ওরাও কি লেপ্রেকন?
মনে হয় না। ওর সহকারীরা নিশ্চয় নৌম কিংবা ট্রোল। এরাও রূপকথার প্রাণী। কোন মানুষের নকল বানানোয় ওস্তাদ।
.
ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম। রবিনের কথাগুলো কোনমতেই মন থেকে সরাতে পারছি না। ওর ব্যাখ্যাটা অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য। কিন্তু যে অবস্থায়
আলমারি থেকে ফিরে এল ফারিহা, সেটাও তো কম অদ্ভুত নয়। দেখতে অবিকল এক রকম হলেও ও এখন ভিন্ন এক ফারিহা।
কী করব বুঝতে পারছি না। এমন একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস্য অবাস্তব গল্প বিশ্বাস করব? মনটা খুঁতখুঁত করতেই থাকল। নাহ্, এর একটা বিহিত করতেই হবে।
বাড়ির সামনের দরজাটা বন্ধ দেখে পিছনের রান্নাঘরের দরজার দিকে এগোলাম। ওটা খোলা থাকতে পারে। এ সময় দেখতে পেলাম কুকুরটাকে। দেয়াল ঘেঁষে আরাম করে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ওকে দেখেই বুদ্ধিটা এসে গেল আমার মাথায়। ডাক দিলাম, জেমি! জেমি!
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কুকুরটা। ঠিক আমাদের পোষা নয়, রাস্তার কুকুরই, তবে আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে এসে থাকে। আঙিনায় ঘুমায়। খাবার দিলে খায়। ফারিহা নাম রেখেছে জেমি। নাম ধরে ডাকলে সাড়াও দেয় কুকুরটা। আমার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে জোরে জোরে লেজ নাড়তে লাগল। তারপর চিত হয়ে শুয়ে পা তুলে দিল আকাশের দিকে। চাইছে, আমি ওর পেট চুলকে আদর করে দিই।
এখন পারব না, কড়া গলায় বললাম। জরুরি কাজ আছে। আয় আমার সঙ্গে।
কুকুরটাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। আলমারি থেকে একটা কুকুরের গলার শিকল আর বেল্ট বের করে জেমির গলায় পরালাম। আগে একটা পোষা কুকুর ছিল আমার। রাস্তা থেকে ধরে এনেছিলাম। অসুখ হয়ে মরে গিয়েছিল কুকুরটা। বেল্ট আর শিকলটা তারই। যাই হোক, জেমি ভাবল, বেড়াতে নিয়ে যাব। দরজার দিকে দৌড় দিতে গেল। শিকল টেনে থামালাম। টেনে নিয়ে চললাম দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে।
দোতলার বারান্দা দিয়ে ফারিহার ঘরের দরজায় এসে থামলাম। থাবা দিলাম পাল্লায়। দরজা শুঁকছে জেমি। লেজ নাড়াচ্ছে।
এসো, ভিতর থেকে ডাকল একটা ভোতা নিরুত্তাপ কণ্ঠ। পাল্লাটা আমি পুরো খোলার আগেই মাথা দিয়ে ঠেলে ফাঁক করে ঘরে ঢুকে পড়ল জেমি। বিছানায় বসা ফারিহার দিকে ছুটল। তারপর হঠাৎ যেন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। একপাশে মাথা কাত করে রাগে গরগর শুরু করল। মেঝে শুকল। আমার দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করে কিছু বোঝাতে চাইল। তারপর ফারিহার দিকে তাকিয়ে গজরাতে লাগল।
বই পড়ছিল ফারিহা। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে জেমির দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে কুঁকড়ে গেল কুকুরটা, লেজ ঢুকিয়ে দিল দুই পায়ের ফাঁকে। কুঁই কুঁই করে শিকল সহ দরজার দিকে টেনে নিয়ে চলল আমাকে, যেন পালাতে পারলে বাঁচে। এত জোরে ছুটল, আমি ওকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে গেলাম। শেষে এক ঝাঁকিতে আমার হাত থেকে শিকলটা ছুটিয়ে নিয়ে। দিল দৌড়।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে পিছনের দরজার কাছে ওকে দেখতে পেলাম। দুই পা দিয়ে দরজা আঁচড়াচ্ছে, বাইরে বেরোনোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আবার ওর শিকল ধরে টেনে নিয়ে চললাম। আমার সঙ্গে আর যেতে চাইছে না ও। আবার যখন দোতলায় নিয়ে চললাম, কয়েক ধাপ উঠে সিঁড়ির ওপর বসে পড়ল। অনেক টানাটানি করেও ওকে তুলতে পারলাম না।
অথচ ফারিহাকে অসম্ভব ভালবাসে জেমি। ফারিহাই বেশির ভাগ সময়। কুকুরটার সঙ্গে খেলা করে। কিন্তু এখন ওকে দেখে এতটাই আতঙ্কিত জেমি, ওর সামনে যেতেও নারাজ। আমি জানি, এমন অনেক কিছুই টের পেয়ে যায়। কুকুররা, মানুষ যা পায় না। ফারিহার চেহারা সবাইকে ফাঁকি দিলেও জেমিকে দিতে পারেনি। ওর গায়ের গন্ধ, কণ্ঠস্বর অপরিচিত লেগেছে কুকুরটার কাছে। বুঝে গেছে, ও ফারিহা নয়।
আর কোন সন্দেহ রইল না আমার। রবিনের কথাই ঠিক।
জেমিকে আবার বাইরে ছেড়ে দিলাম। বাইরে বেরিয়ে একটা মুহূর্ত আর দাঁড়াল না, দৌড়ে বেরিয়ে গেল আমাদের বাড়ির সীমানা থেকে।
ফিরে গিয়ে দোতলায় উঠলাম। ফারিহার ঘরের দরজাটা খোলা। ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম, আগের মতই বিছানায় বসে আছে ফারিহা, কোন ভাবান্তর নেই।
ফারিহা, দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ক্রিকেট বলটা দেখেছ, শচীন টেণ্ডুলকারের সই নিয়েছিলাম যেটায়? ড্রেসারের ওপর ছিল।
বই থেকে মুখ তুলল না ফারিহার চেহারার মেয়েটা, কিংবা, আইরিশ রূপকথার চেইনজেলিংটা। জবাব দিল, না, দেখিনি। ..
কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ দেখলাম ওকে।
কে তুমি? সাহস করে শেষে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম। নিজের কানেই বেখাপ্পা আর কর্কশ শোনাল আমার কণ্ঠ। ধড়াস ধড়াস লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা।
মুখ তুলে তাকাল মেয়েটা।
অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।
কঠিন হাসি ছড়িয়ে পড়ল ওর মুখে। কেন, আমি তোমার খালাত বোন ফারিহা, চিনতে পারছ না??
বদলে গেছে ওর কণ্ঠস্বর। ভয় পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি ওর ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে এসে ঢুকলাম নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে ভিতর থেকে তালা। আটকে দিলাম। বিছানায় বসে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ভাবতে লাগলাম, এরপর কী করব?
৮
আমি এখন শিওর, টেলিফোনে বললাম রবিনকে, তোমার কথাই ঠিক। ওই মেয়েটা আমার বোন নয়। কিন্তু কী করব এখন? কাউকে বিশ্বাস করাতে পারব না আমাদের কথা।