রবিনকে সব জানালাম। ফারিহা কী করেছে, কীভাবে ওর পিছু নিয়ে বনে গিয়েছি, কী কী দেখেছি, কোন কথাই গোপন করলাম না।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রবিন। হু! তাহলে এখন কী করা যায়?
এক মুহূর্ত চিন্তা করে বললাম, আজ রাতে তোমাদের বাড়িতে ঘুমোব।
কিটু কী করে দেখতে চাও?
বুঝে ফেলেছ। মাথা ঝাঁকালাম। হ্যাঁ। রাতে যদি বেরিয়ে যায় কিটু, ওর পিছু নেব আমরা। যদি বনে ঢোকে, আমরাও ঢুকব। এভাবে জিনিস চুরি করার মানেটা কী, জানা জরুরি।
স্কুল থেকে সোজা রবিনদের বাড়িতে চলে গেলাম। মাকে ফোন করে দিলাম, রাতে আর বাড়ি ফিরছি না।
রবিনের বাবা-মা আর কিটুর সঙ্গে বসেই খেলাম আমরা। রবিনদের বাড়িতে থাকি মাঝে মাঝে, এটা নতুন কিছু নয়, তাই আঙ্কেল-আন্টি কোন প্রশ্ন তুললেন না। কিটু কারও দিকে তাকাল না। চুপচাপ খেয়ে গেল। আচরণ। অনেকটা রোবটের মত।
রাতে খাওয়ার পর রবিনের শোবার ঘরে চলে এলাম ওর সঙ্গে। না ঘুমিয়ে বসে রইলাম বিছানায়, কথা বলে সময় কাটাতে লাগলাম। আমাদের জ্যাকেটগুলো খুলে হাতের কাছেই রেখে দিয়েছি, বাইরে বেরোনোর প্রয়োজন পড়লেই যাতে সঙ্গে সঙ্গে পরে নিয়ে দৌড় দিতে পারি।
মূল্যবান জিনিস বিক্রি করে টাকা পাবে, সেজন্যই ছেলেমেয়েদের দিয়ে চুরি করায় জাদুকর, রবিন বলল।
উঁহুঁ, মাথা নাড়লাম। আমার তা মনে হয় না। যে সব জিনিস দেয়। ছেলেমেয়েরা, সেগুলো এত মূল্যবান নয় যে এর জন্য এত ঝামেলা করবে। জাদুকর। তা ছাড়া, টাকা চাইলে, শুধু শো দেখিয়েই তো বিরাট ধনী হয়ে। যেতে পারে ও।
তাহলে?
সেটাই তো রহস্য। জানতে চাই।
কিটু কোনখান দিয়ে বেরোয়, জানা নেই আমাদের
ওর ঘরের জানালা, দিয়েও বেরোতে পারে, কিংবা বাড়ির যে কোনও দরজা দিয়ে। রাত বাড়ছে। কথা বলা কমিয়ে দিলাম আমরা, যাতে কিটুর ঘরে সামান্যতম শব্দ হলেও কানে আসে আমাদের।
বালিশে পিঠ দিয়ে আধশোয়া হয়ে রইলাম। হঠাৎ পাঁজরে কনুইয়ের গুঁতো লাগতে চমকে উঠে বসলাম। আগের রাতে ভাল ঘুম হয়নি, তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রবিনের দিকে তাকালাম। ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাকে কথা বলতে নিষেধ করল ও। ইশারায় আমাদের পিছনের দেয়ালটা দেখাল। পাশের ঘরে কিটুর নড়াচড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম আমরা। জ্যাকেট পরে নিলাম। জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলাম। ঘরের দরজার কাছে গিয়ে। পাল্লায় কান ঠেকিয়ে রেখেছে রবিন, বাইরে কী হচ্ছে শোনার জন্য। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছি আমরা।
হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল রবিন। ছুটে গেলাম। আস্তে পাল্লাটা খুলে ফেলল ও। দরজা দিয়ে সাবধানে দুজনে মুখ বাড়ালাম বারান্দায়। কিটুর ঘরের দরজা খুলে গেছে। বেরিয়ে আসতে দেখলাম ওকে।
৬
