নিরেট একটা কিছুর ছোঁয়া পাওয়ার আশায় দ্রুত হাত নাড়াচাড়া করছে জিনা।
খসখস আওয়াজ উঠছে।
সামনে ঝুঁকে আরও ভিতরে হাত ঢোকাল ও।
এই তো পেয়েছি! কিন্তু… কথা শেষ না করে থেমে গেল। পরক্ষণে তীক্ষ্ণ বাঁশির মত চিৎকার করল, ওটা… ওটা আমাকে খামচে ধরেছে! কী… কী ওটা!!
পাগলের মত হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল ও। কিন্তু কিছু একটা আঁকড়ে ধরেছে ওর হাত।
ছাড়ছে না!
৩
একদিকে চেঁচাচ্ছে জিনা, আরেক দিকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। চেহারা কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে।
মিস্টার পারকার আর হ্যাগার্ড একযোগে উবু হলো কফিনের উপর।
দুই জোড়া হাত মুঠো মুঠো করে টুকরো কাগজ তুলল ভিতর থেকে।
একটু সবুর করো, জিনা, গম্ভীর হয়ে বললেন মিস্টার পারকার।
জলদি করো, বাবা! কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল জিনা।
কিশোর বুঝতে পারছে জিনার হাত আটকে গেছে কিছুর সঙ্গে।
মিস্টার পারকার জিনার হাত তুলে আনলেন কফিন থেকে। সঙ্গে বাহুসহ একটা ধাতব হাতও উঠে এল। ওটা ধাতব কাঁধের সঙ্গে আটকে ছিল। এখন খসে পড়েছে।
না হেসে গম্ভীর হয়ে গেলেন মিস্টার পারকার।
জিনা বোকার মত নিজের হাতের দিকে চাইল।
আসলে মুঠো পাকানো ধাতব হাতটার আঙুলে ওর ব্রেসলেট আটকে আছে-খামচায়নি কেউ।
কাণ্ড! মিস্টার পারকার বললেন। দাঁড়াও, খুলে দিচ্ছি।
ধাতব আঙুলগুলো একটা একটা করে সিধে করলেন তিনি।
ছাড়া পেয়েই জিনা একটানে হাত সরিয়ে নিল।
কপাল কুঁচকে কফিনটার ভিতরে তাকাল।
সবার সামনে এভাবে বেইজ্জতি হওয়ায় মরমে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের আক্রান্ত হাতের দিকে নজর দিল ও। অন্য হাতে ডলতে লাগল ব্যথা পাওয়া জায়গাটা।
আড়চোখে হ্যাগার্ডের দিকে তাকিয়ে বাপ-বেটির অলক্ষে ভুরু নাচাল কিশোর। সে-ও জবাব দিল একইভাবে।
মিস্টার পারকার কফিনের উপর ঝুঁকে হাত ঢোকালেন ভিতরে। কী একটা জিনিস তুলে আনলেন।
দেখো, কী সুন্দর জিনিস, কিশোরদের উদ্দেশে বললেন।
একটা হেলমেট ধরে আছেন তিনি। অস্তমান সূর্যের কোমল কিরণ পড়াতে ঝিকিয়ে উঠল ওটার চকচকে মসৃণ দেহ।
ওটার দিকে চেয়ে রইল কিশোর মন্ত্রমুগ্ধের মত। অবশেষে বলল, দেখে মনে হচ্ছে জিনিসটা কনে ঠাণ্ডা, তা-ই না, আঙ্কেল?
হেলমেট ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন মিস্টার পারকার। বললেন, ধরেই দেখো না ঠাণ্ডা না গরম। চোখে দেখে কোনও কিছুর তাপ বোঝা যায়?
