- বইয়ের নামঃ আমাজানের গহীনে
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
আমাজানের গহীনে
পূর্ব কথা
গরমের এক দিনে, ফ্রগ ক্রীক পেনসিলভেনিয়ার বনভূমিতে উদয় হয় রহস্যময় এক ট্রী হাউস।
তিন গোয়েন্দা দড়ির মই বেয়ে ট্রী হাউসে ওঠে। ওরা আবিষ্কার করে ওটা বই-পত্র দিয়ে ভর্তি।
ওরা শীঘি টের পায় ট্রী হাউসটা জাদুর। বইয়ে উল্লেখ করা বিভিন্ন জায়গায় ওদেরকে নিয়ে যেতে পারে। ওদেরকে শুধু একটা ছবিতে আঙুল রেখে সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হয়।
ওরা এখন পর্যন্ত নানান জায়গায় ভ্রমণ করেছে। এক পর্যায়ে জানতে পারে ট্রী হাউসটার মালিক মরগ্যান লে ফে। রাজা আর্থারের সময়কার এক জাদুকরী লাইব্রেরিয়ান সে। টাইম আর স্পেসে অবাধ বিচরণ তার, বই সগ্রহের বাতিক।
এবার আবার অভিযানে বেরোচ্ছে কিশোর, মুসা, রবিন।
০১.
জলদি এসো! কিশোর আর মুসার উদ্দেশে বলল রবিন।
ফ্রগ ক্রীক উডসে দৌড়ে ঢুকে পড়ল ও।
কিশোর আর মুসা ওকে অনুসরণ করল। এখনও আছে! উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
রবিনের নাগাল ধরল কিশোর আর মুসা। উঁচু এক ওক গাছের পাশে দাঁড়িয়ে রবিন।
মুখ তুলে চাইল কিশোর। বিকেলের রোদে ঝিকোচ্ছে জাদুর ট্রী হাউসটা।
আমরা আসছি, জেরি! চেঁচাল রবিন। দড়ির মইটা ধরে উঠতে শুরু করল।
ওকে অনুসরণ করল কিশোর আর মুসা। ওরা উঠছে তো উঠছেই। শেষমেশ ঢুকতে পারল ট্রী হাউসের ভিতরে।
জেরি? ডাকল মুসা।
কিশোর ব্যাকপ্যাক খুলল। দৃষ্টি বুলিয়ে নিল চারধারে।
এক গাদা বইয়ের উপর তেরছাভাবে রোদ পড়েছে।
কাঠের মেঝেতে চমকাচ্ছে এম অক্ষরটা। এম মানে মরগ্যান লে ফে।
জেরি মনে হয় এখানে নেই, বলল কিশোর। গেল কোথায় তাই ভাবছি, বলল মুসা।
কিঁচ!
হেসে উঠল রবিন। দেখো, দেখো!
ছোট, গোলাপি এক মোজা মেঝের উপর দিয়ে চলে বেড়াচ্ছে। গতকাল রবিন ওর মোজাটাকে জেরির বিছানা বানিয়ে দিয়েছিল।
খুদে পিণ্ডটাকে হাতে তুলে নিল রবিন। আমাজানেরগহীনে
কিঁচ।
মোজার ভিতর থেকে বাদামি-সাদা এক ইঁদুর উঁকি দিল। বড় বড় চোখ ঘুরিয়ে একে একে তিন বন্ধুকে দেখে নিল।
হেসে উঠল কিশোর।
কী রে, জেরি? বলল ও।
তুই কি আজকেও আমাদের হেল্প করবি? রবিনের প্রশ্ন।
এর আগে বিভিন্ন অভিযানে জেরি ওদেরকে সাহায্য করেছে।
মরগ্যানের জন্যে আমাদের আরও কটা জিনিস খুঁজে পেতে হবে, বলল মুসা।
কিশোর নীচের ঠোটে চিমটি কাটল। কোথা থেকে শুরু করব আগে সে সূত্র দরকার, বলল।
বলল তো কী? বলল রবিন।
কী?
আমাদেরকে বেশি দূর খুঁজতে যেতে হবে না, ট্রী হাউসের এক কোনার দিকে ইশারা করল রবিন।
ছায়ার আড়ালে খোলা এক বই।
০২.
আরি, বলে বইটা তুলে নিল কিশোর। কে খুলল এটা?
বইটা বন্ধ করে প্রচ্ছদ দেখল ও।
সবুজ এক অরণ্যের ছবি। গাছগুলো লম্বা-লম্বা আর জড়াজড়ি করা।
প্রচ্ছদে লেখা: দ্য রেইন ফরেস্ট।
বাহ, বলল কিশোর।
না, বলল রবিন।
খাইছে, বলল মুসা।
সমস্যা কী? রবিনকে প্রশ্ন করল কিশোর।
স্কুলে রেইন ফরেস্ট সম্পর্কে পড়েছি। ওখানে বড় বড় পোকা আর মাকড়সা থাকে।
জানি, বলল কিশোর। তাদের অর্ধেকের এখনও নামকরণ হয়নি।
খাইছে, বলে উঠল মুসা।
ভয়ঙ্কর জায়গা, বলল নথি।
ভয় পাচ্ছ কেন? বলল কিশোর। রেইন ফরেস্ট সম্পর্কে নোট নিতে চায় ও। হয়তো অচেনা কয়েকটা পোকাকে নামও দিতে পারবে।
ভয় পাব না? শিউরে উঠে বলল রবিন।
আমরা তো আগেও কত জায়গায় গেছি, বলল মুসা। তখন তো ভয় পাওনি। এখন এত ভয় পাওয়ার কোন মানে হয় না।
কিশোর দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আমাদেরকে ওখানে যেতে হবে। মরগ্যানকে হেল্প করার জন্যে। সেজন্যেই বইটা খোলা পড়ে ছিল।
জানি, বলে ভ্রু কুঁচকাল রবিন।
তা ছাড়া, রেইন ফরেস্ট কেটে ফেলা হচ্ছে, বলল কিশোর। উজাড় হওয়ার আগেই দেখতে চাও না?
