এরমধ্যে কফিনটার ভিতর থেকে বর্মের বাকি অংশগুলো বের করে ফেলেছেন মিস্টার পারকার। ওগুলো জড়ো করে নিয়ে চলল কিশোর সামনের হলের দিকে।
কিশোর ও হ্যাগার্ড ওখানে পৌঁছে বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলো একে একে মিস্টার পারকারকে দিল। একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে নেজারের বর্মটাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিলেন মিস্টার পারকার।
প্রিয় রাফিয়ানের পিঠে হাত রেখে কিশোরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে জিনা, বাবার কাজ দেখছে।
চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে জিনিসটার প্রতি কোনও আগ্রহই নেই ওর।
একটু পিছু হটে বর্মটার দিকে ভাল করে তাকাল কিশোর।
যোদ্ধা নেজারের গড়ন কেমন ছিল, ওটা দেখে আন্দাজ করতে কষ্ট হলো না ওর। বর্মের দুকাঁধ চওড়ায় এক গজ মত হবে।
পা জোড়া গোলাকার ও নিরেট, ছোটখাটো গাছের গুঁড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনটে কিশোর অনায়াসে লুকাতে পারবে বর্মটার ব্রেস্টপ্লেটের মধ্যে।
রবিনের কাছ থেকে নিয়ে মধ্যযুগীয় যোদ্ধাদের উপরে লেখা একটা বই পড়েছিল কিশোর। ওই বইতে ছিল মধ্যযুগের, অর্থাৎ ১১০১ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত ইউরোপে যত দুর্ধর্ষ লড়াকু লোক ছিল, তাদের জীবন-কাহিনি।
সামনের বর্মটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সেই বইটার কথা মনে পড়ে গেল ওর।
কী বিদঘুঁটে! বলল ও বিড়বিড় করে।
শুনে ফেলল হ্যাগার্ড। কিশোরের কাঁধে হাত রেখে বলল, ঠিক বলেছ, কিশোর। আমারও বর্মটাকে বিদঘুঁটেই লাগছে।
চোখ তুলে তাকালেন মিস্টার পারকার। শুনেছি বর্মটা নাকি ভুতুড়ে। তাই যেন হয়। ভূত-প্রেতে আমি বিশ্বাস করি না। এই বর্ম দিয়েই জিনাকে বুঝিয়ে দেব ওসব মিথ্যে।
এমন সময় ফোন বেজে উঠল।
মিস্টার পারকার ধরতে গেলেন।
হ্যাগার্ডও বেরিয়ে গেল। বলে গেল, মোমের জাদুঘরে জরুরী। কাজ পড়ে আছে তার।
কিশোরের দিকে তাকাল জিনা। গলা নামিয়ে বলল, তোমার কি মনে হয়, বর্মটা সত্যি ভুতুড়ে?
হতে পারে, বিজ্ঞের ভঙ্গি করে বলল ও। আবার না-ও হতে পারে। তবে এই মুহূর্তে তোমার চেহারাটা যে ভুতুড়ে দেখাচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কথার খোঁচা ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে তৈরি হয়েছিল জিনা।
কিন্তু কিশোর সেই সুযোগ দিল না ওকে। সিঁড়ি বরাবর দৌড় দিল। আণ্টি ডাকছেন নাস্তা করতে!
