হ্যাঁ, নিজেকে ফিরে পেয়ে বলল কিশোর। এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না আমার। প্রথমে ওই জাদুকর আমাকে একটা বেড়াল বানিয়ে ফেলতে চেয়েছিল, পরে সে স্ফুলিঙ্গ দিয়ে আমাকে খুন করার চেষ্টা করে। ওই স্ফুলিঙ্গ তার দিকে ফেরত পাঠাই আমি ওই সোনালি তলোয়ার দিয়ে।
কথা শেষ করে ইশারায় তলোয়ারটা দেখাল কিশোর। হাত দুটো মস্তিষ্কের নির্দেশ মানতে চাইছে না, থরথর করে কাঁপছে। আবার বলতে শুরু করল ও কাঁপা গলায়, স্ফুলিঙ্গ যখন জাদুকরকে আঘাত করে; তখন পিঙ্গল ধোঁয়ার মেঘে ঢাকা পড়ে যায় সে। তারপর… তারপর শামুক হয়ে যায়। বড়সড় পিঙ্গল একটা শামুক।
শামুক! শামুক হয়ে গেছে ব্যাটা! নেজার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। দারুণ সাজা হয়েছে বদমাশটার! একদম উচিত সাজা হয়েছে।
জিনা আর কিশোর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শুনছে নেজারের প্রেতাত্মার স্বগতোক্তি।
হাসছে নেজার। হেসেই চলেছে।
তার মুখাবরণের ভিতরের আগুন এখন আর আগের মত ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে না। হঠাৎ কিশোরের মনে হলো নেজার আসলে ভয়ঙ্কর নয়। মোটেই তেমন লাগছে না এখন তাকে।
এক হাঁটুতে ভর করে বসে পড়ল নেজার। মাথা নোয়াল কুর্নিশের ভঙ্গিতে।
তোমাকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, কিশোর পাশা!। নিজের অজান্তে বিস্মিত চোখে ঝলমলে হেলমেটটার দিকে তাকাল কিশোর।
জিনা প্রায় স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, শুনেছি আপনি ইতিহাসের জঘন্য এক চরিত্র। আপনাকে আমি ঘৃণা করি।
এখনও লোকটা তার তলোয়ার, ধরে আছে। তবে ওটার ডগা। মেঝেতে ঠেকে আছে। করো… যত খুশি ঘৃণা করো। তারপরেও কিশোরের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।
কোনও চালাকি করছেন না তো? বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে বলল জিনা।
এ না-সূচক মাথা নাড়াল সে। কিশোরের দিকে ফিরে বলল, আমাকে মাফ করে দিয়ো, কিশোর। প্রথমে তোমার গলায় লকেট দেখে আমি তোমাকেই সালমি বেন কাজেম মনে করেছিলাম। ভেবেছি ওই শয়তান জাদুকর আমাকে ধোকা দেয়ার জন্যে বাচ্চা ছেলের রূপ ধরেছে। এখন বুঝতে পারছি আমার ধারণা ভুল ছিল, ওই জাদুকরের সঙ্গে তোমার কোনও যোগাযোগ ছিল না। তুমি নির্দোষ। ইতিহাসের কথা বলছ? ইতিহাস বদলে দেয়ার ক্ষমতা। আমার নেই। থাকলে তা-ই দিতাম।
কনজারভেটরির চারদিকে চোখ বোলাল সে।
তোমরা কেউই আমার দুশমন নও। ওই জাদুকর ছাড়া। এখানকার সবাই আমার বন্ধু। এখনও তা-ই আছ।
আমি? নিজের বুকে বুড়ো আঙুল ঠেকাল জিনা। কিন্তু আমি আপনার বন্ধু হতে চাই না। চ হ্যাঁ, তুমি আমার বন্ধু।
নেজার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। মিস্টার পারকার বর্মটায় রোজ তেল দেয়া সত্ত্বেও জয়েন্টগুলোর জং এখনও পুরোপুরি যায়নি।
ক্যাঁচকোঁচ শব্দ উঠল। টলে উঠল নেজার। কিশোর তার দিকে এক হাত বাড়াল। কেন যেন মানুষটার জন্য সহানুভূতি হচ্ছে ওর।
আশ্চর্য!