রবিন গভীর শ্বাস টেনে ধীরে ধীরে মাথা ঝাকাল।
ঠিক আছে, চলো তবে, বলল কিশোর।
বইটা আবারও খুলল ও। নীল আকাশ, সবুজ গাছ-পালা আর রঙিন ফুল নিয়ে এক ছবি। তাতে আঙুল রাখল।
আমরা ওখানে যেতে চাই, বলল।
বাতাস বইতে শুরু করল।
কিঁচ।
তুই এখানে থাক, জেরি, বলে জেরিকে তুলে পকেটে রাখল রবিন।
বাতাস জোরাল হলো। ঘুরতে আরম্ভ করল ট্রী হাউস। চোখ বুজে ফেলল কিশোর।
শিসের শব্দ তুলে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। বন-বন করে ঘুরছে ট্রী হাউস।
এবার সব কিছু স্থির।
একদম নিথর।
বুনো শব্দ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল।
তীক্ষ্ণ, কর্কশ ডাক।
গুঞ্জন।
কিচিরমিচির।
০৩.
চোখ মেলল কিশোর।
বাতাসে গরম ভাব আর বাষ্প।
মনে হচ্ছে আমরা কোন ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে নেমেছি, বলল রবিন।
ট্রী হাউসের জানালা দিয়ে উকি মারছে ও। ওর পকেট থেকে মুখ। বের করেছে জেরি।
কিশোর আর মুসাও বাইরে তাকাল।
চকচকে সবুজ পাতার সাগরে নেমেছে ওরা। বাইরে ফুল, রঙবেরঙের প্রজাপতি, আর পাখি। ঠিক বইতে যেমন ছিল।
খাইছে, বলল মুসা। আমরা কোন গাছে নামলাম না কেন তাই ভাবছি। যেমনটা সব সময় নামি।
কে জানে, বলল রবিন। এখন চলো তাড়াতাড়ি মরগ্যানের জিনিসটা খুঁজে বের করি। বিরাট বড় কোন মাকড়সার খপ্পরে পড়ার
আগেই যাতে বাড়ি ফিরতে পারি।
দাঁড়াও। ব্যাপারটা অদ্ভুতই বটে, বলল কিশোর। ঝোপের মধ্যে নামলাম কেন বুঝছি না। একটু পড়ে দেখি।
ধুর, এসো তো, বলল রবিন। আমাদের এমনকী মইও লাগবে না। স্রেফ জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলেই হবে।
পকেটে জেরিকে ঢুকিয়ে রাখল রবিন। জানালা দিয়ে বের করে দিল এক পা।
দাঁড়াও! কিশোর রবিনের আরেক পা চেপে ধরল। ও পড়ল:
রেইন ফরেস্টের তিনটি স্তর। ঘন বৃক্ষশীর্ষ
সবচেয়ে উপরের স্তর তৈরি করে। প্রায়ই এর
উচ্চতা হয় ১৫০ ফীট। একে বলে অরণ্যের
শামিয়ানা। তারপর দ্বিতীয় স্তর,
এবং তারপর বনতল।
ফিরে এসো! চেঁচাল কিশোর। আমরা সম্ভবত মাটি থেকে দেড়শো ফীট ওপরে! এটা বনের শামিয়ানা!
বলো কী! বলল রবিন। সাত করে ঢুকে পড়ল ট্রী হাউসের ভিতরে।
আমাদেরকে মই ব্যবহার করতে হবে, বলল কিশোর। হামাগুড়ির ভঙ্গিতে বসল। মেঝের গর্ত থেকে পাতা সরাল। নীচের দিকে চাইল।
মইটা বিশাল এক গাছের ডাল-পালা ভেদ করে নেমে গেছে। কিন্তু অতদূর কিশোরের দৃষ্টি গেল না।
নীচে কী আছে কে জানে, বলল। সাবধান!
ব্যাকপ্যাকে রেইন ফরেস্টের বইটা ঢুকিয়ে রাখল ও। এবার পা রাখল দড়ির মইতে।
নামতে শুরু করল। রবিন আর মুসা অনুসরণ করল।
পাতা ভেদ করে নামতে হচ্ছে।
শামিয়ানার নীচের স্তরে চলে এল ও।
বনতলের দিকে চাইল। অনেক দূরে।
বাব্বা, ফিসফিস করে বলল।
বৃক্ষ শীর্ষের পৃথিবীর সঙ্গে এই পৃথিবীর বিস্তর ফারাক।
সূর্য আড়ালে, তাই এখানে বেশ ঠাণ্ডা। স্যাঁতসেঁতে আর নিস্তব্ধ পরিবেশ।
শিউরে উঠল কিশোর।
০৪.
