো ক্যানভাসের ওপরে ব্যাঙের ছাতার মতো একটা আবরণ পড়েছে যে রঙ দিয়ে আমি এটা এঁকেছিলাম নিশচয তার ভেতরে কিছু ধাতব বিষ মেশানো ছিল। আমি তোমাকে বলছি–এ অসম্ভব ঘটনা।

জানালার ধারে এগিয়ে গিয়ে শিশির-ভেজা শার্সির গায়ে মাথাটা চেপে ডোরিয়েন বললেন; অসম্ভব ঘটনাটা কী?

ছবিটাকে তুমি নষ্ট করে ফেলেছ–এই কথাই তুমি আমাকে বলেছিলে।

সেটা মিথ্যে কথা। ছবিটাই আমাকে নষ্ট করেছে।

আমি বিশ্বাস করি নে এটা আমার আঁকা ছবি।

ডোরিয়েন তিক্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন: তোমার আদর্শ এর মধ্যে খুঁজে পাচ্ছ না?

আমার আদর্শ, যা তুমি বলছ…

যা তুমি বলতে।

তার মধ্যে কোনো নোংরামি ছিল না, ছিল না ঘৃণা করার মতো কিছু জিনিস। তুমি আমার কাছে এমন একটি আদর্শ ছিলে ঠিক যেরকমটি আর কোনোদিনই আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু এই মুখটা তো দেখছি ছাগলের।

এটি হচ্ছে আমার আত্মার মুখ।

হায় ভগবান, এই জিনিসটাকে আমি এতদিনে পুজো করে এসেছি? এর চোখ দুটো তো শয়তানের।

নৈরাশ্যের ভঙ্গি করে ডোরিয়েন বললেন: আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই স্বর্গ আর নরক দুইই রয়েছে, বেসিল।

আবার প্রতিকৃতিটির দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন বেসিল; তাকিয়ে রইলেন তার দিকে; তারপরে চিৎকার করে বললেন: হায় ভগবান, এটাই যদি সত্যি হয়…তোমার জীবন নিয়ে যদি এইরকম খেলাই তুমি সত্যি-সত্যিই খেলে থাক থাহলে লোকে তোমার সম্বন্ধে যা ভাবে তার চেয়ে তো দেখছি তুমি অনেক বেশি খারাপ, অধঃপাতের আরও অনেক নীচে তুমি নেমে গিয়েছ।

এই বলে বাতিটি তুলে আবার তিনি ক্যানভাসটাকে পরীক্ষা করতে লাগলেন। ওপরটা মোটেই বিকৃত হয়নি। যেমন তিনি রেখেছিলেন ঠিক তেমনিই রয়েছে; বিকৃতি যা ঘটেছে তার সবটাই ওই ভেতর থেকে। অবচেতন মনের কোনো একটি বিশেষ আর রহস্যময় চোরা পথ দিয়ে পাপের কুষ্ঠ বাইরে বেরিয়ে এসে ছবিটিকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলছে। জলে বোঝাই কবরের মধ্যে মৃতদেহের পচনও এর মতো ভয়ঙ্কর নয়।

হাত কাঁপতে লাগল তাঁর; বাতিটা হাত থেকে মাটির ওপর পড়ে গেল; শিখাটা ছিটকে পড়ল চারপাশে পা দিয়ে মাড়িয়ে আলোটা নিবিয়ে দিলেন তিনি তারপরে টেবিলের পাশে যে সরু একটা চেয়ার ছিল সেইখানে বসে দুটো হাত দিয়ে মুখটাকে ঢেকে দিলেন। হায় ভগবান, ডোরিয়েন; এ কী শিক্ষা, এ কী ভয়ঙ্কর শিক্ষা!!

কোনো উত্তর এল না ডোরিয়েনের কাছ থেকে। জানালার কাছ থেকে একটা চাপা আর্তনাদে ফোঁপাতে লাগলেন তিনি।

হলওয়ার্ড বললেন: ডোরিযেত, ভগবানের কাছে প্রার্থনা কর। শৈশবে আমাদের কী কণ্ঠস্থ করতে হয় বল তো? “হে ভগবান, পাপের পথে আমাদের পরিচালিত করো না; আমাদের পাপ তুমি ক্ষমা কর; আমাদের পবিত্র কর তুমি।” এস, আমরা দুজনে মিলে সেই প্রার্থনাই করি। তোমার দম্ভের প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছে, তোমার অনুতাপ করার প্রার্থনাও ভাবান পূর্ণ করবেন। তোমার সৌন্দর্যকে আমি খুব বেশি পূজা করতাম। শাস্তি পেয়েছি যথেষ্ট।

ধীরে-ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন ডোরিয়েন; অশ্রুসিক্ত লোচনে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে বললেন: অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, বেসিল।

প্রার্থনার সময়-অসময় নেই, ডোরিয়েন; এস, আমরা দুজনে একসঙ্গে হাঁটু মুড়ে বসে চেষ্টা করে দেখি প্রার্থনার কোনো পদ আমাদের মনে আসে কি না! “যদিও তোমার পাপ লাল টকটকে হয়ে উঠেছে, তবু তাকেই আমি বরফের মতো সাদা করে দেব”–এই ধরনের একটা প্রার্থনা রয়েছে না?

ও-পদ বর্তমানে আমার কাছে অর্থহীন, বেসিল।

চুপ! ওকথা বলো না। জীবনে অনেক পাপ তুমি করেছ। হায় ভগবান, ওই হতভাগা জিনিসটা। আমাদের যে ব্যঙ্গ করছে তা কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না?

ছবিটির দিকে তাকালেন ডোরিয়েন গ্রে। বেসিলের ওপরে একটা অদম্য আক্রোশ হঠাৎ চেপে বসল তাঁর মনে হল, ক্যানভাসের ওপরে আঁকা প্রতিকৃতিটা ঠোঁট বিকৃত করে বেসিলের। বিরুদ্ধে উত্তেজিত করল তাঁকে। বিরাট একটা উত্তেজনায় কেঁপে উঠলেন তিনি। একটা আহত পশুর উন্মত্ত জিঘাংসা তাঁকে অস্থির করে তুলল। ওই চেয়ারে যে মানুষটি বসে রয়েছে তাঁর ওপরে প্রচণ্ড একটা ঘৃণা এল তাঁরা মনে হল এত ঘৃণা জীবনেআর কাউকেই তিনি করেননি। পাগলের মতো তিনি চারপাশে তাকাতে লাগলেন। তাকের ওপরে একটা জিনিস তাঁর চোখে পড়ল। চকচক করছিল জিনিসটা। এটা কী তা তিনি জানতেন। এটা একটা ছোরা। কয়েকদিন আগে একটা দডি কাটার জন্যে তিনি এটাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন, তারপরে সরিয়ে। নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলেন। ধীরে-ধীরে হলওয়ার্ডের পাশ দিয়ে তিনি সেই দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর পেছনে গিয়ে ছোরাটা তুলে নিয়েই ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। হলওয়ার্ড একটু। নড়লেন; মনে হল তিনি এবারে উঠবেন। দ্রুতগতিতে এগিয়ে গিয়ে ডোরিয়েন সেই ছোরা বেসিলের কানের পেছনে যে বড়ো শিরাটা রয়েছে তার মধ্যে প্রচণ্ড বেগে ঢুকিয়ে দিলেন। মাথার ওপরে জোরে আঘাত করে ফেলে দিলেন মেঝেতে, তারপরে বারবার ছুরিকাঘাত করতে লাগলেন তাঁকে।

