কিশোর একদৃষ্টে চেয়ে রইল। লোকটা জেনেশুনে কথা বলছে তো?
আপনি কিশোরকে আপনার নাটকে নিতে চান? প্রশ্ন করল জিনা।
হ্যাঁ! বলে উঠল, লোকটি। তিন হাজার লোক এসেছে আমার লেখা নাটক দেখতে! তাদেরকে আমরা হতাশ করি কীভাবে!
তিন হাজার? বলল কিশোর।
হ্যাঁ! জানাল লোকটি। এবং তাদের মধ্যে একজন দুনিয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ!
না, সম্ভব নয়। আমি পারব না, বলল কিশোর। আমাদের অন্য কাজ আছে।
দাঁড়াও, দাঁড়াও, বাধা দিল জিনা। ফিরে তাকাল লোকটির দিকে। আপনার দুটো পরী দরকার, তাই না?
হ্যাঁ, বলল লোকটি।
হুম… মাথা কাত করে বলল জিনা। গলা চড়ে গেল ওর। আমিও ভাল আবৃত্তি জানি।
হ্যাঁ! জিনাকে নিয়ে নিন, বলল কিশোর। ও ভাল আবৃত্তি জানে। দুটো পরীর কাজ একাই চালিয়ে নিতে পারবে!
তা তো বুঝলাম, কিন্তু জিনা তো মঞ্চে উঠতে পারবে না, নরম কণ্ঠে জানাল লোকটি।
কেন পারব না? প্রশ্ন করল জিনা।
ভ্রূ উঁচু করল লোকটি।
আইনে মেয়েদের নাটক করা নিষেধ, বলল সে। ছেলেরাই মেয়েদের পার্ট করে।
কিন্তু এটা কেমন কথা! বলে উঠল জিনা।
জানি ভাল কথা নয়। কিন্তু কী করব, আইন বলে কথা, বলল লোকটি। কিশোরের দিকে ঘুরে চাইল। তো, কিশোর! তুমি অভিনয় করছ তো?
না, ধন্যবাদ, বলল কিশোর। পা বাড়াতেই জিনা ওর বাহু চেপে ধরল।
আমি জানি কিশোর কী চাইছে, লোকটিকে বলল ও। আমাকে নিলেই শুধু নাটকে অভিনয় করবে ও।
আমি তা চাইছি না, জিনা, শ্বাসের নীচে বলল কিশোর।
কিন্তু, কিশোর, ভেবে দেখো কত মজা হবে, ফিসফিস করে বলল জিনা। ভয়ের কী আছে! তুমি শুধু তোমার পার্টটা পড়ে যাবে। মুখস্থ তো করতে হচ্ছে না।
কিশোর উপলব্ধি করল জিনা নাটকে অংশ নেয়ার জন্য উন্মুখ। ভালুকটার দিক থেকে ওর মন সরানোর জন্য এটা একটা ভাল পথ হতে পারে।
আচ্ছা, ঠিক আছে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল ও। লোকটির দিকে চাইল।
জিনাকে নিলে আমি আপনার নাটকে কাজ করতে রাজি।
লোকটি জিনার দিকে চাইল। জিনা তার দিকে চোখে আশা নিয়ে চেয়ে রয়েছে। মুখে মৃদু হাসি।
লোকটিও পাল্টা হাসল।
বেশ তো, অসুবিধে কী? বলল সে। কিন্তু জিনাকে ভান করতে হবে ও মেয়ে নয়, ছেলে। চুল গোটাতে হবে ওকে। আমরা ওকে অ্যাণ্ডি বলে ডাকব।
ঠিক আছে। ধন্যবাদ, হাসি মুখে বলল জিনা।
থিয়েটারের ভিতরে ট্রাম্পেট বেজে উঠল।
জলদি চল, নাটক এখুনি শুরু হবে! লোকটি বলল। কিশোর আর জিনার হাত ধরে নিয়ে চলল।..
আপনার নামটা তো জানা হলো না, বলল জিনা।
আমার নাম উইল, বলল লোকটা। এসো, কিশোর আর অ্যাণ্ডি! ছায়ার মত দ্রুত চলো।
নামটা শুনে খটকা লাগল কিশোরের। লোকটার চেহারা প্রথম থেকেই কেমন যেন চেনা-চেনা লেগেছে ওর। কে এই উইল?