নড়ল না ও। বনতলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
কী হলো? উপর থেকে প্রশ্ন করল মুসা।
জবাব দিল না কিশোর।
বিরাট বড় কোন মাকড়সা দেখনি তো? রবিনের জিজ্ঞাসা।
না…তা না। কিশোর গভীর শ্বাস টানল।
আমাদেরকে নামতে হবে, ভাবল ও। মরগ্যানের জন্য বিশেষ জিনিসটা খুঁজে বের করতে হবে।
মাকড়সা নেই। ভয় পেয়ো না, গলা চড়িয়ে বলল কিশোর। মই বেয়ে আবারও নামতে শুরু করল।
দ্বিতীয় স্তর ভেদ করে নেমে চলল তিন বন্ধু। শেষমেশ মাটিতে পা রাখল।
জঙ্গলের ভিতরে আলো-আঁধারি পরিবেশ।
গাছগুলো যেমন উঁচু তেমনি মোটা। চারদিকে লতা আর শ্যাওলা ঝুলে রয়েছে। মাটি মরা পাতায় ছাওয়া।
কিছু করার আগে বইটা খুলে দেখি, বলল কিশোর।
রেইন ফরেস্টের বইটা বের করল ও। বৃক্ষশীর্ষের নীচে আঁধার দুনিয়ার এক ছবি খুঁজে নিল। পড়ল ও।
রেইন ফরেস্টে অনেক প্রাণী পরিপার্শ্বের
সঙ্গে মিশে থাকে। একে বলে ক্যামোফ্লেজ।
বাপ রে, বলল কিশোর। বইটা বন্ধ করে চারধারে নজর বুলাল। এখানে অসংখ্য প্রাণী রয়েছে। আমরা যদিও দেখতে পাচ্ছি না।
খাইছে, তাই? ফিসফিস করে বলল মুসা।
নিঃশব্দ বনভূমির চারদিকে চাইল ওরা। কিশোর অনুভব করল অসংখ্য অদৃশ্য চোখ লক্ষ করছে ওদেরকে।
মরগ্যানের জিনিসটা ঝটপট খুঁজে বের করি এসো, ফিসফিস করে বলল রবিন।
পেলেও কি বুঝতে পারব যা খুঁজছি পেয়েছি? কিশোর বলল।
মনে হয় পারব, বলল রবিন। আঁধার ভেদ করে পা বাড়াল।
ওকে অনুগমন করল কিশোর আর মুসা। বিশাল সব গাছ আর ঝুলন্ত লতার মাঝখান দিয়ে সন্তর্পণে এগোচ্ছে ওরা।
হঠাৎই থমকে দাঁড়াল রবিন। দাঁড়াও-কী ওটা?
কীসের কথা বলছ? মুসা বলল।
শোনো-অদ্ভুত একটা শব্দ।
কান পাতল ওরা। শুকনো পাতা ভাঙার খড়-মড় শব্দ। মনে হচ্ছে কেউ পাতার উপর দিয়ে হাঁটছে।
কিশোর চারধারে চোখ বুলাল। কাউকে দেখতে পেল না।
কিন্তু শব্দটা ক্রমেই জোরাল হচ্ছে।
কোন জানোয়ার? বিশাল কোন পোকা?
ঠিক এসময় নীরব অরণ্য জীবন্ত হয়ে উঠল।
পাখিরা বাতাসে ডানা মেলল। পাতার উপর দিয়ে লাফ দিল ব্যাঙেরা। গাছের গুঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে গেল গিরগিটির দল।
অদ্ভুত শব্দটা ইতোমধ্যে আরও জোরদার হয়েছে।
বইতে হয়তো জানা যাবে, বলল কিশোর। বইটা খুলল ও। বিভিন্ন জাননায়ারের ছুটে পালানোর এক ছবি খুঁজে পেল। পড়ল ও :
জানোয়ারেরা খড়মড় শব্দ
শুনলেই ভয়ের চোটে পালায়।
শব্দটার অর্থ তিন কোটি
মাংসাশী ফৌজী পিঁপড়ে মরা
পাতা ভেদ করে এগিয়ে আসছে।
ফৌজী পিঁপড়ে! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। তিন কোটি!
খাইছে, কোথায়? চিৎকার ছাড়ল মুসা।
বুনো দৃষ্টিতে চারপাশে চাইল তিন বন্ধু।
ওই যে! আঙুল নির্দেশ করল রবিন।
ফৌজী পিঁপড়ে–কয়েক কোটি–পাতার উপর দিয়ে পিলপিল করে আসছে।
ট্রী হাউসের দিকে দৌড় দাও! চেঁচাল রবিন।
কোথায় ওটা? বলে চরকির মতন ঘুরল কিশোর। সব কটা গাছ দেখতে একইরকম। দড়ির মইটা কোথায়?
দৌড়াও! চেচাল রবিন।
তিন বন্ধু কালবিলম্ব না করে ঝেড়ে দৌড় দিল।
মরা পাতার উপর দিয়ে ছুটছে ওরা।
চওড়া গাছের গুঁড়ির মাঝখান দিয়ে দৌড়চ্ছে।
দৌড়চ্ছে ঝুলন্ত লতা আর শ্যাওলার পাশ দিয়ে।
মোটা মোটা শিকড় টপকাল ওরা।
কিশোর সামনে একটা ফাঁকা জমি দেখতে পেল। সূর্যের আলোয় আলোকিত।
ওদিকে! চেঁচিয়ে বলল ও।
আলো লক্ষ্য করে দৌড়ল তিন গোয়েন্দা। পথ করে নিল ঝোপঝাড় মাড়িয়ে।
এক নদীর তীরে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল ওরা।
ধীর গতির বাদামি পানির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল তিনজন।
তোমার কি মনে হয় পিঁপড়েবাহিনী এদিকে আসবে? হাঁফাতে হাঁফাতে বলল রবিন।
জানি না, বলল কিশোর। কিন্তু আমরা যদি নদীর পানিতে গিয়ে দাঁড়াই, তা হলে সেফ। পিঁপড়েরা পানিতে নামবে না। এসো।
দেখো! হঠাই বলে উঠল মুসা।
নদীর কিনারে একটা ক্যানু দোল খাচ্ছে।
দূরে খড়-মড় শব্দ।
উঠে পড়ো। জলদি! বলল কিশোর।
কিশোর বইটা ঢুকিয়ে রাখল ব্যাকপ্যাকে। এবার সাবধানে তিন বন্ধু উঠে পড়ল ক্যানুতে।
রবিন ঝুঁকে পড়ল ক্যানু থেকে। হাত দিয়ে তীর থেকে ঠেলে সরাল ক্যান।
দাঁড়াও! বলল কিশোর। বৈঠা নেই!
