নিজের অজান্তে শিউরে উঠল জিনা। অজানা শিহরণের স্রোত বয়ে গেল ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত। অস্বস্তি লেগে উঠল।
মিস্টার পারকার, বাসায় আছেন? সামনের পোর্চ থেকে অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। নার্ভাস কণ্ঠ। কিছু ডেলিভারি দিতে বা মেরামতির কাজ করতে যারাই আসে ভৌতিক জাদুঘরে, সবার কণ্ঠ এমনই নার্ভাস শোনায়। আমরা জি.এম.আর. ট্রাভেলস থেকে এসেছি। একটা পার্সেল আছে।
এক ছুটে সামনের পোর্চে বেরিয়ে এল সবাই।
দেখা গেল বাসার সামনে একটা ভ্যান দাঁড়িয়েছে। ওটার গায়ে কালো, চ্যাপ্টা হরফে লেখা : জি.এম. আর. ট্রাভেলস।
দুজন লোক ভ্যানের পিছন থেকে কফিনের মত বড় একটা বাক্স টেনে বের করছে। হ্যাঁ, কফিনই বলা চলে।
পোর্চের মাঝখানে থমকে দাঁড়াল কিশোর। জিনার পক্ষে সময়মত ব্রেক কষা সম্ভব হলো না। ধাক্কা খেল কিশোরের পিঠে। পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিল কিশোর। জিনা ওর কাঁধের উপর দিয়ে। সামনে তাকাল।
কাঠের কফিনটা বেশ লম্বা। দেখেই বোঝা যায় বেশ পুরানো। কফিনের উপর দিকের কয়েকটা তক্তা বাঁকা এবং চিড় ধরা।
ডেলিভারি-ম্যানরা কফিনটাকে লম্বালম্বি দাঁড় করাল। উচ্চতায় তাদের সব কজনকে ছাড়িয়ে গেল ওটা।
মিস্টার পারকার আর হ্যাগার্ড ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। কফিনটাকে।
কিশোর দ্রুত পায়ে এগিয়ে মিস্টার পারকারের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। জিনা ভয়ে ভয়ে এগোল, কিশোরের পাশে দাঁড়াল।
জিনিসটাকে কাঁধে তোলার সময় সঙ্গে আসা লোকদের মুখ দিয়ে যে অদ্ভুত গোঙানি বেরোল, তাতে বোঝা গেল কফিনের ওজন নেহায়েত কম নয়।
ফাটল দিয়ে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু ভিতরে অন্ধকার বলে দেখা গেল না কিছু। সেই বর্ম মনে হয়, নিচু স্বরে বলল।
মিস্টার পারকার কিছু না বলে মাথা ঝাঁকালেন। সাবধান! খুব সাবধান! তাড়াহুড়ো কোরো না। হ্যাঁ, আস্তে এগোও, মানুষগুলোর উদ্দেশে বলে চলেছেন তিনি। বারান্দায় তুলে রাখো। পরে আমরা। ভেতরে ঢুকিয়ে নেব। সরে দাঁড়াও, জিনা। কিশোর, অত কাছে যেয়ো না, সাবধান! তুমি…
আচমকা থেমে গেলেন উনি। বাক্সের দরজা হাঁ হয়ে গেছে অনেকটা, ভিতর থেকে কিছু একটা বেরিয়ে এসেছে। রোদের আলোয় ঝিলিক মেরে উঠল ওটা।
ভাল করে খেয়াল করতে কিশোর বুঝল ওটা বড়সড় একটা কুঠার। বর্মধারীর কুঠার।
ওটার চকচকে লম্বা ব্লেড বাতাসে শিস কেটে কোপ মারার ভঙ্গিতে দ্রুত নীচে নেমে এল। যেন অদৃশ্য কোনও হাত ভিতর থেকে ঘটিয়েছে কাজটা।
একটা চাপা গোঙানি ছেড়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কিশোর। পারল না। ক্ষুরধার ব্লেডটা ওর ডান পায়ের উপর পড়ছে!
