আসল ছেলেমেয়েগুলোকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে ক্ল্যাণ্ডর জানতে হবে আমাদের, রবিন জবাব দিল। ওদের ফিরিয়ে আনতে পারলেই বিশ্বাস করবে।
একজন শয়তান জাদুকর ফারিহাকে চুরি করে নিয়ে আটকে রেখেছে, ভাবতে ভীষণ রাগ হলো আমার। ভয়ও পেলাম। যদি ইতিমধ্যেই ওর কোন ক্ষতি করে ফেলে থাকে জাদুকর!
হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল মাথায়। বললাম, কী করে ওদের খুঁজে বের করতে হবে, বুঝে গেছি।
কী করে?
জাদুকরের ম্যাজিক আলমারিতে ঢুকতে হবে আমাকে, জবাব দিলাম।
ওপাশে দীর্ঘ নীরবতার পর রবিন বলল, সেটা করা ঠিক হবে না, মুসা। ভয়ানক বিপজ্জনক কাজ। যদি আর ফেরার পথ না থাকে তোমার?
ফেরার পথ নিশ্চয় আছে, আমি বললাম। আসল ছেলেমেয়েগুলোকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়, নিশ্চয় সেখান থেকেই বেরিয়ে আসে। চেইনজেলিংরা।
হয়তো, রবিন বলল।
যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে ফেরার পথ নিশ্চয় আছে। আসল বাচ্চাগুলো যে পথে যায়, নকলগুলো ঠিক সেপথেই বেরিয়ে আসে। আমি সব জেনেশুনে তৈরি হয়ে যাচ্ছি, সাবধান থাকবযাতে আমাকে আটকে ফেলতে না পারে জাদুকর।
আবার নীরব হয়ে গেল রবিন। কয়েক মুহূর্ত পর জবাব দিল, আমার ভয় লাগছে। এ রকম ঝুঁকি নিয়ে বিপদের মধ্যে ঢাকা তোমার ঠিক হবে না।
যা হয় হোক, ওই আলমারিতে আমি ঢুকবই, জবাব দিলাম। ফারিহা, কিটু, আর যাকে যাকে নিয়ে গেছে, সবাইকে বের করে আনব। যদি আমাকে সাহায্য করতে চাও, আজ সন্ধ্যায় ক্ল্যাণ্ডরের শো শুরু হওয়ার আগেই প্যাসিফিক থিয়েটার হলের সামনে চলে এসো। যদি না আসো, একাই যাব। মোট কথা, ওই আলমারিতে ঢুকবই আমি।
তৃতীয়বারের মত চুপ হয়ে গেল রবিন। বুঝতে পারছি, কিটুর কথা ভাবছে। অবশেষে বলল, ঠিক আছে, আমি যাব।
.
শো শুরু হওয়ার বিশ মিনিট আগে থিয়েটার হলে পৌঁছলাম। টিকেট কাউন্টার থেকে দুটো টিকেট কিনলাম–একটা আমার জন্য, একটা রবিনের জন্য। বার বার ঘড়ি দেখছি আর পায়চারি করছি, ওর আসার অপেক্ষা করছি।
থিয়েটার হলের সামনের অংশটা প্রচুর আলো দিয়ে সাজানো। আমার দুই পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হাসিখুশি অসংখ্য পরিবার, প্রায় সবার সঙ্গেই বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রয়েছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল : যেয়ো না, যেয়ো না, ওই ক্ল্যাণ্ডর সাধারণ ম্যাজিশিয়ান নয়–ও একটা দুষ্ট লেপ্রেকন, বিদেশী রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা মনস্টার, অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী!