একটা চাপা গোঙানি শোনা গেল; মনে হল, চাপ-চাপ রক্তে কারও যেন কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। বেসিলের অসহায় দুটি হাত বার তিনেকের মতো কাঁপতে-কাঁপতে ওপরে উঠে শেষবারের মতো মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়ল। আরো দু’বার তাঁর বুকে ছোরাটা বসিয়ে দিলেন ডোরিয়েন। মৃত বেসিলের কাছ থেকে কোনো প্রতিবাদ এল না। মেঝের ওপর জলীয় একটা কিছু ঝিরঝির করে গড়িয়ে পড়ল। বেসিলের মাথাটা নীচের দিকে চেপে রেখে একটু অপেক্ষা করলেন তিনি; তারপর টেবিলের ওপরে ছোরাটা ছুঁড়ে দিয়ে কান পেতে রইলেন। কার্পেটের ওপরে ঝিরঝির করে রক্ত পড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছুই তাঁর কানে এল না। দরজা। খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। চারপাশ নিউন, চুপচাপ। আশেপাশে কাউকেই দেখা গেল না। কয়েক সেকেন্ড চারপাশের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তিনি বারান্দার রেলিং ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপরে চাবিটা বার করে আবার তিনি ভেতরে ঢুকলেন; তারপরে খিল দিয়ে দিলেন ঘরে।

মূর্তিটা তখনো চেয়ারের ওপরেই বসে রয়েছে, মাথাটা তার টেবিলের ওপরে নামানো; পিঠটা উঁচু হয়ে উঠেছে-হাত দুটি অদ্ভুতভাবে রয়েছে ছড়ানো। তার পিঠের ওপর গভীর একটা ইক্ষতচিহ্ন না থাকলে, আর তার ওপরে কালো রক্ত জমাট বেধে না উঠলে, সবাই ভাবত লোকটি ঘুমোচ্ছেন।

কত তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ হয়ে গেল! অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে গেলেন তিনি; জানালার ধারে এসে খুলে দিলেন শার্সিগুলো; তারপরে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। বাতাসে কুয়াশা উড়ে গিয়েছে; অজস্র সোনালি নক্ষত্রে খচিত হয়ে আকাশটাকে একটা দানবীয় ময়ূরের পেখমের মতো দেখাচ্ছে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলেন পুলিশ রোঁদে বেরিয়ে নিস্তব্ধ বাড়িগুলির বন্ধ দরজার ওপরে তার লম্বা লণ্ঠন ঘুরিয়ে-ঘুরিযে আলো ফেলছে। এক কোণে লাল রঙের একটা পুলিশের গাড়ি চকিতে দেখা দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। লম্বা আলোয়ান জড়িয়ে একটি মহিলা রেলিং-এর ধার দিয়ে সন্তর্পণে স্মৃতিপদে এগিয়ে এল। মাঝে-মাঝে সে থামল, যি তাকাল পেছনের দিকে পুলিশম্যান তার সামনে এগিয়ে এসে কী যেন বলল। হাসতে-হাসতে মেয়েটি টলতে টলতে চলে গেল। যাওয়ার সময় হেঁড়ে গলায় অতিস্থের মতো গানের কয়েকটা কলিও আওড়ালা একটা ঠান্ডা হাওযা পার্কের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। গ্যাসের আলোগুলি কাঁপতে লাগল, কাঁপতে কাঁপতে নীলচে হয়ে গেল তারা। পত্রহীন গাছগুলি তাদের সেই কালো কালো লোহার মতো শক্ত ডালগুলি এপাশে-ওপাশে নাড়াতে লাগল। কাঁপতে কাঁপতে পিছিয়ে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলেন তিনি।

দরজার সামনে গিয়ে চাবি দিয়ে তালাটা খুললেন তিনি। নিহত মানুষটির দিকে তিনি একবার ফিরেও তাকালেন না। তাঁর মনে হল ব্যাপারটা নিয়ে কোনোরকম চিন্তা না করাটাই হল আসল কথা। ওই ছবিটাই হল তাঁর সমস্ত দুঃখ আর দুর্দশার মূল কারণ। যে বন্ধুটি ওই বিপজ্জনক ছবি এঁকেছেন তিনি আজ মৃত। সেটাই যথেষ্ট।

তারপরে বাতিটার কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। মুর দেশের কারুকার্য করা অদ্ভুত সেই বাতিদান; মরা রুপো দিয়ে তৈরি; তার গায়ে নীলকান্তমণির বুটি। সেটাকে যথাস্থানে দেখতে না পেয়ে। চাকরটা হয়তো খোঁজাখুঁজি করবে। একটু ইতস্তত করলেন তিনি। তারপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে সেটি তুলে নিলেন। মৃত মানুষটির দিকে একবার চোখ না ফিরিয়ে তিনি পারলেন না। কী চুপচাপ পড়ে রয়েছে দেহটা। দীর্ঘ হাত দুটি কী ভয়ঙ্কর সাদাই না দেখাচ্ছে! মনে হল যেন একটা ভয়াল মোমের মূর্তি চেয়ারের ওপরে বসে রয়েছে।

দরজায় চাবি দিয়ে চুপি-চুপি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলেন তিনি। কাঠের সিড়িঁগুলি মচমচ করল; মনে হল, তারা যেন যন্ত্রণায় গোঙিয়ে উঠছে। কয়েকবারই তিনি থামলেন; উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়ালেন। না। চারপাশ নিস্তব্ধ। যে শব্দ তাঁর কালে ঢুকেছিল সেটা তাঁরই পায়ের।