খাইছে! অস্ফুটে বলে উঠল মুসা।
ওদেরকে নিয়ে, কর্দমাক্ত নদীর পানি ভেদ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ক্যানু।
০৫.
কিঁচ।
রবিন পকেটে আলতো হাত বুলিয়ে আদর করল জেরিকে।
ভয় পাস না, জেরি। পিঁপড়েরা নদীতে হামলা করতে পারবে না। আমরা নিরাপদ।
পিঁপড়েদের ভয় নেই ঠিক, কিন্তু ক্যানুটা যাচ্ছে কোথায়? প্রশ্ন করুল কিশোর।
তিন বন্ধু নদীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। পানির উপরে ছড়িয়ে রয়েছে ডাল-পালা। তা থেকে ঝুলছে লতা আর শ্যাওলা।
দেখে নিই বইতে কী বলে, বলল কিশোর। ব্যাকপ্যাক থেকে রেইন ফরেস্টের বইটা বের করল ও। দ্রুত পাতা উল্টে চলল।
শীঘি এক নদীর ছবি খুঁজে পেল। পড়ল:
আমাজান নদী ৪০০০ মাইলের বেশি
লম্বা। পেরুর পর্বতশ্রেণী থেকে শুরু
করে, ব্রাজিল পেরিয়ে, আটলান্টিক
মহাসাগরে পড়েছে। নদীর অববাহিকা
পৃথিবীর রেইন ফরেস্টের অর্ধেকের
বেশি ধারণ করে।
বন্ধুদের দিকে চাইল কিশোর।
আমরা আমাজান নদীতে, বলল। এটা চার হাজার মাইলের বেশি লম্বা।
দুনিয়ার সবচাইতে বড় নদী, বলল মুসা।
রবিন নদীর দিকে চাইল। হাত রাখল পানিতে।
আমি কিছু নোট নেব, বলল কিশোর। প্যাক থেকে নোটবই বের করে লিখল:
আমাজান রেইন ফরেস্ট হচ্ছে…
কিশোর, দেখো! সভয়ে বলে উঠল রবিন। পিরানহা!
কিছু নীল রঙের মাছ নৌকার কাছে সাঁতরাচ্ছে। লাল পেট আর তীক্ষ্ণধার দাঁত ওদের।
সাবধান! সতর্ক করল কিশোর। একবার বাগে পেলে আর রক্ষে নেই।
আমাদের তীরে ফেরা উচিত, বলল মুসা।
কিশোর বইটা ব্যাকপ্যাকে রেখে দিল।
কীভাবে? বলল রবিন। পানিতে নামা যাবে না। আর আমাদের কাছে বৈঠাও নেই।
কিশোর মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করল। একটা প্ল্যান দরকার, বলল।
নদীর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ও। ক্যানুটা শীঘ্রি কিছু লতার নীচ দিয়ে যাবে।
আমি একটা লতা চেপে ধরব, বলল কিশোর। তারপর নিজেদেরকে টেনে তীরে নিয়ে যাব।
ঠিক আছে, সায় জানাল রবিন।
ডালগুলোর নীচ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, সটান উঠে দাঁড়াল কিশোর।
দুলে উঠল ক্যানু। আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল ও।
ক্যানুটার ব্যালেন্স ঠিক রাখো, বলল কিশোর।
মুসা একপাশে হেলে পড়ল। রবিন আরেক পাশে। কিশোর হাত বাড়াল-কিন্তু ধরতে ব্যর্থ হলো!
ক্যানুটা কয়েকটা ডালের নীচ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে।
কিশোর আরেকটা মোটা লতার উদ্দেশে হাত বাড়াল।
এবার ধরতে পারল!
লতাটা ঠাণ্ডা আর আঁশযুক্ত। সহসা কিলবিল করে উঠে ঝাঁকি দিল ওটা!
আহহহ! কিশোর আর্তচিৎকার ছেড়ে ক্যানুতে পড়ে গেল।
লতাটা জীবন্ত।
ওটা একটা লম্বা, সবুজ সাপ!
গাছ থেকে খসে পড়ল সাপটা। ছলাৎ করে পানিতে পড়ে সাঁতরে চলে গেল।
খাইছে! বলে উঠল মুসা।
আরেকটু হলেই গেছিলাম, বলল কিশোর।
তিন বন্ধু পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল।
এখন কী? রবিন জানতে চাইল।
দেখি… নদীর দিকে চাইল কিশোর। সামনে কোন লতা নেই। তবে প্রকাণ্ড এক গুঁড়ি ভাসছে পানিতে।
ওই ডালটা ধরো, বলল কিশোর। ওটাকে বৈঠা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
ডালটার কাছে ভেসে এল ক্যানু। রবিন হাত বাড়াল।
হঠাৎই ডালটা শূন্যে মাথা তুলল।
কুমির!
বাঁচাও! আর্তচিৎকার ছেড়ে ক্যানুতে চিতিয়ে পড়ে গেল রবিন।
কুমিরটা বিশাল হাঁ করল। এবার ক্যানুর পাশ দিয়ে সাঁতরে চলে গেল।
বাপ রে, ফিসফিস করে বলল কিশোর।
এসময় তীক্ষ্ণ এক শব্দ বাতাস চিরে দিল।
তিন বন্ধু আঁতকে উঠল।
খাইছে, চেঁচাল মুসা।
আবারও ভয়ঙ্কর কোন জানোয়ার দেখবে ভেবেছে।
কিন্তু তার বদলে দেখতে পেল ছোট্ট বাদামী এক বানর। গাছে লেজ বেঁধে ঝুলছে।
০৬.
কিঁচ-কিঁচ!