কিন্তু বলতে পারলাম না। জানি, কেউ আমার কথা শুনবে না। পাগল ভাববে।
থিয়েটার হলের সামনে দেয়ালে লাগানো গ্রেট ক্ল্যাণ্ডরের ছবিওয়ালা বড় বড় পোস্টার। ছবির নীচে লিখে দিয়েছে : গ্রেট ক্ল্যাণ্ডর হুডিনির চেয়ে বড় জাদুকর। ছবিটার দিকে যতটা সম্ভব কম তাকানোর চেষ্টা করলাম, তাকালে অস্বস্তি বোধ করি, ভয় বাড়ে।
আবার ঘড়ির দিকে তাকালাম। হঠাৎ আমার কাঁধে একটা হাত পড়ল। ভীষণ চমকে গিয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম।
সরি, রবিন বলল। তোমাকে চমকে দিতে চাইনি।
ওর টিকেটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। একসঙ্গে বসব না আমরা, বুঝলে। কোনভাবেই ক্ল্যাণ্ডরের সন্দেহ জাগাতে চাই না।
দরজায় দাঁড়ানো দারোয়ানের হাতে টিকেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম দুজনে। দুই পাশে ছোট ছোট তামার খুঁটি বসিয়ে ওগুলোর মাথায় ছিদ্র করে তার ভিতর দিয়ে লাল দড়ি ঢুকিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে, মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা। সেটা ধরে হেঁটে চললাম। অডিটরিয়ামের দরজার কাছে পৌঁছলাম। ভিতরে ঢুকলাম। দর্শকে ভর্তি হয়ে আছে। হাসি আর উত্তেজিত কথা শোনা যাচ্ছে চতুর্দিকে। শো শুরুর অপেক্ষা করছে সবাই। অডিটরিয়ামের চারপাশে চোখ বোলালাম। আমার বয়েসী, আমার চেয়ে ছোট-বড়, প্রায় শখানেক ছেলেমেয়ে এসেছে ম্যাজিক দেখতে। এত ছেলেমেয়ের মধ্য থেকে ক্ল্যাণ্ডরের দৃষ্টি আকর্ষণ করব কীভাবে? কী করে নিশ্চিত হব, আমাকেই ভলান্টিয়ার হিসেবে বেছে নেবে ও?
রবিনের দিকে ফিরলাম। আমাদের দুজনকেই কাজ করতে হবে। আমি গিয়ে ওকে আমাকে আলমারিতে ঢোকাতে বলব।
আর আমি? রবিন জিজ্ঞেস করল।
আমি আলমারিতে ঢুকে যাবার পর এমন কিছু করবে তুমি, যাতে আমি কাজ করার সময় পাই। ওপাশে গিয়ে কী দেখব তা তো জানি না, তবে কিছু করার জন্য সময় দরকার হবে। সেই সময়টা তুমি আমাকে করে দেবে।
এখান থেকে দুজনে আলাদা হয়ে গেলাম আমরা। সিটের মাঝখানের গলিপথ ধরে তৃতীয় সারিতে ঢুকে পড়লাম আমি। দুটো পরিবারের মাঝখানে একটা খালি সিট দেখে বসলাম। ফিরে তাকিয়ে দেখি, পিছনের সারিতে চলে গেছে রবিন। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে যেন অভয় দিতে চাইল।
ঘুরে তাকালাম স্টেজের দিকে। লাল মখমলের পর্দাটা ঝুলে রয়েছে। ওটার ওপাশে কোন শয়তানির খেলা চলছে আমি জানি না। গায়ে কাঁটা দিল। চারপাশের অসংখ্য হাসিখুশি মুখের দিকে তাকালাম আরেকবার।
আবার ফিরে তাকালাম, রবিন কী করছে দেখার জন্য। ওর পাশে বসা। পরিবারটার সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিয়েছে। হাসছে, কথা বলছে। ভঙ্গি দেখে, মনে হচ্ছে যেন কতকালের চেনা।
এই সময় আলো কমতে শুরু করল। চুপ হয়ে গেল দর্শকরা। লাল পর্দার ওপর গোল একটা স্পটলাইটের উজ্জ্বল আলো পড়ল। পর্দা সরে গিয়ে শূন্য স্টেজ দেখা গেল। তারপর, স্পটলাইটের আলোর মাঝখানে ধোঁয়ার ফিতে দেখা গেল। কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠছে ফিতেটা। বাড়তে লাগল ধোঁয়া। মোটা হলো অনেক। এত জোরে পাক খেতে শুরু করল, যেন টর্নেডো হচ্ছে। হঠাৎ করেই সেই ধোঁয়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ক্ল্যাণ্ডর। ওর কালো আলখেল্লার কোনা উড়ছে বাতাসে। দর্শকদের ঘন ঘন হাততালি আর চিৎকার-চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা।