থপ থপ!
মুখ নিচু করে লকেটটার দিকে তাকাল কিশোর। ওটার ভিতরের নীলচে ধোঁয়া থপ্ থপ আওয়াজের তালে তালে ঘুরপাক খাচ্ছে, উঠছে-নামছে।
আশ্চর্য!
থপ থপ!
শব্দ অনুসরণ করে নীচে নেমে এল, জাদুঘরের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল। কিচেনের কাছে পৌঁছে থেমে দাঁড়াল। লম্বা শ্বাস টানল। বার কয়েক, যেন কয়েক মাইল পথ দৌড়ে এসেছে।
সুযোগ এসেছে!
নতুন কোনও এক ভূতের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ও!
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে যাবে বর্মটা সত্যিই ভুতুড়ে কি।
থপ থপ!
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাবধানে কিচেনের দরজা খুলে ফেলল ও।
থপ থপ!
কাঁপা পায়ে কিচেনে ঢুকল কিশোর। এক-পা দুই-পা করে এগোল কয়েক পা।
থপ্ থপ!
চোখ সরু হয়ে এল কিশোরের।
দেখতে পেয়েছে ওটাকে!
অন্ধকারে ভয়ঙ্কর এক বিভীষিকার মত লাগছে দেখতে!
৫
আর পারল না কিশোর, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল ওর। কড়া স্বরে বলল, জিনা, তুমি! এত রাতে এখানে কী করছ?
ঝাড়ু হাতে কিচেনের মাঝখানে উঁচ একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে আছে র্জিনা। ওটার গোড়া দিয়ে থেকে থেকে সিলিঙে শব্দ করছিল এতক্ষণ।
আগুন-ঝরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। হচ্ছেটা কী এসব? ধমকের সুরে বলল ও।
হেসে উঠল জিনা। কিশোরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, তুমি না ভূত শিকারী! এই বাড়িতে ভূত খুঁজবে!
হাসতেই থাকল জিনা। মনে ভূতের সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়ে কিশোরকে টেনে এনে আনন্দে আটখানা। ভাবছে বোকা বানাতে পেরেছে।
রাত-বিরেতে ঘর ঝাঁট দিতে শখ হয়েছে দাও, কিন্তু সিলিঙে ঠোকাঠুকির দরকারটা কী? বলল কিশোর। নীচতলায় এই কাজ করলে ওপরতলায় কার না সন্দেহ হবে? তা ছাড়া আমার কাজই অলৌকিক, অবিশ্বাস্য, রোমহর্ষক আর ভীতিকর সব ঘটনার সমাধান খুঁজে বের করা। তোমার ঝাড়ুর থপথপ শুনে ভাবলাম, দেখি কোন ভূত এই বাড়িতে এল ভিতুর ডিম জিনাকে ভয় দেখাতে। তাই এসেছি, কিন্তু এর মধ্যে এত হাসির কী হলো?
নিজের বুকের উপর ঝুলন্ত নীল লকেটটার দিকে তাকাল কিশোর। থপ্ থপ শব্দ বন্ধ হওয়াতেই বুঝি ভিতরের ধোঁয়ার মেঘ অনেকটা শান্ত হয়েছে।
লকেটটার এমন কাণ্ডের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝল না ও।
তোমার কপাল ভাল, মাথা দোলাল কিশোর। আঙ্কেল পারকার জেগে ওঠেননি। উনি শুনলে মনে করতেন সত্যি সত্যি বুঝি ভূত এসেছে এ বাড়িতে। ব্যাপার সত্যি কি না যাচাই করার জন্যে এখানে এসে তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে ঝটার বাড়ি একটাও মাটিতে পড়ত না। কী বলে?
