অকারণে ভয় পেতে রাজি নয় কিশোর। কিন্তু এখন এমন লাগছে। কেন?
আসলে ভুতুড়ে জাদুঘরটাই এর কারণ। এটাকে গভীর রাতে কেমন যেন শ্মশান শ্মশান মনে হলো ওর।
হঠাৎ একটা আওয়াজ কানে এল কিশোরের।
খর-খর-খরখর-খরখর!
ব্ল্যাকবোর্ডে নখ দিয়ে আঁচড় কাটলে যেমন হয়, অনেকটা তেমন শব্দ।
নিজের অজান্তে গায়ে কাঁটা দিল ওর।
থেমে দাঁড়াল।
অমনি শব্দটাও থেমে গেল।
মেঝের আওয়াজ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও।
আগেই বোঝা উচিত ছিল, এবাড়ির প্রায় সবকিছু থেকে নানান রকম আওয়াজ হয়। পুরানো, প্রকাণ্ড এই বাড়িটাতে যে-কারণে মজা। লাগে কিশোরের, তার একটা হলো গা শিউরানো এইসব আওয়াজ।
অবশ্য রাতের বেলা ওসব তেমন একটা ভাল ঠেকে না, বিশেষ করে যখন অদ্ভুতুড়ে সংগ্রহগুলোর ভিতর দিয়ে হাঁটতে হয়, তখন।
ভী-ষ-ণ অস্বস্তি লাগে।
গা শিরশির করে। সেই অস্বস্তি এই মুহূর্তে আবার ভর করেছে। ওর উপর।
ভুতুড়ে বর্মটা দেখতে চলেছে ওরা।
ভয়ে কলজে শুকিয়ে গেছে জিনার।
কখন কী করে বসে মেয়েটা, বলা মুশকিল। ওর সামনে। কিশোরের ভয় প্রকাশ পেলে আরও ঘাবড়ে যাবে ও। তাই যতটা সম্ভব মনের ভাব চেপে রেখেছে কিশোর। নিজেকে বারবার বোঝাচ্ছে, ও কিছু নয়, বাতাস।
ডাইনিং রুমে ঢুকল ওরা।
মিস্টার পারকারের সমস্ত কফিন সাজিয়ে রাখা হয়েছে এই রুমে প্রদর্শনের জন্য। তাই এ রুমের নাম রাখা হয়েছে কফিনঘর।
লুকোচুরি খেলার জন্য কফিন-ঘরের তুলনা নেই। লুকানোর জায়গার অভাব নেই এখানে।
দিনের বেলায় অবশ্য।
রাতে?
বুকটা কেঁপে উঠল কিশোরের।
এই গভীর রাতে..
চাপা একটা হেঁচকির আওয়াজ কানে এল কিশোরের। পরক্ষণে টের পেল হেঁচকিটা ও নিজেই তুলেছে। ঝট করে জিনার মুখের দিকে তাকাল।
জিনা যে এখন ওকে টিপ্পনী কাটবে, তাতে কোনও ভুল নেই।
কিন্তু কিশোরকে অবাক করে দিয়ে নিশ্চপ রইল ও।
আসলে এ রুমের থমথমে ভাব বোবা বানিয়ে দিয়েছে ওকে। কিশোরের হাত আঁকড়ে ধরল। পা চলতে চাইছে না ওর, যেন সীসার মত ভারী হয়ে উঠেছে।
ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল কিশোর।
সব কটা কফিনের ডালা বন্ধ। হ্যাগার্ড ঘুমাতে যাবার আগে বন্ধ করে রেখে যায়।
কিন্তু তাতে কী?
কিশোর, জিনা দুজনেরই জানা, ওগুলোর ভিতরে কী আছে!
