ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে ফিরে যাব, এ সময় ফারিহার বিছানার দিকে। চোখ পড়ল। শূন্য বিছানা। ফারিহা নেই। ওর বেডক্লথগুলোও নেই। খোলা গদিটা দেখা যাচ্ছে। বালিশটার কভার নেই।
দৌড়ে সুইচবোর্ডের কাছে এসে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে ঘরের ভিতর খুঁজলাম। বাথরুমে গেছে কি না দেখার জন্য দরজা ধাক্কা দিলাম। পাল্লা খোলা। ভিতরে কেউ নেই।
ঘাবড়ে গেলাম। কেউ ওকে কিডন্যাপ করল না তো! জানালার কাছে। এসে আবার পাল্লা খুললাম। জানালা দিয়ে মাথা বের করে আঙিনাটা দেখলাম। কেউ নেই। কিছুদূরে রাস্তা থেকে কুকুরের ডাক শোনা গেল। নীচে তাকালাম। জানালার চৌকাঠে পড়া বালিতে দুটো ছোট পায়ের ছাপ চোখে পড়ল। আঙুলগুলো বাইরের দিকে ফেরানো। জানালার কাছের মেইপল
গাছটার দিকে মুখ করে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছিল কেউ। ফারিহা ছাড়া আর কেউ না, পায়ের ছাপই বলে দিচ্ছে।
ঘরের আলোয় আরেকটা জিনিস দেখতে পেলাম। মেইপল গাছের ডালে বাঁধা একটা সাদা চাদর। অন্ধকারে বাতাসে দোল খাচ্ছে চাদরটা।
জানালার পাল্লা দুটো আবার বন্ধ করলাম। আলো নিভিয়ে বেরিয়ে এলাম ফারিহার ঘর থেকে। দৌড়ে ফিরে এলাম নিজের ঘরে। তাক থেকে টর্চটা নিলাম। জানালা খুলে মাথা বের করে দিলাম ঠাণ্ডা বাতাসে। আলো ফেললাম মেইপল গাছের ডালে বাঁধা চাদরটায়। প্রথম চাদরের এক কোণায় আরেকুটা। চাদর বাঁধা। দ্বিতীয় চাদরটার নীচে একইভাবে গিট দেয়া একটা কম্বল। সামনের লনের প্রায় ঘাস ছুঁয়েছে কম্বলের নীচের কোণা।
স্তব্ধ হয়ে গেছি। রাত দুপুরে এভাবে চাদর আর কম্বল বেঁধে দড়ির মত বেয়ে বেরিয়ে যাবে, বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। এত সাহস ও কোথায় পেল? বিছানার কিনারে বসে ভাবতে লাগলাম। কী করা যায়? মাকে ডাকব?
দরজার দিকে এগোলাম। অর্ধেকটা পেরিয়েছি, এ সময় বাইরে একটা মচমচ শব্দ কানে এল। জানালার দিকে ফিরলাম। গাছের ডালপাতাগুলোকে ওপরে-নীচে দুলতে দেখলাম চাঁদের আলোয়। ঝকি খাচ্ছে। নিঃশব্দে জানালার কাছে ফিরে এসে নীচে উঁকি দিলাম। একেবারে সময়মত পৌঁছেছি। চাদর বেয়ে উঠে এসে জানালার চৌকাঠে পা রাখছে তখন ফারিহা!
একটা মুহূর্ত চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রইল ও। এত বেশি গরম কাপড় পরেছে, একটা পুঁটুলির মত লাগছে ওকে। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে প্রথমে একটা দস্তানা খুলে হাতে নিল, তারপর আরেকটা খুলল। দস্তানা দুটো ঘরের ভিতর ছুঁড়ে ফেলে ডালে বাঁধা চাদরের গিট খুলতে শুরু করল। কোনরকম উত্তেজনা কিংবা তাড়াহুড়া নেই ওর মাঝে, পুরোপুরি শান্ত। অথচ মাটি থেকে প্রায় বিশ ফুট ওপরে রয়েছে। চাঁদরুটা খুলে নিয়ে ভিতরে লাফিয়ে পড়ল ও। ভালমত দেখার জন্য আরও খানিকটা মুখ বাড়ালাম জানালার বাইরে। চাদরের কোণা ধরে টেনে দ্বিতীয় চাদর ও কম্বলটা ভিতরে নিয়ে গেল ফারিহা। পাল্লা লাগানোর শব্দ শুনলাম।
যতটা সম্ভব শব্দ না করে আমার জানালার পাল্লা লাগালাম। নিজের বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে ভাবতে লাগলাম, যা দেখলাম সত্যি দেখলাম? নাকি স্বপ্ন!
