ফারিহার পালা এল। বালিশের কভারের ভিতর থেকে একটা সাদা বল। বের করল ও। দেখে আর সহ্য করতে পারলাম না, লাফিয়ে উঠে বসলাম। হায় হায়, ওটা দিয়ে দিচ্ছে! আমার ক্রিকেট বলটা!
হাত ধরে টেনে আমাকে মাটিতে শুইয়ে দিল রবিন। আমার মুখ চেপে ধরল। কানের কাছে রাগত স্বরে ফিসফিস করে বলল, করছ কী, শুনে ফেলবে তো!
সরি, সামলে নিয়েছি নিজেকে। শচীন টেন্ডুলকারের অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম ওটাতে। আমার বোন হয়ে ও এ কাজ করবে, ভাবতেই পারিনি।
সারির শেষ ছেলেটাও তার জিনিস ভরে দিল জাদুকরের থলেতে।
শয়তানি হাসি খেলে যেতে দেখলাম ক্ল্যাণ্ডরের মুখে। শীতল চোখ দুটো আগুনের আলোয় চকচক করছে। ছেলেমেয়েদের মাথার ওপর হাত উঁচু করে আদেশের সুরে বলল, হিক গ্রুম ব্রুম, আরও জিনিস চুরি করে নিয়ে এসো। আমার জন্য! আগুনের দিকে হাত নাড়ল ও। কয়েকবার ফটফট করে নিভে গেল আগুন।
৭
সোমবার দুপুরে স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে ক্লাসে বসে রবিনের অপেক্ষা করছি। ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ওর টিফিন বক্সটা আমার কাছে রেখে বেরিয়ে গেছে। এখনও আসছে না। খিদেয় পেট জ্বলছে আমার। থাকতে না পেরে আমার ব্যাগ থেকে একটা আপেল নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।
হঠাৎ একটা বই হাতে ঘরে ঢুকল ও। ভীষণ উত্তেজিত।
কাছে এসে বইটা ফেলল আমার সামনে ডেস্কের ওপর। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, লাইব্রেরি থেকে আনলাম।
দেখলাম, একটা ইংরেজি কবিতার বই। বই খুলে একটা কবিতা বের করে তার ওপর আঙুল চেপে ধরল ও। এটা পড়ো!
দা স্টোলেন চাইল্ড, নামটা পড়লাম আমি। বাই উইলিয়াম বাটলার ইয়েস্ট।
ইয়েস্ট না, ইয়েস্ট না, ইয়েটস! কী উল্টোপাল্টা পড়ছ! ভুরু কোঁচকাল ও। বিখ্যাত আইরিশ কবি, নোবেল পুরস্কার পাওয়া। তার এই কবিতাটা পড়েছিলাম আমি। হঠাৎ মনে পড়ল, তাই বইটার জন্য লাইব্রেরিতে চলে গিয়েছিলাম।
কী আছে এতে?
ক্ল্যাণ্ডর সমস্যার সমাধান। পড়েই দেখো না! তাগাদা দিল রবিন। পড়ো!
জোরে জোরে পড়তে লাগলাম। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন।
এ তো পরীর কবিতা, কয়েক লাইন পড়ে বললাম। এতে ক্ল্যাণ্ডর সমস্যার সমাধান দেখলে কোথায়?
আইরিশ লোককাহিনী বলে, রবিন বলল, ওখানকার রূপকথার প্রাণীরা মানুষকে যন্ত্রণা দিতে পছন্দ করে।
লেপ্রেকন জাতীয় কোন প্রাণী?
হ্যাঁ, লেপ্রেকনই! উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রবিন। আইরিশ লেপ্রেকনরা ভীষণ পাজি। দেখতে মানুষের মত হওয়ায় খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে এরা।
পুরো কবিতাটা পড়ে ফেললাম। মুখ তুলে তাকালাম ওর দিকে
এবার বুঝলে তো? জিজ্ঞেস করল রবিন।
না, বুঝিনি। এতে বলা হয়েছে, কয়েকটা রূপকথার প্রাণী একটা মানুষের বাচ্চাকে চুরি করেছে।
এত সহজ কথাটা বুঝলে না? অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রবিন।
আইরিশরা বিশ্বাস করে, লেকেরা সুযোগ পেলেই মানুষের বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যায়। তাদের জায়গায় চেইনজেলিং রেখে যায়।
চেইনজেলিংটা আবার কী?