লাইব্রেরিতে ঢুকে এলেন তিনি, ঘরের এক কোণে ব্যাগ আর কোটটা পড়ে রয়েছে। ওগুলিকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। ঘরের দেওয়ালের ভেতরে একটা গোপন কুঠরি ছিল। তার মধ্যে তিনি তাঁর গোপন ভিজনিসগুলি রাখতেন। সেই দেরাজটা খুলে ব্যাগ আর কোট তার ভেতর ঢোকালেন। পরে যথাসময়ে ওগুলিকে সহজেই পুড়িয়ে ফেলা যাবে। তারপরে তিনি ছোটো ঘড়িটা বার করে দেখলেন। দুটো বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি।

বসে পড়ে ভাবতে লাগলেন তিনি। যা তিনি করেছেন তার জন্যে ইংলন্ডে প্রতিটি মাসে প্রতিটি বছরে মানুষকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। আকাশে-বাতাসে হত্যার উন্মত্ততা ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো ধূমকেতু পৃথিবীর খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে।..তবু, তিনিই যে হত্যাকারী তার প্রমাণ কী? রাত্রি এগারোটার সময় বেসিল হলওয়ার্ড তাঁর বাড়ি থেকে। বেরিয়ে গিয়েছেন। তাঁকে ফিরে আসতে কেউ দেখেনি। অধিকাংশ চাকরই সেলবি রয়্যালে গিয়েছে। তাঁর নিজস্ব পরিচারক গিয়েছে ঘুমোতে প্যারিস! হ্যাঁ। বেসিল প্যারিসেই গিয়েছেন। তাঁরই সময়সূচী অনুযায়ী মাঝরাতের ট্রেনেই তিনি প্যারিসের পথে রওনা হয়েছেন। নিজেকে লোকচক্ষু থেকে লুকিয়ে রাখার স্বভাব যে তাঁর রয়েছে একথা কে না জানে। সুতরাং তিনি যে মারা গিয়েছেন সে-সন্দেহ মানুষের হতে কয়েক মাস সময় লাগবে। দীর্ঘ কয়েকটি মাস। তার ভেতরে তাঁর সমস্ত পশ্চাৎ চিই একেবারে নষ্ট করে ফেলা সম্ভব হবে।

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। ফার-এর কোট আর টুপি চড়িয়ে তিনি হলঘরে বেরিয়ে এলেন। একটু থাকলেন। ফুটপাতের ওপরে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। সে-শব্দ তাঁর কালে এল। তাদের লণ্ঠনের আলো গোল হয়ে শার্সির কাঁচের ওপরে পড়েছে তাও তিনি দেখলেন। নিঃশ্বাস টিপে অপেক্ষা করলেন তিনি।

তারই একটু পরে চাবিটা টেনে নিয়ে তিনি পকেটের মধ্যে ফেলে দিলেন; তারপরে খুব আস্তে-আস্তে দরজাটা বন্ধ করে, তিনি বেলটা বাড়াতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই। তার ব্যক্তিগত পবিচারক গায়ে কোনোরকমে পোশাকটা উড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। চোখেমুখে তখনো তার বেশ ঘুম জড়িয়ে রয়েছে।

দু’পা এগিয়ে এসে তিনি বললেন: ফ্রান্সিস, তোমাকে ঘুম থেকে টেনে তোলার জন্যে আমি দুঃখিত। কিন্তু আমি “ল্যাচ কীটা আনতে ভুলে গিয়েছি। কটা বাজে বল তো?

চোখ দুটো মিটমিট করে লোকটি বলল: দুটো বেড়ে দু’মিনিট হয়েছে স্যার।

দুটো বেজে দু’মিনিট! বল কী! বড় রাত হয়ে গিয়েছে তো তাহলে তুমি কিন্তু কাল বেলা ন’টার সময় আমাকে তুলে দিয়ো। কিছু কাজ রয়েছে আমার।

দেব স্যার।

সন্ধের দিকে কেউ আমার খোঁজ করছিল?

মিঃ হলওয়ার্ড, স্যার। তিনি এখানে রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত বসেছিলেন। তারপরে ট্রেন ধরতে হবে বলে উঠে গেলেন।

তাঁর সঙ্গে দেখা হল না বলে আমি দুঃখিত। কিছু বলে গিয়েছেন তিনি; অথবা কোনো চিঠি দিয়েছেন?

না স্যার। তিনি বলে গিয়েছেন ক্লাবে যদি আপনার সঙ্গে আজ দেখা না হয় তাহলে প্যারিস থেকে তিনি আপনাকে চিঠি দেবেন।

ঠিক আছে ফ্রান্সিস। কাল আমাকে সকাল ন’টায় ঢেকে দিতে ভুলো না।

না স্যার।

চটি পায়ে দিয়ে লোকটি টলতে-টলতে ঘুমের ঘোরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

টুপি আর কোটটা টেবিলের ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে ডোরিয়েন লাইব্রেরিতে ঢুকলেন। ভাবতে-ভাবতে আর ঠোঁট কামড়াতে-কামড়াতে প্রায় মিনিট পনেরো ধরে তিনি পায়চারি। করলেন। তারপরে একটি ব্যাগ থেকে তিনি ব্লু বুকটা টেনে নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগলেন। “অ্যালেন ক্যাম্পবেল, ১৫২, হার্ট ফোর্ড স্ট্রিট, মে ফেয়ার’। হ্যাঁ; এই লোকটিকেই তাঁর দরকার।

.

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

পরের দিন সকাল ন’টার সময় চাকরটি ট্রেতে করে এক কাপ চকোলেট নিয়ে ঘরে ঢুকে জানালার শার্সিগুলি খুলে দিল। ডান দিকে পাশ ফিরে একটা হাত গালের নীচে রেখে বেশ আরাম করেই ঘুমোচ্ছিলেন ডোরিয়েন। তাঁকে সেই অবস্থায় দেখলে মনে হবে যেন খেলা অথবা পড়ার পরে ক্লান্ত হয়ে একটা শিশু ঘুমিয়ে পড়েছে।

লোকটি তাঁর কাঁধে বার দুই ঠেলা দেওয়ার পরে তাঁর ঘুম ভাঙল। চোখ খোলার সঙ্গে-সঙ্গে। তাঁর ঠোঁট দুটির ওপরে একটি মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। মনে হল যেন একটা মিষ্টি স্বপ্নে এতক্ষণ তিনি বিভোর হয়ে ছিলেন। তবু স্বপ্ন তিনি মোটেই দেখেননি। আনন্দ বা দুঃখ কোনোটাই তাঁর রাত্রিটিকে ভারাক্রান্ত করে তোলেনি। কিন্তু অকারণেই যৌবন হাসো। এটাইটাই হচ্ছে তার সেরা সৌন্দর্য।