জেরি মাথা বের করে দিল রবিনের পকেট থেকে। মনে হলো বানরটার উদ্দেশে চেঁচাচ্ছে।
ভয় পাস না, জেরি। ও আমাদের ক্ষতি করবে না, অভয় দিল রবিন।
কিন্তু আচমকা বানরটা গাছ থেকে ঝোলা বড়, লাল এক ফল আঁকড়ে ধরল। তারপর ছুঁড়ে দিল ক্যানু লক্ষ্য করে।
দেখো! সাবধান করল কিশোর।
ফলটা ছলাৎ করে পানিতে পড়ল।
বানরটা খিচিয়ে উঠল আরও জোরে।
আরেকটা ফল পেড়ে নিল।
ছুঁড়িস না! চেঁচাল রবিন।
কিন্তু বানরটা লাল ফলটা সোজা ছুঁড়ে দিল ওদের উদ্দেশে।
আবারও মাথা নোয়াল তিন বন্ধু। পানিতে ছলাৎ করে পড়ল ফলটা।
করিস কী! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
কিন্তু বানরটা দুহাত নেড়ে তীক্ষ্ণ ডাক ছাড়ল আবারও।
খাইছে! বানরটা তিন নম্বর ফলটা পেড়ে নিয়ে ওদের দিকে ছুঁড়ল। ধুপ করে ক্যানুর ভিতরে পড়ল ওটা। আম।
মুসা আমটা তুলে নিল। এবার উঠে দাঁড়িয়ে পাল্টা ছুঁড়ে মারল বানরটার উদ্দেশে।
লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। দুলে উঠল ক্যানু। প্রায় পড়ে যাওয়ার দশা হলো মুসার।
আরও জোরাল ডাক ছাড়ল বানরটা।
চলে যা বলছি! চেঁচাল রবিন। এমন দুষ্টু বানর আর দেখিনি!
ডাক ছাড়া বন্ধ করল বানরটা।
রবিনের দিকে চাইল। তারপর দোল খেয়ে ঢুকে পড়ল জঙ্গলের ভিতরে।
মনে হয় মনে চোট পেয়েছে, বলল রবিন।
পাকগে, বলল কিশোর। আম ছুঁড়বে কেন?
খাইছে, বৃষ্টি হচ্ছে, বলল মুসা।
কী? কিশোর মুখ তুলে চাইল। এক ফোঁটা পানি ওর চোখে পড়ল।
হায়, হায়, বলে উঠল রবিন।
হায় হায় করার কিছু নেই, বলল কিশোর। এর নাম রেইন ফরেস্ট।
দমকা বাতাস দুলিয়ে দিল ক্যানুটাকে। আকাশে বাজের গুড়-গুড় শব্দ।
ঝড়ের মধ্যে নদীতে থাকা বিপজ্জনক, বলল কিশোর। আমাদেরকে তীরে ফিরতে হবে। এখুনি।
কিন্তু কীভাবে? বলল রবিন। পানিতে নামা যাবে না। পিরানহা, সাপ আর কুমির ধরবে।
এসময় তীক্ষ্ণ চিঙ্কার বাতাস চিরে দিল আবারও।
খাইছে! বানরটা আবার ফিরে এসেছে।
ওটা এখন লম্বা এক লাঠি তাক করেছে ক্যানুর দিকে।
মুসা ঝুঁকে বসল। বানরটা কি লাঠিটা ছুঁড়ে মারবে ওদের দিকে? বর্শার মত?
রবিন তড়াক করে দাঁড়িয়ে বানরটার মুখোমুখি হলো।
সাবধান! ওর কিন্তু মাথা খারাপ, সতর্ক করল মুসা।
কিন্তু বানরটা সরাসরি রবিনের দিকে চেয়ে রয়েছে। আর রবিন চেয়ে রয়েছে বানরটার দিকে।
দীর্ঘ দুমুহূর্ত বাদে, বানরটা যেন হেসে ফেলল।
রবিনও পাল্টা হাসল।
কী হচ্ছে এসব? কিশোরের জিজ্ঞাসা।
ও আমাদেরকে হেল্প করতে চায়, বলল রবিন।
কীভাবে করবে? প্রশ্ন করল কিশোর।
লম্বা লাঠিটা বাড়িয়ে দিল বানরটা।
অপর প্রান্ত চেপে ধরল মুসা।
বানরটা লাঠি ধরে টানছে। ক্যানু ভেসে যেতে লাগল ওর দিকে।
নদীর তীরে ক্যানুটা টেনে নিয়ে গেল বানরটা।
০৭.
তিন বন্ধু লাফিয়ে নেমে পড়ল ক্যানু থেকে।
বৃষ্টির তেজ বেড়েছে ইতোমধ্যে।
বানরটা বিদায় নিল। গাছ থেকে গাছে দোল খেয়ে, নদী তীর ধরে এগিয়ে চলল।
ডাক ছেড়ে তিন বন্ধুকে হাতছানি দিচ্ছে। আমাদেরকে ওর সাথে যেতে বলছে, বলল মুসা।
না! আমাদেরকে বিশেষ জিনিসটা খুঁজে বের করতে হবে। তারপর বাড়ি ফিরে যাব! বলল কিশোর।
ও আমাদের হেল্প করতে চায়! বলল রবিন। বানরটার পিছন পিছন দৌড় দিল।
রেইন ফরেস্টের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা দুজন।
রবিন! ডাকল কিশোর।
আকাশ কেঁপে উঠল বাজের শব্দে।
খাইছে! ও গেল কোথায়? বলল মুসা।
ওরা দুজন দৌড় দিল রবিন আর বানরটার পিছু পিছু। ঢুকে পড়ল অন্ধকার অরণ্যের ভিতরে।
বনভূমি আশ্চর্যজনকভাবে শুকনো।
মুখ তুলে চাইল কিশোর, এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু বৃক্ষশীর্ষ বিশাল
এক ছাতার মত কাজ করছে।
রবিন? ডাকল কিশোর।
কিশোর! মুসা! রবিনের কণ্ঠ।
তুমি কোথায়? মুসা গলা চড়িয়ে বলল।
এখানে!
