হ্যারি, এই রকম কথা বলছ কী করে?
প্রিয় বন্ধু, যেমন করেই বলি, কথাটা সত্যি। বর্তমানে আমি নারীচরিত্র বিশ্লেষণ করছি। সুতরাং নারীচরিত্র বলতে কী বোঝা যায় তা আমার জানা উচিত। বিশ্লেষণ করে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে নারী মূলত দুটি শ্রেণির সাধারণ এবং রঙিনা সাধারণ অর্থাৎ ঘরোয়া মহিলারা প্রয়োজন মেটানোর দিক থেকে উৎকৃষ্ট। তুমি যদি সমাজে সম্ভ্রম পেতে চাও তাহলে এই শ্রেণির একটি মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢোক। অন্য শ্রেণির মহিলারা দেখতে সুন্দরী, কিন্তু তারা একটা ভুল করে। নিজেদের যুবতী বলে জাহির করার জন্যে তারা অতিমাত্রায় প্রসাধন করে। আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা প্রসাধন করতেন সুন্দর করে কথা বলার জন্যে। রুভ-পাউডারের সঙ্গে তখন মেশানো থাকত বুদ্ধিদীপ্ত বাক্যবিন্যাসের কলাকৌশল। কিন্তু সে যুগকে আমরা আজ হারিয়েছি। আজকাল মহিলারা খুশি হয় কিসে জান? যদি তারা নিজেদের ব্যসটাকে তাদের মেয়েদের বয়সের চেয়ে দশটা বছর কমিযে। আনতে পারে। আর বাচনভঙ্গির কলাকৌশলের কথা যদি ধর তাহলে আমি বলব যে বর্তমানে সারা লন্ডন শহরে ওই ডাতীয়া মহিলা মাত্র পাঁচজন রয়েছেন। এবং সেই পাঁচজনের মধ্যে দুজনকে কোনো সভ্য, বিদগ্ধ সমাজে বার করা যায় না। সে যাক গে, এখন তোমার ওই ভিনিযাসটির সম্বন্ধে আমাকে কিছু বল। কদিন তোমাদের আলাপ হয়েছে?
হায় হ্যারি, তোমার কথা শুনে আমার ভয় লাগছে।
ওকথা বাদ দাও। কদ্দিন তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তোমার?
তিন সপ্তাহের কাছাকাছি।
তার সঙ্গে তোমার দেখা হল কোথায়?
তোমাকে আমি সব বলছি, হ্যারি। কিন্তু আমার কাহিনি শুনে তুমি নির্দযের মতো হাসবে না। অবশ্য তোমার সঙ্গে পরিচয় না হলে এ সমস্যা আমার কোনোদিনই দেখা দিত না। জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ভালো করে দেখার একটা উন্মাদ কামনা তুমিই আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার পরে অনেকদিন আমার শিরায়-শিরায় কৌতূহলের ঢল নেমেছিল। পার্কে ঘুরতে ঘুরতে অথবা পিকাডেলির পথে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে বেড়াতে বেড়াতে একটা উদগ্র বাসনা নিয়ে, একটি অপ্রতিরোধ্য কৌতূহল নিয়ে পথচারী প্রতিটি মানুষের দিকে আমি তাকিয়ে থাকতাম। কী ভাবে তারা বেঁচে রয়েছে তাই অনুসন্ধান করে বেড়াতাম। কেউ কেউ আমাকে মুগ্ধ করেছিল, কেউ কেউ বা আমাকে করে তুলেছিল ভয়ার্ত। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল লক্ষ লষ্ক বিষের অতি মনোরম কণিকা। উন্মাদ উচ্ছ্বাসের। ওপর আমার কেমন যেন একটা ঝোঁক ছিল।