২
ডান পা নড়ানোর চেষ্টা করল কিশোর। ধীরে ধীরে আঙুল নাড়াচাড়া করল। ভয়ে ভয়ে নীচে তাকাল। না, একটুর জন্য পায়ের উপর পড়েনি।
কাঠের মেঝেতে ডেবে আছে কুঠারের ব্লেড। ডান পায়ের সামান্য আগে পড়েছে। ব্লেডের ওপাশে ওর জুতোর কালো ডগা দেখা যাচ্ছে। এপাশে পা সহ বাকি অংশ। নিখুঁতভাবে কাটা পড়েছে জুতোর ডগা।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ও। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। জুতোর কাটা ডগা দিয়ে বেরিয়ে থাকা পায়ের আঙুলগুলো নাড়াল, শ্বাস ফেলল। ওগুলো এখনও পায়ের সাথে এঁটে আছে। পুরো পাঁচটা আঙুলই আছে। একটাও কাটা পড়েনি।
ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মিস্টার পারকার। কিশোর তার দিকে চেয়ে বোকা বোকা হাসল।
জুতোর ডগা কাটা পড়েছে, আঙ্কেল, লজ্জা পাওয়া ভঙ্গিতে বলল ও। আঙুল কাটেনি। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি।
তোমার আরও সাবধান থাকা উচিত ছিল, কিশোর, গম্ভীর গলায় বললেন মিস্টার পারকার। যাও, জুতো পাল্টে এসো।
কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। জিনিসটা পুরো না দেখা পর্যন্ত সরতে মন চাইছে না।
হ্যাগার্ড এগিয়ে এসে এক হাত রাখল ওর কাঁধে। বলল, এসো, কিশোর। দৌড় প্রতিযোগিতা হয়ে যাক তোমার আমার মধ্যে।
কথায় কথায় প্রতিযোগিতা করা হ্যাগার্ডের স্বভাব। সব ব্যাপারে ছোট-বড় সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে না পারলে যেন তার পেটের খাবার হজম হয় না।
অবশ্য কিশোরও লোকটার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মজা পায়। কারণ এ পর্যন্ত যতবার প্রতিযোগিতা হয়েছে, কিশোরই জিতেছে প্রত্যেকবার।
দৌড় শুরু হয়ে গেল।
সিঁড়ি ভেঙে ঘরের দিকে ছুটল কিশোর। চোখের পলকে দরজার সামনে পৌঁছে গেল। দরজায় কালো রঙের পটভূমিতে ক্যাটকেটে লাল রঙে লেখা ভৌতিক জাদুঘর।
ঠেলে দরজা খুলে ফেলল কিশোর, ডানে বাঁক নিয়ে এগোল জুতোর র্যাকের দিকে। ঝটপট কাটা জুতো খুলে আরেক জোড়া পরে নিল।
এসময় হাঁসফাঁস করতে করতে পৌঁছুল হ্যাগার্ড।
শামুকের মত এলে পারবেন না আপনি কখনও, বলল কিশোর।
তা-ই তো দেখছি, হাসল হ্যাগার্ড।
লোকটাকে খোঁচা দিয়ে কোনও লাভ হয় না। যে খোঁচা গায়ে মাখে না, তাকে খোঁচা দেয়ার সার্থকতা কোথায়? হ্যাগার্ড খেপে না, উল্টে হাসে দাঁত বের করে।
কিন্তু এ যাত্রায় হাসিটা নিষ্প্রাণ। কিশোরের কথা তার কানে গেছে বলেও মনে হলো না। যে-কারণেই হোক, লোকটাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে। বাদামী চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি লেগে আছে।
কিশোরের পাশে এসে দাঁড়াল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমি যা দেখলাম, তুমি তা দেখেছ, কিশোর?
ঘুরে দরজার দিকে তাকাল সে। ডেলিভারি-ম্যানরা ভারী কফিনটা বারান্দায় ওঠাচ্ছে।