আচমকা জ্বলন্ত মশালটা প্রাণী দুটোর দিকে ছুঁড়ে দিলাম। ভয়ে লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেল ওরা। দৌড় দিলাম সামনে। পিছনে ছুটন্ত পায়ের শব্দ। নিশ্চয় আমাকে ধরতে আসছে প্রাণী দুটো। সামনে ছেলেমেয়েগুলোকে দেখা যাচ্ছে না আর। ধোঁয়ার ভিতর অদৃশ্য হয়েছে। আমিও কোন দিকে না তাকিয়ে ঝাঁপ দিলাম তাতে।
পায়ের নীচে মাটি নেই। মনে হলো শূন্যে উড়ছি। হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কোথায় যে পড়ছি, কে জানে! এক সময় করাতের গুড়ো আর আঠার। আঁঝাল গন্ধ নাকে এল। বুঝলাম, আলমারিতে ফিরে এসেছি। অনেকগুলো ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমিও জড়াজড়ি করতে লাগলাম বদ্ধ জায়গাটায়। ছোট একটা আলমারিতে এতজনের জায়গা হলো কী করে, ভেবে অবাক লাগল।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল আলমারির দরজা। কুয়াশার ভিতর দিয়ে উজ্জ্বল। আলো এসে চোখে লাগল। ধোঁয়ার মত গলগল করে খোলা দরজা দিয়ে। বেরোতে লাগল কুয়াশা। স্টেজের কয়েক ফুট ওপরে শূন্যে ভেসে রয়েছে আলমারিটা। চিৎকার-চেঁচামেচি করে ওপর থেকেই স্টেজে লাফিয়ে পড়তে শুরু করল ছেলেমেয়েরা। দল বেঁধে আমাদেরকে বেরোতে দেখে হাততালিতে ফেটে পড়ল দর্শকরা। হল জুড়ে প্রচণ্ড হট্টগোল। চারদিকে ছুটোছুটি করছে ছেলেমেয়েরা। চেঁচাচ্ছে। হাসছে। লাফাচ্ছে। নিরাপদে আবার পরিচিত পৃথিবীতে ফিরে আসার আনন্দে অস্থির।
ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে ক্ল্যাণ্ডর। সবার শেষে আলমারি থেকে বেরোলাম আমি। দর্শকদের হাততালি আর হট্টগোল আরও বেড়ে গেল। আমার দিকে ছুটে এল জাদুকর। চোখে চোখে তাকিয়ে রইল। শক্ত করলাম নিজেকে। চোখ সরালাম না। দাঁত খিচাল একবার ক্ল্যাণ্ডর। তারপর ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল আলমারিতে। ভিতর থেকে টান দিয়ে দড়াম করে দরজা লাগাল।
তাকিয়ে আছি। দুলতে শুরু করল আলমারিটা। গুমগুম শব্দ আসছে ভিতর থেকে। দুলতে দুলতে ওপরে উঠে গেল ওটা। ঘুরতে লাগল। কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে ছাত থেকে। গা থেকে বৈদ্যুতিক ফুলিঙ্গের মত আলোর কণা বেরিয়ে ছরছর করে স্টেজের ওপর পড়ছে। ক্রমেই ঘোরার গতি বাড়ছে আলমারিটার। কালো ধোঁয়া! ফুলিঙ্গ! সব কিছুর মাঝে ঝাপসা লাল রঙটা বন্ করে ঘুরছে!
পিছিয়ে এলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দর্শকরা। সবার চোখ এখন গুঞ্জন তুলে ঘুরতে থাকা আলমারিটার দিকে। হট্টগোল থেমে গেছে।
ঘুরতে ঘুরতে একসময় মিলিয়ে গেল আলমারিটা। রয়ে গেল শুধু কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। পাক খেয়ে উড়তে উড়তে ছাতের দিকে চলে গেল।
এরপরও বেশ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল দর্শকরা। তারপর হঠাৎ করেই লাফিয়ে উঠে আবার করতালি আর চিৎকার-চেঁচামেচিতে ফেটে পড়ল। এমন ম্যাজিক জীবনে দেখেনি কেউ!
সিটের সারির গলিপথ ধরে আমার দিকে দৌড়ে আসতে দেখলাম রবিনকে। মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে।
অ্যাই, তোমার নাম কী? কাছে এসে জিজ্ঞেস করল ও।
মুসা।
এবার বলো, আমার নাম কী?
হেসে বললাম, আর পরীক্ষা করতে হবে না, রবিন! আমি চেইনজেলিং নই, তোমার বন্ধু, মুসা। আমি আসল না হলে আমাকে দেখে পালাত না জাদুকর!
মাথা দোলাল রবিন। তা ঠিক।
.
পরদিন স্থানীয় খবরের কাগজে এই ম্যাজিক শো নিয়ে খবর বেরোল। বড় বড় হেডলাইন দিয়ে ক্ল্যাণ্ডরের প্রশংসা করে বেশ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রথম পৃষ্ঠাতে খবরটা ছেপেছে। শেষ কথা লিখেছে : দুঃখের বিষয় হলো, আজকের শো-টা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। হাজার হাজার টাকার টিকিট বিক্রি করে মাথায় হাত দিয়ে বসেছে প্যাসিফিক থিয়েটার হল কর্তৃপক্ষ, কারণ ক্ল্যাণ্ডরের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে ওকে পাওয়া যায়নি। কোথায় গেছে, কেউ জানে না।
খবরটা পড়ে মুচকি হাসলাম। আমি জানি, কোথায় গেছে। ক্ল্যাণ্ডর আয়ারল্যাণ্ডে, ওর নিজের দেশে। চেইঞ্জেলিংগুলোও নিশ্চয় কোনও অলৌকিক উপায়ে ওর সঙ্গে চলে গেছে। আর জাদুকরের বাড়িতে খুঁজে জিনিসপত্রগুলো সব উদ্ধার করল পুলিশ, ছেলেমেয়েদের দিয়ে যেগুলো চুরি করিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ক্ল্যাণ্ড।