ওদের সবার হাতেই কোন না কোন ধরনের ব্যাগ-কাপড়ের থলে, প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ; একমাত্র ফারিহার হাতেই বালিশের কভার।
আমার পিছনে নড়াচড়া টের পেয়ে আবার লুকালাম. একটা বড় গাছের গোড়ায়। ভাবলাম, আবার কোন বাচ্চাটাচ্চা হবে। আড়াল থেকে সাবধানে উঁকি দিয়ে দেখি, বাচ্চা নয়, বড় মানুষ। কালো আলখেল্লা পরা। হুড দিয়ে মাথা ঢাকা। দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলেছে আগুনের দিকে।
আমার পাশ দিয়ে গেল লোকটা। গাছের গায়ে নিজেকে চেপে ধরে। মিশিয়ে ফেলতে চাইলাম।
তবে আমার দিকে তাকাল না লোকটা। বোধহয় নিজের চিন্তায় মশগুল। আমার মাত্র দুই হাত দূর দিয়ে চলে গেল ও। আমাকে দেখল না।
পায়ের শব্দ দূরে সরে গেলে বেরিয়ে এলাম গাছের আড়াল থেকে। আগুনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা, ছেলেমেয়েগুলোর কাছে। আগুনের লাল আভার পটভূমিতে কালো একটা মূর্তি। হুড় দিয়ে এমন করে মুখ-মাথা ঢাকা, চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। তবু চেনা চেনা লাগল ওকে। কোথায় যেন দেখেছি।
আলখেল্লার ভিতর থেকে বড় একটা কাপড়ের থলে বের করল লোকটা। সেটার মুখ খুলে সামনে বাড়িয়ে ধরল। এক এক করে ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এসে ওদের সঙ্গে আনা থলে থেকে সেই ব্যাগের ভিতর সমস্ত জিনিসপত্র ঢেলে দিতে লাগল। রূপার টি সেট থেকে শুরু করে সোনার ব্রেসলেট, গহনা। ভর্তি গহনার বাক্স, অনেক কিছুই আছে।
ফারিহার পালা এল। বালিশের কভারের ভিতর হাত ঢুকিয়ে কয়েকটা গহনা বের করে লোকটার বাড়িয়ে ধরা ব্যাগের মধ্যে ফেলল ও। নিশ্চয় মার গহনা, যেগুলো খুঁজে পাচ্ছিল না। আবার বালিশের কভারে হাত ঢোকাল ও। এবার বের করল একটা ক্যামেরা। বাবার ক্যামেরাটা। লোকটার ব্যাগে ওটা ফেলার সময় আগুনের আলোয় ফারিহার চোখ চকচক করতে দেখলাম। অদ্ভুত দৃষ্টি সে-চোখে।
জিনিসপত্র সব নেয়া হয়ে গেলে আগুনের দিকে হাত বাড়াল লোকটা। বিড়বিড় করে কী বলল। সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল আগুন।
চাঁদের আলোয় দেখলাম, কালো মূর্তিটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আবার গাছের আড়ালে লুকালাম। এবারও আমার পাশ দিয়ে চলে গেল লোকটা, আমাকে দেখল না। এরপর ছেলেমেয়েগুলো চলে গেল আমার পাশ দিয়ে। গাছের গায়ে মিশে রইলাম, যাতে আমাকে দেখতে না পায়। দুরে সরে যেতে থাকল পায়ের শব্দ। আড়াল থেকে বেরোলাম, বনটা নীরব হয়ে যাবার পর।
যখন বাড়ি ফিরলাম, ফারিহার জানালা তখন বন্ধ। মেইল গাছে কম্বল আর চাদরগুলো নেই। সামনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। পা টিপে টিপে উঠে এলাম ওপরতলায়। জানালা খোলা রেখে গিয়েছিলাম। বরফ-শীতল হয়ে আছে আমার ঘর। জানালাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে কম্বলের নীচে ঢুকলাম।
৫
তোমার কাজিন কি ইদানীং অদ্ভুত আচরণ করে, খেয়াল করে দেখেছ?
