শো শুরু হলো।
নানারকম খেলা দেখাতে লাগল ক্ল্যাণ্ডর, এসব খেলা আগেও দেখেছি; প্রথম যেদিন এসেছিলাম। সেরাতে আনন্দ পেয়েছিলাম, আজ হতে লাগল রাগ।
একই রকম খেলা দেখিয়ে যাচ্ছিল ক্ল্যাণ্ডর, তবে বাধা পড়ল তাতে। বাধা দিলেন অফিসার হাওয়ার্ড। পাঁচ নম্বর সারিতে বসেছেন তিনি। উঠে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন জাদুকরকে।
এই যে, মিস্টার ক্ল্যাণ্ডর, হই-হট্টগোলের মধ্যে চেঁচিয়ে বললেন তিনি। পোস্টারে লেখা রয়েছে আপনি হুডিনির চেয়ে বড় জাদুকর।
কপালে হাত রেখে আলো আড়াল করে দর্শকদের সারির দিকে তাকাল ক্ল্যাণ্ডর। অফিসার হাওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, ঠিকই লিখেছে! বাধা দেয়ায় রেগে গেছে ও।
বেশ, তাহলে দেখব এটা থেকে কী করে মুক্তি পান, একটা হাতকড়া তুলে দেখালেন হাওয়ার্ড। হাতটা আরেকটু উঁচু করলেন তিনি, যাতে সিটে বুসা দর্শকরাও হাতকড়াটা দেখতে পায়। বহু কষ্টে এটা জোগাড় করে এনেছি, পরীক্ষা করে দেখার জন্য। আজ দেখব, সত্যি আপনি হুডিনির চেয়ে। বড় জাদুকর কি না।
চেঁচাতে লাগল দর্শকরা। কেউ জোরে শিস বাজাল। কেউ জোরে পা ঠুকতে লাগল মেঝেতে। রাগত দৃষ্টিতে দর্শকদের ওপর চোখ বোলাল ক্ল্যাণ্ডর। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল ও।
এ তো বাচ্চাছেলের খেলা, কর্কশ কণ্ঠে বলল ক্ল্যাণ্ড।
উল্লসিত চিৎকার করে উঠল দর্শকরা। হাতকড়াটা নিয়ে স্টেজে উঠলেন অফিসার হাওয়ার্ড।
দর্শকদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল ক্ল্যাণ্ডর। দুই হাত পিছনে নিয়ে এল। ওর কব্জিতে হাতকড়া পরিয়ে তালা লাগিয়ে দিলেন হাওয়ার্ড। পকেটে রাখলেন চাবিটা। চুপ হয়ে গেছে দর্শকরা। পিনপতন নীরবতা। উত্তেজনায় কখন যে সামনে ঝুঁকে বসেছি, বলতে পারব না। আবার ঘুরে দাঁড়াল ক্ল্যাণ্ডর, দর্শকদের মুখোমুখি।
ঠোঁট নড়তে আরম্ভ করল ওর। কী বলে শোনার জন্য কান খাড়া। করলাম। বার বার একই কথা, সুর করে ছন্দের মত করে বলে গেল ও, গ্রুক ফ্রক ধ্রুম! গ্রুক ফ্রক ধ্রুম! এক ফুক ধ্রুম!
