লাল আলমারিটার কাছে আমাকে টেনে নিয়ে গেল ক্ল্যাণ্ডর। হঠাৎ করেই হাঁটু কাঁপতে শুরু করল আমার, তবে আমি যে ভয় পেয়েছি ওকে সেটা বুঝতে দিলাম না। আলমারিতে ঢুকে দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। ভিতরটা বেশ গরম। করাতের গুঁড়ো আর আঠার ঝাঁঝাল গন্ধ।
ক্ল্যাণ্ডরের চোখের দিকে তাকালাম না, সম্মোহিত হওয়ার ভয়ে। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেঝে থেকে উঠতে আরম্ভ করল আলমারিটা। মনে হলো, এলিভেটরে চড়ছি। দুরুদুরু করছে বুকের ভিতর। হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে। রবিনের দিকে তাকালাম। সাদা হয়ে গেছে ওর মুখ। ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। Obr
তারপর, দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হলাম।
৯
মনে হতে লাগল, গভীর অন্ধকার মহাশূন্য থেকে নীচে পড়ছি আমি। কানের পাশে বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ। গর্জন করে বয়ে চলেছে যেন ঝোড়ো বাতাস।
ধুপ করে পড়লাম পাথরের মেঝেতে। আমাকে ঘিরে পাক খেতে লাগল ঘন কুয়াশা। দুই কব্জি চেপে ধরল ঠাণ্ডা দুটো হাত। টানাটানি করে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। পারলাম না। মনে হচ্ছে বরফ-শীতল সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরা হয়েছে আমার হাত দুটো টেনে খাড়া করল আমাকে। কুয়াশা সরে যাচ্ছে। আলো চোখে পড়ল। অন্ধকার একটা পাথরের সুড়ঙ্গে রয়েছি আমি। দুই দেয়ালে লাগানো মশাল জ্বলছে। যেন প্রাচীন কোনও সময়ে চলে এসেছি।
আমার দুই পাশে প্রায় গায়ের ওপর চেপে রয়েছে দুটো প্রাণী। আমার চেয়ে খাটো। কিন্তু অনেক বেশি চওড়া কাঁধ, ভারি শরীর, গরিলার মত হাতের মস্ত ঠাণ্ডা থাবা দুটোতে প্রচণ্ড শক্তি। পরনে কালো কাপড়ের পোশাক। গল্পের বইয়ে এ রকম প্রাণীর ছবি দেখেছি। আইরিশ রূপকথার দুষ্ট নৌম কিংবা ট্রোল-এর ঠিক কোনটা ওরা, বুঝতে পারলাম না। অদ্ভুত, দুর্বোধ্য, বিচিত্র ভাষায় পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে, একটা বর্ণও বুঝলাম না। কথা। বলার সময় ঘোঁৎ-ঘোৎ আর চি-চি শব্দ বেরোচ্ছে গলা থেকে।
হাত ছাড়ানোর জন্য আবার ধস্তাধস্তি শুরু করলাম। ব্যর্থ হলাম এবারও। অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলল ওরা। ইস্পাতের তৈরি একটা বন্ধ দরজার সামনে এনে দাঁড় করাল। আড়াআড়ি লোহার ডাণ্ডা লাগিয়ে রাখা হয়েছে দরজাটায়। দুই পাশে দেয়ালে গাঁথা দুটো মশাল জ্বলছে।
বিড়বিড় করে কী যেন বলল একটা প্রাণী। আলিবাবার গুহার দেয়ালের মত আপনাআপনি খুলে গেল দরজাটা। মস্ত একটা গুহায় আমাকে টেনে ঢোকাল প্রাণী দুটো। গুহাটা মশালের আলোয় আলোকিত। চারপাশের দেয়াল ঘেঁষে অনেকগুলো ছেলেমেয়েকে দেখলাম, শিকল দিয়ে বাঁধা। ভীত, ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওদের। দেয়ালের কাছে একটা খালি জায়গায় আমাকে টেনে নিয়ে গেল প্রাণী দুটো, দেয়ালে গাঁথা আংটা থেকে লোহার শিকল ঝুলছে। এখানে।
হঠাৎ মুসা ভাইয়া, মুসা ভাইয়া! ডাক শুনলাম। কাঁধের ওপর দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকালাম। ফারিহাকে দেখতে পেলাম। পরনে এখনও সেই লাল রঙের টি-শার্ট। অন্য ছেলেমেয়েগুলোর মতই পাথরের দেয়ালের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা রয়েছে ও। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আরও একবার ধস্তাধস্তি করে প্রাণী দুটোর হাত থেকে ছোটার চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না।
আমার কব্জি আর গোড়ালিতে আংটা পরিয়ে আটকে দিল প্রাণী দুটো। তারপর পিছিয়ে গিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। বুঝলাম, ভালমত দেখে নিচ্ছে আমাকে, আমার চেহারার চেইনজেলিং বানানোর জন্য। বানানোর পর আমার নকলটাকে বের করে দেবে জাদুকরের আলমারির ভিতর দিয়ে। আর সেটা দেখে হাততালি দেবে দর্শকরা। লেপ্রেকনের শয়তানি কিছুই বুঝতে পারবে না।
বড় দরজাটা দিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে গেল প্রাণী দুটো। ঝনঝন শব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ফারিহার দিকে তাকালাম।
কিছু একটা করো, মুসা ভাইয়া, কাতরকণ্ঠে অনুরোধ করল ফারিহা। বাঁচাও আমাদের!
গুহার চারপাশে চোখে বোলালাম। আতঙ্কিত কিটুকেও দেখলাম। বনের ভিতর অগ্নিকুণ্ডের কাছে এদেরকে-না না, এদের চেইনজেলিংকে দেখেছি। মশালের আলোয় প্রতিটি ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকালাম। রকি বিচ থানার অফিসার জন হাওয়ার্ডের ছেলে ডোরিকে চিনতে পারলাম।
টানাটানি করে শিকল খোলার চেষ্টা করলাম। ব্যথাই পেলাম শুধু, কিছুই করতে পারলাম না। দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ঝনঝন শব্দ তুলল লোহার শিকল।
ভাবছি, রবিন এখন কী করছে?
১০
শো প্রায় শেষ। আর একটা কী দুটো খেলা দেখানোর পর আলমারি দিয়ে মুসার চেইনজেলিংটাকে বের করবে জাদুকর–ভাবছে রবিন। জাদুকরকে দেরি করানোর জন্য কিছু একটা করা দরকার। উঠে দাঁড়াল ও। অডিটরিয়াম থেকে বেরিয়ে এসে দড়ির বেড়া দেয়া সরু রাস্তাটায় অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে লাগল। ভাবনার ঝড় বইছে মাথায়। গলার ভিতরটা শুকিয়ে গেছে। একটা কোকটোক পেলে ভাল হতো। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা ড্রিংকের স্টল দেখে সেদিকে এগোল। ড্রিংক খেতে খেতে দেখল, স্টলের পাশে একটা দরজার গায়ে লেখা : সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
দরজার নবে মোচড় দিল রবিন। তালা নেই। ফিরে তাকিয়ে দেখল, কেউ দেখছে কি না। না, কেউ তাকাচ্ছে না ওর দিকে। আস্তে করে পাল্লা ঠেলে খুলে দ্রুত চলে এল ভিতরে। টেনে লাগিয়ে দিল আবার পাল্লাটা।