৬
উইল কিশোর আর জিনাকে এক দরজার ভিতর দিয়ে গ্লোব থিয়েটারের পিছন দিকে নিয়ে এল। এবার ওদেরকে পিছনে নিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল।
উপরে উঠছে, দর্শকদের হাসির শব্দ শোনা গেল। কিশোর নার্ভাস বোধ করল।
এদিকে, বলল উইল।
তাকে অনুসরণ করে জনাকীর্ণ, স্বল্পালোকিত এক কামরায় প্রবেশ করল কিশোর আর জিনা। চারদিকে অভিনেতাদের ব্যস্ত ছোটাছুটি। সবাই যেন তার নিজস্ব জগতে বিরাজ করছে। একজন আলখিল্লা পরছে। আরেকজন কোমরে রশি বাঁধছে। তৃতীয়জন ফিসফিস করে নিজের সাথে কথা বলছে।
আমি তোমাদের পোশাক খুঁজে দিচ্ছি, বলল উইল।
উইল কাপড় ভর্তি বিশাল এক ঝুড়ির মধ্যে হাত ভরে দিল। কিশোর আর জিনা কস্টিউম রূমের চারপাশে নজর বুলাল। কামরাটা চটকদার গাউন, বেগুনী আর নীল আলখেল্লা, সোনালী-রূপালী পরচুলা, হ্যাট, মুখোশে ঠাসা।
চমৎকার, ফিসফিস করে বলল জিনা। একটা গাধার ও একটা সিংহের মুখোশ স্পর্শ করল। এগুলো দারুণ ছদ্মবেশ হতে পারে, তাই না?
জিনার শান্ত-শিষ্ট ভাব দেখে একটু অবাকই হলো কিশোর। ও কি ভুলে গেছে ওদেরকে তিন হাজার মানুষের সামনে দাঁড়াতে হবে? ভাবনাটা মাথায় আসতেই ঢোক গিলল কিশোর। পেটের ভিতরে প্রজাপতির নাচ অনুভব করল।
এই নাও! বলল উইল। ওদের হাতে সবুজ পোশাক, হ্যাট আর চটী তুলে দিল। এগুলো পরে নাও! একদম সময় নেই! শীঘ্রি তোমাদের পালা। আসবে!
কিশোর আর জিনা সাত করে এক পর্দার আড়ালে গিয়ে পোশাক পাল্টে নিল। হ্যাট পরার সময় জিনা ওর পিগটেইল লুকাল।
ওরা বেরিয়ে এলে, উইল দুজনের হাতেই একটা করে গোটানো, ছোট কাগজ তুলে দিল।
এগুলো তোমাদের রোল, বলল সে। শুধু তোমাদের লাইনগুলোই এতে আছে, অন্য কারওটা নেই।
নিজের কাগজটা আনরোল করল কিশোর। ওকে দুটো লম্বা ভাষণ পড়তে হবে।
এক সেকেণ্ড, বলল সে। আমি ভেবেছিলাম অল্প কয়েক লাইন। কিন্তু এ তো দেখছি মহাভারত।
চিন্তা কোরো না, বলল উইল। শুধু মনে রেখো-স্পষ্ট করে আর আবেগ দিয়ে পড়তে হবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা একদম স্বাভাবিক থাকতে হবে!
স্বাভাবিক থাকতে হবে! ভাবল কিশোর। টেনশন হচ্ছে, এ অবস্থায়। স্বাভাবিক থাকা যায়?
ঠিক এসময় বেঁটে, গোলগাল এক লোক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল কস্টিউম রূমে। লোকটার মাথায় কোঁকড়া চুল। গালজোড়া টকটকে লাল। পরনে আপাদমস্তক সবুজ পোশাক।
হায় ঈশ্বর! আতঙ্কিত ফিসফিসে স্বরে বলল সে। এখন কী হবে, উইল?
ভেবো না! দেখো কাদেরকে পেয়েছি! এরা দুজনেই পড়তে পারে! জানাল উইল। কিশোর আর জিনাকে সামনে ঠেলে দিল। কিশোর আর অ্যাণ্ডি, তোমরা রাতের বেলা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো পাকের সঙ্গে পরিচিত হও। ও তোমাদেরকে মঞ্চে নিয়ে যাবে। গুড লাক!