ঘুরে বালিশের ওপর কনুইটা রেখে চকোলেটে চুমুক দিলেন তিনি। নভেম্বর মাসের মিষ্টি রোদ তাঁর ঘরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পরিচ্ছন্ন আকাশ; বাতাসে মিষ্টি রোদের আমেজ। দিনটা মে মাসের প্রভাতের মতোই উজ্জ্বল।

ধীরে ধীরে নিঃশব্দ রক্তাক্ত পদক্ষেপে গতরাত্রির ঘটনাগুলি তাঁর মাথার মধ্যে ভিড় করে। দাঁড়াল; পরিস্ফুট করে তুলল সেই বিপজ্জনক নাটকটিকে তিনি যে দুঃখ পেয়েছেন সেই দুঃখ আর বেদনার স্মৃতি হঠাৎ তাঁকে ভারাক্রান্ত করে তুলল; তারই উত্তেজনায় চেয়ারের ওপরে উঠে বসলেন তিনি এবং যে ঘৃণা বেসিল হলওয়ার্ডকে হত্যা করতে তাঁকে বাধ্য করেছিল। সেই নিদারুণ ঘৃণা আবার এসে দেখা দিল; তাঁর সমস্ত সহানুভূতি হিমশীতল হয়ে জমাট বেঁধে গেল। মৃত লোকটি এখনো সেইখানে একইভাবে বসে রয়েছে, তবে বর্তমানে রোদ এসে তার। গায়ের ওপরে পড়েছে। কী ভয়ঙ্কর! এইরকম ভয়ঙ্কর কাজের দোসর রাত্রির অন্ধখার, দিনের পরিচ্ছন্ন আলো নয়। তাঁর মনে হল গতরাত্রির কথা আবার যদি তিনি ভাবতে শুরু করেন। তাহলে হয় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন, আর না হয়, পাগল হয়ে যাবেন। এমন অনেক পাপ রয়েছে যাদের স্মৃতি সত্যিকারের কাজের চেয়ে অনেক বেশি মানুষকে মুগ্ধ করে। সত্যিকার ভোগ মানুষের প্রবৃত্তির আকাঙ্খা মেটায় সন্দেহ নেই; তাকে আনন্দ দেয়; কিন্তু এই সব। কাল্পনিক বিজয়, যাকে আমরা পাপের মনোচারণ বলি, তারা আমাদের আনন্দ দেয় অনেক বেশি, আমাদের কল্পনাকে অনেক বেশি রাঙিয়ে তোলে। কিন্তু বর্তমান স্মৃতিটা ঠিক সেই জাতীয় নয়। এই স্মৃতি ভযাবহ, বিপজ্জনক–মানুষকে আফিঙের নেশায় আচ্ছন্ন, একেবারে ধ্বংস করে ফেলে তাকে সেই ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে একে নষ্ট করে দিতে হবে।

আধঘণ্টা এইভাবে বসে থাকার পরে, কপালের ওপর হাতটা বুলালেন তিনি; তারপরে। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন; পরিপাটি করে পোশাক পরলেন, অন্যান্য দিনের চেয়েও বেশি যত্ন নিলেন প্রসাধনে; পছন্দমতো নেকটাই পরলেন, বাছাই করে নিলেন একটা আংটি। অনেকক্ষণ ধরে চিবিয়ে-চিবিয়ে প্রাতরাশ খেলেন, চাকরদের এবারে কী ধরনের পোশাক তৈরি করিয়ে দেবেন তাই নিয়ে চাকরের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন, চিঠিপত্র খুঁটিযে-খুঁটিয়ে পড়লেন। কয়েকটি চিঠি পড়ে তিনি হাসলেন; তিনটি চিঠি পড়ে বিরক্ত হলেন। একখানা চিঠি বারবার তিনি পড়লেন; তারপরে, ভ্রু কুঁচকে সেটিকে ছিঁড়ে ফেললেন। এই জাতীয় চিঠির সম্বন্ধেই লর্ড হেনরি একবার বলেছিলেন; একেই বলে মহিলাদের স্মৃতিচারণ। বাপরে বাপ, কী ভয়ানক!!

এক কাপ কালো কফি খাওয়ার পরে তোয়ালে দিয়ে ধীরে-ধীরে মুখ মুছলেন তিনি; চাকরকে অপেক্ষা করতে বলে লেখার টেবিলের দিকে উঠে গেলেন, সেখানে গিয়ে চিঠি লিখলেন দুটি। একটা তিনি নিজের পকেটে ঢুকালেন আর একটা তাঁর চাকরের হাতে দিয়ে বললেন: ফ্রান্সিস, এটা নিয়ে তুমি ১৫২ নং হার্ট ফোর্ড স্ট্রিটে যাও। মিঃ ক্যাম্পবেল যদি এখন শহরের বাইরে গিয়ে থাকেন তাহলে তাঁর ঠিকানাটা নিয়ে এস।

আবার তিনি একা, নিঃসঙ্গ। চাকরটি চলে যাওয়ার পরেই তিনি একটা সিগারেট ধরালেন; তারপরে এক টুকরো কাগজ নিয়ে ছবি আঁকতে বসলেন; প্রথমে আঁকলেন ফুলের ছবি, তারপরে ঘর-বাড়ির, তারপরে মানুষের মুখেরা আঁকতে আঁকতে হঠাৎ তিনি মন্তব্য করে বসলেন–বেসিল হলওয়ার্ডের মুখের সঙ্গে এই সব কটিরই কোথায় যেন একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ভ্রুকুটি করে উঠে পড়লেন তিনি, বুক-কেস-এর দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখান থেকে একখানা বই তুলে নিলেন। বাধ্য না হলে যা ঘটেছে তা নিয়ে আর তিনি আলোচনা করবেন না বলে মনোস্থির করে বসলেন।

সোফার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে তিনি গিটারের লেখা একখানা বই, জাপানি কাগজে ছাপানো ছবি ভ্যাকিমার্ট-এর; সবুজ চামড়া দিয়ে বাঁধাই। বইটি আদ্রিয়েন সিঙ্গলটল তাঁকে দিয়েছিলেন। বইটির পাতা ওলটাতে-ওলটাতে ল্যাসিন্যের-এর ঠান্ডা সবুজ, হাতের ওপরে লেখা একটি কবিতার ওপরে তাঁর চোখ পড়ে গেল। কবিতাটি পড়ে নিজের সাদা সূচালো। আঙুলগুলির দিকে তিনি একবার তাকিয়ে দেখলেন; দেখে, নিজের অজান্তেই কেমন যেন শিউরে উঠলেন। তারপরে পড়লেন ভেনিস-এর ওপরে লেখা সুন্দর একটি কবিতা।

