নেজার ম্যাণ্ডার হাসছে।
মুক্তির আনন্দে হাসছে।
তার হাসি জিনার সব ভয় দূর করে দিল। সহজ হয়ে উঠল ও।
কিশোরও সহজ হয়ে এল।
তোমাদের দুঃসাহসিকতার কারণেই অবশেষে আমি বর্মের কারাগার থেকে মুক্তি পেলাম। বর্মের এই কবর থেকে বেরোতে পারলাম। কিন্তু তার আগে…।
নেজার তার তলোয়ার কিশোরের দিকে ঘোরাল। হাতের ইশারায় ওকে কাছে ডাকল। কাছে এসো, কিশোর।
কিশোর! ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করল জিনা। যেয়ো না। কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। বলা যায় না, নতুন কোনও দুর্ঘটনা… সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে ও বর্মটার দিকে।
কিন্তু কিশোরের মনে কোনও সন্দেহ নেই। আসল-নকল চিনতে ওর ভুল হয়নি আজ পর্যন্ত।
কিছু করবে না, ফিসফিস করে জিনার কানের কাছে বলল। কিশোর। ও প্রেতাত্মার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। কাজেই নির্দ্বিধায় এগিয়ে গিয়ে বর্মটার সামনে দাঁড়াল।
নেজার তার তলোয়ার ওঠাল। তারপর ধীরে ধীরে নামিয়ে আনল। প্রথমে কিশোরের ডান কাঁধে ছোঁয়াল, তারপর বাঁ কাঁধে।
আমি নেজার ম্যাণ্ডার কিশোরকে তার সৎসাহস ও দুর্দান্ত মনোবলের। জন্য একটি বিশেষ উপাধিতে ভূষিত করছি। আজ থেকে কিশোর… থেমে গেল সে। তারপর আবার বলল, আজ থেকে কিশোরের অন্য নাম–ভিক্টর।
ভিক্টর! ভুরু কোঁচকাল কিশোর।
অর্থ জানো তো? প্রশ্ন করল নেজার।
হ্যাঁ। শত্রু দমনকারী।
ঠিক। তুমি পৃথিবীর জঘন্যতম এক শত্রুকে দমন করেছ। ভিক্টর নামটা তাই তোমার প্রাপ্য। ধন্যবাদ, কিশোর–ভিক্টর।
নেজার সামান্য পিছাল। দুহাতে তলোয়ারটা সামনে ধরে রেখেছে। জিনার দিকে চাইল সে। বলল, বন্ধুরা, চিরকাল তোমাদের কথা মনে থাকবে। আসি, কেমন?
হঠাৎ কোত্থেকে হালকা নীল ধোঁয়া এসে ঘিরে ধরল নেজারকে। এ ধোঁয়া সালমি বেন কাজেমকে ঘিরে ধরা ধোঁয়ার মত উৎকট নয়। এ ধোঁয়া কোমল। ধোঁয়ার মেঘটা নেজারকে ঢেকে ফেলল গরম কম্বলের মত। কিশোর নেজারকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুনল।
পাঁচ সেকেণ্ড পর ধোঁয়ার মেঘ কেটে গেল। সেই সঙ্গে নেই হয়ে। গেল নেজার ম্যাণ্ডার।
২০
এই হলো ঘটনা, পরদিন সকালে মিস্টার পারকারকে বলল কিশোর। বুঝতেই পারছেন ওই বর্ম আর কনজারভেটরি আমি ইচ্ছে। করে লণ্ডভণ্ড করিনি…
আর কৈফিয়ত দিতে হবে না তোমাকে, বললেন মিস্টার পারকার। আমি বুঝতে পারছি সব। সত্যিই দারুণ সাহসের পরিচয় দিয়েছ তুমি।
মিস্টার পারকার এক হাত রাখলেন কিশোরের কাঁধে।
কিশোরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে জিনা। মিস্টার পারকার ওর কাঁধে অন্য হাত রাখলেন। আমার মেয়েটাও কম সাহসী নয়, কী বলো, কিশোর?
মাথা দুলিয়ে সায় দিল কিশোর। আমার চেয়ে বেশি।
শয়তান এক জাদুকর কীভাবে আমাদের সবার চোখে ধুলো দিয়েছে! বললেন মিস্টার পারকার। দাঁড়াও, সিনিয়রকে হাতের কাছে পেয়ে নিই একবার। এমন বকা দেব। ও যদি বর্মটা না পাঠাত…
মিস্টার পারকার আছেন? দরজায় নক করে ডাক দিল কেউ।
মিস্টার পারকার, আমরা জি.আর.এম. ট্রাভেলস থেকে এসেছি।
কণ্ঠটা বেশ উত্তেজিত শোনাল।
ব্যাপার কী?