হাতে নিতে কিশোর বুঝল যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও ভারী জিনিসটা। হাত বোলাল ওটার গায়ে। নিরেট ধাতু যেমন ঠাণ্ডা হয়, এটা মোটেই তেমন নয়, বরং কিছুটা গরমই ঠেকছে। যেন অনেকক্ষণ পরে থাকার পর এইমাত্র খুলে রেখেছে কেউ।
অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে গেল কিশোরের সারা দেহে। দুহাতে ধরল ও হেলমেটটা।
মিস্টার পারকার কফিন থেকে একটা শিনগার্ড (হাঁটুর নীচের অংশের আবরণ বের করে মেঝেতে রাখলেন। তারপর বের করলেন একটা ধাতব পা।
উত্তেজনায় দুচোখ চকচক করছে তার। ছড়ানো-ছিটানো। কাগজের মধ্যে দ্রুত হাত চলছে।
বর্মের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে পাশে জড়ো করছেন ব্যস্ত হয়ে।
এই সেই জিনিসই, নীরবতা ভাঙলেন উনি। এটাই হবে ভৌতিক জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস। শুধু গোবেল বিচে কেন, গোটা ক্যালিফোর্নিতে এমন চমকানো বর্ম দুটো নেই। এটার কথা একবার প্রচার হলেই দলে দলে লোক আসবে এই জাদুঘরে।
হঠাৎ থেমে গেলেন উনি। কপাল কুঁচকে উঠেছে। আবার কফিনের ভিতরে হাত চালাতে শুরু করেছেন। আচমকা থেমে গেলেন।
বোঝা গেল কিছু একটা ঠেকেছে তাঁর হাতে।
এ আবার কী! বলতে বলতে হাত তুলে আনলেন।
উজ্জ্বল এবং চকচকে একটা জিনিস দেখা গেল তার হাতে।
অদ্ভুত, গোল জিনিসটা। একটা সোনালি চেইনের প্রান্তে ঝুলছে।
বড়সড় একটা মার্বেলের মত মনে হচ্ছে ওটাকে।
তবে মার্বেল যে নয়, এক নজর দেখলেই বোঝা যায়।
জিনিসটার ভিতরে নীল ধোঁয়া পাক খাচ্ছে, উঠছে-নামছে। ধোঁয়ার ভিতরে আবার উজ্জ্বল রুপোলি কণা ভেসে বেড়াচ্ছে ছুটন্ত তারার মত।
মিস্টার পারকার কিশোরের হাতে দিলেন ওটা।
চোখের সামনে নিয়ে দেখল কিশোর। আঙ্কেলের দিকে তাকাল। এটাই বোধহয় আমাদের জন্যে সিনিয়র আঙ্কেলের সেই সারপ্রাইজ?
তা-ই মনে হচ্ছে, বললেন মিস্টার পারকার। চট করে জিনাকে দেখে নিয়ে কিশোরকে বললেন, উনি বোধহয় এটা তোমার জন্যেই পাঠিয়েছেন। জিনার তো লকেট আছে।
আমার জন্যে তা হলে কী? গরম স্বরে বলল জিনা।
পরে পাঠাবেন হয়তো।
গম্ভীর হয়ে গেল জিনা। বলল, কিশোরের জিনিস… ও। দেখতেও তো ভাল না। ভেতরে আবার ধোঁয়া।
একমুহূর্ত দ্বিধা করল কিশোর। তারপর চেইনটা গলায় ঝোলাল। মুখ নিচু করে সাদা টি-শার্টের উপর ঝুলে থাকা লকেটটার দিকে তাকাল। দারুণ জিনিস, তা-ই না, আঙ্কেল?
নীরবে একমত হলেন উনি মাথা ঝাঁকিয়ে।
জিনা কিছু বলল না, তবে ওর দৃষ্টিতে ঈর্ষা। তাই জিনিসটা দ্বিগুণ ভাল লাগল কিশোরের।
এগিয়ে এল হ্যাগার্ড।
লকেটটার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, আমার কী মনে হয়, জানো?
কী?
মনে হয় এটা জাদুর লকেট।
তা-ই বুঝি? বলল কিশোর।
জাদুর লকেট!
বহুদিন পর চমৎকার একটা লকেট উপহার পেয়েছে কিশোর। তাই মনে মনে সিনিয়র পারকারকে লম্বা-চওড়া থ্যাঙ্কস না দিয়ে পারল না।
সত্যি দারুণ একটা জিনিস গিফট করেছেন উনি।