কী সুন্দর বর্ণনা ভেনিস-এর কবিতাটা পড়তে-পড়তে পাঠকের মনে হবে সে যেন পাটল বর্ণের মুক্তার মতো শহরে নদীর ওপর দিয়ে পাল তুলে রূপালি দাঁড় লাগানো কালো গনডোলার ওপরে বসে ভেসে চলেছে; শরৎকালে ভেনিসে তিনি যে দিনগুলি কাটিয়েছিলেন সেইগুলির কথা মনে পড়ে গেল তাঁরা কী আনন্দেই না কেটেছিল দিনগুলি–অজস্র আনন্দ আর ভুলের উত্তেজনায় মাতোয়ারা হয়ে ছিলেন তিনি। প্রতিটি জায়গায় রোমান্স একেবারে থইথই করছে সেখানে; কিন্তু অক্সফোর্ডের মতো, ভেনিসও তার সমস্ত রোমান্সকে পেছনে সরিয়ে রেখেছে। আর সত্যিকার রোমান্টিক চিন্তাধারার মানুষের কাছে পটভূমিকাটাই আসল অথবা একমাত্র সত্য। কিছুদিন বেসিলও তাঁর সঙ্গে ওখানে কাটিয়েছিলেন। হতভাগ্য বেসিল! মানুষে যে এভাবে মারা যেতে পারে সেকথা ভাবতেও তাঁর হৃৎকম্প উপস্থিত হল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বইটা তুলে নিলেন তিনি। সব কিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা। করলেন। একটার পর একটা পাতা ওলটাতে লাগলেন তিনি। দেশ-বিদেশের পাখির কাহিনি। পড়লেন; স্মার্নার ছোটো কাপের জানালার ভেতর দিয়ে চড়াই পাখিরা উড়ে বেড়ায–সেখানে। হ্যাঁডিসরা বসে-বসে হলদে রঙের মালা গণে, পাগড়িওয়ালা বণিকদের দল তাদের লম্বা-লম্বা পাইপ টানে; আর মাঝে-মাঝে গম্ভীরভাবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সব পড়লেন তিনি। আরো অনেক কিছু পড়লেন তিনিঃ সূর্যহীন প্যালেস দ্য লা কনকোর্ড-এর ওবেলিক পাখির কথা, নীল নদের ধারে সিম্পনিকস-এর কথা, ইজিপ্টের শকুন আর কুমিরের কথা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বইটি তাঁর হাত থেকে পড়ে গেল। কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়লেন তিনি। বিরাট ভয় এসে তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। অ্যালেন ক্যাম্পবেল যদি ইংলন্ডের বাইরে চলে যায়? তাঁর ফিরে আসতে অনেকদিন লাগবে। তিনি নাও আসতে পারেন। তাহলে তিনি কী করবেন? প্রতিটি মুহূর্ত এখন জরুরি। পাঁচ-ছ’ বছর আগে তাঁদের মধ্যে অগাধ বন্ধুত্ব ছিল–যাকে বলে অচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব। তারপরেই হঠাৎ তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এখন মাঝে-মাঝে কোনো জায়গায় যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তাহলে ডোরিযেই পরিচিতির হাসি হাসেন অ্যালেন পরিচয়কে অগ্রাহ্য করে যান।

মানুষ হিসাবে অ্যালেন সত্যিকারের বুদ্ধিমান যুবক। কিন্তু বাস্তব কলার সৌন্দর্য তাঁকে কোনোদিনই আকর্ষণ করতে পারেনি; আর কাব্যিক সৌন্দর্য বলতে যেটুকু তিনি বুঝতেন। বলে মনে হত তার সবটুকুই তাঁর ডোরিয়েন-এর কাছ থেকে নেওয়া। বিজ্ঞানের দিকেই তাঁর ঝোঁকটা ছিল প্রবল। কেম্ব্রিজে পড়ার সময় বেশিরভাগ সময়টাই তিনি ল্যাবরেটরিতে কাটাতেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে তিনি ভালোই ছিলেন। এখনো পর্যন্ত তিনি রসায়নশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করতেন, নিজের একটি পরীক্ষাগারও তিনি তৈরি করেছেন এবং সেইখানেই দিনের অধিকাংশ সময় দরজা বন্ধ করে দিয়ে গবেষণায ডুবে থাকতেল অ্যালেন। তাঁর মা তাঁর এবম্বিধ ব্যবহারে বড়ো হব্ধ ছিলেন। তিনি মনে করতেন কেমিস্টরা কেবল রোগীর প্রেসক্রিপশন লেখে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র পার্লামেন্টের নির্বাচনে দাঁড়াক। গায়ক হিসাবেও অ্যালেনের যথেষ্ট নাম ছিল। অনেক শখের বাজিয়েদের চেয়ে অনেক ভালো তিনি। বেহালা আর পিয়ানো বাড়াতে পারতেন। সত্যি কথা বলতে কি এই গান বাজনার মধ্যে সেই ডোরিয়েন-এর সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়; আর অন্যান্য ক্ষেত্রে যা ঘটেছে–ডোরিয়েন-এর অদ্ভুত সৌন্দর্য আর সম্মোহনী শক্তিই তাঁকে তাঁর কাছে টেনে এসেছিল। লেডি বার্কশায়ারের বাড়িতে যে রাত্রিতে রুবিনস্টেন বাজনা বাড়িয়েছিলেন সেই রাত্রিতেই ওঁদের দুজনের পরিচয় হ্য; তারপরেই তাঁরা একসঙ্গে অপেরায় যেতে শুরু করেন; শুরু করেন গানের মজলিসে যোগ দিতে। আঠারো মাস ধরে তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল নিবিড়। এই সময় সেলবিরয়্যাল অথবা। গ্রসভেনর স্কোয়ারে প্রায় অ্যালেনকে দেখা যেত। তাঁদের মধ্যে কী কারণে কলহ হয়েছিল, অথবা কলহ কোনো আদৌ হয়েছিল কি না সে কথা কেউ জানে না। কিন্তু হঠাৎ শোনা গেল তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে; আর কোনো জায়গায় ডোরিয়েন হাজির হলে অ্যালেন অনেক আগেই সেখান থেকে চলে যান। অ্যালেন-এর ভেতরেও অনেক পরিবর্তন। দেখা দিয়েছে। সেই হাসিখুশি ভাবটা তাঁর আর নেই; সব সময়েই কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকেন। গান-বাজনার জলসায় বিশেষ দেখা যায় না তাঁকে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন বিজ্ঞানের গবেষণায় তিনি এতই ব্যস্ত থাকেন যে ও-সব দিকে মন দেওয়ার মতো সময় তাঁর আর নেই। কথাটা সত্যি। দিনদিন তিনি শরীরতত্ত্ব নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। মাঝে-মাঝে অদ্ভুত ধরনের গবেষণাও তিনি করতেন। বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকপত্রে তাঁর নামও মাঝে-মাঝে দেখা যেত।

