ফারিহার ড্রেসারের ওপর রাখা পানি ভর্তি একটা গ্লাস। আমিই রেখেছি। পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় অতিরিক্ত উত্তেজনায় নিতে ভুলে গেছি। এই গ্লাসটা প্রমাণ করছে, কাল রাতে যা দেখেছি, সত্যি দেখেছি, স্বপ্ন ছিল না!
সেদিন স্কুল থেকে ফিরে, আমার ছিপের এক বাণ্ডিল সুতো খুঁজে বের করলাম। নাইলনের সুতো, খুব শক্ত। ফারিহা নীচতলায় টেলিভিশনে কার্টুন দেখছে। এটাই সুযোগ। নিঃশব্দে ওর ঘরে ঢুকে জানালার হুড়কোর সঙ্গে সুতোর এক মাথা বাঁধলাম। বাণ্ডিলটা আমার জানালার কাছে মেইপল গাছের একটা ডালের ওপর ছুঁড়ে দিলাম। খানিকটা সুতো খুলে গিয়ে বাণ্ডিলের বাকি অংশটা ডালে ঝুলে রইল। পাল্লা লাগালাম। আমার শোবার ঘরে এসে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সুতোর বাণ্ডিলটা টেনে আনলাম ঘরের ভিতর।
একটা টিনের মগে আমার সমস্ত পেন্সিল আর কলম রাখি। সেগুলো ডেস্কের ওপর ঢেলে দিয়ে শূন্য মগটা এনে রাখলাম ড্রেসারের কিনারে। সুতোর আরেক মাথা বেঁধে দিলাম মগের হাতলে। মগের ওপর একটা বই রেখে তার ওপর রাখলাম একটা খালি কোকের টিন।
ফারিহার ঘরের জানালাটা এখন খুললেই সুতোয় টান পড়বে, মগে টান লেগে ওপরে রাখা সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে মাটিতে পড়বে ওটা। শব্দ হবে। তাতে আমার ঘুম ভেঙে যাবে। রাতে আমার অজান্তে ঘর থেকে বেরোতে পারবে না ও।
ভীষণ ঠাণ্ডার মধ্যেও সুতোটার কারণে সেরাতে আমার জানালাটা খোলা রাখতে হলো। বাইরে বেরোনোর কাপড় পরে শুলাম
জিনসের প্যান্ট, জ্যাকেট, পায়ে হাইকিং বুট। মাথায় একটা মাংকি ক্যাপও পরেছি, কানের ওপর টেনে দিয়েছি, যাতে গরম থাকে কান। পকেটে টর্চ লাইট তো নিয়েছিই, বাড়তি ব্যাটারিও নিয়েছি। ফারিহা, এত রাতে বাইরে গিয়ে কী করে, দেখতেই হবে আমাকে।
ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঠাণ্ডা আর উত্তেজনাও ঘুম ঠেকাতে পারল না। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলাম। একটা পাগলা কুকুর আমাকে তাড়া করে যখন প্রায় ধরে ফেলেছে, ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দে চোখ মেলোম। প্রথমে কোথায় আছি, কী করছি, কিছু বুঝতে পারলাম না। তারপর মনে পড়ল টিনের মগটার কথা। ঘুমের মধ্যে ওটা পড়ার শব্দ শুনেছি।
লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে গেলাম জানালার কাছে। মুখ বের করে বাইরে উঁকি দিলাম। গাছের ডালে দ্বিতীয় চাদরটা বাধা শেষ করেছে তখন ফারিহা।
পা টিপে টিপে চলে এলাম নীচতলায়। সামনের দরজার ছিটকানি খুলে পাল্লা ফাঁক করলাম কয়েক ইঞ্চি। লনের ঘাসের ওপর ঝুলতে দেখছি ফারিহার কম্বলের কোণা। ওটা বেয়ে মাটিতে লাফিয়ে নামল ও। দাঁতে কামড়ে ধরে রেখেছে ওর বালিশের কভারটা। ভারি কোন জিনিস রয়েছে। ওটার ভিতরে। মাটিতে নেমে কভারটা দাঁত থেকে হাতে নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে রওনা হলো রাস্তার দিকে।
আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিঃশব্দে ওর পিছু নিলাম। অসম্ভব জোরে হাঁটছে ও। ওর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে রীতিমত দৌড়াতে হলো আমাকে। এত শক্তি কোথায় পেল ও, বুঝলাম না।
চাঁদের আলোয় অনুসরণ করে চলেছি ওকে। চলেছে তো চলেছেই ও, থামার নাম নেই। একটুক্ষণের জন্য গতি কমাচ্ছে না। ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘেমে নেয়ে গেছি আমি। হাঁপাচ্ছি। অথচ ওর যেন কিছুই হচ্ছে না।
শহরের প্রান্তে চলে এসেছি, এ সময় একটা ছেলেকে দেখলাম। বয়েস ফারিহার সমানই হবে। হাতে একটা বাজারের থলে। ভিতরের জিনিসগুলো বেশ ভারি, বহন করার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একই দিকে চলেছে। দুজনে, রাস্তার দুই পাশ ধরে। কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না। দুজনেই চুপচাপ হেঁটে চলেছে যেন ঘোরের মধ্যে, নজর সামনের দিকে।
শহরের কিনারে এসে মূল রাস্তা থেকে আরেকটা সরু রাস্তা ঘুরে বনে ঢুকে গেছে। মোড় নিয়ে সেই রাস্তায় নেমে বনে ঢুকল দুজনে। আমিও ঢুকলাম। রাস্তার বাতি নেই এখানে। তবে চাঁদের আলো আছে। সেই আলোয় পাতাগুলো ভেজা ভেজা দেখাচ্ছে। বনতলে অন্ধকার।
গা ছমছম করছে আমার।
গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে এগিয়ে চলেছে ছেলেমেয়ে দুটো। ওদের পিছু নিয়ে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে হাঁটার চেষ্টা করছি আমি। অন্ধকারে গতি বাড়াতে পারছি না। টর্চ জ্বাললে ফারিহা ও ছেলেটার চোখে পড়ে যাবু।
কতক্ষণ হেঁটেছি বলতে পারব না। তবে অনেকক্ষণ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। হঠাৎ আমার পিছনে মট করে শুকনো ডাল ভাঙার শব্দ হলো। ধড়াস করে এক লাফ মারল আমার হৃৎপিণ্ড! তাড়াতাড়ি একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফিরে তাকালাম।
৪
প্রথমে কিছু চোখে পড়ল না। তারপর দেখলাম। একটা গাছের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এল ও। আরেকটা বাচ্চা ছেলে। ওর পিছনে আরও একজন। আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল ছেলে দুটো, ফারিহা আর অন্য ছেলেটা যেদিকে গেছে।
গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে পা টিপে টিপে ছেলেগুলোর পিছু নিলাম। আরও কিছুটা এগোনোর পর দূরে আলো চোখে পড়ল। যতই এগোচ্ছি, আলোটা বাড়ছে। আরও কাছে আসার পর দেখলাম, বেশ বড়সড় একটা অগ্নিকুণ্ড।
আগুন ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দশ-বারোটা ছেলেমেয়ে। কেউ কথা বলছে। না। মূর্তির মত স্থির। আগুনের আভায় লালচে দেখাচ্ছে ওদের মুখগুলো। ওদের সঙ্গে ফারিহাকে দেখলাম। ওর পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাকে চিনতে পারলাম। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রবিনের কাজিন কিটু! রবিনের এক মামার ছেলে। ফারিহার বয়েসী। ফ্লোরিডায় থাকে। রকি বিচে খালার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।