লম্বা একটা করিডর দেখতে পেল ও। বাতিল জিনিসপত্রে ঠাসা–পুরানো বালতি, ঝাড়, ব্রাশ, রঙের টিন, এসব। একটা মইয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল, ওপরে স্পটলাইট নিয়ন্ত্রণ করছে একজন লোক। ওখানে না থেমে করিডর ধরে এগিয়ে চলল ও। চলে এল স্টেজের পিছন দিকে।
এই, কে তুমি? জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ। পাক খেয়ে ঘুরে গেল রবিন। শ্রমিকের পোশাক পরা বিশালদেহী একজন লোককে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখল ওর দিকে। এখানে আসার অনুমতি কে দিল তোমাকে?
আ-আমি ট-ট-ট-ট-ট্রম! তুতলে জবাব দিল রবিন। অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ল, আপনাদের ইলেকট্রিশিয়ানের ছেলে।
রুক্ষকণ্ঠে লোকটা বলল, কিন্তু ওর কোন ছেলে আছে বলে তো জানতাম না, কখনও বলেনি। যাকগে, কোন কিছুতে হাত দেবে না, বুঝলে?
স্টেজের পিছনে দাঁড়িয়ে ক্ল্যাণ্ডরকে দেখতে পাচ্ছে রবিন। শেষ খেলাটার আগের খেলাটা দেখাচ্ছে এখন ও। শো শেষ হতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি।
কী করা যায় ভাবছে ও। একপাশে একটা মোটরের মত যন্ত্র চোখে পড়ল ওর। ওটার সঙ্গে লাগানো কয়েকটা দাঁতওয়ালা চাকা। ওগুলো গিয়ার, বুঝতে পারল ও। একটা গিয়ারের কেন্দ্রে ঢোকানো লোহার ডাণ্ডায় পেঁচানো দড়ির অন্য মাথাটা পুলির ওপর দিয়ে চলে গেছে ছাতের দিকে। দড়িটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল রবিন। আবার ফিরে তাকাল মোটরটার দিকে।
কোমর থেকে বেল্টটা খুলে নিয়ে লেজের দিকটা দুটো চাকার দাঁতের ফাঁকে খাড়া ঢুকিয়ে দিল। তারপর টান মারল মোটরের একটা লিভার ধরে। গুঞ্জন তুলে চালু হয়ে গেল মোটর, ঘুরতে শুরু করল পুলি, স্টেজের ওপর নেমে যেতে থাকল লাল পর্দাটা। খেলা দেখাতে দেখাতে আচমকা থেমে গেল ক্ল্যাণ্ড। পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। বেল্টের চামড়া ছেঁড়ার শব্দ হলো। দাঁতগুলো আটকে গিয়ে ঘোরা বন্ধ করে দিল। ওদিকে মোটর চলছে। পোড়া গন্ধ আর ধোঁয়া বেরোতে লাগল মোটর থেকে। স্টেজের তিন-চার ফুট ওপরে এসে থেমে গেল পর্দার ঝুল।
ফিরে তাকাতে রবিনের ওপর চোখ পড়ল ক্ল্যাণ্ডরের। প্রচণ্ড রাগে চেঁচিয়ে উঠল, জলদি পর্দা তোলো!