উপর তলা থেকে আণ্টি আবারও ডাকলেন।
দৌড়ে কিশোরকে হারাতে ছুটল জিনা। দুজন সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গেল একইসঙ্গে। ধাপগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে টপকাল। একইসঙ্গে ডাইনিঙে ঢুকল। হারল না কেউ।
৪
কাল একবার ফোন করতে হবে রকি বিচে, ভাবল কিশোর মনে। মনে।
মুসার এক বিখ্যাত মামা মিশর থেকে বেড়াতে আসার কথা। মুসাদের বাসায় উঠবেন। উনি এরমধ্যে আসার তারিখ জানিয়েছেন। কি না জানতে হবে। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চায় ও।
তা ছাড়া পরশুদিন সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছে রবিন, ওর হাল কী তা-ও জানা দরকার।
ভুলে যাবার ভয়ে কালকের করণীয় কাজগুলো একটা কাগজে লিখে ওটা টেবিলক্লথের নীচে রাখল কিশোর।
হরর ছবি আছে রাত সাড়ে নটায়। দেখা দরকার। অবশ্য প্রায়। একঘণ্টা বাকি আছে এখনও।
ইলেকট্রনিক্স গেম ওয়াচ নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল কিশোর। খেলতে খেলতে একসময় বিরক্তি ধরে গেল, টিভি দেখার এনার্জিও গায়েব হয়ে গেছে ততক্ষণে।
দাঁত ব্রাশ করে এসে পাজামা পরে নিল। তারপর লম্বা হলো। বিছানায়।
চেইনটা গলায় ঝুলছে।
চিত হয়ে শুয়ে চোখের সামনে তুলে ধরল ওটা।
জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় লকেটের ভিতর নীলচে ধোঁয়ার ঘুরপাক দেখল।
ওর কেন যেন মনে হতে লাগল এই অপার্থিব ধোঁয়া সুকৌশলে কিছু একটা আড়াল করে রেখেছে। বড় কিছু।
আরও ভাল করে দেখার জন্য লকেটটা চোখের কাছাকাছি নিয়ে এল ও। সমানে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে ভিতরকার ধোঁয়া, মুহূর্তের জন্যও বিরাম নেই।
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল কিশোর।
থপ থপ!
স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও।
দেখল হ্যাগার্ড হাফপ্যান্ট পরে সাঁতরে বেড়াচ্ছে একটা কচুরিপানা ভরা পুকুরে।
দৃশ্যপট পাল্টে গেল। দেখল, ইয়া মোটা একটা ছাতিম গাছের ডালে একটা হলুদ মার্বেল ঝুলছে। আর… আর দেখল, একটা ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে নেজার ম্যাণ্ডারের বর্ম।
একের পর এক আরও কত কী যে দেখল ও, তার ইয়ত্তা নেই। এক দৃশ্যের সাথে আরেক দৃশ্যের মিল নেই। সব ছাড়া ছাড়া, আজগুবি।
উদ্ভট।
থপ থপ!
আবারও কানে এল আওয়াজটা।
চোখ খুলে কান পাতল কিশোর।
থপ থপ!
নাহ, শব্দটা স্বপ্নে শুনছে না ও। নিজেকে চিমটি কেটে নিশ্চিত হলো কিশোর। শুনছে বাস্তবে।
উঠে বসে দম বন্ধ করে থাকল কয়েক মুহূর্ত।
থপ থপ!
পা ঝুলিয়ে দিল খাট থেকে। মাথা কাত করে ভাল করে শোনার চেষ্টা করল।
থপ্ থপ!
কিশোর মনে করতে পারছে না নীচতলায় এমন কী আছে যা এরকম আওয়াজ করতে পারে।
আশ্চর্য তো!
পাঁচ দিন হলো এই বাড়িতে আছে কিশোর, এমন আওয়াজ এর মধ্যে আর কখনও শোনেনি।
থপ্ থপ!
উঠে দাঁড়াল কিশোর। হঠাৎ জিনিসটার কথা মনে পড়ে গেল। ওই একটা জিনিসই আছে এ বাড়িতে, যা ওরকম আওয়াজ তুলতে পারে।
বর্ম!
হ্যাঁ, নেজারের বর্ম।
থপ থপ!
সিঁড়ির উদ্দেশে পা বাড়াল কিশোর। নিজেকে জিজ্ঞেস করল, ভয় করছে?
যেতে ইচ্ছে করছে, তা বলা যায় না।
কিন্তু কৌতূহলের কাছে হেরে গেল ভয়।
জাদুঘরের কিচেনটা ঠিক কিশোরের রুমের নীচে। আওয়াজটা ওখান থেকেই আসছে।