নকল, নকল! যে বাচ্চাটাকে চুরি করে, তার নকল, অবিকল এক রকম দেখতে। কেউ বুঝতে পারে না, আসল বাচ্চাটা চুরি হয়ে গেছে।
তাতে লাভটা কী?
এটা লেপ্রেকনের স্বভাব, লাভ-লোকসান ওরাই জানে।
তারমানে তুমি বলতে চাইছ, জাদুকর ক্ল্যাণ্ডর আইরিশ লেপ্রেকন?
হলে অবাক হওয়ার কিছু আছে কি? রবিন বলল। ও যে সব কাণ্ড করছে, তাতে লেপ্ৰেকন মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। যে ফারিহা আর কিটুকে দেখছি এখন আমরা, ওরা হয়তো আসল নয়।
তারমানে…চেইনজেলিং?
আমার তো তা-ই ধারণা, রবিন বলল। নিশ্চয় ক্ল্যাণ্ডর আসল বাচ্চাদের চুরি করে নিয়ে গিয়ে নকল বাচ্চা দিয়ে ভরিয়ে ফেলছে আমাদের শহরটা, ওদেরকে দিয়ে জিনিসপত্র চুরি করাচ্ছে।
ভয়ঙ্কর ব্যাপার!
হ্যাঁ, ভয়ঙ্কর ব্যাপার! আমার কথার প্রতিধ্বনি করল যেন রবিন। চোরাই জিনিসগুলো নিয়ে গিয়ে ক্ল্যাণ্ডর কী করে, সেটার জবাবও পাওয়া গেল।
কী করে?
জমিয়ে রাখে। এটাও ওদের স্বভাব। মানুষের ওপর প্রচণ্ড আক্রোশ ওদের। মানুষের বাচ্চা চুরি করে, ওদের দিয়ে ওদেরই জিনিস চুরি করায়। সেগুলো নিজের ঘরে জমিয়ে রেখে আনন্দ পায়। একটু থেমে রবিন বলল, আমাদের শহরের ছেলেমেয়েগুলোকেও ধরে নিয়ে গিয়ে ওদের জায়গায় চেইনজেলিং পাঠাচ্ছে ক্ল্যাণ্ডর। এই চেইনজেলিংরা ওর কথায় ওঠে-বসে। শহরের কেউ বুঝতেই পারছে না, আসল বাচ্চাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
আমার মনে হচ্ছে এই ইয়েস্ট লোকটা তোমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে, আমি বললাম।
ইয়েস্ট নয়, ইয়েটস! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
আস্তে বলো, নিচুস্বরে বললাম। সবাই তাকাচ্ছে। কিছুদূরে আরেকটা ডেস্কে বসা দুটো ছেলেকে আমাদের দিকে তাকাতে দেখে হেসে বললাম, রবিন একটা পরীর কবিতা পড়ে উত্তেজিত হয়ে গেছে। আমাদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিল ছেলে দুটো।
ভাল করে ভেবে দেখো, মুসা, ফিসফিস করে বলল রবিন। ফারিহাকে আলমারিতে ভরে গায়েব করে দেয়ার অনেকক্ষণ পর ফিরিয়ে এনেছে। জাদুকর। এত দেরি করল কেন? ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগেনি তোমার?
তা লেগেছে, অস্বীকার করলাম না।
কেন দেরি হয়েছে, বোঝনি এখনও? ভুরু নাচাল রবিন। ওর মত দেখতে একটা চেইনজেলিং বানিয়েছে। আর তাতেই সময়টা লেগেছে ওদের।
কাদের?
জাদুকরের সহকারীদের।