ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে আমার, হাই তুলে বলল কিশোর। মনে হচ্ছে এখানেই… এত কিছু ঘটে গেল বিশ্বাসই…
ওর পাশেই কিছু একটা নড়ে উঠতে থেমে গেল। জিনার অস্পষ্ট গোঙানি কানে এল। কিন্তু ওর দিকে তাকানোর সময় পেল না কিশোর।
নেজার ম্যাণ্ডারের একটা গ্লাভের উপর নজর স্থির।
আপনাআপনি গ্লাভটা বর্মের স্তূপ থেকে উঠে এসে তলোয়ারের হাতলের উপর বসল। একে একে সব কটা আঙুল বেঁকে গেল, এঁটে বসল হাতলে।
সোনালি তলোয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরল গ্লাভের ধাতব আঙুল।
ও, ক্রাইস্ট! আঁৎকে উঠল জিনা।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। এটা কী?
তলোয়ারটা শূন্যে উঠে পড়ল। ভাসতে লাগল বাতাসে।
গভীর একটা গোঙানি শুনতে পেল কিশোর। ভয়ে ওর ঘাড়ের খাটো খাটো চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেল।
গোঙানির আওয়াজটা নিচু হতে লাগল। মনে হচ্ছে কয়েক মাইল। দূর থেকে আসছে। অবশ্য পরমুহূর্তে আবার চড়া হয়ে উঠল। মনে হচ্ছে অদৃশ্য কেউ খুব কাছ থেকে গোঙাচ্ছে।
একটু পর মনে হলো চারদিক থেকেই আসছে আওয়াজটা।
আতঙ্কভরা চোখে বর্মের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্তূপটার দিকে তাকাল কিশোর। তলোয়ারটার ডগা ঘুরে গেল বর্মের বিচ্ছিন্ন পা দুটোর দিকে। পরমুহূর্তে হুশহুশ শব্দ কানে এল। পা দুটো উঠে পড়ল। শূন্যে। তলোয়ারটার দিকে ছুটে এল। তারপর গতি পরিবর্তন করে যেখানে থাকার কথা, সেখানে এসে স্থির হয়ে গেল।
এরপর তলোয়ারটা ঘুরে গেল বুট জোড়ার দিকে।
কিশোর! ওর বাহু আঁকড়ে ধরল, জিনা। কিশোর, কিছু একটা করো, প্লিজ! জলদি কিছু একটা করো! ও ফিরে আসছে আবার!
সত্যিই তা-ই! বর্মের ভূত তা হলে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়নি। জ্যান্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে কিছু একটা করা দরকার। নইলে…
আর ভাবার সময় নেই। নেজার ম্যাণ্ডারের বুটজোড়ার দিকে ছুটল কিশোর। কিন্তু জিনিস দুটো ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক শক খেল ও, ঝট করে দুহাত সরিয়ে নিল।
ঠাণ্ডায় দুহাত জমে যাওয়ার জোগাড়। ওগুলো কীভাবে এত ঠাণ্ডা হলো কে জানে!
