জিনা স্মিত হাসল। কিশোর গুঙিয়ে উঠল।
এসো, ছেলেরা! বলল পাক। আমার সঙ্গে এসো!
কিশোর আর জিনাকে পিছনে নিয়ে কস্টিউম রূম ত্যাগ করে হলওয়েতে বেরিয়ে এল পাক। এবার ওদেরকে মঞ্চের পিছনদিকে আঁধার মত এক জায়গায় নিয়ে এল।
অভিনেতারা নীরবে কাছেই দাঁড়ানো, মঞ্চে ওঠার অপেক্ষায়। একজন পরেছে চমৎকার এক সাদা গাউন। অন্যদের গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া বাদামি পোশাক।
কিশোর এক ধনুকাকৃতি খিলান ভেদ করে মঞ্চের ছাদ দেখতে পেল। নীলের পটভূমিতে অজস্র তারা আর একটা চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। মঞ্চের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে বিশাল এক জনতা। উপরের গ্যালারি থেকে দেখছে আরও বেশি দর্শক।
ইংল্যাণ্ডের সমস্ত মানুষ এখানে জ্বড় হয়েছে! ভাবল কিশোর। জিনার কথায় আমি রাজি হলাম কীভাবে?
আমি আগে তোমাকে মঞ্চে নিয়ে যাব, পাক ফিসফিস করে কিশোরকে বলল। আমি যখন বলব, হাউ নাও, স্পিরিট! উইদার ওয়াণ্ডার ইউ? তুমি তোমার লাইনগুলো পড়তে শুরু করবে। বুঝতে পেরেছ? বা কোনমতে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ওর গলা শুকনো ঠেকছে। ঢোক গিলতে চেষ্টা করে পারল না।
পাক এবার জিনার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
তুমি পরী রানীর সাথে মঞ্চে যাবে, ফিসফিস করে বলল। মনোলোভা সাদা গাউন পরা অভিনেতাটিকে আঙুল ইশারায় দেখাল ও। ও যখন তোমাকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে বলবে, তখন তুমি তোমার গানটা শুরু করবে।
সুর? প্রশ্ন করল জিনা।
বানিয়ে নিয়ে যা খুশি একটা, বলল পাক। ওরা যদি উল্টোপাল্টা বলে, চেঁচামেচি করে, তবুও থামবে না। স্রেফ
কারা উল্টোপাল্টা বলবে, চেঁচামেচি করবে? হস্তক্ষেপ করল কিশোর।
গ্রাউণ্ডলিংরা একটু বুনো স্বভাবের হয়ে থাকে আরকী, বলল পাক।
গ্রাউণ্ডলিং কারা? কিশোরের প্রশ্ন।
যে সব উচ্ছঙ্খল লোকেদের বাসায় জায়গা নেই, বলল পাক। ওরা মঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দুএকজন পচা ফল ছুঁড়লেও থেমো না। চালিয়ে যেয়ো।
অনেক হয়েছে আর নয়, ভাবল কিশোর।
মঞ্চে উঠতে পারবে না ও-যখন উচ্ছঙ্খল দর্শকরা পচা ফল ছুঁড়বে, তিন হাজার দর্শক নাটক দেখবে, অসংখ্য লাইন পড়তে হবে-এবং ওকে যে মুহূর্তে অভিনয় করতে হবে।
পাক আর জিনা যখন নাটক দেখছে, আলগোছে সরে পড়ল কিশোর। বেরনোর পথ খুঁজছে। সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছে, এমনি সময় ধাক্কা খেল উইলের সঙ্গে।
চললে কোথায়? উইল ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করল।
শরীর খারাপ করছে! বলল কিশোর। আমি পারব না।
আঁতকে উঠল উইল। পরমুহূর্তে কিশোরের কাঁধে দুহাত রেখে শান্ত স্বরে কথা বলল।
এক মুহূর্তের জন্যে চোখ বোজো, কিশোর, বলল
চোখ বুজল কিশোর। বুক ধড়ফড় করছে।
ভয়ের কিছু নেই, ফিসফিস করে বলল উইল। কল্পনা করো তুমি একটা পরী। গরমের এক রাতে বনের ভিতরে রয়েছ। মাথার উপরে রূপালী চাঁদ দেখতে পাচ্ছ? শুনতে পাচ্ছ পেঁচার ডাক? হু-হুঁ।
উইলের গভীর ফিসফিসানি যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে দিল কিশোরকে। শরীর মন শিথিল হয়ে এল ওর। রূপালী চাঁদের ছবি ফুটে উঠল মনের পর্দায়। কানে এল পেঁচাঁদের ডাক।
তুমি কি গরমের এক দিনে বনের ভিতরে রয়েছ? প্রশ্ন করল উইল।
কিশোর মাথা ঝাঁকাল।
তুমি এটা বিশ্বাস করলে দর্শকরাও করবে, ফিসফিস করে বলল উইল।
কই, এসো! ফিসফিসাল পাক। মোটাসোটা অভিনেতাটি দৌড়ে এল কিশোরের কাছে। ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে মঞ্চে আবিষ্কার করল কিশোর!
