এখনও। ওগুলোর টুকটাক কাজ চলছে। মিস্টার পারকার নিজে করেন সেসব।
চোখের কোণ দিয়ে পারকার আঙ্কেলের প্রিয় মমিটার দিকে তাকাল ও। মিস্টার পারকার ওটার নাম দিয়েছেন উদাস।
উদাস তার খাড়া কফিনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
গজমোড়া বাহু দুটো সামনে বাড়িয়ে রেখেছে।
কোটরের গর্তে বসা চোখজোড়া যেন অন্ধকার ভেদ করে চেয়ে। আছে সোজা কিশোরের দিকে।
আস্তে ঢোক গিলল ও। নিজের অজান্তেই কেশে উঠল। হয়তো সহজ হওয়ার জন্য।
দ্রুত পা চালাল।
কিছুক্ষণ পর নির্দিষ্ট রুমের সামনে পৌঁছল ওরা। রুমের ভিতর দরজার কাছেই কাঠের একটা স্ট্যাণ্ডের উপর দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল বর্মটাকে।
চোখ গোল গোল করে কিশোরের কাঁধের উপর দিয়ে সামনে তাকাল জিনা।
চোয়াল ঝুলে পড়েছে। হাত ইশারা করল ও। সামনে তাকাল কিশোর। সাথে সাথে বেদম এক ঝাঁকি খেল।
জায়গাটা শূন্য!
বর্মটা নেই!
৭
কিশোর! জিনার গলা কেঁপে উঠল। কোথায় গেল ওটা? কোথায় গেল? এখানেই তো ছিল!
বর্মটা গায়েব হয়ে গেছে। ওটার কাঠের স্ট্যাণ্ডটা আছে কেবল।
এর অর্থ বুঝতে পারছ, জিনা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পারছি, ঢোক গিলল জিনা। বর্মটা হাঁটাচলা করতে পারে। ওটা… ওটা… আসলেই…
মনে হয় ভুতুড়ে! ওর কথা কেড়ে নিল কিশোর। বদমাশ নেজারের ভূত আছে ওটার মধ্যে। ভূতটা বর্মসহ নড়াচড়া করে। হাঁটাচলাও করতে পারে।
ওটা এখন কোথায় আছে কে জানে! সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলল জিনা। চেহারায় তীব্র আতঙ্কের ছাপ পড়ল। তলকুঠুরিতে লুকিয়ে আছে। হয়তো। নয়তো… নয়তো ওপরতলায় গেছে। এক পা পিছিয়ে মমিঘরে পা রাখল ও। এই রুমেও থাকতে পারে। হয়তো ঘাপটি মেরে বসে আছে অন্ধকারে কোথাও।
চারদিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল কিশোর। আমার তা মনে হয়, বলল ও। ওটার যে সাইজ, এখানে ঘাপটি মেরে থাকা সম্ভব নয়। অন্য কোথাও আছে। এসো, খুঁজে দেখি।
দরকার নেই, পিছিয়ে গেল জিনা। সময় হলে আপনিই ফিরে আসবে। চলো, ফিরে যাই।
বলো কী! কিশোর অবাক হলো। এতদূর এসে ফিরে যাব? তুমি ভাল করেই জানেনা সেটা উচিত হবে না। এই রহস্য ভেদ না করতে পারলে চলবে না।
জিনার ঢোলা জামার আস্তিন ধরল ও। নিয়ে চলল যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে।
এর মধ্যে জানা হয়ে গেছে, নেজার মমিঘরে নেই।
কফিনঘরেও নেই।
কিচেনের অন্ধকার কোণ আর ছায়াগুলো ভাল করে পরখ করল। ওরা, ওখানেও নেই বর্মটা।
তা হলে?
আর কোথায় থাকতে পারে ওটা?