ওদের সবচেয়ে কাছের কফিনটার ভিতরে আছে মোমের তৈরি ড্রাকুলার ডামি। ওটার বুকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ঢোকানো আছে একটা কাঠের গোঁজ, বা কীলক।
ডান দিকের কফিনটার মধ্যেও আছে একটা মোমের ডামি। ডামিটা ওয়্যারউলফের।
তার পাশের কফিনটায় আছে একটা আধা গলা লাশের ডামি। ওটার মাথার জায়গায় বসানো আছে একটা আয়না।
বীভৎস দেহের ডামিটাকে দেখার জন্য সামনে ঝুঁকলেই ওই আয়নায় দর্শকদের প্রতিবিম্ব দেখা যায়।
শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা একটা প্রবাহের ওঠা-নামা টের পেল কিশোর।
সরসর করে খাড়া হয়ে গেল গায়ের সমস্ত রোম। চলার গতি বাড়িয়ে দিল ও।
আমার ভয় করছে, কিশোর, লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই বসল জিনা। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
দূর, কীসের ভয়! জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু কণ্ঠস্বর বিশ্বাসঘাতকতা করল নাকি? তেমন একটা দৃঢ় শোনাল না।
হঠাৎ চেহারা বিকৃত করে ককিয়ে উঠল কিশোর।
জিনা খপ করে ওর বাহু আঁকড়ে ধরল। কী হলো?
৬
কফিনের কোনায় গুঁতো খেয়েছি, কুঁজো হয়ে হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল ও।
তাই বলে ওভাবে চেঁচাবে? ফিসফিস করে বলল জিনা। বাবা জেগে গেলে মজা টের পাবে।
পাশাপাশি হেঁটে চলল কিশোর-কিশোরী।
জিনা হঠাৎ থেমে দাঁড়াল।
কিশোর পাশ ফিরে তাকাল। কী হলো?
চোখ পিটপিট করে কফিনগুলো দেখছে জিনা। বেশ কিছুক্ষণ পর কপালের সামনে থেকে এক গোছা চুল সরাল ও। বলল, সত্যিই যদি এ ঘরে ভূত থেকে থাকে, তা হলে? আমার মনে হয় ওটাকে সপ্তাখানেক সময় দেয়া উচিত আমাদের। নতুন পরিবেশের সাথে পরিচিত হয়ে উঠুক, তারপর না হয়…
জবাব দিল না কিশোর।
ওর মন বলছে, এ বাড়িতে ভূত আছে।
এবং ওটা অভিশপ্ত ভূত।
মিস্টার পারকারের মত ও-ও চায় ভৌতিক জাদুঘরে দেশ-বিদেশ থেকে দলে দলে দর্শনার্থী আসুক। কিন্তু ভুতুড়ে বর্মটা যদি বিপজ্জনক হয়ে থাকে?
হ্যাগার্ডের কথাই যদি সত্যি হয়?
তা হলে বদনাম হয়ে যাবে জাদুঘরের। লোকজন আসতে দ্বিধা করবে। মিস্টার পারকারের এই বিচিত্র হবি ভেস্তে যাবে।
অবশেষে কফিনঘর পেরিয়ে পাশের রুমে ঢুকল ওরা। মিস্টার পারকার আজ সারাটা বিকেল মমি ঝাড়পোছ করে। কাটিয়েছেন এখানে। এত পরিশ্রম করেছেন যে আজ আর তার প্রিয় ল্যাবরেটরিতে যাননি একবারের জন্য। এত ঝাড়া-মোছার পরও প্রতিটি জিনিসে চিকচিক করছে বালু।
ওদের প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে ধুলো উড়ছে। রীতিমত বিরক্তিকর লাগছে ধুলোর অত্যাচার। অবশ্য মেঝেতে ধুলোর ছড়াছড়ির ব্যবস্থা। মিস্টার পারকার ইচ্ছে করেই করেছেন।
তাঁর কথা হলো, ভুতুড়ে জাদুঘর হবে ধুলোমোড়া, যা-তা চেহারার। দেয়াল থেকে ঝুলবে মাকড়সার জাল। পরিবেশ হবে। ভৌতিক, ইত্যাদি।
ওদের হাঁটার তালে তালে মৃদু খসখস শব্দ উঠছে।
মমি হাঁটলেও এমন শব্দ হয়, মুসার কাছে শুনেছে কিশোর। মিশরে মসা নাকি ওই আওয়াজ পেয়েছে।
দূর, এসব কী ভাবছি আমি! নিজের উপর বিরক্ত হলো কিশোর।
হ্যাগার্ড ঘুমাতে যাবার আগে মমি কেসের ঢাকনা লাগিয়ে যেতে ভুল করে না কখনও। কয়েকটা কেস অবশ্য খোলাই থাকে