কিন্তু অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল। হাসল না ফারিহা। কথাও বলল না। একভাবে বসে থেকে শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল।
না, কিছু বুঝতে পারছি না! বোধহয় আমাকে যন্ত্রণা দেয়ার জন্যই এ রকম করছে ও। ওর জ্বালাতন করার কৌশলগুলো অদ্ভুত। কখনও আমার ঘরে ঢুকে অকারণেই মুখ ভেঙচায়। রাগের চোটে একেক সময় মনে হয় জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিই। কখনও বা আমি যখন হোমওঅর্কে ব্যস্ত, দরজায় এসে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, কোন কথা বলে না, আমার ওপর থেকে চোখ সরায় না। ওর ভঙ্গিতে রাগ হতে থাকে আমার। স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিই। মিনিট দশেক পরে ও চলে গেছে। ভেবে আবার যখন খুলি, দেখি একই ভঙ্গিতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ও, সেই একই রকম বিরক্তিকর ভঙ্গিতে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে। আজ আমাকে খেপানোর আরেকটা নতুন ভোল ধরেছে, ভাবলাম।
জাদুকর যদি তোমাকে ফিরিয়ে না আনলেই ভাল করত! রেগেমেগে বললাম।
অকারণে ওকে ধমকাচ্ছ কেন? রেগে গেল মা। চুপ করে আছে, থাক। হয়তো ক্লান্তি লাগছে।
চুপ হয়ে গেলাম।
এতক্ষণে আমার আমার দিকে ফিরে হাসল ফারিহা, মা আমাকে ধমকানোতে বোধহয় আনন্দ পেয়েছে। কেমন ভূতুড়ে লাগল হাসিটা। গা ছমছম করে উঠল আমার। অবাক কাণ্ড! ওর হাসি দেখে আগে তো কখনও এমন হয়নি আমার!
২
পরদিন আরও বেশি অদ্ভুত আচরণ করল ফারিহা। রোবটের মত একঘেয়ে যান্ত্রিক স্বরে কথা বলে। ঘরের কোন কিছুই যেন চিনতে পারে না। যেন অপরিচিত একটা বাড়িতে ঢুকেছে। ড্রেসারের ওপর রাখা একটা পুতুল হাতে নিয়ে এমনভাবে তাকিয়ে রইল, যেন জীবনেও দেখেনি ওটা।
নাস্তার সময় দুই বাটি সজি খেয়ে ফেলল, যে জিনিস অন্যদিন বকাবকি করেও, মুখে দেয়াতে পারে না ওকে মা। স্কুলে গিয়ে ওর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলল না, যেন ওদের চিনতে পারছে না। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরে টিভিতে ওর সবচেয়ে প্রিয় সিরিয়ালটা দেখতে বসে এমন বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল, যেন এরচেয়ে বাজে নাটক আর হয় না। নাটকের কুকুরটার ভাড়ামি দেখে হাসল না, বরং চোখমুখ কুঁচকে রাখল। খাবার টেবিলে বাবার। রসিকতায় কান দিল না, নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খেয়ে চলল।
ডিনারের পর লিভিং রুমের মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে রং-তুলি নিয়ে ছবি আঁকতে লাগল। বাবা তখন টিভিতে খবর দেখছে। দুজনের কেউ আমার দিকে তাকাল না। একটা মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে ফারিহার ছবি আঁকা দেখলাম। কোথায় যেন কী একটা অস্বাভাবিক লাগছে আমার কাছে। হঠাৎ বুঝে ফেললাম।
আরে! বললাম আমি, ডান হাতে আঁকা শুরু করলে কবে থেকে?
আমার দিকে মুখ তুলে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল ও।
তুমি না বাইয়া? আবার বললাম। ডান হাতে আঁকছ কী করে? হলোটা কী তোমার?