এবার যেন রসভঙ্গ হলো জিনার। ঝাড় রেখে দিল। আসলে বাবার কথা ভাবিইনি আমি, বলল দ্বিধা করে। আমার মাথায় ছিল শুধু তোমাকে ভয় দেখানোর চিন্তা।
না, শুধু আমাকে ভয় দেখানোর চিন্তা ছিল না তোমার মাথায়, দুহাত বুকের উপর বেঁধে গম্ভীর হলো কিশোর। ও লক্ষ করেছে, এমন ভঙ্গি করলে মুখের কথার ওজন দ্বিগুণ হয়ে যায়। সহজেই প্রভাবিত হয় প্রতিপক্ষ। তোমার মাথায় ছিল আসলে অনর্থক ঝামেলা। পাকানোর চিন্তা।
অস্বস্তি ঝেড়ে টুল থেকে নেমে দাঁড়াল জিনা। এক পা সামনে বাড়ল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, তুমি সত্যি বর্মটাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছ, তা-ই না?
কাকে কী বলছ? অবাক হলো ও। ভয় পাচ্ছি আমি? না তুমি? বিকেলে কী চেঁচানোটাই না চেঁচালে। আরেকটু হলে গোটা পাড়া জড়ো হয়ে যেত।
বিকেলের কথা বাদ দাও, বলল জিনা। কাঁধের উপর থেকে চুলের গোছা কানের পিছনে গুজল। ভূত-প্রেতে আমি বিশ্বাস করি না, করো তোমরা তিন গোয়েন্দা। তুমি আসলে বিশ্বাস করো বর্মটা ভুতুড়ে, আমি নই।
করতেই পারি। কারণ ভূতের সঙ্গে বহুবার মোলাকাত হয়েছে। আমার। তুমি ভাল করেই জানো সেসবের সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবও নেই আমার হাতে। ভূতে বিশ্বাস করা আর ভূতের ভয় পাওয়া এক নয়। আজকাল আমি ভূতে বিশ্বাস করি, কিন্তু ভয় করি না। তুমি বিশ্বাস করো না, কিন্তু ভয় পাও। ধরো ওই বর্মটার ব্যাপারে যে কাহিনি চালু আছে, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে? থেমে দম নিল কিশোর। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল জিনার দিকে। তারপর বলল, তুমি চাইবে ভয়ঙ্কর এক সৈনিক ভূতের মুখোমুখি হতে?
দেখো কিশোর, কপাল কুঁচকে বলল জিনা, আমি জানি রহস্যময় বা অলৌকিক সব কাণ্ড-কারখানা শুধু তোমাকে আর রবিন মুসাকে ঘিরেই ঘটে। না হয় মানলাম ভূত বলে কিছু একটা আছে, তাই বলে নিরীহ বর্মটাকেও ভুতুড়ে বলবে তুমি? রাতের বেলায় ওটা হেঁটে বেড়ায়, এমন আজগুবি কথা তুমি বিশ্বাস করো?
আমি হা-না কিছুই বলব না, জবাব দিল গোয়েন্দা-প্রধান।
সেটা জানার একটাই উপায় আছে, এখনই একবার গিয়ে চেক করে দেখা।
জিনা এমন ভান করল, যেন কিশোরের প্রস্তাবটা ওর কানেই যায়নি। বাইরে যতই মুড দেখাক, ভিতরে ভিতরে ও যে ভয়ে কুঁকড়ে গেছে, কিশোরের বুঝতে অসুবিধে হলো না।
চলো, একবার দেখে আসি, আবার প্রস্তাব করল কিশোর।
অসম্ভব! দুপাশে মাথা দোলাল জিনা। আমার আর খেয়ে কাজ নেই যে…
বুঝতে পেরেছি, ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হেসে উঠল কিশোর, ভয় পেয়েছ তুমি।
কিশোরের সামনে নিজেকে ভিত প্রমাণের কোনও ইচ্ছে নেই জিনার। তা-ই ইচ্ছের বিরুদ্ধে রাজি হতেই হলো। আচ্ছা, চলো, হাল ছাড়া ভঙ্গিতে বলল।
কিচেন থেকে বেরিয়ে অন্ধকার করিডর ধরে এগোল ওরা। বুকের মধ্যে কেমন যেন ধুপধাপ শুরু হলো কিশোরের। দোতলায় বসে থপ। থপ শব্দটা প্রথম শোনার সময়ও এমনটা লেগেছিল।