ওর কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে তড়িঘড়ি এগোল কিশোর আর মুসা।
শীঘ্রি বানরটাকে খুঁজে পেল ওরা। দাঁত-মুখ খিচিয়ে ডাক ছেড়ে দোল খাচ্ছে গাছ থেকে।
বনের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে রবিন। বিড়ালছানার মত দেখতে খুদে এক জানোয়ারের সঙ্গে খেলা করছে।
খাইছে, এটা তো জাগুয়ারের বাচ্চা! বলে উঠল মুসা।
জাগুয়ার আমাজানের সবচাইতে বড় বাঘ।
ছানাটার থাবায় হাত বুলোচ্ছে রবিন। সোনালী পশম আর কালো ফুটি-ফুটি দাগ ওটার গায়ে।
বলো কী? বলে উঠল রবিন।
গররর! হঠাই ভয়ঙ্কর এক রক্তজমাট করা গর্জন উঠল।
পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর।
এক গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে মা জাগুয়ার। মরা পাতার উপর দিয়ে পা টিপে টিপে এগোচ্ছে-সোজা রবিনকে লক্ষ্য করে।
নোড়ো না! ফিসফিস করে বলল কিশোর।
কাঠ-পুতুল হয়ে গেল রবিন। জাগুয়ারটা সন্তর্পণে এগোচ্ছে ওর দিকে।
খাইছে!
আচমকা গাছ থেকে সাঁ করে নেমে এল বানরটা। চেপে ধরল জাগুয়ারের লেজ!
বাঘটা গর্জে উঠে চরকির মতন ঘুরে দাঁড়াল।
রবিন লাফিয়ে উঠল।
বানরটা জাগুয়ারের লেজ ধরে আবারও টানল। এবার ছেড়ে দিয়ে পালাল।
জাগুয়ারটা লাফ দিল বানরটার পিছনে।
দৌড়াও, রবিন! চেঁচাল কিশোর।
রেইন ফরেস্ট ভেদ করে ছুটল তিন বন্ধু। জান নিয়ে পালাচ্ছে ওরা!
০৮.
দাঁড়াও–হাঁফাতে হাঁফাতে বলল কিশোর। মনে হয় বেঁচে গেছি।
থেমে দাঁড়িয়ে শ্বাস ফিরে পেল তিন গোয়েন্দা। আমরা কোথায়? কিশোরের জিজ্ঞাসা।
বানরটা কই? বলে জঙ্গলের দিকে চাইল রবিন। জাগুয়ারটা কি ওকে ধরতে পেরেছে মনে কর?
না, বানররা খুব ফাস্ট হয়, বলল মুসা।
জাগুয়ারও খুব ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন, ভাবল ও। কিন্তু এ কথা রবিনকে বলতে চায় না।
খোদা, ও যেন ভাল থাকে, বলল রবিন।
কিঁচ। রবিনের পকেটের ভিতর থেকে উঁকি দিল জেরি।
জেরি! তোর কথা তো ভুলেই গেছিলাম! বলে উঠল নথি। তুই ঠিক আছিস তো?
বড় বড় চোখ মেলে একদৃষ্টে রবিনের দিকে চেয়ে রইল ইঁদুরটা।
মনে হয় ভয় পেয়েছে, বলল মুসা। বেচারী।
বেচারী বানরটার যে কী হলো খোদাই জানে, বলল রবিন। জঙ্গলের চারধারে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।
বইটা দেখা যাক, বলল কিশোর।
বইটা টেনে বের করল ও। পাতা উল্টাল। সাহায্য খুঁজছে।
ভয়ঙ্কর এক প্রাণীর ছবি।
ভ্যাম্পায়ার বাদুড়-রক্তচোষা, বলল ও।
খাইছে! ছবির নীচের লেখাটা পড়ল কিশোর:
আমাজান রেইন ফরেস্টে ভ্যাম্পায়ার
বাদুড় বাস করে। রাতের বেলা নিঃশব্দে
শিকারকে কামড় দিয়ে রক্ত পান করে।
রাতের বেলা বেরোয়, বলল কিশোর।
তিন বন্ধু চারধারে দৃষ্টি বুলাল। বনভূমিতে আঁধার ঘনাচ্ছে।
আমাদের বাড়ি ফেরা উচিত, বলল রবিন।
কিশোর মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল।
কিন্তু আমাদের মিশনের কী হবে? প্রশ্ন করল মুসা। আর মরগ্যানের?
আমরা ফিরে আসব, বলল কিশোর। তৈরি হয়ে।
কাল এলে হয় না? রবিনের প্রশ্ন।
হয়। এখন বলো ট্রী হাউসটা কোন্ দিকে? বলল কিশোর।
এদিকে, বলে আঙুল তাক করল রবিন।
ওদিকে, উল্টো দিক দেখাল কিশোর।
পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল দুজনে।
আমরা হারিয়ে গেছি, বলল একসঙ্গে।
আমিও চিনতে পারছি না, বলল মুসা।
কিঁচ।
ভয় পাস না, জেরি, ইঁদুরটার গায়ে আলতো চাপড় মারতে শুরু করল রবিন। কিন্তু পরক্ষণে থেমে গেল।
কিঁচ। কিঁচ। কিঁচ।
ও মনে হয় আমাদেরকে হেল্প করতে চায়, বলল রবিন।
কীভাবে? কিশোরের প্রশ্ন।
আগে যেভাবে করেছে। পাতাবহুল বনতলে ইঁদুরটাকে ছেড়ে দিল রবিন।
আমাদেরকে ট্রী হাউসে নিয়ে যা, জেরি।
ইঁদুরটা রওনা হলো।
কোথায় যাবে ও? বলল রবিন। আমি তো ওকে দেখতে পাচ্ছি না!