…তারপরে একদিন সন্ধ্যায় জীবনের সম্বন্ধে নতুন কোনো অভিজ্ঞতা সঞ্চযের উদ্দেশ্যে আমি বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। আমি মনে করেছিলাম আমাদের এই ধোঁয়াটে রঙের দানব লন্ডন শহর কেবল বহু বিচিত্র মানুষেরই আবাসস্থল নয়, আদর্শহীন পাপী আর গৌরবময় পাপে একেবারে বোঝাই। লন্ডনের এই ব্যাখ্যা অবশ্য তোমারই। ভেবেছিলাম এ-হেন লন্ডন শহর আমার জন্যে কিছু সঞ্চয় করে রেখেছে হাজার রকমের কল্পনায় মন আমার উদ্বেলিত হয়ে উঠল। নিছক বিপদের সম্ভাবনা আমাকে উৎসাহিত করল। সে চমৎকার রাত্রিতে আমরা দুজনে একসঙ্গে প্রথম ডিনার খেলাম সেদিন। তুমি আমাকে যা বলেছিল তা আমার মলে ছিল। ঠিক কী চাইছিলাম তা আমি জানতাম না, কিন্তু আমি বেরিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে পূর্বদিকে হাঁটতে হাঁটতে শেষ পর্যন্ত আমি। শক্ত দৈত্যদীঘল গাছ, কালো আর রুক্ষ পার্কের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। সাড়ে আটটার কাছাকাছি আমি একটা কিম্ভুতকিমাকার ছোটো থিয়েটারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, বড়ো বড়ো গ্যাসের আলো আর মোটা মোটা হরফে লেখা পোস্টারে ঝকমক করছিল তার দেওয়ালগুলি। একটি বিরাটাকার জু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সস্তাদামের সিগার খাচ্ছিল। তার গায়ের ওপরে ওয়েস্ট কোট দেখে আমার হাসি পাচ্ছিল। আসল কথা, ওরকম পোশাক জীবনে আর কখনো আমার চোখে পড়েনি। তার আঙুলে একটা তেল চিটচিটে ছোটো আঙটি, একটা। নোংরা শার্টের মাঝখানে বিরাট একটা হিরে বসালো। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে জিজ্ঞাসা করল, মি লার্ড, একটা বক্স চাই? এই কথা বলেই দাসত্বের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে। আমাকে অভিবাদন জানানোর উদ্দেশ্যে সে তার টুপিটা খুলে ফেলল। হ্যারি, লোকটির মধ্যে এমন একটি জিনিস ছিল যা আমার কাছে বেশ কৌতুকপ্রদ বলে মনে হয়েছিল। চেহারার দিক থেকে মানুষটা একেবারে দৈত্যবিশেষ। বুঝতে পারছি আমার কথা শুনে মনে মনে তুমি হাসছ, কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই ভেতরে ঢুকে এক গিনি খরচ করে একটা বক্সের টিকিট কিনে ফেললাম। কেনই বা ওই থিয়েটারে ঢুকলাম, আর কেনই বা অত দামের টিকিট কিনলাম তা আমি আজও বুঝতে পারছি না, তবু একথাও সত্যি যে আমি যদি সেদিন না যেতাম, সত্যি বলছি হ্যারি, তাহলে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রোমান্স থেকে বঞ্চিত হতাম আমি। দেখতে পাচ্ছি আমার কথা শুনে তুমি হাসছ। ভারি অন্যায়, ভারি অন্যায়।
না ডোরিয়েন, আমি হাসছি না, অন্তত তোমাকে উপহাস করার জন্যে হাসছি না। কিন্তু তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রোমান্স বলে ওটিকে চিহ্নিত করো না। বরং বল, ওটি তোমার জীবনের প্রথম রোমান্স। সব সময়েই তোমাকে কেউ না কেউ ভালোবাসবে, তুমি ভালোবাসবে কাউকে না কাউকে করার মতো কোনো কাজ যাদের হাতে থাকে না এই রকম উচ্ছ্বাসের শিকার হওয়ার নৈতিক অধিকার নিশ্চয় তাদের রয়েছে। দেশের অলস শ্রেণির ওইটিই একমাত্র কাজ। ভয় পেযো না। অনেক অপরূপ সুন্দর জিনিস তোমার জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছে। এই তো সবে শুরু।