ট্রী হাউসটা চওড়া, বাদামি এক নদীর কাছে, গাছ-গাছালির এক জটলার মধ্যে নেমেছে। ওয়াগন, ঠেলাগাড়ি আর মানুষ-জন এগিয়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। পারাপারের নৌকা, পাল তোলা জাহাজ আর সাদা রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে পানিতে।
বাব্বা, একেবারে জমজমাট! বলল জিনা।
কিশোর ওদের গবেষণার বইটা খুলে পড়ল:
১৬০০ খ্রিস্টাব্দে, এক লাখের বেশি
মানুষ বাস করত ইংল্যাণ্ডের লণ্ডন শহরে। সে
সময় ইংল্যাণ্ড শাসন করতেন রানী
প্রথম এলিজাবেথ। জনগণ তাকে
খুব ভালবাসত।
রানী? ভাল তো, বলল জিনা।
কিশোর নোটবই বের করে তথ্যগুলো টুকে নিল।
এরকম ব্রিজ আগে দেখিনি, বাঁ দিকে চেয়ে বলল জিনা।
কিশোরও ওর সঙ্গে চাইল। নদীর উপরে বিশাল এক পাথুরে সেতু। সেতুটা অনেকটা যেন ছোটখাট এক শহরের মত। ওটায় গিজগিজ করছে বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট। এমনকী একটা গির্জাও রয়েছে।
কিশোর সেতুটার একটা ছবি খুঁজে পেল গবেষণার বইটায়। জোরে জোরে পড়ল ও:
লণ্ডন শহরের কেন্দ্রস্থলে ছিল লণ্ডন সেতু।
সেতুটা ছিল টেমস নদীর উপরে। ইতিহাসের নানান
সময়ে সেতুটা ধসে পড়ে। কিন্তু ওটাকে
বারবারই মেরামত করা হয়।
এইবার বুঝেছি, বলে উঠল জিনা। গানটা কোত্থেকে এসেছে। ও গাইল, লণ্ডন ব্রিজ ইয় ফলিং ডাউন, ফলিং ডাউন…
জিনা গান গাইছে, কিশোর নোটবই বের করে তথ্যগুলো লিখে নিল।
এবার জাদুটা খুঁজি চলো বলল জিনা। মরগ্যানের চিরকুটটা পড়ল আবারও:
টু ফাইণ্ড আ স্পেশাল ম্যাজিক,
ইউ মাস্ট স্টেপ ইনটু দ্য লাইট
অ্যাণ্ড উইদাউট ওয়্যাণ্ড, স্পেল, অর চার্ম,
টার্ন ডেটাইম ইনটু নাইট।
কিশোর চোখ পিটপিট করে আকাশের দিকে চাইল। মেঘশূন্য গাঢ় নীল। আকাশ।
এটা সম্ভব নয়, বলে মাথা নাড়ল ও।
কিন্তু ও গবেষণার বই আর নোট বইটা চামড়ার ব্যাগের ভিতরে ছুঁড়ে দিল। এবার জিনাকে অনুসরণ করে দড়ির মই বেয়ে নামতে লাগল। মাটিতে নেমে নদীর উদ্দেশে হেঁটে চলল।
এহ! বলে নাক টিপে ধরল জিনা।
নদী থেকে দুর্গন্ধ আসছে।
অন্য কেউ অবশ্য দুর্গন্ধটাকে পরোয়া করছে না। লোকজন খোশমেজাজে গাদাগাদি করে নৌকায় উঠছে, কিংবা সেতুর দিকে এগোচ্ছে। সবার মুখের চেহারায় খুশির ছাপ। কোথাও আমোদ-ফুর্তি করতে যাচ্ছে যেন।
এক দল রাস্তার ছেলে কিশোর আর জিনার পাশ দিয়ে চলে গেল। বারো-তেরো বছর বয়স হবে। হাসাহাসি করছে। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।
জলদি চল! দেরি হয়ে যাবে! একজন চেঁচিয়ে উঠল।
ছেলেগুলো সেতুর পাথুরে তোরণটার উদ্দেশে দৌড় দিল।
কীসের দেরি? প্রশ্ন করল জিনা। ব্রিজের ওপাশে কী আছে? ওদের এত তাড়াহুড়ো কীসের?