ধাক্কা দিয়ে রবিনকে সরিয়ে দিল শ্রমিকের পোশাক পরা লোকটা। উল্টো দিকে ঠেলে দিল মোটরের লিভার। কঁকি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল মোটর।
আটকে গেছে, ক্ল্যাণ্ডকে জানাল ও। এই ছেলেটা কিছু করেছে… কোন ছেলেটা দেখাতে গিয়ে ফিরে তাকাল লোকটা। রবিনকে দেখল না। ও ততক্ষণে সরে পড়েছে।
অডিটরিয়ামে ফিরে রবিন দেখল, পর্দা সরিয়ে স্টেজের এপাশে বেরিয়ে। আসছে ক্ল্যাণ্ড। হট্টগোল করতে থাকা দর্শকদের উদ্দেশ্যে হাত তুলে বলল, প্লিজ, লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলম্যান, আপনারা শান্ত হোন। একটা যান্ত্রিক গোলযোগ ঘটেছে। এখনই ঠিক হয়ে যাবে। প্লিজ, শান্ত হোন আপনারা।
পর্দার ঝুল উঁচু করে আবার ওপাশে চলে গেল ক্ল্যাণ্ডর।
১১
গুহার দেয়াল ঘেঁষে তখন শিকলে আটকে রয়েছি আমি, ওপরে অডিটরিয়ামে যে এত কিছু ঘটছে, তার কিছুই জানি না। হঠাৎ করেই আবার খুলে গেল গুহার ইস্পাতের দরজাটা। সেই প্রাণী দুটো ঢুকল। ওদের পিছন পিছন আসছে আরেকজন। কে, দেখতে পাচ্ছি না। কাছে আসার পর যখন আমার দৃষ্টিপথ থেকে সরে দাঁড়াল প্রাণী দুটো, তখন দেখলাম, অবিকল আমার মত দেখতে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে আয়নায় দেখা আমার প্রতিরিম্বের মত!
বার বার আমার দিকে আর আমার চেইনজেলিংটার দিকে তাকাচ্ছে প্রাণী দুটো। মিলিয়ে নিচ্ছে কোথাও কোন অমিল আছে কি না। বিড়বিড় করে নিজেদের মধ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে। এপাশ থেকে, ওপাশ থেকে, সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে আমাকে দেখার পর নকল ছেলেটাকে নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল ওরা। সম্ভবত, যেসব জায়গায় খুঁত রয়েছে সেসব মেরামত করতে। নাকি সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছে ওটাকে আলমারি দিয়ে বের করে দেয়ার জন্য? তা হলে তো মরেছি!
তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে বলছে আমাকে ফারিহা। ওর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাকি ছেলেমেয়েগুলোও ওদেরকে মুক্ত করতে অনুরোধ করছে। ওদের মধ্যে বয়েসে বড় আমি। একমাত্র আমিই এখন ওদের আশা-ভরসা। আবার শিকলের আংটা খোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এত শক্ত শিকল ছেঁড়া সম্ভব হলো না। প্রাণী দুটো আর আসছে না। ক্রমেই দমে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, আলমারিতে ঢুকে ভুল করেছি। অন্যদের সঙ্গে আমিও আটকা পড়েছি লেপ্রেকনের কারাগারে। আর কোনদিন বেরোতে পারব না এই বন্দিশালা থেকে!
আমার বাবাকে বলে গিয়ে, কেঁদে উঠে বলল একটা ছেলে। আমাকে এসে নিয়ে যাক! চোখ তুলে তাকালাম। ডোরি। অফিসার হাওয়ার্ডের ছেলে। আমার বাবাকে গিয়ে বলো, প্লিজ!
খুব খারাপ লাগছে আমার। বেরিয়ে গিয়ে ওর বাবাকে খবর দেয়াটা যে এত সহজ নয়, বুঝতেই পারছে না ছেলেটা। ও জানে না, এ মুহূর্ত অডিটরিয়ামে বসে অন্য দর্শকদের সঙ্গে ম্যাজিক শো উপভোগ করছেন ওর বাবা। তার ছেলে যে নিখোঁজ হয়েছে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। বরং যে লোকটা তার ছেলেকে গায়েব করে দিয়েছে, তার জাদুর খেলা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দিয়ে নিশ্চয় অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
অফিসার হাওয়ার্ডের কথা ভাবতে হঠাৎ করেই বুদ্ধিটা মাথায় এল আমার। জাদুকরের হাতে শিকল পরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মন্ত্র পড়ে শিকলের তালা খুলে ফেলেছিল ক্ল্যাণ্ডর। ও বলছিল: গ্রুক ফুক ধ্রুম! গ্রুক ফুক ধ্রুম! গ্রুক ফুক ধ্রুম!