ওই যে! বলল মুসা। মাটিতে পাতার খসখস শব্দ। সেদিকে তর্জনী নির্দেশ করল।
সাদা কিছু একটা পিলপিল করে ছুটে যাচ্ছে পাতার উপর দিয়ে।
হ্যাঁ, ওই যে! বলল রবিন।
চলন্ত পাতা অনুসরণ করল তিন বন্ধু। সাদা দেহটা একবার উদয় হচ্ছে, পরমুহূর্তে উধাও।
সহসা থমকে দাঁড়াল কিশোর।
বনতল স্থির। জেরির চিহ্ন নেই।
কোথায় ও? প্রশ্ন করল কিশোর।
মাটির দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ ওর।
কিশোর! মুসা!
ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল কিশোর। উল্টো পাশে এক গাছের কাছে দাঁড়িয়ে রবিন। উপর দিকে আঙুল তাক করেছে।
মুখ তুলে চাইল কিশোর আর মুসা।
ট্রী হাউস।
খাইছে! অস্ফুটে বলে উঠল মুসা।
ও আবার আমাদেরকে বাঁচিয়েছে, বলল রবিন। কীভাবে মই বেয়ে উঠছে! দেখো, দেখো!
দড়ির মইটার দিকে আঙুল তাক করল রবিন।
দড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে যাচ্ছে জেরি।
চলো, বলল কিশোর।
রবিন উঠতে শুরু করল। ওকে অনুসরণ করল মুসা আর কিশোর।
জেরিকে অনুসরণ করে রেইন ফরেস্টের চাঁদোয়ায় উঠে এল ওরা।
০৯.
কিশোর, মুসা, রবিন ট্রী হাউসে উঠে পড়ল।
জেরি বসা এক গাদা বইয়ের উপর।
রবিন জেরির খুদে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ধন্যবাদ, মৃদু কণ্ঠে বলল।
রেইন ফরেস্ট সম্পর্কে নোট নিতে হবে আমার, বলল কিশোর। পেনসিলভেনিয়ার বইটা বের করো, রবিনের উদ্দেশে বলল।
রবিন পেনসিলভেনিয়ার বইটা খুঁজতে শুরু করল-ওদেরকে সব সময় যেটা বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
কিশোর নোটবইটা বের করে নিল।
ও অনেক তথ্য টুকতে চেয়েছিল। কিন্তু লিখতে পেরেছে শুধু :
আমাজান রেইন ফরেস্ট হচ্ছে…
এখানে নেই! বলল রবিন।
কী বলছ? মুখ তুলে চাইল কিশোর। ট্রী হাউসের চারপাশে দৃষ্টি বুলাল।
রবিন ঠিকই বলেছে। পেনসিলভেনিয়ার বইটা নেই।
এখানে আসার আগে কী ছিল? মুসা জিজ্ঞেস করল।
মনে নেই, বলল রবিন।
খাইছে, আমরা এখন আর ফ্রগ ক্রীকে ফিরতে পারব না, বলে উঠল মুসা।
এর মানে রক্তচোষা বাদুড়েরা আমাদেরকে ধরবে, বলল রবিন।
কিছু একটা উড়ে এল ট্রী হাউসের খোলা জানালা দিয়ে।
আহ! মাথা লুকাল ওরা।
ধুপ।
মেঝেতে পড়ল কিছু একটা। আম।
মুখ তুলে চাইল কিশোর। জানালায় বসে সেই বানরটা। মাথা এক পাশে কাত করে রেখেছে। দেখে মনে হলো ওদের দিকে চেয়ে হাসছে।
তুই বেঁচে আছিস! বলে উঠল রবিন।
আমাদের জীবন বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ, বলল কিশোর।
বানরটা শুধু দাঁত বের করে হাসল।
একটা প্রশ্ন, বলল রবিন। আমটার দিকে ইশারা করল। তুই খালি আমাদের দিকে আম ছুঁড়ে মারিস কেন?
আমটা তুলে নিল বানরটা।
না! ছুঁড়িস না! বলল কিশোর, মাথা নোয়াল।
কিন্তু বানরটা আমটা ছুঁড়ল না।
বাড়িয়ে দিল রবিনের দিকে। ঠোট নেড়ে কী সব বলার চেষ্টা করল।
রবিন বানরটার চোখে চোখে চাইল। আবারও ঠোট নাড়ল জানোয়ারটা।
হুঁ, এবার বুঝতে পেরেছি, বলল রবিন।
কী বুঝতে পেরেছ? প্রশ্ন করল মুসা।
আমটা বানরটার হাত থেকে নিল রবিন।
এটাই আমাদের দরকার ছিল, বলল। মরগ্যানের জাদুর মায়া কাটানোর জন্যে যে সব জিনিস দরকার এটা তার একটা।
খাইছে, তুমি শিয়োর? বলে উঠল মুসা।
রবিন জবাব দেওয়ার আগেই কিশোর পেনসিলভেনিয়ার বইটা দেখতে পেল।
দেখো! দেখো! আমাদের বই! তর্জনী তাক করে বলল।
আমরা জিনিসটা পেয়েছি। এখন বইটাও দেখতে পাচ্ছি। এভাবেই ওটা কাজ করে, মনে নেই? বলল রবিন।
মাথা কঁকাল কিশোর। যেটা খুঁজছে সেটা না পাওয়া পর্যন্ত পেনসিলভেনিয়ার বইটা অদৃশ্য থাকবে, এমন কথাই বলা হয়েছিল ওদেরকে।
বানরটা এসময় তীক্ষ্ণ স্বরে হেসে উঠল।
তিন বন্ধু ওর দিকে চাইল। হাততালি দিচ্ছে জানোয়ারটা।
রবিন ওর সঙ্গে গলা মিলিয়ে হেসে উঠল।
তুই জানলি কীভাবে আমটা আমাদের দিতে হবে? বলল। কে বলেছে তোকে?