চকিতে মিস্টার পারকারের দিকে তাকাল জিনা। নার্ভাস দৃষ্টি।
মিস্টার পারকার মেয়ের দিকে তাকাল।
জিনা তাকাল কিশোরের দিকে।
পরক্ষণে দৌড় দিল দুজন পোর্কের উদ্দেশে।
কী ওটা? কফিনের মত প্রকাণ্ড একটা বাক্সের দিকে চেয়ে বলল কিশোর। আগন্তুক আর তার সহকারীরা ওটাকে ভ্যান থেকে নামিয়ে আনছে।
বাক্সটার সারা গায়ে অজস্র লাল স্ট্যাম্প। সব কটাতেই ছোট বড় করে লেখা-ভঙ্গুর।
ভ্যানের লোকেরা ধরাধরি করে বাক্সটা পোর্চে নিয়ে এল।
কোত্থেকে এল ওটা? দ্বিধার সাথে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
জানি না, মিস্টার পারকার জবাব দিলেন। ভ্যানের লোকদের ধন্যবাদ জানালেন।
ভ্যানটা চলে যাওয়ার পর মিস্টার পারকার তাঁর ক্রোবার নিয়ে এলেন ভিতর থেকে।
বাক্সের পেরেকগুলো খুলে ডালা তুলে ফেললেন।
গোটা বাক্স টুকরো টুকরো প্যাকিং কাগজে ভরা।
নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। জিনা নার্ভাস কণ্ঠে বলল, এটার চেহারা তো বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না। ভেতরে হাত ঢোকালে না আবার আঁকড়ে ধরে!
আমারও খুব একটা সুবিধের ঠেকছে না, মিস্টার পারকার বললেন। যাই হোক, দেখি কী আছে ভেতরে। বলতে বলতে দুহাত ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন।
পাথরের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।
ভাবছে।
কী দেখতে হবে মিস্টার পারকার হাত বের করার পর?
কোনও হেলমেট, যার ভিতরে ধকধক করে জ্বলছে দুটো ভৌতিক চোখ? নাকি জাদুর কোন লকেট, যার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে নীল ধোঁয়া?
নাকি বড়সড় পিঙ্গল কোনও শামুক?
ভেবে পাচ্ছে না কিশোর।
সেকেণ্ড চারেক পর মিস্টার পারকার তার দুহাত বের করলেন। এক হাতে লম্বা, সাদা একটা খাম।
এটা আবার কী? কপাল কুঁচকে ওটা দেখলেন মিস্টার পারকার। খুলব? তোমরা কী বলো?
বললেন ঠিকই, তবে কিশোর বা জিনার জবাবের অপেক্ষা না করে ছিঁড়ে ফেললেন ওটার মুখ। ভিতর থেকে বের করে আনলেন একটা চিঠি। ভাজ খুললেন। মনে হচ্ছে আমাদের সিনিয়রের পাঠানো চিরকুট।
তা-ই নাকি? জিনা আগে বাড়ল। ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইল, কী লেখা আছে ওতে?
মিস্টার পারকার গলা খাকারি দিয়ে পড়তে শুরু করল:
প্রিয় হ্যারিসন,
জিনিসটা পাঠালাম। ফোন দিতে পারতাম, কিন্তু চিঠির দামই অন্যরকম, তাই চিঠিই দিলাম। জিনিসটা পাঠাতে দেরি হয়ে গেল। এই বর্ম নিয়ে আজগুবি সব গল্প চালু রয়েছে। আমি জানি না সেসব সত্যি কি না। তবে যার কাছ থেকে বর্মটা কিনেছি, সে বলেছে ওটা নাকি আসলেই ভুতুড়ে। তবে এমন ভুতুড়ে কিন্তু নয়, যাতে তোমাদের বড় ধরনের দুর্ঘটনা বা কোনও ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। মোট কথা, বর্মটা হয়তো ভুতুড়ে, কিন্তু বিপজ্জনক নয়। তোমাদের তো এমন একটা বৰ্মই দরকার, তা-ই না? কাজের চাপ কমলেই দেখতে আসব ভুতুড়ে জাদুঘর।