এই মানুষটির জন্যেই ডোরিয়েন গ্রে অপেক্ষা করে বসেছিলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটি একটি মিনিট গুনে যাচ্ছিলেন তিনি। মিনিটের পর মিনিট কেটে যাওয়ার পরেই তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। খাঁচায় পোরা একটি রমণীয় বস্তুর মতো তিনি উঠে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলেন। দুটি হাত অদ্ভুতভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে তিনি লম্বা-লম্বা পা ফেলে ঘুরতে লাগলেন।

প্রতীক্ষা অসহ্য হয়ে উঠল তাঁরা মনে হল, সময় যেন আর কাটে না। প্রতিটি মুহূর্তে একটি কালো ঝড়ো হাওয়া যেন তাঁকে ঠেলে-ঠেলে চড়াই-এর একেবারে কিনারের দিকে নিয়ে। চলেছে। তারপরেই নীচে বিরাট অন্ধকার তলহীন গহ্বর। সেখানে তাঁর জন্যে কী অপেক্ষা করে বসে রয়েছে তা তিনি জানতেন। সেই ভয়ে দুটি হাত দিয়ে জোরে-ডোরে তিনি তাঁর চোখ দুটো ঘষতে লাগলেন মনে হল তিনি তাঁর নিজের মাথাটা ভেঙে ফেলবেন, দুটি চোখকে ঢুকিয়ে দেবেন কোটরের ভেতরে। কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়ে গেল। দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেলেন না তিনি। দুশ্চিন্তার পঙ্গপাল তাঁরই চোখের সামনে নেচে-নেচে বেড়াতে লাগল। তারপরে হঠাৎ স্থবির হয়ে গেল সময়। সেই মরা সময় কবরখানা থেকে লঘুগতিতে তাঁর চোখের ওপরে যে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎটিকে টেনে নিয়ে এল তা দেখেই আঁৎকে উঠলেন তিনি। ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন। আতংকে পাথর হয়ে গেলেন তিনি।

অবশেষে দরজা খুলে গেল; ঘরে ঢুকল চাকর। তার দিকে চকচকে চোখে চেয়ে দেখলেন ডোরিযে।

লোকটি বলল: মিঃ ক্যাম্পবেল এসেছেন স্যার।

তাঁর সেই শুকনো ঠোঁট দুটির ভেতর থেকে একটা স্বস্তির স্বর ফুটে বেরল। বিবর্ণ গণ্ড দুটি ধীরে-ধীরে আবার তাদের পুরনো রঙ ফিরে পেল। কিছুটা সহজ হয়ে এলেন ডোরিয়েন।

তাঁকে এখনই পাঠিয়ে দাও ফ্রানসিস।

তাঁর মনে হল, আবার যেন স্বস্থানে ফিরে এসেছেন তিনি। তাঁর দেহ-মন থেকে ভীরুতা, দুর্বলতার সব চিহ্ন তখন অপহৃত হয়েছে।

মাথাটা নীচু করে লোকটি চলে গেল। কিছুক্ষণের ভেতরেই অ্যালেন ক্যাম্পবেল ভেতরে ঢুকে এলেন। আগন্তুকের মেজাজ বেশ রুক্ষ, কিন্তু মুখের রঙটি বিবর্ণ। ঘন কালো চুল আর ভুরু দুটির জন্যে তাঁর মুখের পাণ্ডুরতা আরো বেশি করে চোখে পড়ল।

অ্যালেন! তুমি যে দয়া করে এসেছ তার জন্যে ধন্যবাদ।

গ্রে, তোমার বাড়িতে আর কোনোদিন আসার ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু আমি চিঠিতে লিখেছিলে যে জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ।

তাঁর স্বরটি যে কেবল কঠোর তাই নয়; রীতিমতো নিরুত্তাপ। ধীরে-ধীরে চিবিয়ে-চিবিয়ে কথাগুলি বললেন তিনি। ডোরিয়েন গ্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন; সেই দৃষ্টি ঘৃণার, অবহেলারা হাত দুটি কোটের পকেটে ঢুকিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন; ডোরিয়েন গ্রের সাগ্রহ অভ্যর্থনাকে কোনোরকম আমল দিলেন না।

হ্যাঁ, সত্যিই তাই-জীবন-মৃত্যুই বটে, আর আমার একারই নয়, আরো অনেকের। বস।

টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন ক্যাম্পবেল: তাঁর মখোমখি বসলেন ডোরিয়েন। চোখাচোখি হল দুজনের। একটু করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ডোরিয়েন। তিনি জানতে যা। তিনি বলতে যাচ্ছেন তা সত্যিই ভয়ঙ্কর।

কয়েক মুহূর্ত বিক্ষুব্ধ নিস্তব্ধতার পরে তিনি অ্যালেনের দিকে একটু ঝুঁকে শান্তভাবে বললেন, প্রতিটি কথা কী ভাবে তাঁর ওপর প্রভাব বিস্তার করছে তাও লক্ করলেন তিনি; অ্যালেন, এই বাড়ির ছাদে একটা বন্ধ ঘর রয়েছে। সেই ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ ঢোকে না। সেইখালে টেবিলের ধারে একটা চেয়ারের ওপরে একটি মৃত মানুষ বসে রয়েছে। এখন থেকে ঘন্টা দশেক আগে তার মৃত্যু হয়েছে। উঠো না; আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থেকো না। লোকটি কে, কেন সে মারা গেল, কী ভাবে মারা গেল–সে-সব বিষয়ে জানার কোনো প্রয়োজন তোমার নেই। তোমাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে এই যে…