নির্বিকার ভঙ্গিতে হাতের তুলিটার দিকে তাকাল ফারিহা। আবার ছবি আঁকায় মন দিল।
গা ছমছম করে উঠল আমার। ফারিহার আচরণ মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। বাবার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, বাবাও ব্যাপারটা লক্ষ করেছে কি না; কিন্তু বাবার মনোযোগ টিভির দিকে।
রান্নাঘরে এলাম। টেবিলে বসে বাজার করতে কত খরচ হয়েছে, হিসেব করছে মা। মা, আজ ফারিহার কী হয়েছে, বলো তো? খালি উল্টোপাল্টা কাজ করছে। নাকি আমারই মাথা খারাপ হয়ে গেল!
মুখ তুলে তাকাল মা। কেন, কী হয়েছে?
ডান হাতে ছবি আঁকছে ও, আমি বললাম। ও যে বাইয়া, ভুলেই গেছে। যেন। সারাটা দিন রোবটের মত কথা বলল। খেয়াল করনি?
ছোটরা এ রকম উল্টোপাল্টা কাণ্ড করেই থাকে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আবার হিসেবে মন দিল মা।
কিন্তু এটা উল্টোপাল্টা নয়, রীতিমত উদ্ভট। ওর সামনে গেলেই আমার। গা ছমছম করে।
মুখ তুলে তাকিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে হাতের কলমটা টেবিলে রেখে দিল মা।
মুসা, ওর বয়েসে তুমি কি করেছ জানো? পুরো একটা সপ্তা কুকুর সেজে থেকেছ। শেষে কুকুরের ঘরে গিয়ে টুটুর সঙ্গে ঘুমোতে চেয়েছ।
লজ্জা পেলাম। বললাম, তখন তো পিচ্চি ছিলাম আমি!
সেজন্যই বলছি, হাসল মা। ছোটরা এ রকম উল্টোপাল্টা কাণ্ড করেই থাকে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!
কিন্তু এখন মার এই কথাটা মানতে পারলাম না আমি, অন্তত ফারিহার ব্যাপারে।
.
সেদিন রাত দুটোয় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আমার। পিপাসা পেয়েছে। পানি খেতে উঠলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলার বারান্দা ধরে এগোলাম। পুরো বাড়িটাই নীরব হয়ে আছে। ।
এক গ্লাস পানি খেয়ে, আবার পিপাসা পেলে খাওয়ার জন্য আরেক গ্লাস পানি হাতে ওপরে উঠলাম। আমার পাশের ঘরটা ফারিহার। ওটার পাশ কাটানোর সময় হঠাৎ পায়ে ঠাণ্ডা বাতাস লাগল। দরজার নীচের ফাঁক দিয়ে আসছে।
নভেম্বর মাস। রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ে। বাতাস আসছে, তারমানে জানালা খুলে রেখেছে ফারিহা। এই শীতের মধ্যে জানালা খুলে ঘুমাচ্ছে! অবাক লাগল আমার। গরমকালেও জানালা খুলে শুতে ভয় পায় ও। অথচ এই শীতের মধ্যে…তারমানে, আরেকটা অস্বাভাবিক কাণ্ড করছে ও!
দরজার নব চেপে ধরে আস্তে মোচড় দিলাম। শব্দ করে ওর ঘুম ভাঙাতে চাইলাম না। ধীরে ঠেলে পাল্লা খুলে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলাম। ঠিকই অনুমান করেছি। জানালা খোলা। এক ঝলক জোরালো বাতাস পর্দা দোলাল। গরম কাপড় গায়ে দিয়ে আসিনি। শীতে কেঁপে উঠলাম। হাতের গ্লাসটা ড্রেসারের ওপর রেখে এগিয়ে গিয়ে জানালার পাল্লা লাগালাম। কাঁচের শার্সির ভিতর দিয়ে বড় মেইপল গাছটাকে চাঁদের আলোয় ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। পর্দাগুলোও টেনে দিলাম ভালমত।