জোরে জোরে সুর করে বললাম কথাগুলো। সঙ্গে সঙ্গে কাঁপতে শুরু করল আমার হাত-পায়ের কড়াগুলো। গরম হয়ে গেল।
আবার বললাম; গ্রুক ফুক ধ্রুম! গ্রুক ফুক ধ্রুম! গ্রুক ফুক ধ্রুম! খসে পড়ে গেল কড়াগুলো। আমি এখন মুক্ত।
ফারিহার কাছে দৌড়ে এলাম। চেঁচিয়ে বললাম, বলো, গ্রুক ফ্রক ধ্রুম? বার বার বলতে থাকো। অ্যাই, সবাই তোমরা সুর করে বলো কথাগুলো। বলে যাও, যতক্ষণ না কড়া খোলে।
অনেকগুলো কণ্ঠ সুর করে গেয়ে উঠল, এক ফ্রক ধ্রুম! গ্রুক ফ্রক ধ্রুম! এক ফুক ধ্রুম!
মুক্ত হয়ে গেল সবাই। আমাকে জড়িয়ে ধরল ফারিহা। ওর চোখে পানি। আমাকে ঘিরে নাচতে শুরু করল ছেলেমেয়ের দল। আনন্দে হই-হই করতে লাগল। দরজার কাছে ছুটে গেলাম। খোলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। এ সময় বাইরে পায়ের আওয়াজ শুনলাম। ক্রমেই কাছে। আসছে।
অ্যাই, সবাই যার যার জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ো! যে যেখানে বাঁধা ছিলে! জলদি! এমন ভান করে থাকো, যেন এখনও শিকলে বাঁধা রয়েছ। আমি না বলা পর্যন্ত কেউ জায়গা থেকে নড়বে না, কেউ কোন কথা বলবে না। যাও!
সবাই দৌড়ে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। দুই হাত পিছনে। সবাই উত্তেজিত। মুক্তির আনন্দে অস্থির। ব্যাপারটা এখন প্রাণী দুটো লক্ষ না করলেই হয়!
ফারিহা, ডেকে বললাম। আমি তোমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকানোর সাথে সাথে চেঁচানো শুরু করবে, যত জোরে পারো, বুঝলে?
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল ও।
খুলে গেল দরজাটা। প্রাণী দুটো ঘরে ঢুকল, ছেলেটাকে নিয়ে। অবিকল আমার মত দেখতে। কোন খুঁত বের করতে পারলাম না। এমনকী কাপড় চোপড়গুলোও আমারগুলোর মত। চেঁচিয়ে উঠল ফারিহা।
ভয় নেই, চুপ করে থাকো, আমি বললাম।
আমার সামনে এসে দাঁড়াল প্রাণী দুটো। চেইনজেলিংটাকে দাঁড় করাল আমার পাশে। একবার আমার দিকে একবার চেইনজেলিংটার দিকে তাকিয়ে কোথাও কোন অমিল আছে কি না বোঝার চেষ্টা করছে ওরা। নিজেদের কাজে সন্তুষ্ট মনে হলো ওদের। বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে দুজনে। ওদের কাঁধের ওপর দিয়ে ফারিহার দিকে তাকালাম। ইশারা করল ও।
মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে এমন এক বিকট চিৎকার দিল ও, আমি পর্যন্ত চমকে গেলাম। পাথরের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল সে-চিৎকার। চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল প্রাণী দুটো। ফারিহার দিকে
ফিরে তাকাল। চেঁচিয়েই চলল ফারিহা। কী হয়েছে বোঝার জন্য ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল প্রাণী দুটো। আমার ইচ্ছে সফল হলো। কাত হয়ে চেইনজেলিংটার কানে কানে হিক গ্রুম ব্রুম, নিজের হাতে শিকল লাগাও! [ঠিকই আছে এখানে] বলে সরে গেলাম। সামান্যতম দ্বিধা না করে আমার জায়গাটায় সরে এসে নিজের হাতে কড়া লাগিয়ে দিল ওটা।
এতক্ষণে চিৎকার থামাল ফারিহা। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী বলল প্রাণী দুটো, তারপর আমাদের দিকে ঘুরল। একবার আমার। মুখের দিকে, একবার চেইনজেলিংটার মুখের দিকে তাকাতে লাগল। দুরুদুর করছে আমার বুকের ভিতর। ভয় পাচ্ছি, ধরা না পড়ে যাই। কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না ওরা। সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে নিয়ে দরজার দিকে রওনা হলো।
দুজনের পিছনে রয়েছি আমি। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সবাই। ঠোঁটে আঙুল রেখে ওদের কথা বলতে নিষেধ করলাম। দরজার কাছে পৌঁছে দরজাটা খুলল প্রাণী দুটো। ওদের পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে এলাম। একটানে দরজার পাশের দেয়াল থেকে খুলে নিলাম একটা মশাল। জ্বলন্ত দিকটা ওদের মুখের কাছে ঠেলে দিলাম।
চেঁচিয়ে উঠে গুহার ভিতর পিছিয়ে গেল প্রাণী দুটো।
এসো তোমরা! ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললাম। জলদি বেরিয়ে এসো!
একদৌড়ে দরজার কাছে চলে এল ওরা। যতক্ষণ না সবাই সুড়ঙ্গে বেরোল, আগুন দেখিয়ে ঠেকিয়ে রাখলাম প্রাণী দুটোকে।
দৌড়াও! থেমো না! ছেলেমেয়েদের বললাম। আমি তোমাদের পিছনেই আসছি!
ফিরে তাকালাম আমার চেইনজেলিংটার দিকে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওটা, ভাবলেশহীন মুখ। ওই জায়গাটায় এখন আমার থাকার কথা, আর ওটা চলে যেত জাদুকরের আলমারি দিয়ে বেরিয়ে, আমাদের বাড়িতে ভেবে শিউরে উঠলাম!
প্রাণী দুটোকে গুহার মধ্যে শিকলে আটকে রেখে যেতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু ভিতরে ঢুকলেই যদি দরজাটা বন্ধ করে দেয় ওরা, আর খুলতে পারব না। তাই ঝুঁকি নিলাম না। ওদের দিকে মুখ করে পিছিয়ে যেতে থাকলাম সুড়ঙ্গ ধরে। আগুনের ভয় দেখিয়ে ওদের কাছে আসতে দিচ্ছি না। রাগে বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলছে ওরা, বোধহয় আমাকে গালি দিচ্ছে। দিক। বুঝতেও পারছি না। আর পারলেও মাথা ঘামাতাম না। আমার এখন একটাই উদ্দেশ্য, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় পৌঁছে দেখলাম, আমার জন্য অপেক্ষা করছে ছেলেমেয়ের দল। হাসি চলে গেছে সবার মুখ থেকে। আবার ভীত হয়ে পড়েছে ওরা। কারণ, সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ!
ভয় পেয়ো না, কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে সাহস জোগালাম ওদের। এখান থেকে বেরিয়ে যাবই আমরা, যে করেই হোক!
ঠিক এ সময় ধোঁয়া দেখা গেল। সবাইকে ঘিরে পাক খেয়ে ঘুরছে। কী ঘটছে, বুঝলাম। সুড়ঙ্গের মুখ খুলে দিয়েছে জাদুকর। চেইনজেলিংকে আলমারিতে ঢোকার পথ করে দিচ্ছে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে এখন আমাকে!