গ্রে, তুমি চুপ কর। আর কিছু আমি জানতে চাইনে। তুমি যা বললে তা সত্যি কি না তা ডানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। আসল কথা, তোমার জীবনের কোনো ঘটনার সঙ্গে নিজেকে আর জড়িয়ে রাখতে আমি নারাজ। যদি কোনো ভয়ঙ্কর গোপন কাহিনি তোমার থাকে তা তুমি নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখা সেটা জানার কোনো কৌতূহল আমার নেই।

অ্যালেন, তোমাকে তা জানতেই হবে; বিশেষ করে এই গোপন কথাটা তোমার জানা চাই। তোমার জন্যে সত্যিই আমার বড়ো দুঃখ হয়, অ্যালেন। কিন্তু আমার কোনো উপায় নেই। একমাত্র তুমিই আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে পার। সেই জন্যে বাধ্য হয়েই তোমাকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি। তাছাড়া অন্য কোনো পথ আমার ছিল না। অ্যালেন তুমি বৈজ্ঞানিক। রসায়ন আর ওই জাতীয় কিছু বিষয়ে তোমার জ্ঞান রয়েছে। এই সব বিষয়ে অনেক পরীক্ষা তুমি করেছ। ওপরে যে জিনিসটি পড়ে রয়েছে সেটিকে একেবারে লোপাট করে। দিতে হবে; এমনভাবে পুড়িয়ে ফেলতে হবে যেন তার কোনো চিহ্নটুকু পর্যন্ত আর না থাকে। এ বাড়িতে ঢুকতে লোকটিকে কেউ এখানে দেখেনি। সত্যি কথা বলতে কি, ঠিক এই সময় তার প্যারিসে থাকার কথা। বেশ ক’টা মাস তার প্যারিসে থাকার কথা। বেশ ক’টা মাস তার কেউ খোঁজখবর নেবে না। যখন লোকে তাকে খুঁজবে তখন তার কোনো চিহ্ন যেন এখালে না। থাকে। অ্যালেন, তুমি তাকে আর তার সমস্ত চিহ্নগুলিকে পুড়িয়ে ছাই করে দাও; সেই ছাই আমি বাতাসে ছড়িয়ে দেব।

ডোরিয়েন, তুমি উন্মাদ।

তুমি আমাকে ওই নামে ডাকবে তারই জন্যে অপেক্ষা করছিলাম এতদিন অ্যালেন।

তুমি উন্মাদ হয়েচ্ছ উন্মাদ না হলে ভাবতে পারতে না যে যা তুমি চাইছ তাই আমি করব উন্মাদ না হলে, এ প্রস্তাব তুমি আমাকে দিতে পারতে না। ঘটনাটা যাই হোক, তার মধ্যে আমি আর নেই। তুমি কি মনে কর, তোমাকে বাঁচানোর জন্যে একটি মিথ্যে দুর্নামের বোঝা আমি মাথায় তুলে নেব? তুমি যদি কিছু শয়তানি করে থাক তার দায়িত্ব আমার নয়।

অ্যালেন, লোকটি আত্মহত্যা করেছে।

শুনে খুশি হলাম। কিন্তু কে তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে? সম্ভবত, তুমি।

আমার জন্যে এতটুকু করতে কি তুমি এখনো নারাজ?

নিশ্চয়। তোমার জন্যে আমি কিছুই করতে রাজি নই। এর জন্যে তোমার কী দুর্নাম ঘটবে। তার দায়িত্ব আমার নেই। সেইটাই তোমার উপযুক্ত পুরস্কার। দশজনের কাছে তুমি যদি হেয় প্রতিপন্ন হও, সমাজে সবাই যদি তোমাকে দূর-দাই করে তাহলেও তোমার জন্যে আমার কোনো দুঃখ হবে না। পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে তোমার দুষ্কর্মের ভাগীদার হতে তুমি আমার শরণাপন্ন হয়েছ দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভেবেছিলেম অন্য মানুষের চরিত্র সম্বন্ধে তোমার কিছু জ্ঞান জন্মেছে। তোমার বন্ধু লর্ড হেনরি ওটন তোমাকে যাই শিখিয়ে থাকুন মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে কিছুই শেখাননি। তোমাকে সাহায্য করার জন্যে একটা। আঙুলও আমি তুলতে রাজি নই। তুমি ভুল লোকের কাছে এসেছ। সাহায্যের জন্যে তুমি তোমার বন্ধুদের কাছে যাও–আমার কাছে এস না।

অ্যালেন, ব্যাপারটা হচ্ছে হত্যা। আমি তাকে হত্যা করেছি। তুমি জান না তারই জন্যে। জীবনে আমি কত যন্ত্রণা ভোগ করেছি। আমি আজ যে-অবস্থায় এসে পৌঁছেছি তার জন্যে হ্যারির অবদান যত তার চেয়ে অনেক বেশি অবদান ছিল তার ভালোর জন্যেও বটে, খারাপের জন্যেও বটোতার ইচ্ছে হয়তো তা ছিল না; কিন্তু হরে-দরে জিনিসটা একই দাঁড়িয়েছে।

হত্যা! হায় ভগবান! শেষ পর্যন্ত ডোরিয়েন, তুমি এতটা নীচে নেমে এসেছ? এদিক থেকে কোনো সাহায্য আমার তুমি পাবে না। ও কাজ আমার নয়। তা ছাড়া, আমার সাহায্য ছাড়াই পুলিশ তোমাকে শীঘ্রই গ্রেপ্তার করবে। মূর্খ ছাড়া কেউ কোনো পাপ কাজ করে না। কিন্তু এবিষয়ে আমার কিছুই করণীয় নেই।

তোমাকে কিছু একটা করতেই হবে। থাম, থাম; অস্থির হয়ো না। আমার কথা শোনো, শোনো না অ্যালেন। তুমি একটু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা কর। এ ছাড়া আর কি আমি চাইনে। তুমি হাসপাতালেও যাও, মর্গে যাও; সে-সব ভাযগায় তুমি যে বীভৎস মৃতদেহ দেখ সেগুলি তোমার ওপরে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কোনো নোংরা শবব্যবচ্ছেদগারের টেবিলের ওপরে যদি তুমি এই মানুষটিকে শায়িত অবস্থায় দেখতে তাহলে বস্তুটিকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার উপযুক্ত আধার ভেবে তুমি কেবল খুশিই হতো এতটুকু দ্বিধা করতে না তুমি তোমার একবারও মনে হত না যে তুমি কিছু অন্যায় করতে যাচ্ছ; বরং তোমার মনে। হত মনুষ্য জাতির একটা উপকার তুমি করছ। বিশ্বের জ্ঞান বাড়িয়ে দিচ্ছ অথবা চিন্তার। কিছুটা কৌতূহল মেটাস্থ বা ওই জাতীয় কোনো সৎ কাডে তুমি নিজেকে উৎসর্গ করেছ। যে। কাজ আগেও তুমি অনেকবারই করেছ সেই রকম একটা কাজই আমি তোমাকে আজ করতে বলছি। বরং, যে-কাজ করতে তুমি অভ্যস্ত, এ কাজ তার চেয়ে অনেক কম ভযুদ্ধর–এই পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়াটা। মনে রেখ, আমার বিরুদ্ধে এটাই একমাত্র সাী। এই মৃতদেহ যদি কেউ আবিষ্কার করে ফেলে তাহলেই আমরা শেষ; আর তুমি যদি আমাকে সাহায্য না কর, তাহলে আমি ধরা পড়ে যাবই।