আবার যখন চোখ মেলোম, জানালা দিয়ে রোদ ঢুকছে ঘরে। সকাল। হয়ে গেছে।
৩
মনে পড়ল, গতরাতের কথা। নাহ, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছি। ফারিহাকে যা করতে দেখেছি, সেটা কেবল স্বপ্নেই সম্ভব, বাস্তবে নয়।
নাস্তা খেতে নীচে নামলাম। ফারিহা আগেই উঠে পড়েছে। চুপচাপ টেবিলে বসে খাচ্ছে। খেতে খেতে আড়চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছি। ভেবে পাচ্ছি না, হঠাৎ করেই আমার ছোট্ট বোনটি এতটা দুঃসাহসী হয়ে উঠল কী করে? আর এতটা বদলেই বা গেল কেন? কেন ওর দিকে তাকালে আমার গা ছমছম করে?
রান্নাঘরে ঢুকল মা। উদ্বিগ্ন লাগছে মাকে। ফারিহাকে জিজ্ঞেস করল, আমার গহনায় হাত দিয়েছ আবার? ওগুলো নিয়ে খেলেছ?
নীরবে খেয়ে যাচ্ছে ফারিহা। জবাবও দিল না, মুখও তুলল না।
এই মেয়ে, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি, মা বলল। আমার কিছু গহনা খুঁজে পাচ্ছি না। ওগুলো পরে খেলেছিলে তুমি?
দরজায় এসে দাঁড়াল বাবা। মা আর ফারিহার দিকে তাকিয়ে আছে। এক হাতে বাবার ক্যামেরাটা, আরেক হাতে ফিল্মের একটা রোল।
না, ম্যাডাম, মুখ না তুলে জবাব দিল ফারিহা।
পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল মা আর বাবা।
কী হয়েছে, ফারিহা? ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বাবা জিজ্ঞেস করল। ক্যামেরা আর ফিল্মটা রাখল টেবিলে। তুমি এমন করছ কেন? খালাকে ম্যাডাম ডাকছ। অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছ। কোনও সমস্যা হয়ে থাকলে আমাদের বলতে পারো।
কিছু হয়নি, জবাব দিল ফারিহা।
আবার বাবার দিকে তাকাল মা। নীরবে কাঁধ ঝাঁকাল বাবা। ফিল্মটা তুলে নিয়ে বলল, আমি কাজে বেরোচ্ছি। দোকান থেকে কিছু আনতে হবে?
বাবার সঙ্গে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে গেল মা। ফারিহার দিকে তাকালাম আমি। বাবার ক্যামেরটার দিকে চেয়ে আছে ও।
খাওয়া শেষ করে খাবারের এঁটো প্লেট আর বাটি নিয়ে সিংকে চলে এলাম। ধোঁয়া শেষ করে ফিরে তাকিয়ে দেখি, ফারিহা নেই। নেই টেবিলে রাখা বাবার ক্যামেরাটাও।
স্কুলে যাবার সময় হয়েছে। বাস আসবে যে কোন সময়। তৈরি হতে হবে। আমাকে। দৌড়ে ওপরতলায় উঠে নিজের ঘরে ঢুকলাম। কাপড় বদলে ব্যাকপ্যাকটা বাধলাম পিঠে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি, ফারিহার ঘরের দরজাটা খোলা। দরজার কাছে এসে ভিতরে উঁকি দিলাম। বিছানাটা সুন্দর করে গোছানো। বোঝাই যায় না, এই বিছানা থেকে চাদর আর কম্বল তুলে গাছের ডালে বেঁধে নেমে গিয়েছিল ও। নাহ, স্বপ্নই দেখেছি আমি! পা বাড়াতে যাব, এ সময় এমন একটা জিনিস চোখে পড়ল, চমকে উঠলাম।