আমি ভাবছি, আলমারির তলায় নিশ্চয় কোনও চোরা দরজা আছে, ট্র্যাপ, ডোরের মত কিছু, ক্ল্যাণ্ডর বাইরের দরজাটা বন্ধ করলেই ওই দরজা খুলে নীচ থেকে ফারিহাকে টেনে নেবে জাদুকরের সহকারী। আমার মনের কথা পড়তে পেরেই যেন একপাশে সরে দাঁড়াল ক্ল্যাণ্ডর। আলমারির দিকে হাত তুলে। আদেশ দিল, ওপরে! কেঁপে উঠল আলমারিটা। দুলতে দুলতে ওপরে। উঠতে শুরু করল। তিন-চার ফুট উঠে থেমে গেল। ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিহা। আমাদের দিকে চোখ। আতঙ্কে জমে গেছে যেন। দরজার দিকে হাত তুলে ইশারা করল ক্ল্যাণ্ডর। দড়াম করে লেগে গেল দরজার পাল্লা। ভীষণভাবে দুলতে শুরু করল আলমারিটা। দরজার ফাঁক থেকে ধোঁয়ার মত কী যেন বেরোচ্ছে। প্রায় ঢেকে ফেলল দরজাটাকে। তারপর হঠাৎ করেই আবার খুলে গেল পাল্লা। আলমারির ভিতর ফারিহা নেই।
ফারিহার ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম। খানিকটা ভানভণিতা করে এখুনি হয়তো ফিরিয়ে নিয়ে আসবে ওকে ক্ল্যাণ্ড, জাদুকররা সাধারণত যা করে থাকে। কিন্তু ও সেটা করল না। ফারিহার কথা যেন বেমালুম ভুলে গিয়ে অন্য খেলায় মন দিল। ভিতরে ভিতরে উদ্বিগ্ন হলাম। কোথায় পাঠাল ফারিহাকে? স্টেজের নীচে? ও কি ভয় পাচ্ছে? মাত্র সাত বছর বয়েস ওর অন্ধকারে একা ফেলে রেখেছে? টর্চটার কথা ভেবে খানিকটা ভরসা পেলাম। একেবারে অন্ধকারে থাকতে হবে না ওকে। : শো শেষ হয়ে আসছে। এর মধ্যে একটিবারের জন্য ফারিহার কথা উল্লেখও করেনি জাদুকর। সমস্ত খেলা শেষ করে আবার আলমারির দিকে এগোল ও। বিড়বিড় করে কী সব বলল। তারপর দরজা খুলল।
ভিতরে কেউ নেই। এমন ভঙ্গি করতে লাগল জাদুকর, যেন কোথায় কী একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। জাদুকরদের এসব অভিনয়ের কথা আমার জানা আছে।
হাত তুলে আবার আদেশ দিল আলমারিটাকে, ওপরে!
লেগে গেল দরজার পাল্লা। কাঁপতে কাঁপতে ওপরে উঠতে লাগল আলমারিটা। তিন-চার ফুট ওপরে উঠে স্থির হলো। ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল। আবার ঝটকা দিয়ে খুলে গেল পাল্লা। দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আমার ছোট বোনটাকে। হাতে জ্বলন্ত টর্চ। ওকে ঘিরে পাক খাচ্ছে ঘন ধোঁয়া। দর্শকদের উন্মত্ত হাততালিতে কানে তালা লাগার জোগাড় হলো।
ক্ল্যাণ্ডর আদেশ দিতেই আপনাআপনি স্টেজে নামল আলমারিটা। হাত বাড়াল ও। এবার নির্দ্বিধায় ওর হাত ধরল ফারিহা। আলমারি থেকে বেরিয়ে এল। ভয় পাচ্ছে না এখন আর। জাদুকরের দিকে তাকিয়ে হাসল বলেও মনে হলো। ক্ল্যাণ্ডরের ঠোঁট নড়তে দেখলাম। কী যেন বলছে ওকে। কিন্তু দর্শকদের হই-চইয়ে কী বলল কিছুই শুনতে পেলাম না।
জাদুকরের হাতে টর্চটা ফিরিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে স্টেজ থেকে নেমে এল ফারিহা। সিটের সারির মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখছি ওকে। সবাই ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু কারও দিকে তাকাচ্ছে না ও। মাথা নিচু করে এগোচ্ছে। সিটের নম্বর গুনতে গুনতে আসছে, যেন ভুলে গেছে কোন সিটটায় বসেছিল। অবাক হলাম। জাদুর খেলা খেলতে গিয়ে মাথাটা গুলিয়ে গেল নাকি ওর!