তোমাকে সাহায্য করার কোনো বাসনা আমার নেই। সেই কথাটাই তুমি ভুলে যাচ্ছ। এই ব্যাপারটাতেই কোনো আগ্রহ নেই আমার। এর সঙ্গে নিজেকে আমি জড়াতে চাই নে।

অ্যালেন, তোমাকে আমি অনুরোধ করছি। আমি কী গাড্ডায় পড়েছি সেকথাটা একবার ভেবে দেখা তুমি এখানে আসার ঠিক আগে পর্যন্ত ভয়ে আমি আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকেও হয়তো একদিন এই অবস্থায় পড়তে হতে পারে। না, তা ভেব না। গোটা। ব্যাপারটিকে তুমি কেবল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা পরীক্ষা করতে গিয়ে কোথা থেকে মৃতদেহটি পাওয়া গিয়েছে সেই অনুসন্ধান কি তুমি কোনোদিন কর? সুতরাং এখনো তা জানতে চেয়ো না। তোমাকে আমি অনেক কথা বলে ফেলেছি। তোমাকে অনুরোধ করছি এই কাজটি তুমি করে দাও। অ্যালেন, আমরা একদিন বন্ধু ছিলেম।

ডোরিয়েন, সে-সব দিনের কথা আর তুলো না; সেগুলি আজ মৃত।

মাঝে-মাঝে মৃতেরাও বেঁচে থাকে। ওপরে যে-মালটি রয়েছে সে চলে যাবে না। মাথা নীচ করে হাত দুটি ছড়িয়ে সে টেবিলের ওপরে বসে রয়েছে। অ্যালেন, অ্যালেন–তুমি যদি আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে না আস তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব। বুক ত পারছ না। যা করে ফেলেছি, তার জন্যে ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে।

এ নিয়ে আর বেশি কচকচি করে লাভ নেই। এ বিষয়ে কিছু করতে আমি রাজি নই। উন্মাদ না হলে এ অনুরোধ তুমি আমাকে করতে না।

রাজি নও তুমি?

না।

অ্যালেন, আমার অনুরোধ।

অনর্থক অনুরোধ করো না।

ডোরিয়েন-এর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। তারপরেই তিনি হাত বাড়িয়ে এক টুকরো কাগজ টেনে নিলেন; তার ওপরে একটা কী যেন লিখলেন। বার দুই পড়লেন; ভালো করে ভাঁজ করলেন; তারপরে সেটিকে টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলে দিলেন।

চিঠিটা ঠেলে দিয়ে উঠে পড়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।

তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ক্যাম্পবেল; তারপরে কাগজটা টেনে নিয়ে পড়লেন, পড়তে-পড়তে তাঁর মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠল; তিনি চেয়ারের ওপরে বসে পড়লেন। একটা ভয়াবহ অস্থিরতা গ্রাস করে ফেলল তাঁকে। মনে হল, একটা শূন্য গুহার দেওয়ালে তাঁর হৃৎপিণ্ডটা যেন অনবরত মাথা ঠুকে চলেছে।

দু’তিন মিনিটের মতো একটা ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা নেমে এল। তারপরে, ডোরিয়েন ঘুরে দাঁড়ালেন, ক্যাম্ববেলের পেছনে এসে তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন।

আস্তে-আস্তে বললেন ডোরিয়েন তোমার জন্যে আমি দুঃখিত, অ্যালেন, কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো পথআমার জন্যে তুমি খোলা রাখনি। আমি আগেই চিঠি লিখে রেখেছি। এই দেখ, কোথায় পাঠানোর কথা তাও তুমি দেখতে পাচ্ছ। যদি তুমি আমাকে সাহায্য না কর তাহলে এ চিঠি আমি যথাস্থানেই পাঠিয়ে দেব। এর ফল কী হবে তা তুমি জান। কিন্তু তুমি আমাকে সাহায্য করবে; বর্তমান পরিস্থিতিতে সাহায্য না করাটা তোমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। তুমি নিশ্চয় স্বীকার করবে যে তোমাকে আমি বাঁচতেই চেয়েছিলেম। কিন্তু আমার সঙ্গে ত্ব অত্যন্ত বুঢ় ব্যবহার করেছ। তুমি আমাকে যেভাবে অপমান করেছ ঠিক সেই ভাবে অপমান করার দুঃসাহস আজ পর্যন্ত কোনো জীবন্ত মানুষের হয়নি। আমি সব সহ্য করেছি। এখন বদলা নেওয়ার পালা আমার।

দু’হাতের মধ্যে মুখটাকে লুকিয়ে ফেললেন ক্যাম্পবেল; তাঁর শরীরটা কাঁপতে লাগল।

হ্যাঁ, অ্যালেন, এখন তুমি আমার হাতের মুঠোয়। তোমাকে কী করতে হবে তা তুমি জান। কাজটা খুব সহজ এস; অনর্থক উত্তেজিত হযো না. দুর্বল করে ফেল না। নিজেকে। কাজটা করতেই হবে। সুতরাং আর দেরি করো না।

ক্যাম্পবেলের ঠোঁটের ভেতর দিয়ে একটা মৃদু গোঙানি বেরিয়ে এল। সারা শরীরটা তাঁর কেঁপে কেঁপে উঠল। সেলফ-এর ওপরে ঘড়ির টিকটিক শব্দ মনে হল সময়টাকে যেন অসংখ্য টুকরো-টুকরো যন্ত্রণার অণুতে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলছে। সেই যন্ত্রণা সহ্য করা কষ্টকর। তাঁর মনে হল যেন একটা লোহার সাঁড়াশি ধীরে ধীরে তাঁর কপালের ওপরে চেপে বসছে। যে-কলঙ্কের ভয় তাঁকে দেখানো হয়েছে, তাঁর মনে হল সেই কলঙ্কের কা