৭
উজ্জ্বল সূর্যালোকে মঞ্চে দাঁড়াল কিশোর। তিন হাজার জোড়া চোখ ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে।
হাউ নাও, স্পিরিট! চড়া গলায় বলল পাক। উইদার ওয়াণ্ডার ইউ?
নিজের স্ক্রলের দিকে চোখ নামিয়ে চাইল কিশোর। এবার মুখ খুলল। কোন শব্দ বেরোল না।
এক গ্রাউণ্ডলিং হিসিয়ে উঠল।
হাউ নাও, স্পিরিট! এবারে গলা আরও চড়াল পাক। উইদার ওয়াণ্ডার ইউ?
চোখ বুজল কিশোর। গরমের রাতের অনুভব নিল। গভীর শ্বাস টানল। গলা খাকরাল। ভাষণটার দিকে চাইল।
এবার পড়তে শুরু করল:
ওভার হিল, ওভার ডেল,
থ্রু বুশ, থু ব্রায়ার,
ওভার পার্ক, ওভার পেল,
থ্রু ফ্লাড, থ্রু ফায়ার,
আই ডু ওয়াণ্ডার এভরিওয়্যার,
সুইফটার দ্যান দ্য মুনস স্ফিয়ার;
অ্যাণ্ড আই সার্ভ দ্য ফেয়ারি কুইন…
কিশোর যখন পড়ছে, দর্শকরা শান্ত হয়ে এল। কিশোর ভুলে গেল ও যে কিশোর। রাতের বেলা বনভূমির ভিতরে, পাকের সঙ্গে কথা বলছে যেন সে।
ওর পড়া শেষ হলে কেউ হিসিয়ে উঠল না কিংবা কোন কিছু ছুঁড়ে মারল না।
পাক তার লাইনগুলো পড়তে আরম্ভ করলে বুক ভরে শ্বাস টানল কিশোর। ওকে আরেকটা ভাষণ পড়তে হবে। বুকের ভিতরে ধড়াস-ধড়াস করছে ওর। ভয়ের কারণে যতটা না তার চাইতে বেশি উত্তেজনার ফলে।
দ্বিতীয় বক্ততার সময় তৈরি ছিল কিশোর। এবার স্পষ্টভাবে আর আবেগ ঢেলে পড়ল ও। চেষ্টা করল যথাসম্ভব স্বাভাবিকতা ফুটিয়ে তুলতে। ওর পড়া শেষ হলে দর্শকরা হাত তালিতে ফেটে পড়ল।
কীভাবে মঞ্চ ত্যাগ করল বলতে পারবে না কিশোর। উইল ওর জন্য অপেক্ষা করছিল।
সাবাস! বলে কিশোরের পিঠ চাপড়ে দিল উইল। তুলনাহীন!
লজ্জায় লাল কিশোর উইলের স্ক্রলটা ফিরিয়ে দিল। এত লোকের সামনে পারফর্ম করেছে বিশ্বাস হতে চাইছে না ওর। এবং জিনার কথা মত সত্যিই আনন্দ পেয়েছে ও।
ছায়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে জিনার পড়া শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল কিশোর। পরী রানী এবং অন্যান্য পরীদের সঙ্গে ওকে মঞ্চে উঠতে দেখল ও।