কিটুর পিছু নিলাম দুজনে। আরও কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দেখলাম, একই দিকে চলেছে। বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে চলেছি আমরা। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না ছেলেমেয়েগুলো। মনে হচ্ছে যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে।
শহরের শেষ বাড়িটাও ছাড়িয়ে এলাম। বনে ঢুকে পড়ল ছেলেমেয়েগুলো। আমরাও পিছু নিলাম। চলতে চলতে গাছের ফাঁক দিয়ে আগুনের আলো নাচতে দেখে ওর হাত টেনে ধরলাম।
ওটাই সেই অগ্নিকুণ্ড, হাত তুলে দেখালাম। চলো, উল্টো দিক দিয়ে ঘুরে যাই। এদিক দিয়ে গেলে আলখেল্লা পরা লোকটা আমাদের পিছন থেকে এসে হাজির হবে। কাল আমাকে দেখেনি, তবে রোজ রোজ কপাল ভাল। না-ও হতে পারে। ওর চোখে পড়া চলবে না কোনমতে।
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
অনেকখানি ঘুরে অগ্নিকুণ্ডের উল্টো দিকে চলে এলাম আমরা। কথা শোনা যাবে, এমন দূরত্বে একটা ঘন ঝোপের মধ্যে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলাম। আগুনের কিনারে ফারিহা আর কিটুর সঙ্গে দাঁড়ানো কয়েকটা ছেলেমেয়েকে চিনতে পারলাম। আমাদের স্কুলেই পড়ে, নীচের ক্লাসে।
পুলিশ অফিসার জন হাওয়ার্ডের ছেলে ডোরি না ওটা? রবিন জিজ্ঞেস করল আমাকে।
মাথা ঝাঁকালাম। ফিসফিস করে বললাম, হ্যাঁ।
গুনে দেখলাম, পনেরোটা ছেলেমেয়ে এসেছে। অগ্নিকুণ্ডের কিনারে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, সম্মোহিতের মত। সবার হাতেই একটা করে থলে কিংবা ব্যাগ। শুধু ফারিহার হাতে বালিশের কভার।
উপুড় হয়ে শুয়ে আছি আমরা। আগুনের এত কাছে রয়েছি, লাকড়ি পোড়ার পটপট আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি।
হঠাৎ ধড়াস করে এক লাফ মারল আমার হৃৎপিণ্ড। গাছপালার অন্ধকার ফুড়ে কালো আলখেল্লা পরা মূর্তিটাকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। আগুনের কাছে এসে দাঁড়াল ও। আগুনের আভা পড়েছে হুড পরা মুখে। গ্রেট ক্ল্যাণ্ডকে চিনতে আজ আর অসুবিধে হলো না।
হিক গ্রুম ব্রুম, এক সারিতে দাঁড়াও, জাদুকর বলল। এক সারিতে ওর সামনে দাঁড়িয়ে গেল ছেলেমেয়েরা। আলখেল্লার ভিতর থেকে বড় একটা কাপড়ের থলে টেনে বের করল ক্ল্যার। মুখ খুলে বাড়িয়ে ধরল।
হিক গ্রুম ব্রুম, তোমাদের জিনিসপত্র এই থলেতে রাখো, আদেশ দিল জাদুকর। এক এক করে এগিয়ে গিয়ে সমস্ত জিনিসপত্র ওর ব্যাগে ঢালতে লাগল ছেলেমেয়েরা। একটা ছোট মেয়ে একটা মানিব্যাগ রাখল জাদুকরের থলেতে। নিজের ব্যাগ থেকে একটা সোনার চেন টেনে বের করল একটা ছেলে। কিটুর পালা এল। রবিন আর আমি দুজনেই গলা লম্বা করে তাকিয়ে আছি। আগুনের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল রূপার প্লেটটা, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল জাদুকরের থলেতে। নিজের খালার রান্নাঘর থেকে প্লেটটা চুরি করে এনেছে কিটু।