ওদের উদ্দেশে স্রেফ হাত দোলাল বানরটা। এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে দোল খেয়ে বেরিয়ে গেল ট্রী হাউসের জানালা দিয়ে।
দাঁড়া! ডাকল কিশোর, জানালা দিয়ে বাইরে চাইল।
অনেক দেরি হয়ে গেছে।
বানরটা উধাও, হারিয়ে গেছে বৃক্ষশীর্ষের নীচে।
বিদায়! গলা ছেড়ে বলল রবিন।
নীচের রহস্যময় জগৎ থেকে উৎফুল্ল এক ডাক ভেসে এল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর। নোটবইটা তুলে নিল আবারও। নিজের লেখাটার দিকে চাইল:
আমাজান রেইন ফরেস্ট হচ্ছে চলে যাওয়ার আগে কিছু লিখতে হবে। ঝটপট যোগ করল ও।
অসাধারণ এক জায়গা
নোটবইটা সরিয়ে রাখল কিশোর। পেনসিলভেনিয়ার বইটা তুলে নিল রবিন।
এবার সত্যি সত্যি যাওয়ার সময় হলো, বলল ও।
পাতা উল্টে ফ্রগ ক্রীক বনভূমির ছবিটা বের করল।
আমরা ওখানে যেতে চাই, বলে ছবিতে আঙুল রাখল।
বাতাস বইতে শুরু করল।
কাঁপতে লাগল গাছের পাতা।
ট্রী হাউসটা ঘুরছে।
বন-বন করে ঘুরতে লাগল।
এবার সব কিছু নিথর। একদম স্থির।
১০.
কিঁচ।
চোখ মেলল কিশোর। ট্রী হাউসের জানালার ধারিতে বসা জেরি।
আমরা ফিরে এসেছি, বলল রবিন।
স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর।
বিকেলের আলোয় আমটা তুলে ধরল রবিন।
ওর হাত থেকে আমটা নিয়ে এম খোদাই করা মেঝেতে রাখল মুসা। মুনস্টোনটার পাশে।
মুনস্টোন…ম্যাংগো, আওড়াল রবিন। অনেকটা জাদুমন্ত্রের মত শোনাল।
আর দুটো অভিযান, বলল কিশোর। তারপরই আমরা মরগ্যানের জাদুর মায়া কাটাতে পারব।
শুনলেন, মরগ্যান? বলল রবিন, যেন মরগ্যান কাছেপিঠেই রয়েছে। শীঘ্রি আপনি মুক্তি পাবেন।
খাইছে, ও এখানে আছে নাকি যে শুনতে পাবে? প্রশ্ন করল মুসা।
আমার মন বলছে আছে, জানাল রবিন।
মৃদু হাসল কিশোর।
কিঁচ। ওদের দিকে চেয়ে রয়েছে জেরি।
আমরা এখন তোকে ছেড়ে চলে যাব, ইঁদুরটার উদ্দেশে বলল কিশোর।
কিঁচ।
ওকে সাথে করে নিয়ে গেলে হয় না? বলল রবিন।
না, ও এখানেই ভাল থাকবে, জবাবে বলল কিশোর।
ঠিক আছে, বলল রবিন। জেরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। যাই। আমাদের জন্যে এখানে অপেক্ষা করিস, আমরা কাল আবার আসব।
কিশোর আর মুসাও জেরিকে আদর করল।
বাই, জেরি। তোর সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ, বলল কিশোর।
কিঁচ।
রেইন ফরেস্টের বইটা অন্যান্য বইয়ের উপরে রেখে দিল কিশোর।
এবার ব্যাকপ্যাক পিঠে তুলে নিল। ট্রী হাউস ছাড়ল ওরা তিনজন।
দড়ির মই বেয়ে নামতে লাগল ওরা। কিছুক্ষণ পরে পা রাখল মাটিতে।
বনভূমি ভেদ করে এগিয়ে চলল তিন বন্ধু।
আবছায়ায় চোখে পড়ল আলোর নাচন।
কোথাও একটা পাখি ডেকে উঠল।
রেইন ফরেস্টের সঙ্গে এই জঙ্গলের অনেক তফাৎ, ভাবল কিশোর।
এখানে কোন জাগুয়ার কিংবা ফৌজী পিঁপড়ে নেই, বলল ও। ছোট বানরও না।
বানরটা আসলে দুষ্টুমি করছিল না, বলল রবিন। আমাদেরকে আমটা দেয়ার চেষ্টা করছিল শুধু।
জানি, সবাই স্বাভাবিক আচরণই করছিল, বলল মুসা। ফৌজী পিঁপড়েরা নিজেদের মত মার্চ করছিল। জাগুয়ারটা তার বাচ্চার ভালমন্দ দেখছিল।
একটু পরে ফ্রগ ক্রীক উডস থেকে বেরিয়ে এল তিন বন্ধু।
রাস্তা ধরে হেঁটে চলল ওরা। রাস্তাটা সোনালী আলোয় আলোকিত।
রেস ইউ! বলে উঠল রবিন।
তিন বন্ধু দৌড় দিল।
এক দৌড়ে ইয়ার্ড পেরোল ওরা।
দৌড়তে দৌড়তে উঠে গেল সিঁড়ি ভেঙে।
সেফ! তিনজনে চেঁচিয়ে উঠল একসঙ্গে।
দরজার হাতলের দিকে হাত বাড়াল কিশোর।