এবার তার হাতটা আর শীতল লাগল না। কেন কে জানে!
সালমি নিশ্চয়ই উদ্ভট কোনও গল্প শুনিয়ে তোমাদের বিভ্রান্ত করেছে? আমি জানি কী হতে পারে সেই গল্প। বলে উঠে দাঁড়াল সে। সে তোমাদের বলেছে আমি পাজি, তা-ই না?
উপর-নীচ মাথা ঝাঁকাল জিনা।
সালমি একটা ঘূণ্য পশু, নেজার সোজা কিশোরের দিকে চেয়ে আছে। আমি কখনও পাজি ছিলাম না। পাজি ছিল সালমি। আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগের কথা। ব্রিটেনের রাজার আমল। আমি কাজেমের মেয়েকে ভালবাসতাম। কিন্তু ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি সে। কিছুতেই রাজি হলো না আমাদের বিয়েতে। তার ইচ্ছে ছিল মেয়েকে আমার চেয়ে অনেক ধনী, ক্ষমতাধর কারও সঙ্গে বিয়ে দেবে। একদিন তার সঙ্গে তর্কাতর্কি বেধে যায় আমার। এক পর্যায়ে আমি যখন তাকে বলি যে-কোন মূল্যে, আমি তার মেয়েকেই বিয়ে করব, তখন সে ভয়ানক খেপে যায় আমার ওপর। তার সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয় আমার। সুবিধে করতে না পেরে কী সব মন্ত্র পড়ে সে, এই বর্মের মধ্যে আমাকে বন্দি করে। তোমরা জানো না, কেউ জানে না, সেই আমলে ওর মত পাজি জাদুকর দুটো ছিল না। দুনিয়ায়। এখনও বেঁচে আছে ও, বুঝতেই পারছ তার জাদুর গুণ কত ভয়ঙ্কর। সাধারণ মানুষ জানত না তার কথা, গোপনে জাদুচর্চা করত সে। জাদুর বলে বেঁচে ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। তার এই অস্বাভাবিক আয়ুর কথা লোকে যাতে জানতে না পারে, সেজন্য সত্তর-আশি বছর পরপর জায়গা বদলাত সে। যা হোক, সালমি আমাকে বর্মে বন্দি করার সময় জানায় আমি কেবল সেদিনই মুক্তি পেতে পারি, যেদিন আমি তাকে হারাতে পারব। কিন্তু হারাব কী করে? সে আমাকে বন্দি করে রাখে আমারই বাড়ির তলকুঠুরিতে। আমার বাড়ি তখন এই আমেরিকায়, মন্টানায়। এই বর্মের ভেতরে থেকে খিদে-তেষ্টায় মারা গেলাম আমি একদিন। তারপর ভূত হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার বন্দিদশা ঘুচল না। আমার বন্দিত্ব ঘোচাবার একমাত্র উপায় আমার এই সোনালি তলোয়ার।
থেমে কয়েক মুহূর্ত ফ্লোরের দিকে চেয়ে রইল নেজার। চোখে ঘৃণা।
সালমি আমার তলোয়ার তার মার্বেলের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে, ফের বলতে শুরু করল নেজার। লকেটটা আমার সঙ্গেই রেখে দেয়। কিন্তু ওটা ব্যবহার করার কোনও ক্ষমতা ছিল না আমার। আমি কিছুতেই লকেটের ভেতর থেকে আমার তলোয়ার বের করতে পারিনি। ওই তলোয়ার ছাড়া দিনকে দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে গেলাম আমি। টের পেয়ে গেলাম, পারব না আর কোনওদিন জাদুকরকে হারাতে। আজ সেই অসাধ্য কাজ করলে তোমরা, কিশোর-জিনা, বলে থামল নেজার, জিনার দিকে তাকাল। কিছু মনে কোরো না তোমরা।