কী? প্রশ্ন করল কিশোর।
কফিনটার গায়ের লেখাগুলো পড়েছ? জিজ্ঞেস করল সে।
লেবেল? নাহ!
বলো কী! বিস্ময় ফুটল লোকটার চেহারায়।
পড়ার সুযোগ পেলাম কোথায়।
লেবেলে লেখা আছে, মণ্ট্যানার জ্যাণ্ডে ভিলা থেকে ওটা লস অ্যাঞ্জেলেসে পাঠানো হয় প্রথমে। ওখান থেকে এখানে এসেছে।
আসতেই পারে, বলল কিশোর। সিনিয়র পারকার হয়তো মণ্ট্যানা থেকে আনিয়েছেন ওটা।
হ্যাঁ, তাই হবে। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। আমার যদি ভুল হয়… থেমে গভীর ভাবনায় ডুবে গেল হ্যাগার্ড। একটু পর বলল, হ্যাঁ, ভুল না হওয়ারই কথা। জ্যাণ্ডে ভিলা নামে একটা বাড়ি আছে। মণ্ট্যানার হেলেনায়। বাড়িটা তিন শতাব্দী আগের দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ সৈন্য নেজার ম্যাণ্ডারের। মার নামে চ্যাপেলের ধাচের বাড়িটা সে বানিয়েছিল।
নেজার ম্যাণ্ডারের কথা এমনভাবে বলছে লোকটা, যেন সে বিখ্যাত কেউ। আসলে উল্টো।
মাথা ঝাঁকাল হ্যাগার্ড। নেজারের কাহিনি জানো তুমি? সে ছিল হাড় বজ্জাত এক সৈন্য। জাত বদমাশ। নিষ্ঠুর। ১৭০৫ সালের দিকে হেন বদ কাজ নেই যা সে করত না। ইংরেজ রাজার আস্কারায় দিনকে দিন বদমায়েশী মাত্রা ছাড়িয়ে যায় নেজারের, চলে আসে আমেরিকায়। সে-সময়ে প্রতাপশালী কয়েকজন বণিকের অনুরোধে এক নামকরা জাদুকর জাদু করে নেজারকে। নিজের বর্মের মধ্যে তাকে চিরতরে বন্দি করে। বর্মের মধ্যে বন্দি অবস্থায় সে মারা যায়। কফিনবন্দি বর্মটা সবার অজান্তে তারই বাড়ির তলকুঠুরিতে লুকিয়ে রাখে জাদুকর। এটা হয়তো সেই বর্মটাই।
তা হলে তো আরও ভাল, কিশোর বলল। যেসব জিনিসে ভূত ভূত গন্ধ আছে, সেসবই তো এখানে দরকার। আমার মনে হয় বর্মটা। পারকার আঙ্কেলের পছন্দ হবে।
মাথা ঝাঁকাল হ্যাগার্ড। আমারও তা-ই মনে হয়, চেহারায় চিন্তার ছাপ ফুটল লোকটার। গলা আপনাআপনি নিচু হয়ে এল।
নেজারের কাহিনির বাকি অংশটুকু তোমার চাচা জানেন কিনা আমি বলতে পারি না।
লোকটার বলার ভঙ্গি কিশোরকে সচকিত করল। রহস্যের গন্ধ পেল ও। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, বাকি অংশটা কী?
শব্দ করে হাসল লোকটা। না না, তেমন কিছু না, নাকের সামনে থেকে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল। সে-কথা শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না। আষাঢ়ে গল্পের মত মনে হবে। লোক কাহিনি মতে নেজারের বর্মটা যার কাছে গেছে, তারই কপাল নাকি পুড়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে সে।
সত্যিই যদি ওটা ভুতুড়ে হয়, তা হলে তো জাদুঘরের জন্যে ভালই, তা-ই না?