কে জানে, বলল কিশোর। গবেষণার বইটা টেনে বের করল। দেখি বইতে কী বলে।
না, চলো আমরাও যাই-নইলে দেরি হয়ে যাবে! বলল জিনা, ছুট দিল।
আচ্ছা, আচ্ছা, বলল কিশোর।
বইটা ঢুকিয়ে রেখে, জিনার পিছু পিছু লণ্ডন ব্রিজের দিকে দৌড় দিল।
৩
পাথুরে তোরণের নীচ দিয়ে লণ্ডন ব্রিজের দিকে পা বাড়াল কিশোর আর জিনা।
সেতুতে ওঠার পর, অবাক হয়ে গেল কিশোর। সেতুটা ভয়ানক কোলাহলমুখর। আর বাতাসে কীসের যেন দুর্গন্ধ। খোয়া বাধানো পথের উপর দিয়ে বাজের মত শব্দ তুলে গড়িয়ে চলেছে ওয়াগনের চাকা। মালগাড়িতে ঠনঠন শব্দে পাত্রে পাত্রে ঠোকাঠুকি। ঘোড়ারা হেষাধ্বনি করছে। দোকানদাররা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে।
অ্যাই পাই! পাই!
অ্যাই ভাজা মটরশুটি! ভাজা মটরশুটি!
অ্যাই পিন! পিন!
চাই জুতা! সাবান! লবণ!
এক দোকানীর সঙ্গে কিশোরের চোখাচোখি হয়ে গেল।
কিছু লাগবে, বাবু? চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল সে।
না, ধন্যবাদ, চলতে চলতেই বলল কিশোর।
সাবধান! এক মালগাড়ির চালক চেঁচাল।
কিশোর জিনার হাত ধরে রাস্তা থেকে টেনে সরিয়ে আনল। মালগাড়িটা সরু রাস্তা ধরে ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল।
দেখো! দেখো! বলে উঠল জিনা। মালগাড়ির পিছনে কাঠের খাঁচায় বন্দি এক ভালুক। সারা গায়ে বাদামী লোম। মাথা নোয়ানো।
মালগাড়িটাকে এগিয়ে যেতে দেখে মাথা নাড়ল কিশোর।
এবার কী? প্রশ্ন করল।
ওদিকে দেখো, বলে মুখ তুলে চাইল জিনা।
কয়েকটি বাড়ির ছাদের কিনারায় কুঁজো হয়ে বসে থাকা কালো রঙের বিশালকায় পাখিগুলোকে আঙুল ইশারায় দেখাল ও। পাখিগুলো ঠায় বসে নীচ দিয়ে চলে যাওয়া মালগাড়ি, মানুষ-জন আর জীব-জন্তুদের দেখছে। কিশোর শিউরে উঠে নীরব, দানব পাখিগুলোর দৃষ্টি এড়াতে দ্রুত পা চালাল।
শেষমেশ সেতুর শেষ প্রান্তে চলে এল ও আর জিনা। পা রাখল নদীর তীরে। এখানে থমকে দাঁড়িয়ে চারধারে চোখ বুলাল।
ছেলেগুলো গেল কোথায়? বলল জিনা।
কিশোর লক্ষ করল সেতুর সংযোগ রাস্তাটি ধরে এগিয়ে চলেছে জনতা। টোকাই ছেলেগুলোর ছায়া দেখা গেল না।
গবেষণার বইটা বের করল কিশোর। লণ্ডন ব্রিজের ছবি খুঁজে নিল। জোরে জোরে পড়ল:
লণ্ডন ব্রিজ ছিল নদীর দক্ষিণ তীরের সঙ্গে
লণ্ডনের সংযোগ সেতু। লণ্ডনবাসী
ওখানে যেত বিনোদনের জন্য। বেয়ার
গার্ডেন ছিল জনপ্রিয় একটি স্পট।
বেয়ার গার্ডেন? সোৎসাহে বলে উঠল জিনা। কোথায় সেটা?
কিশোর দক্ষিণ তীরের এক ম্যাপ খুঁজে পেল। গোল এক দাগের মধ্যে বেয়ার গার্ডেন চিহ্নিত করা হয়েছে।
এখানে, বলল ও। মুখ তুলে চাইল। আর…এখানে! দূরের কালো, গোল এক বিল্ডিঙে আঙুল রাখল।
দারুণ! বলে উঠল জিনা। বাগান ভর্তি ভালুক দেখতে চাই আমি।