দুহাত গরম করার জন্য জোরে জোরে ঘষল ও।
বিস্ফারিত চোখে কিশোর দেখল খটমট শব্দ তুলে বুটজোড়া দূরে সরে যাচ্ছে। টাইলের ফ্লোরে আওয়াজটা স্বাভাবিকের চেয়েও চড়া শোনাচ্ছে।
নেজারের লেগ-গার্ড দুটো যেখানে ছিল, সেখানে চলে গেল। বুটজোড়া।
এদিকে গোঙানির আওয়াজ আরও চড়া হয়েছে। কানে তালা। লাগার জোগাড় হলো কিশোর-জিনার।
নেজারের ব্রেস্ট-প্লেটটা শূন্যে উঠে পড়ল। এবং বর্মটার ঠিক মাঝখানে বসে গেল সুন্দরভাবে।
এরপর হাত জোড়া উঠে এল স্তূপ থেকে। নিজের নিজের অবস্থানের দিকে ছুটে চলল। ব্রেস্ট-প্লেট যেখানে কাঁধের সাথে। মিলেছে, সেখান থেকে ঝুলে পড়ল ওদুটো।
যে বাহুতে কোনও হাত নেই, অন্য গ্লাভটা ছুটে গিয়ে সেটার সঙ্গে এঁটে বসল।
কিশোর মনে হলো পাথর হয়ে গেছে। অথবা পাথরের চেয়েও অনড়। টের পেল কপালের শিরা দপদপ করে লাফাচ্ছে ওর। বুকের ভিতর ভয়ঙ্কর ভাবে ধকধক করছে হৃৎপিণ্ড। যে-কোনও মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারে ওটা।
জিনা ও কিশোর একযোগে নেজার ম্যাণ্ডারের দিকে তাকাল।
পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়েছে সে, দাঁড়িয়ে আছে ওদের সামনে।
শুধু… তার মাথাটা নেই।
ভয়ঙ্কর শোঁ-শোঁ শব্দ উঠল হঠাৎ। আতঙ্কে কিশোর-জিনার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল।
শো-শোঁ আওয়াজটা তুলছে গ্লাভ পরা হাতে ধরা সোনালি তলোয়ারটা। ওটা এবার একটু একটু করে ঘুরছে বর্মের হেলমেটের দিকে।
বাধ্য ছেলের মত হেলমেটটা শূন্যে উঠে বাতাসে ভাসতে লাগল। তারপর বর্মের দিকে এগোতে শুরু করল।
কিশোরদের পেরিয়ে গেল। পরক্ষণে চারপাশে শীতল বাতাস বইতে শুরু করল।
বর্মের উপর গিয়ে স্থির হলো হেলমেটটা। খটমট শব্দ তুলে আস্তে আস্তে বসে গেল নির্দিষ্ট জায়গায়।
দুসেকেন্ড পেরিয়ে গেল।
তারপর…
তারপর ফেসপ্লেটের ভিতরের আগুনটা আচমকা দপ করে জ্বলে উঠল কোন অদৃশ্য হাতের ইশারায়।
জ্বলে উঠল নেজার ম্যাণ্ডারের চোখজোড়া।
লাল।
রক্ত লাল।
নিঃশব্দে তলোয়ার তুলল বর্ম-প্রেতাত্মা।
ওটার চোখা প্রান্ত ঠেকাল কিশোরের বুকে।
১৯
এবার কিশোরকে কুচিকুচি করবে প্রেতাত্মা। কোনও সন্দেহ নেই।
শুধু কিশোরকে নয়, জিনাকেও।
সৈনিকের জ্বলজ্বলে চোখের দিকে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকল কিশোর।
সামান্য আগে বাড়ল সে। কিশোর টের পেল তলোয়ারের তীক্ষ্ণ ডগা ওর শার্ট ফুটো করে ত্বকে ঠেকেছে।
দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছে ও। মূর্তির মত ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে জিনা।
জীবনের শেষ মুহূর্ত কটা গুনছে কিশোর। তলোয়ারে ওর বুক এফেঁড়-ওফোড় হবার অপেক্ষায় আছে।
নেজার তার ভারী মাথাটা ঘোরাল। শামুকের পিঙ্গল তরলের দলাটার দিকে তাকাল। আবার চোখ ফেরাল কিশোরের দিকে।
কে মেরেছে সালমিকে? প্রশ্নটা নেজারের বর্মের ভিতরে কয়েকবার প্রতিধ্বনিত হলো।
কিশোর জবাব দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বের হলো না।
জিনা ওকে ঠেলে সামনে এগিয়ে দিল।
কিশোর! বলল ও কিশোরের দিকে আঙুল তাক করে। এ মেরেছে সালমি বিন কাজেমকে। জাদুকরের জাদু তারই বিরুদ্ধে লাগিয়ে তাকে খুন করেছে ও।
সৈনিকের প্রেতাত্মা নড়ল না।
আতঙ্কভরা চোখে কিশোর-জিনা দেখল তার গনগনে চোখজোড়া ভাটার মত জ্বলজ্বল করছে।
সত্যি? প্রশ্ন করল সে।