আমাদের কাছে পৌঁছে মুখ তুলে তাকাল ও। বসবে কি না, দ্বিধা করছে। আমি বললাম, কী হলো? চিনতে পারছ না? বোসো।
চুপচাপ বসে পড়ল ফারিহা। আমাদের সঙ্গে কথা বলল না। ক্ল্যাণ্ডরের দিকে তাকিয়ে আছে।
বাউ করছে তখন জাদুকর। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ, লেডিস অ্যাণ্ড জেন্টেলম্যান। আজ রাতের শো এখানেই শেষ।
উঠে দাঁড়াল দর্শকরা। জাদুকরের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছে সবাই। ও যে কতবড় ম্যাজিশিয়ান বার বার বলছে সেকথা। কয়েকবার বাউ করার ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল ক্ল্যাণ্ডর, হাত তুলে দর্শকদের শান্ত হতে বলল, যেন জরুরি কিছু বলতে চায়। হাততালি বন্ধ হলো। হট্টগোল থামল। ঘরে পিনপতন নীরবতা। গলা লম্বা করে সবাই সামনে মুখ বাড়িয়ে দিয়েছে, জাদুকর কী বলে শোনার জন্য। কিন্তু কথা না বলে হঠাৎ দুই আঙুলে তুড়ি বাজাল জাদুকর, চোখের পলকে আলোর ঝিলিকের মত অদৃশ্য হয়ে গেল। স্টেজ থেকে। একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল সবাই। তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে যেন হাততালি আর চিৎকারে ফেটে পড়ল। আর সবার মতই আমিও হতবাক। এ রকম আশ্চর্য ম্যাজিক আর কখনও দেখিনি।
তালি দিতে দিতে হাত ব্যথা করে ফেলেছি। ফারিহার দিকে তাকালাম। হাততালি দিচ্ছে না। চোখে অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টি। কোন উত্তেজনা নেই চেহারায়। এ যেন আমার বোন নয়, অন্য এক ফারিহাকে দেখছি!
.
গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছি। বাবা গাড়ি চালাচ্ছে। পাশে প্যাসেঞ্জার সিটে মা বসেছে। পিছনের সিটে বসেছি আমি ও ফারিহা। জাদুকর ওকে কীভাবে গায়েব করেছিল, জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছি আমি। নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম : কীভাবে ওকে গায়েব করল ক্ল্যাণ্ড, স্টেজ থেকে নিয়ে গিয়ে কোথায় রেখেছিল ওকে, ভয় পেয়েছিল কি না? কিন্তু আমার একটা প্রশ্নেরও জবাব দিল না ও। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, সেই একই রকম ভাবলেশহীন চেহারা, চোখে শূন্য দৃষ্টি। যে ফারিহার বকবকানির ঠেলায় একেক সময় পাগল হওয়ার জোগাড় হয় আমার, তাকে এ রকম চুপ করে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক লাগছে আমার।
মা! আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, ফারিহা কিন্তু অদ্ভুত আচরণ করছে!
ফিরে তাকিয়ে হেসে মা বলল, আসলে তোমাকে খেপাচ্ছে। এখুনি হেসে উঠবে, দেখো। আবার বকবক শুরু করবে।