চলো, মোমঘরটা চেক করে আসি, কিশোর বলল।
অসম্ভব! তীব্র প্রতিবাদ জানাল জিনা। ওই ঘরে কেন যেন কখনোই যেতে চায় না ও, ভয় পায়। ওই ঘর ছাড়া যেখানে খুশি চলো।
ঠিক আছে, ওখানে যাব না, বলল কিশোর। কী যেন ভাবছে। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, কনজারভেটরিতে থাকতে পারে।
বাড়ির পিছন দিকে বিশেষভাবে তৈরি একটা কাঁচের ঘর ওটা। বাগান ঘর।
জিনা ওখানে না যাবার উছিলা খুঁজল, কিন্তু যুৎসই কোনও কারণ দাঁড় করানোর সময় পেল না। কিশোর তার আগেই ওকে নিয়ে চলল বাড়ির পিছন দিকে।
এই বাড়িতে যেদিন প্রথম এসেছে কিশোর, সেদিন মিস্টার পারকার, জিনা আর হ্যাগার্ডের মুখে বারবার শুনেও বুঝতে পারেনি কনজারভেটরি কী জিনিস।
শেষে মিস্টার পারকার ওকে বোঝালেন ওটা আর কিছু নয়, এক ধরনের গ্রিন হাউজ।
ওটা প্রকাণ্ড এবং ফাঁকা। ওটার ছাদ আর তিনদিকের দেয়াল কাঁচের।
মিস্টার পারকার ওখানে নানান জাতের শাক-সবজি, গাছপালা লাগিয়ে গবেষণা করেন। কিশোর যতদূর জানে, ওই ঘরটাকে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করার কোনও ইচ্ছে নেই মিস্টার পারকারের। রুমটা বিশাল, বেঢপ।
তা ছাড়া এখানে জাদুঘর করতে গেলে এখানে-ওখানে বিস্তর মেরামত করাতে হবে। সাময়িক শখের জন্য অত ঝামেলায় যেতে রাজি নন মিস্টার পারকার।
কনজারভেটরির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ল কিশোর ও জিনা।
চাঁদের রহস্যময় নীল আলো দেয়াল আর ছাদ ভেদ করে ভিতরে ঢুকছে। একেবারেই অন্যরকম লাগছে জায়গাটাকে।
দেয়াল ঘেঁষে এগিয়ে চলল ওরা পা টিপে টিপে। কতগুলো গাছের আড়ালে চলে এল ওরা। জাদুঘরে ব্যবহার করার জন্য মিস্টার পারকার গাছগুলো লাগিয়েছেন।
ঝুলে থাকা বড় বড় কিছু লতা-পাতার ফাঁক দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে তাকাল কিশোর।
সামনে ওর নাক বরাবর কিছু একটা ঝিকিয়ে উঠল। যেন কোনও চক্চকে জিনিসের উপর চাঁদের আলো পড়েছে।
কিশোর ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে চুপ থাকার ইশারা করল জিনাকে।
ছায়ার ভিতর দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে চলল ওরা বেড়ালের মত, নিঃশব্দে।
একটা মাকড়সার জাল আটকে গেল কিশোরের মুখে। বাঁ হাতে চটচটে জালটা সরাল ও। খুব সাবধানে শ্বাস-প্রশ্বাস নিল, কোনও অবাঞ্ছিত শব্দ যাতে না হয়।
নেজার ম্যাণ্ডার!
হ্যাঁ, এখানেই আছে ব্রিটিশ রাজার সৈন্য।
রুমটার ঠিক মাঝখানে প্রমাণ সাইজের একটা ঘোড়ার ডামির পিঠে বসে আছে সে। মাথার উপর খিলানের মত কাঁচের ছাদ।
হঠাৎ কিশোরের মনে হলো নেজারকে নড়তে দেখেছে ও।
চোখের পলক পড়ল না ওর।
এক কদম সামনে বাড়ল।
আম্মু! প্রকাণ্ড, শূন্য কাঁচের ঘরে জিনার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভয়ঙ্কর প্রতিধ্বনি তুলল। কিশোরের কানে বড় বেশি লাগল আওয়াজটা।
ঘোড়াটার গায়ে হেলান দেয়া রয়েছে একটা মই। মিস্টার পারকার ওটাকে উঁচু জিনিসপত্র সেট করার কাজে ব্যবহার করেন।