হঠাৎ ঝটকা দিয়ে হাত দুটো সামনে নিয়ে এল ক্ল্যাণ্ডর। একহাতে ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে হাতকড়াটা। দুটো আংটাই ভোলা। দর্শকদের প্রচণ্ড চিৎকারে কানের পর্দা ফাটার জোগাড় হলো। স্তম্ভিত হয়ে গেছেন হাওয়ার্ড। শিকলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে স্টেজ থেকে তাঁকে নামিয়ে দিল ক্ল্যাণ্ডর। গম্ভীর মুখে সিটে ফিরে এলেন হাওয়ার্ড। চোখের বিস্ময় কাটছে না।
স্টেজের দিকে ফিরলাম। ছায়ার মধ্যে আলমারিটা দেখা যাচ্ছে এখন।
আমার পরের খেলার জন্য, দর্শকদের মাঝ থেকে আমি একজন ছোট্ট সহকারী চাই, ক্ল্যাণ্ডর বলল।
অসংখ্য হাত ঝটকা দিয়ে উঠে গেল ওপরে। সিটের সারিগুলোর বা দিকে তাকিয়ে আছে জাদুকর। ওর নজর দেখেই বুঝতে পারছি, কোন বাচ্চাটাকে পছন্দ করেছে ও। মনে হলো, শো শুরু হওয়ার আগে থেকেই বাছাই করে রেখেছিল। হাত লম্বা করে আঙুল তুলে সেদিকে নির্দেশ করল।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তাড়াহুড়া করার জন্য আমার সামনের দুই সারি সিট ডিঙিয়ে স্টেজের কাছে চলে এলাম। আমার কাণ্ড দেখে কাত হয়ে। জায়গা করে দিল অবাক দর্শকরা, তবে সবাই ওরা ছোট ছেলেমেয়ে। বড়রা ধমকে উঠল। কান দিলাম না। যে ছেলেটাকে বাছাই করেছে ক্ল্যাণ্ডর, সে আসার আগেই স্টেজে উঠে ক্ল্যাণ্ডরের মুখোমুখি দাঁড়ালাম।
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল জাদুকর। রাগে বাঁকা হয়ে গেছে। ঠোঁটের দুই কোণ। এই ছেলে! হিসিয়ে উঠল ও। ওর গরম নিঃশ্বাস লাগল আমার গলায়। আমি তো তোমাকে ডাকিনি। ভাল চাও তো সিটে ফিরে যাও।
বিশাল হলঘর জুড়ে আবার পিনপতন নীরবতা।
না, সার, ফিসফিস করে বললাম, আমি আপনার সহকারী হব! পিছনের দর্শকদের সারি থেকে হাততালি শোনা গেল। ফিরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। উজ্জ্বল আলোর ভিতর দিয়ে দেখা কঠিন। কপালে হাত তুলে আলো আড়াল করে দেখলাম, হাততালি দিচ্ছে রবিন। চেঁচিয়ে সুর করে বলল ও, মুসা তুমি এগিয়ে চলো! আমরা আছি তোমার সাথে! ওর পাশে বসা পরিবারটাও ওর সঙ্গে গলা মেলাল। আরও অনেকেই গলা মেলাল, একইসঙ্গে হাততালি দেয়া শুরু করল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে সমস্ত দর্শকরাই যেন আমার পক্ষে চলে এল। আমাকে নিতে অনুরোধ করছে জাদুকরকে।
আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করল ক্ল্যাণ্ডর। আমাকে ভলান্টিয়ার হিসেবে নিতে রায় দিয়েছে দর্শকরা। না নিয়ে আর উপায় নেই ওর। রাগে হিসিয়ে উঠে ফিসফিস করে বলল, কীসের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছ, জানো না তুমি। বেশ, এতই যখন ইচ্ছে, তোমাকেই নিলাম। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে হাসল ও। কিন্তু ওই হাসির আড়ালে ওর অস্বস্তিটা টের পেলাম আমি।
আলমারিটা স্পটলাইটের নীচে টেনে আনল ক্ল্যাণ্ডর। দরজা খুলে আগের দিনের মতই দর্শকদের দেখাল ভিতরে কিছু নেই। থাবা দিয়ে বোঝাল, নিরেট কাঠ।
আমার পাশে এসে দাঁড়াল। দর্শকদের শুনিয়ে আমাকে বলল, অন্ধকারকে নিশ্চয় ভয় পাও না তুমি, তাই না?
মাথা নাড়লাম।
দর্শকদের হাসি শোনা গেল। কে একজন বলল, সাহস আছে। ছেলেটার।
আমি কোনদিকে তাকাচ্ছি না, সোজা তাকিয়ে আছি ক্ল্যাণ্ডরের চোখের দিকে। আমি আপনাকে ভয় পাই না, নিচুস্বরে বললাম।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইল ও। মনে হলো, আমি যে ওর গোপন কথা সব জানি, সেটা যেন বুঝে গেছে। একটা ভুরু উঁচু করল। তোমাকে বিদেয় করাটা সত্যিই এখন জরুরি হয়ে পড়েছে, ইয়াং ম্যান। জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল ও।