তীক্ষ্ণ চোখে কিশোরের দিকে তাকাল হ্যাগার্ড। ভুরু কুঁচকে উঠেছে। সামনে ঝুঁকে কিশোরের মুখের কাছে নাক এনে বলল, জাদুঘরের জন্যে ভাল হবে কি না জানি না, তবে আমাদের জন্যে যে ভাল হবে না, সে-ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল লোকটা কয়েক মুহূর্ত। কী যেন ভাবল। তারপর কিশোরের চোখে চোখ রেখে বলল, তুমি তো গোয়েন্দাগিরি করতে পছন্দ করো, তা-ই না?
করি। মৃদু হাসল কিশোর। আপনি কী বলতে চান বুঝতে পেরেছি। বর্মটার ওপর নজর রাখতে হবে আড়াল থেকে, এই তো?
মাথা উপর-নীচ করল সে। হ্যাঁ।, ঠিক আছে, মিস্টার হ্যাগার্ড, কিশোর বলল। আপনি যখন। কাজে ব্যস্ত থাকবেন, তখন আমি চোখ রাখব।
আর তুমি যখন ব্যস্ত থাকবে, কিশোরের কাঁধে হাত রাখল সে, তখন আমি নজর রাখব। ঠিক আছে?
আচ্ছা।
বারান্দায় বেরিয়ে এল দুজন।
কফিন রেখে গাড়িতে ফিরে গেছে লোকগুলো। বারান্দার এক কোণে রাখা আছে কফিনটা।
মিস্টার পারকার আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করতে নারাজ। একটা ক্রোবার হাতে ওটার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন তিনি। কফিনের ডালার নীচে ক্রোবারের বাঁকানো মাথাটা ঢুকিয়ে চাড় দিলেন। পেরেক দিয়ে কোনওরকমে আটকে ছিল ডালা, চাপ পড়তেই কড়মড় শব্দে উঠে এল।
মিস্টার পারকার ডালাটা সামান্য তুলে ধরতে হ্যাগার্ড ফাঁক দিয়ে হাত ভরে ওটাকে টান মারতে লাগল উপর দিকে।
জিনা একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিশোরের চোখে ওর ভিতরের নার্ভাস ভাবটা ঠিকই ধরা পড়ে গেল। নীচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে জিনা। ঘাবড়ে যাওয়ার লক্ষণ–কিশোর জানে।
একটু একটু করে উত্তেজনা বাড়ছে কিশোরের। তীক্ষ্ণ চোখে মিস্টার পারকার আর হ্যাগার্ডের কাজ দেখছে।
তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় অবশেষে খুলে উঠে এল ডাটা।
কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। জিনা ওর গা ঘেঁষে থামল। ঝুঁকে কফিনের ভিতরে উঁকি দিল ওরা একযোগে।
ফেঁশো জিনিস দেখা গেল ভিতরে। ওগুলো আর কিছু নয়, লম্বা ফালি করে কাটা প্যাকিঙের কাগজ। একই সাইজের।
কাগজ! জিনার কণ্ঠে হতাশা। কিশোরও রীতিমত হতাশ হয়ে পড়েছে।
খালি কাগজ নয়, রহস্য করে বললেন মিস্টার পারকার। হাত ঢুকিয়ে দেখো ওর ভেতরে আসল জিনিসও আছে।
ইয়ে… না, থাক, এক পা পিছিয়ে গেল জিনা। তুমিই দেখো, বাবা।
ভয় করছে? নরম সুরে বলল কিশোর। মনে মনে হাসছে।
মোটেই না, কড়া স্বরে মিথ্যে বলল জিনা। সম্মানে লেগেছে। ভয় পাব কেন? ভয়ের কী আছে! কিশোরের কাছে ছোট হতে রাজি নয়।
আরও কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল কিশোর। কিন্তু জিনা সে সুযোগ দিল না। কারণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফুলহাতা জামার আস্তিন গুটিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল ভিতরে। প্যাকিং কাগজের মধ্যে কনুই পর্যন্ত ঢুকে গেল ওর।