পরদিন স্কুলে জিজ্ঞেস করলাম আমার বন্ধু রবিনকে। লাঞ্চের সময় টিফিন খাচ্ছি। একই বেঞ্চে আমার পাশে বসেছে ও। কিশোর নেই আমাদের সঙ্গে। ওর মামা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন। ওঁকে দেখতে বাংলাদেশে চলে গেছে ও।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে রবিন। কয়েকটা ছেলেকে ছোটাছুটি করে খেলতে দেখা যাচ্ছে।
অদ্ভুত আচরণ? পাউরুটি চিবাতে চিবাতে আনমনে জিজ্ঞেস করল ও। বুঝলাম না, কী বলতে চাও।
সিনেমার রোবটের মত কথা বলে? এমন কিছু খায়, যা আগে মুখেও তুলত না? এ রকম নানা ধরনের পরিবর্তন।
জানালার দিক থেকে চোখ ফেরাল রবিন। আমার দিকে তাকাল। তুমি কী করে জানলে?
ফারিহাও ইদানীং অস্বাভাবিক আচরণ করছে। বললাম ওকে। ওর দিকে তাকালে গা ছমছম করে, কেমন ভূতুড়ে লাগে। ওর কাজকর্ম কিছুই আর এখন আগের মত মনে হয় না আমার। রবিনের ভাইকেও গতরাতে আমার বোনের সঙ্গে বনে ঢুকতে দেখেছি, উদ্ভট কাণ্ড করেছে দুজনেই, এ কথাটা তখুনি বলতে চাইলাম না ওকে, যদি বিশ্বাস না করে। বরং বললাম, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তোমার ভাইও অদ্ভুত আচরণ করে।
হ্যাঁ, করে, মাথা ঝাঁকাল রবিন। জানালা দিয়ে আবার তাকাল খেলার মাঠের দিকে। অসংখ্য ছেলেমেয়ে জড় হয়েছে ওখানে। কয়েক দিন ধরে অদ্ভুত আচরণ করছে–দেখে মনে হয় স্মৃতিবিলোপ হয়েছে ওর। ওর জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।
হুঁ!বাড়ি থেকে স্যাণ্ডউইচ বানিয়ে দিয়েছে মা। সেটার শেষ টুকরোটা, মুখে পুরে চিবাতে লাগলাম। রাত দুপুরে চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে যায় না তোমার কিটু?
হাসল রবিন। বলতে পারব না। সন্দেহও হয়নি, তাই দেখতেও যাইনি। কেন, ফারিহা বেরিয়ে যায় নাকি?
যায়। সেজন্যই তো বলছি। একটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কিটু কবে থেকে ওরকম কাণ্ড শুরু করেছে?
সপ্তাখানেক হলো, যদূর মনে পড়ে, রবিন বলল। জাদুকর ক্ল্যাণ্ডরের ম্যাজিক শো দেখে আসার পর থেকে। কবে যেন সেটা? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। গত বৃহস্পতিবার।
ঘাড়ের পিছনে শিরশির করে উঠল আমার। বড়ই কাকতালীয় ব্যাপার। ক্ল্যাণ্ডর কি কিটুকে স্টেজে যেতে বলেছিল?
হ্যাঁ, বলেছিল, রবিন বলল। একটা আলমারির মধ্যে ঢুকিয়ে কিটকে গায়েব করে দিয়েছিল। তোমাকে বলিনি?
না, মাথা নাড়লাম। ফারিহাকেও নিয়ে গিয়ে আলমারিতে ঢুকিয়েছিল। বনের মধ্যে অগ্নিকুণ্ডের সামনে দাঁড়ানো হুড পরা মূর্তিটাকে চেনা চেনা কেন। লাগছিল, বুঝে ফেললাম। আসলে জাদুকর ক্ল্যাণ্ডরকেই দেখেছি।